সংযুক্তা মিত্র
খোলসা করে না বললেও সরকারি পক্ষে বলে দেওয়া হয়েছে আন্দোলনকারী বা বর্তমানে অনশন-আন্দোলনে বসা চিকিৎসকদের উত্থাপিত দশটি দাবির সাতটি তারা মেনে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু তিনটি দাবি মূলত প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিষয়, আলোচনার টেবিলে বসে ‘নাকি’ এইসব দাবির নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। কী সেই তিনটে দাবি? প্রথমত, স্বাস্থ্যসচিবের অপসারণ। দ্বিতীয়ত, ছাত্র সংসদের নির্বাচন ও তার মাধ্যমে মেডিকেল কলেজগুলির উপযুক্ত পরিচালকমণ্ডলী গঠন। তিন নম্বর হল, হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড ও মেডিকেল কাউন্সিলের যাবতীয় অন্ধকারগুলি দূর করা ও দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা। কিন্তু এই তিনটে দাবির মধ্যে কী এমন বিস্ফোরক আছে যা নেড়েচেড়ে দেখতে প্রশাসন এত পিছিয়ে যাচ্ছে?
ইচ্ছে থাকলে উপায় হয় এই আপ্তবাক্যের যেমন কোনও জুড়ি নেই তেমনি অনিচ্ছে দিয়েও কোনও-কোনও সময় উপায়ের পথে যে একরকম বাধা তৈরি করে ফেলা সম্ভব তার সবচেয়ে হালফিলের উদাহরণ জুনিয়র ডাক্তারদের চলমান আন্দোলন। ক্যালেন্ডারের হিসেবে যা দু-মাস পার হয়ে আড়াই মাসের দিকে এগিয়ে চলেছে। সম্ভবত কৃষকদের কেন্দ্রীয় সরকারের নীতি-বিরোধী লাগাতার অবস্থান ছাড়া এর কাছাকাছি কোনও সাম্প্রতিক উদাহরণ নেই। দিল্লি-সীমান্তের আন্দোলন যদি কেন্দ্রীয় নীতি-বিরোধী হয় তাহলে আমাদের রাজধানীর কেন্দ্র দখল করা আন্দোলন আসলে দুর্নীতি-বিরোধী। প্রবল পরাক্রমী এক পোক্ত দুরাচারের কেন্দ্রে যে নিষ্ঠুর এক পরিকল্পিত হত্যা— এই আন্দোলনের যাবতীয় অভিমুখ সেই রক্তের দিকে উদ্যত। সেটাই তার জোর। কিন্তু দশ দফা দাবিতে ছড়িয়ে পড়া এই উত্তেজনার নিষ্পত্তি কি এতদিনেও হতে পারত না? এতগুলো মিটিং, এতগুলো মেলের আদানপ্রদান, সাংবাদিক সম্মেলন— এগুলো কি ইচ্ছে না অনিচ্ছে?
খোলসা করে না বললেও সরকারি পক্ষে বলে দেওয়া হয়েছে আন্দোলনকারী বা বর্তমানে অনশন-আন্দোলনে বসা চিকিৎসকদের উত্থাপিত দশটি দাবির সাতটি তারা মেনে নিতে প্রস্তুত। কিন্তু তিনটি দাবি মূলত প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিষয়, আলোচনার টেবিলে বসে ‘নাকি’ এইসব দাবির নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। কোন সাতটি মানা যায় বা কোন তিনটি মানা যায় না? প্রকাশ্যে এটা নিয়ে চর্চা কম। কারণ অশেষ উদ্বেগের সঙ্গে প্রতিদিনই কয়েকজন করে অনশনকারীকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হচ্ছে, সংবাদমাধ্যম স্বাভাবিকভাবেই সেদিকে নজর রাখছে বেশি। কিন্তু এই অচলাবস্থার অন্তরালে তো আপাতত এই তিনটে দাবিই খড়ের গাদার পাশে বিপজ্জনক স্ফুলিঙ্গের মতো জেগে আছে— এগুলির সমাধান না হলে কি মূল বিরোধের নিরসন সম্ভব?
কী সেই তিনটে দাবি? প্রথমত, স্বাস্থ্যসচিবের অপসারণ। দ্বিতীয়ত, ছাত্র সংসদের নির্বাচন ও তার মাধ্যমে মেডিকেল কলেজগুলির উপযুক্ত পরিচালকমণ্ডলী গঠন। তিন নম্বর হল, হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড ও মেডিকেল কাউন্সিলের যাবতীয় অন্ধকারগুলি দূর করা ও দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা। কিন্তু এই তিনটে দাবির মধ্যে কী এমন বিস্ফোরক আছে যা নেড়েচেড়ে দেখতে প্রশাসন এত পিছিয়ে যাচ্ছে? গত দু-মাসে প্রকাশিত অসংখ্য সংবাদ ও নানান অন্তর্তদন্তমূলক প্রতিবেদনে এগুলো প্রায় প্রমাণিত যে রাজ্যের গোটা স্বাস্থ্যব্যবস্থায় বিপুল দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের ঋতু প্রায় পোক্তভাবে প্রতিষ্ঠিত। আমরা যাকে পাবলিক পারসেপশন বলি, তা কিন্তু এই অভিযোগের পক্ষে। যে কারণে, আরজিকরের কেন্দ্রীয় যে ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এই আন্দোলনের জন্ম তাতে আইনি প্রমাণ কী পাওয়া গেল বা গেল না তার চেয়েও বড় কথা হল, মানুষ স্পষ্টত বিশ্বাস করে ফেলেছেন সাঙ্ঘাতিক একটি অপরাধ সুসংগঠিত হয়েছে সেই রাত্রে। তদন্তকারী সংস্থা কী আদালতগ্রাহ্য প্রমাণ পেল বা পেল না সেটা আর তত জরুরি নয়— উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণের অনুপস্থিতি আদপে অপরাধীর অনুপস্থিতি আর নয়। এই অবস্থায় সরকারি ব্যবস্থায় আস্থা ফেরাতে প্রশাসনের সর্বোচ্চ আধিকারিকের দায় নির্দিষ্ট করা আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বাভাবিক প্রত্যঙ্গ— তাহলে স্বাস্থ্য দফতরের প্রধান সচিবের অপসারণের দাবি ঠিক কোন দিক থেকে বেঠিক? বিশেষ করে এই অনাচারের দৃষ্টান্ত সামনে রেখে স্বাস্থ্য-অধিকর্তা ও স্বাস্থ্যশিক্ষা-অধিকর্তাকে তো সরিয়ে দেওয়া হয়েছে মাত্র কিছুদিন আগেই— সে দাবিও উঠেছিল চিকিৎসকদের পক্ষ থেকেই। রাজ্য প্রশাসনে একজন সচিবকে অন্য দফতরে বদলি করে দেওয়া কি খুব একটা অসাধ্য কাজ? তাহলে এক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় কি আসলে অনিচ্ছে আর তার সূত্র ধরেই বিষয়টাকে আরও খানিকটা জিইয়ে রাখা?
অবশ্য একটা সম্ভাবনার কথা এখন অনেকেই বলছেন। স্বাস্থ্যসচিবকে সরিয়ে দিলে পুরনো দুর্নীতির অভিযোগগুলির দায় নেবেন কে? ঘটনাচক্রে এই মুহূর্তে কেন্দ্রীয় এজেন্সির আওতায় স্বাস্থ্য দফতরের আর্থিক ও নানারকম বেহিসেবি কাজকর্মের তদন্ত চালু হয়েছে— তার পরিণতি কী হবে জানা নেই— কিন্তু অন্তত কাউকে তো চাই যাকে খাতায়কলমে অভিযুক্ত করা যায়, তাই একটা মুখ (পড়ুন চেয়ার) অন্তত সামনে রাখা দরকার! সেই বিড়ম্বনা এড়াতেই কি এই দোটানা? এই সূত্রেই কিন্তু জড়িয়ে যায়, চিকিৎসকদের তৃতীয় ঝুলে থাকা দাবি। স্বাস্থ্য দফতরে সমস্ত ধরনের সরাসরি নিয়োগ করার জন্য হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের জন্ম হয়েছিল ১ আগস্ট ২০১২-য়। এই সংক্রান্ত সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছিল যেসব পদে এতদিন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমেও নিয়োগ হত সেইসব পদেও এবার থেকে নিয়োগ করবে এই সংস্থা। রাজ্যের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান পাবলিক সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ পদ্ধতি নিয়ে ইতিপূর্বে কোনও অস্বচ্ছতার অভিযোগ ওঠেনি— তবু স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণের মতো গুরুত্বপূর্ণ দফতরে নিয়োগের গোটাটাই কেন নতুন একটি সংস্থার হাতে চলে গেল তার কোনও ব্যাখ্যা রাজ্যের মানুষের কাছে ছিল না। গত এক যুগ ধরে যাবতীয় নিয়োগ হয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই— নিয়োগ নিয়ে বেআইন ও হুমকি সংস্কৃতির অভিযোগে আজ বিদ্ধ সেই একই প্রতিষ্ঠান— এর প্রতিস্পর্ধী সুবিচার চাওয়া কি খুব অবান্তর দাবি?
সমস্ত প্রশ্নের শেষ যে এখানেই তাও তো নয়। সরকারি বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ডের চেয়ারম্যান বা মুখ্য নির্বাহী আধিকারিক হিসেবে থাকার কথা কোনও সরকারি আমলার যাঁকে অন্ততপক্ষে বিশেষ সচিব পদমর্যাদার বা সমতুল পদ থেকে অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক হতে হয়। আজ এই যুগমুহূর্তে যখন নানান প্রান্ত থেকে নানান অসঙ্গতির ইশারা প্রতিফলিত তখন দেখা যাচ্ছে আসলে এই প্রতিষ্ঠানের মাথায় বসে আছেন শাসকদলের এক চিকিৎসক-বিধায়ক— প্রতিটি নিয়োগ, প্রতিটি বদলির পেছনে তিনি গড়ে তুলেছেন এক মাফিয়া সাম্রাজ্য। সরকারি বিজ্ঞপ্তিকে যখন সরকার নিজেই মান্যতা দিচ্ছেন না তার বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য দফতরের প্রধান পরিষেবা প্রদানকারী সরকারি চিকিৎসকরা যদি আওয়াজ তোলেন সেটা কি খুব অন্যায্য চাওয়া? এহ বাহ্য। ওই একই ব্যক্তি আবার আরজিকর হাসপাতালের বিধিবদ্ধ সংস্থা ‘রোগী কল্যাণ সমিতি’-রও চেয়ারম্যান। জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনের নিয়ম অনুযায়ী যখন দেশের প্রতিটি সরকারি হাসপাতালে ‘রোগী কল্যাণ সমিতি’ তৈরি হয় তখন সেই সমিতির কিছু দায়বদ্ধতার কথা উল্লিখিত ছিল। তারই মধ্যে ছিল ‘স্বার্থের সঙ্ঘাত’ বা ‘কনফ্লিক্ট অফ ইন্টারেস্ট’-এর প্রসঙ্গ, কারণ এই সমিতির অন্যতম প্রধান দায়িত্ব সরকারি তহবিলের সুষ্ঠু ব্যবহার হচ্ছে কি না তা নিশ্চিত করা— অনেকটা পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির মতনই। আর চেয়ারম্যানের নিচে হাসপাতালের মেডিকেল সুপার বা মেডিকেল কলেজের ক্ষেত্রে তার প্রিন্সিপ্যাল কাজ করেন এই বিধিবদ্ধ সমিতির সচিব হিসেবে। আর্থিক ব্যয় বা হাসপাতালের নিত্যনৈমিত্তিক কেনাকাটা তাঁকে এই কমিটিতে অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। ঘটনাচক্রে, আরজিকর হাসপাতালের অধ্যক্ষ যখন প্রত্যক্ষভাবে আর্থিক ব্যাভিচারের দায়ে আপাত অভিযুক্ত তখন সেই একই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যানেরও অন্তত পরোক্ষ দায় থেকেই যায়। তাহলে তার অপসারণ হবে না কেন?
এইসব জটগুলি যে আদপে সরকারি প্রশাসনেরই সৃষ্টি, তাও ভুলে যাওয়া উচিত নয়। স্বাস্থ্যভবনের সামনে চিকিৎসকদের ধর্নামঞ্চে এসে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান সর্বসমক্ষে বলেছিলেন তিনি রাজ্যের সব হাসপাতালের রোগী কল্যাণ সমিতিগুলি ভেঙে দিচ্ছেন। গোড়ার কথা হল, এইভাবে প্রকাশ্যে ঘোষণা করে জাতীয় স্বাস্থ্য মিশনে স্বীকৃত এই বিধিবদ্ধ সমিতি ‘ভেঙে’ দেওয়া যায় না। সমিতির পুনর্বিন্যাস করা যেতে পারে, তার জন্য প্রশাসনিক প্রক্রিয়া দরকার হয়। কার্যত সেই প্রক্রিয়া শুরু করে আজ অবধি একটি হাসপাতালেরও রোগী কল্যাণ সমিতি ‘ভাঙা’ বা পুনর্বিন্যস্ত হয়নি। তাহলে কি আবারও সেই অনিচ্ছের ডুবো পাথরে আটকে যাচ্ছে না সমাধানের ‘আন্তরিক’ বৈতরণী? এই একই কথা প্রযোজ্য মেডিকেল কাউন্সিল নিয়েও। রাজ্যের চিকিৎসাব্যবস্থার কেন্দ্রীয় সংস্থা রাজ্য মেডিকেল কাউন্সিল নিয়ে গত কয়েক বছরে অভিযোগের অন্ত নেই। বছর দুয়েক আগে এই প্রতিষ্ঠানের নির্বাচন নিয়ে যে-সব ঘটনা সামনে এসেছিল তা প্রায় বুথস্তরের গ্রামপঞ্চায়েত ভোটে ব্যালট ছিনতাই বা ব্যালট খেয়ে ফেলার মতোই রোমাঞ্চকর। ভোটার চিকিৎসকদের থেকে ভোটার স্লিপ কেড়ে নেওয়া থেকে আর যা যা কদর্যতা ঘটতে পারে তার ষোলো আনাই অভিনীত হয়েছে রঙ্গমঞ্চে। এবং তার নিট ফল হল, হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড তথা রোগী কল্যাণ সমিতি (আরজিকর)-র চেয়ারম্যানের মাথায় মুকুটের তৃতীয় রত্ন হিসেবে কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের পদলাভ। যদিও এই নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে ইতিমধ্যেই আদালতে মোকদ্দমা হয়েছে। জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সঙ্গে না হয় প্রচুর আর্থিক লেনদেনের যোগ থাকে বলেই সেখানে লড়াই আক্ষরিক অর্থেই মাঠে নেমে আসে। কিন্তু চিকিৎসকদের ভোট নিয়ে আদালতে দৌড়নো বেশ ব্যতিক্রমী সন্দেহ নেই। আন্দোলনে সংহত জুনিয়র চিকিৎসকরা এই বিষয়েও সরকারের কাছে কিছু দাবি রেখেছেন। সরকারি অর্থের অপব্যবহার বা পদের ওজন কাজে লাগিয়ে সুবিধে দেওয়া বা সুবিধে নেওয়া অত্যন্ত সহজ একটি ধর্তব্যমূলক অপরাধ— সেইসব অপরাধের নিষ্পত্তি চাইলে তাকে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিষয় বলে এড়িয়ে যাওয়া আদপে সেই একই গোপন অনিচ্ছের মুখব্যাদান। চিকিৎসকরা মূল যে ব্যাপ্ত অরাজকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেমেছেন শুধু কিছু সিসিটিভি বসিয়ে তার সমাধান সম্ভব নয়। এটা আন্দোলনকারীরা বোঝেন বলেই তাঁদের দাবিগুলিকে বিছিয়ে রেখেছেন সরকারের সামনে।
এবার আসে মেডিকেল কলেজে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ও তারই সূত্রে উপযুক্ত পরিচালকমণ্ডলী তৈরি করার দাবি। যে কোনও গণতান্ত্রিক দেশে গণতন্ত্রের শুরু হয় সামাজিকভাবে সবচেয়ে নিচের জনগোষ্ঠীর মধ্যে। দেশের সংবিধান পঞ্চায়েতি রাজ ব্যবস্থায় ‘গ্রামসভা’র সংস্থান রেখেছে সেই স্পিরিটকে সামনে রেখেই। আর স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আসলে একটা সামাজিক ক্রস সেকশনকে বিম্বিত করে, তাই সেইসব প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত ছাত্র সংসদ ও পরিচালকগোষ্ঠী নির্মাণ করা আদপে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে গতি ও সম্মান দেওয়ার অংশ। এই রাজ্যে কলেজে ছাত্রসংসদ নির্বাচন কী এক অজ্ঞাত কারণে বহুদিন বন্ধ। মেডিকেল কলেজেও তা স্থগিত হয়েছে বছর দুয়েক। এই চালু ব্যবস্থাকে সচল করার দাবি কোন দিক দিয়ে খুব কঠিন ও সমস্যাসঙ্কুল বলে প্রশাসন ভাবছে তা বোঝা দুষ্কর। সব মিলিয়ে যে তিনটে দাবি নিয়ে প্রশাসনের সবচেয়ে ওপরতলা নানা ওজর আপত্তি তুলতে চাইছেন ইচ্ছে থাকলে অনায়াসেই সেগুলি তাঁরা মেনে নিতে পারতেন বা এখনও পারেন। কিন্তু পুরো বিষয়টায় একদিকে যেমন ইচ্ছে ও অনিচ্ছের দ্বৈরথ আছে অন্যপক্ষে আছে আগলে রাখার মতো বহুল বিষফোঁড়া। প্রশাসনিক সৌজন্যে ত্রিমুকুটজয়ী চেয়ারম্যান ইতিমধ্যেই নানা আর্থিক অনিয়মের অভিযোগে বিদ্ধ, তাঁর ছড়ানো সাম্রাজ্যে এমন অনেকেই প্রসাদ পেয়েছেন যাঁরা এখন শ্যাম রাখি না কুল রাখি-র দোটানায় পড়েছেন। সম্ভবত এই ঘুলিয়ে থাকা জলে সরকারি প্রশাসনও ঠিক নিজেদের অবস্থান নির্ণয় করতে দিশেহারা অথবা সচেতনভাবে জল মাপতে কৌশলী। কারণ যেদিকেই যাবে কোথাও একটা তাদের হয় আঘাত করতে হবে কায়েমি স্বার্থের ধাঁচাকে অথবা সবার রঙে রং মিশিয়ে নিতে হবে চুপিসাড়ে।
এই কারণেই অনিচ্ছের বাঁধন কেবলই তাঁদের পা টেনে ধরছে প্রকৃত সমাধানের গন্তব্যের বিপরীতে। এই সভয় আড়ষ্টতা আর ইচ্ছেহীনতার আড়াল হিসেবে চাই প্রচুর কথা, প্রচুর এলোমেলো কাঠামোহীন বক্তব্যের অসার সম্প্রচার, ক্লীবতার আচ্ছাদন হিসেবে বারবার চড়া আলোর সামনে অকাতরে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে শব্দ ছুড়ে দেওয়া— এমনকি তার প্রত্যুত্তরকে না শুনে নিজেদের চেষ্টিত বধির করে রাখা। আজ থেকে একশো একচল্লিশ বছর আগে ‘ভারতী’ পত্রিকার একটি নিবন্ধে লেখা হয়েছিল: ‘সেকরা গাড়ি যত না চলে ততোধিক শব্দ করে, তাহার চাকা ঝনঝন করে, তাহার জানলা ঝরঝর করে, তাহার গাড়োয়ান গাল পাড়িতে থাকে, তাহার চাবুকের শব্দে অস্থির হইতে হয়।’ না-বললেও চলে এই নিবন্ধের রচনাকার কে। আর আজ তার শব্দ থেকেই প্রতিবাদী চিকিৎসকরা নিয়ত চয়ন করছেন স্পর্ধার ভাষা, দ্রোহের ব্যাকরণ, অন্যায়কারীর চোখে চোখ রেখে উদ্যত রাখছেন নীরবতার তর্জনী। তাঁদেরও শব্দ আছে, তাঁরাও ছড়িয়ে দিতে পারেন তার বজ্রশিখা, ভাঙতে পারেন ওই অনিচ্ছের বাঁধন। এমনকি আকাশ অন্ধ করা আঁধার পুঞ্জীভূত হলেও।
হ্যাঁ তাঁরাও পারবেন।
*মতামত ব্যক্তিগত