প্রিয়ক মিত্র
পূর্ব প্রকাশিতের পর
—এ মধু, মদ ঢাল!
ঘরঘরে গলায় হুকুম করছিল অনুজ পাণ্ডে। দেবাশিস টানা উসখুস করে যাচ্ছিল সামনে বসে। চার পেগ হয়ে গেছে। এখনও সমাধান হয়নি সমস্যাটার।
জেটির ওপর দুজন বন্দুকধারী বসে চুইংগাম চিবোচ্ছে। দেখে ভরসা হচ্ছে না দেবাশিসের। ও জানে, লুকিয়ে লুকিয়ে ওরাও মদ গিলেছে অনেকক্ষণ। মধু, অনুজ পাণ্ডের বেয়ারা একটু ‘ব্যাঁকা’। অন্তত বাকি চ্যালাদের ভাষায়। হাঁটাচলা-কথাবলা দেখে ওকে ‘ব্যাটাছেলে’ বলে মনেই হয় না নাকি। মধুকে ভুলিয়ে-ভালিয়েই বসের ভাল হুইস্কি মারছে এই দুটো গুন্ডা। বাংলা খাওয়া পেটে অমন মখমল মদ পড়লে যা হয়, দুজনেই খানিক ঢুলুঢুলু।
আর দেবার টেনশন ক্রমশ বাড়ছে।
খবর যদি ঠিক হয়, যদি সত্যিই ভগা আজ এখানে আসবে বেগুনিবাবুর অর্ডার-মোতাবেক, তাহলে আজকেই হিসেব মেটাতে হবে। বিয়ের পর থেকে একদিনের জন্যও স্বস্তি পায়নি দেবা। কবিতা ওরফে রিনি ওর মাথা খেয়ে রেখেছে তখন থেকেই। রিনি ওর আসল ডাকনাম, কবিতাও ওর আসল নাম। কিন্তু এইসব নামে দেবা ওকে চেনেনি। চিনেছিল ‘পিঙ্কি’ নামে। শহরের একটা ম্যাসাজ পার্লার থেকে তোলা তোলার সুযোগ ওকে করে দিয়েছিল অনুজ পাণ্ডে। সেখানেই আলাপ। কলেজ শেষ করতে পারেনি টাকার অভাবে। তখন ওই ম্যাসাজ পার্লারটাই পিঙ্কি ওরফে কবিতা ওরফে রিনির একমাত্র সম্বল।
অমন সর্পিল ব্যক্তিত্ব দেবা আগে কখনও দেখেনি। ম্যাসাজ পার্লারের সব মেয়েকেই তো ও আপাদমস্তক চেনে। এইরকম আগুন আগে দেখেছে? মনে তো পড়ে না।
দেবা ঠিক প্রেমে পড়েনি, ওই আগুনকে বশ মানাতে চেয়েছিল। সংসারে বেঁধে। কিন্তু ওই আগুন ওর সব ছারখার করেছে। বেগুনিবাবুর কল্যাণে দিনদিন বাড় বেড়েছে রিনির। আর ভগা! ভগা রিনির সঙ্গে শুতে আসে জানতে পেরে লুকিয়ে লুকিয়ে বেডরুমের আয়নায় ক্যামেরা লাগিয়েছিল দেবা, বিছানায় ওরা ঠিক কী করে দেখার জন্য।
কিন্তু ভগা আর রিনিকে দেখে কেবলই বিস্মিত হয়েছে দেবা। রিনি পাথরের মতো হয়ে থাকত দেবা আদর করলে। অথচ ভগার সব আদর রিনি নেয়। ভগা যেভাবে আদর করে রিনিকে, তা দেখেও অবাক হয় দেবা। এ তো শরীরের ওপর দখল নেওয়া নয়, বরং শরীরকে তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করা। কোনওদিন তো দেবা পারেনি এমন। তাহলে কি রিনি আর ভগা একে অপরকে ভালবাসে?
নতুন ভয় ঢুকল দেবার মনে।
রিনি কাউকে ভালবাসতে পারে, এটাই কোনওদিন বিশ্বাস করেনি দেবা। ভগা, দু-পয়সার গুন্ডা, তার প্রেমে পড়ল রিনি! ফুটেজটা দেখতে দেখতে দেবা দেখেছিল, হঠাৎই, আয়নার দিকে তাকিয়েছিল রিনি। ভগাও। রিনি তখন ভগার ওপর বসে, রিনিকে আঁকড়ে রেখেছে ভগা। ওই তাকানোটুকু সন্দেহ জাগিয়েছিল দেবার মনে, ওরা কি জানে আয়নায় সিসিটিভি আছে?
আর তারপরেই দেবা সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়।
কিন্তু তাও, দেবা এখনও জানে না, সেদিন, বন্ধ ঘরে বেগুনিবাবুর সঙ্গে ঠিক কী কথা হয়েছিল রিনির।
জানে না, ভগা বা রাইটুও। জানলে নিশ্চিত বুঝত, কেবলই অনুজ পাণ্ডে বেগুনিবাবুর বউকে খিস্তি করেছে বলে ওদের এই অভিযান নয়।
বেগুনিবাবুর মাথায় এখন অনেক চিন্তা। তাও ভগা-রাইটুর রাতের এই অভিযান নিয়ে সে যথেষ্ট তৎপর। কুমোরটুলির স্টুডিওতে বসে তাই বারবার তার চোখ চলে যাচ্ছিল ফোনের দিকে। বাক্স ফোন, মাথায় ছোট্ট অ্যান্টেনা। ফোন এলে বাক্সের ওপর থাকা খুদে স্ক্রিনে নীল আলোয় দেখা যাবে, ফোনটা কে করছে।
ছেনো আর বাবলু একটা ছিলিম ধরিয়ে বুঁদ। চুরুটটা পুড়ছে বেগুনিবাবুর।
রিনি। মাথা ঘুরিয়ে দিয়েছিল রিনি। মাথাখারাপ বউ আর তার ড্রাগের নেশা নিয়ে অতিষ্ঠ বেগুনিবাবু চাইছিল, আরেকটা বিয়ে না-হোক, অন্তত বউয়ের মতো কেউ একটা থাকুক, যে তার দেখভাল করবে। কিন্তু রিনি দেবার বউ, বেগুনিবাবুও নিজের বউকে ত্যাগ দিতে পারবে না, কারণ সেই ছোটবেলা থেকে তাদের সম্পর্ক, ড্রাগ ধরাও একসঙ্গেই। নিজেই নিজের বউয়ের সর্বনাশ করেছে, মাঝেমধ্যে ভাবে বেগুনিবাবু, ওরফে শোভাবাজারের মানিক তরফদার। কী থেকে যে কী হয়ে গেল!
তাও বেগুনিবাবু সরাসরি বলেছিল রিনিকে কথাটা। বলেছিল, বিছানায় উঠতেই হাঁপিয়ে যায় সে, কাজেই রিনিকে তার সঙ্গে শুতে হবে না। কিন্তু একটু যদি দেখাশোনা করে রিনি, ওর আর ওর বউয়ের।
রিনিকে দেখে নিঃসন্তান বেগুনিবাবুর খ্যাঁচ উঠেছিল, না বাৎসল্যের বুদবুদ ডগমগিয়ে উঠেছিল ভেতরে, এখনও বুঝতে পারে না বেগুনিবাবু।
বউ যতই ড্রাগখোর হোক, ডাক্তারি রিপোর্ট বলছে সমস্যাটা বেগুনিবাবুরই। কী করে সেকথা অস্বীকার করে বেগুনিবাবু নিজে।
বেগুনি ডাকনামটা ঠাকুমারই দেওয়া। কারণ ছোটবেলায় পাতলা বেগুনির মতোই চেহারা ছিল মানিকের। সেই চেহারা ফুলতে ফুলতে আজকে এই, আর আশ্চর্য, গায়ের মিশকালো রংয়েও বেগুনি ছোঁয়াচ লাগতে শুরু করেছে তার।
নানা কথা ভেবে আনমনা যখন, তখনই বাক্সের ওপর নীল আলোয় জ্বলে উঠল ভগার নাম।
ফোনটা শান্তভাবেই ধরল বেগুনিবাবু।
ভগা ওপাশ থেকে যতক্ষণ উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করল, মাথাটা এলিয়ে চোখ বুজে রইল বেগুনিবাবু। তারপর প্রয়োজনীয় ইনস্ট্রাকশন দিয়ে ফোনটা রেখেই ছেনো আর বাবলুকে হাঁক পাড়ল বেগুনিবাবু— এই শুয়ারের বাচ্চা, চুরুটটা নিভে গেছে দেখছিস না! জ্বালিয়ে দিয়ে যা।
অনুজ পাণ্ডের ঠেকে ভগাদের গাড়িটা ঢুকল দুদ্দাড়িয়ে, তিন-চারটে টেবিল উলটে দিয়ে। ফলে মদ প্রথমেই নষ্ট হল অনেকটাই। চার-পাঁচটা সিঙ্গল মল্টের দামি বোতল ঝনঝন করে পড়ে ভাঙল মাটিতে।
দরজা খুলে নেমে বোতলগুলোর সামনে এসে দাঁড়াল রাইটু।
—এহ হে ভগা! কী ফালতু ড্রাইভ করিস! মানুষ আর কুত্তার বাচ্চা চাপা দিস ঠিক আছে, শালা মালের ওপর দিয়ে গাড়ি চালাবি?
অনুজ পাণ্ডে রক্তচক্ষুতে দাঁড়িয়ে। চোখদুটো আরেকটু হলে ঠিকরে বেরিয়ে আসবে। পেছনে ভেড়ুয়ার মতো, দেবা, চোখেমুখে যদিও ভাব কম নেই। বন্দুকধারীদুটো কোনওক্রমে টাল সামলে এগিয়ে আসছে ভগা-রাইটুর গাড়ির দিকে। মধু ওরফে ব্যাঁকা একটা পিস্তল বের করে তাক করে আছে। ভগা স্টিয়ারিংয়ে বসেই সিনটা দেখল আগে। তারপর মন্টির দিকে ফিরল।
—গাড়ি থেকে নামবি না। না ডাকলে।
গাড়ির দরজা খুলে নামল ভগা।
—শালা বাঞ্চোতের বাটখারা! কোন সাহসে আমার জেটিতে এসেছিস?
হুঙ্কার দিল অনুজ পাণ্ডে।
রাইটুর দাঁতগুলো বেরিয়ে এল বত্রিশ পাটি।
—একটা গল্প বলি কত্তা! আমাদের পাড়ায় একটা ছেলের তিনটে বিচি ছিল। মানে মনে হত তাই, এতটাই ঝোলা ছিল। ওর নাম দিয়েছিলাম, তিন্টে। ও ভাবত, ওর বিচি বেশি, তাই সাহসও বেশি। পাড়ার একটা পাগলা কুত্তার সঙ্গে একবার লাগতে গিয়েছিল। সে কামড়ে ওই তিনটে বিচি দুটো করে দিয়েছিল!
—অ্যাই চোপ! বসের সামনে একদম এসব ফালতু কথা বলবি না! মধু বলল।
—তোকে যে তোর বস ব্যাঁকা বলে ডাকে, তুইও চাইলে তোর বসের বিচি দুটো থেকে একটা করে দিতে পারিস। যদি আদৌ থাকে।
—অ্যাই! গর্জন করে উঠল অনুজ পাণ্ডে! দুটো অটোমেটিক রিভলভার আর মধুর পিস্তল আরেকটু সচেতন হল এবার।
এবার হিসহিসে গলায় মুখ খুলল দেবা।
—এই ধ্বজটা এখানে এসেছে কেন?
উদ্দেশ্য, ভগা।
—জানি ভাই, তোর বাপের জায়গির। কিন্তু যে তোর বিছানায় রোজ ব্যাগাডুলি খেলে, সে তোর বাপের বাড়িতে ঢুকলে এত চুলকোচ্ছে কেন?
—এই হারামির বাচ্চা! তোকে আর ওই খানকি মাগিকে যদি আমি একসঙ্গে পুঁতে না দিই…
দেবা অনুজ পাণ্ডেকে ঠেলে এগিয়ে আসতে গেল, দুটো আর্মড লোকের মাঝখান দিয়েই। ভগার হাত কখন উঠল, কখন নামল, বোঝা গেল না। দেবা ছিটকে পড়ল অনুজের পায়ের সামনে। বুকে বুলেটের ছ্যাঁদা থেকে তখনও গরম ধোঁয়া বেরোচ্ছে।
এরপর মন্টি গাড়ি থেকে যা দেখতে পেল পরের আধ মিনিট, তা আতসবাজির খেল। ঝিকমিকিয়ে উঠল বারুদ। দেখতে দেখতে দুটো রিভলভার ধরা তাগড়াই লাশ মাটি ছুঁয়ে ফেলল। অনুজ পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মধু অনুজের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। হাতে পিস্তল।
একটা বোতলের ভাঙা টুকরো হাতে তুলে নিয়ে রাইটু অনুজকে জিজ্ঞেস করল— মালটা ভাল? স্মুথ?
অনুজ বলে উঠল— ক-বোতল লাগবে? নিয়ে যা।
রাইটু ভগার দিকে ফিরে বলল— ভগা একটা বোতল থেকে একচুমুক মেরে দেখ তো!
একটা বোতল আস্ত ছিল সামনের টেবিলে। তুলে নিয়ে ভগা ছিপি খুলল, তারপর ঢকঢক ঢকঢক করে বেশ কিছুটা মেরে দিয়ে বলল, স্মুথ, কিন্তু কড়ক না।
রাইটু চুক চুক করে বলল, এই তো এসব মালের মুশকিল! চট করে কিছুই হয় না। কিন্তু ঝিমটা দেয় পরে, দেখবি রাতের দিকে…
রাইটুর কথা শেষ হল না।
হঠাৎ মধুর পিস্তল গজরাল।
ভগা ওই একটা আস্ত বোতল হাত থেকে ফেলে ভাঙল প্রথমে। তারপর দু-মিনিট টলে ধপ করে পড়ল মাটিতে।
রাইটু বিস্ফারিত নেত্রে দেখল ঘটনাটা। তারপর বিনা বাক্যব্যয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের মেশিন থেকে দুটো গুলি ছোটাল পরপর।
অব্যর্থ লক্ষ্য।
মধু আর অনুজ দুজনেরই কপালে দুটো বড় ফুটো হয়ে গেল।
‘খোদ কলকাতার বুকে শুটআউটে একাধিক নিহত। এই ঘটনা নিয়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে রাজ্যজুড়ে। এই মুহূর্তে সাংবাদিক বৈঠকে রয়েছেন নগরপাল। আমরা চলে যাব আমাদের প্রতিনিধি…’
থানার টিভিতে গমগম করে বাজছিল। যদিও টিভি দেখছিল না রিনি। উদাসীন হয়ে বসে পেপারওয়েটের ভেতর দেখছিল অভ্রের চলাচল।
রিনি কি তবে মুক্ত?
[আবার আগামী সংখ্যায়]