রাহুল রায়
রাহুল রায় অ্যামেরিকার বস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ মেডিসিনের অধ্যাপক। স্নাতকোত্তর ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়-মনোনীত পরামর্শদাতা। প্রবাসেও অক্ষুণ্ণ রেখেছেন শিকড়-মাটির সম্বন্ধ। শখ বলতে বেহালাবাদন, লেখালিখি, গান করা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে মার্কিন দেশে বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসার।
মারিয়া স্কলোডাউস্কা ক্যুরি বা মেরী ক্যুরি ছিলেন মূর্তিমান ‘ফার্স্ট’। পৃথিবীর ইতিহাসে এতগুলো ‘ফার্স্ট’ কারও ভাগ্যে, বিশেষ করে কোনও মহিলার ভাগ্যে জোটেনি, এবং ভবিষ্যতেও জুটবে কী না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। প্রথম মহিলা নোবেল-প্রাপক, প্রথম দুই বিষয়ে নোবেল-জয়, প্রথম দুই ভিন্ন বিষয়ে (পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন) নোবেল পুরস্কার পাওয়া, প্রথম বিজ্ঞানী যিনি দুটি নতুন মৌল (এলিমেন্ট) রেডিয়াম ও পোলোনিয়াম আবিষ্কার করেন, প্রথম মহিলা যার দেহাবশেষ প্যারিসের বিখ্যাতপ্যান্থিওন মুসোলিয়ামে সংরক্ষণ করা আছে বিজ্ঞানের আর এক দিকপাল ও তাঁর নোবেলজয়ী স্বামী পিয়ের ক্যুরির সাথে।
তাঁর পাওয়া পুরস্কারের সংখ্যার কোনও শেষ নেই। তাই সেই ফর্দ দেওয়ার কোনও মানে হয় না। কিন্তু তাঁর নাম অমর করে রেখেছে তাঁরই দেওয়া তেজস্ক্রিয়তার নাম রেডিওএকটিভিটি। তেজস্ক্রিয়তার মাত্রা (ইউনিট)-এর নাম ‘ক্যুরি’, মৌলের পিরিয়ডিক টেবিলে মৌল ৯৬-এর নাম ‘ক্যুরিয়াম’, মহাকাশে একটি অ্যাস্ট্রারয়েড-এর নাম ৭০০০ ক্যুরি। আর আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে তাঁর নাম বহন করে নানান গবেষণা কেন্দ্র।
তদানীন্তন রাশিয়ান-প্রাশিয়ান-অস্ট্রিয়ান এম্পায়ার-এর অন্তর্ভুক্ত পোল্যান্ডের ওয়ারশ শহরে ১৮৬৭ সালে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে মারিয়া স্কলোডাউস্কা-র জন্ম। মারিয়া-র বাবা ছিলেন পদার্থবিদ্যা ও গণিতের এক নামজাদা শিক্ষক, আর দুটি ছেলেদের স্কুল (জিমনেসিয়াম)-এর পরিচালক। অন্যদিকে তিনি ছিলেন একজন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তি। পোল্যান্ড-কে বিদেশী শাসনের হাত থেকে বাঁচানো ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। আর সেইজন্য তিনি পড়েন রাশিয়ান শাসকদের রোষে। তার ফলে তিনি চাকরি, পারিবারিক সম্পত্তি সবই হারান। তাই মারিয়া ও তার চার ভাই-বোনের শৈশব ও বাল্যকাল কেটেছে নানা টানাপোড়েনের মধ্যে, যার মধ্যে ছিল চরম অর্থকষ্ট।
এদিকে স্কুল বা জিমনেসিয়াম থেকে বেরোনোর পর মারিয়া ও তার বোন ব্রনিয়া-র উঁচু ক্লাসে পড়াশুনোর পথ বন্ধ হয়ে যায় তৎকালীন ইউরোপিয়ান সমাজের লিঙ্গ-বৈষম্যের ফলে। কিন্তু তাদের জ্ঞান অর্জনের ইচ্ছা ছিল এতই প্রবল যে তারা দুই বোন চোরাগোপ্তাভাবে পোলিশ জাতীয়তাবাদী ‘ফ্লাইং ইউনিভার্সিটি’-তে বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে পড়াশুনো করতে আরম্ভ করে। সুখের কথা তাদের এই অদম্য ইচ্ছা পুরস্কৃত হয় যখন এই টানাপোড়েনের মধ্যেও ব্রনিয়া ইউনিভার্সিটি অফ প্যারিসে পড়ার সুযোগ পেয়ে যায়।
কিন্তু সেই পড়াশুনোর খরচ আসবে কোথা থেকে? বড় বোন মারিয়া তখন তাদের এক বিত্তশালী আত্মীয়র বাড়ি গভর্নেস-এর কাজ করে বোনের পড়াশুনোর খরচ জোগাড় করে। কিন্তু সেই চাকরি বেশিদিন টেঁকেনি। কারণ এই বাড়ির ছেলে মারিয়ার প্রেমে পড়ে। কিন্তু তার বড়লোক বাবা-মা তাদের ছেলে এক কপর্দকহীন মেয়ের সাথে প্রেম করবে, তা মেনে নেননি। তার ফলে মারিয়া ও কাজিমিয়ার্জ-এর ভালবাসায় যবনিকা পড়ে। এই কাজিমিয়ার্জ জোরাওস্কি পরে হয়ে ওঠেন এক বিখ্যাত গণিতজ্ঞ। অনেক বৃদ্ধ বয়সেও তিনি মারিয়ার প্রতিষ্ঠিত রেডিয়াম ইনস্টিটিউট-এ মেরী ক্যুরির মুর্তির সামনে চুপ করে বসে থাকতেন, হয়তো তাদের ব্যর্থ প্রেমের স্মৃতি রোমন্থন করতে।
ব্রনিয়ার প্যারিস যাওয়ার দু বছর বাদে, ১৮৯১ সালে মারিয়ারও ইউনিভার্সিটি অফ প্যারিসে পড়ার সুযোগ আসে, কিন্তু অর্থের ভাঁড়ে তো মা ভবানী! ততদিনে মারিয়া ‘ফ্লাইং ইউনিভার্সিটি’-তে পড়িয়ে ও গভর্নেস–এর কাজ করে কিছু টাকা জমিয়েছে। মারিয়ার বাবাও আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন তাঁর মেয়ে জীবনে সফল হোক। তাই তিনিও অল্প কিছু দিয়ে মারিয়াকে সাহায্য করেন। এই নিয়ে মারিয়া রসায়ন, পদার্থবিদ্যা ও গণিতশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষার্থে ইউনিভার্সিটি অফ প্যারিসে যোগ দেয়। কিন্তু অর্থচিন্তা কখনওই তাকে ছেড়ে যায়নি। সকালে পড়াশুনো আর রাতে ছাত্র পড়িয়ে তার পড়াশুনো চলে। বহুদিন থাকতে হয়েছে আধপেটা খেয়ে, আবার কখনও প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় প্রায় জমে যাওয়ার অবস্থা হয় যথেষ্ট জামা-কাপড়ের অভাবে। তা সত্বেও মারিয়ার বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা ও হাড়ভাঙ্গা খাটুনি কোনওটাতেই বিন্দুমাত্র ছেদ পড়েনি।
ইতিমধ্যে ১৮৯৪ সালে মারিয়ার জীবন এক নতুন দিকে মোড় নেয়। তাঁর সাথে আলাপ হয় পদার্থবিদ ও গবেষক পিয়ের ক্যুরির সাথে। প্রায় প্রথম দেখাতেই প্রেম। পরের বছরেই তাদের বিয়ে হয়, আর পোলিশ মারিয়া রূপান্তরিত হন মেরী ক্যুরি-তে, যে নামে তিনি পান জগত-জোড়া খ্যাতি। কিন্তু তিনি কোনওদিনই তাঁর পোলিশ পরিচয় ভুলতে পারেননি। পিয়ের-এর বিবাহ-প্রস্তাব মারিয়া প্রথমে নাকচ করে দেন, কারণ তিনি চেয়েছিলেন পোল্যান্ডে ফিরে গিয়ে বিজ্ঞান-সাধনা করতে, কিন্তু সেখানে তাঁর কোনও চাকরি জোটেনি। তা সত্বেও মেরী ক্যুরি সর্বদা নিজের নাম সই করতেন ‘মেরী স্কলোডাউস্কা ক্যুরি’। আবার প্রথমবার নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল আবিষ্কারের পর তিনি তার নাম দেন ‘পোলোনিয়াম’, স্বদেশভূমিকে প্রণাম জানিয়ে, যদিও পোল্যান্ড তখনও রাশিয়ান-প্রাশিয়ান এম্পায়ার-এর অন্তর্ভুক্ত।
ফ্রান্সে পড়তে আসার আগে মারিয়া স্কলোডাউস্কা বিখ্যাত রাশিয়ান রসায়নবিদ ডিমিট্রি মেন্ডেলীভের ছাত্র ও তাঁর এক আত্মীয় জোসেফ বোগুস্কির পরিচালিত এক ল্যাবরেটরিতে রসায়নে গবেষণা করা শুরু করেছিলেন ফলিত রসায়নে হাত পাকাতে। ফ্রান্সে এসে পিয়েরের সংস্পর্শে আসা, পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা ও বিজ্ঞানের প্রতি তাঁদের নিবেদিত প্রাণ দু-জনের অপরিসীম অনুসন্ধিৎসা ও অসাধারণ কর্মক্ষমতায় অনুঘটক (ক্যাটালিস্ট)-এর কাজ করে। তার ফলে তাঁদের গবেষণার কাজ এগিয়ে চলে ঝড়ের গতিতে।
মারিয়া ও পিয়েরের বিয়ে হয় ১৮৯৫ সালে। সেই বছরেই জার্মানিতে উইলহেলম রন্টজেন এক্স-রে আবিষ্কার করেছেন। তার পরের বছর ফরাসী হেনরি বেকারেল আবিষ্কার করেছেন ইউরেনিয়াম নামের এক মৌল, যার থেকে এক জ্যোতি বা রে বেরোয়। তিনি লক্ষ করলেন যে সেই জ্যোতি ইলেকট্রিক বা ম্যাগনেটিক ফিল্ড দিয়ে প্রভাবিত করা যায় না।
মেরী ও পিয়ের ক্যুরি গবেষণা শুরু করেন এই অচেনা-অজানা জ্যোতির আসল রূপ কি তা জানতে। আর সেই জানার ফল হয়েছিল সুদুরপ্রসারী। শীঘ্রই তাঁরা আবিষ্কার করলেন দুটি নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল, পোলোনিয়াম আর রেডিয়াম। এ ছাড়াও তাঁরা আবিষ্কার করেন তেজস্ক্রিয়তার নানান ধর্ম। তেজস্ক্রিয়তার ওপরে মৌলিক কাজের জন্য ১৯০৩ সালে মেরী ক্যুরি পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরস্কার পান স্বামী পিয়ের ক্যুরি ও হেনরি বেকারেল-এর সাথে। মাদাম ক্যুরি আবার নোবেল পান ১৯১৩ সালে রসায়নে, রেডিয়ামকে, তার আকরের উৎস থেকে আইসোলেট করার জন্য। ইতিমধ্যে তাঁর স্বামী ও বিজ্ঞানের পথ চলার সাথী পিয়ের-এর মৃত্যু হয়েছে এক পথ দুর্ঘটনায়। মেরী ক্যুরি স্বামীহারা হন দুই মেয়ে আইরিন আর ইভ-কে নিয়ে।
মাদাম ক্যুরি সর্বতোভাবেই চেয়েছিলেন বিজ্ঞানের উন্নতি হোক, আর চেয়েছিলেন সেই উন্নতির পথে যেন কোনও বাধা না থাকে। সেইজন্যই রেডিয়াম আবিষ্কার করার জন্য তিনি কোনও পেটেন্ট নেননি, কারণ তিনি চেয়েছিলেন অন্য বিজ্ঞানীরা যেন বিনা বাধায় এই বিষয়ে গবেষণা করতে পারেন। নোবেল প্রাইজের জন্য পাওয়া সমস্ত অর্থ মেরী ও পিয়ের বিভিন্ন গবেষনাগার ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে ভাগ করে নেন। এমনকি স্টকহোমে গিয়ে নোবেল প্রাইজ নেওয়াতেও তাঁরা প্রথমে নারাজ ছিলেন। তাঁরা ছিলেন পুরোপুরি খ্যাতি ও প্রচারবিমুখ। অ্যালবার্ট আইনস্টাইন এক সময় বলেছিলেন — পিয়ের ও মেরী ক্যুরিই একমাত্র লোক, খ্যাতি যাদের দূষিত করতে পারেনি।
ইতিমধ্যে ১৯১১ সালে শুরু হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, আর এই যুদ্ধের প্রধান মঞ্চ ছিল ইউরোপ। সুতরাং যুদ্ধ চলাকালীন সবরকম পড়াশুনো, বিজ্ঞান চর্চা বন্ধ করে দিতে হয়। মাদাম ক্যুরিও সেই অশুভ কালোছায়ার বাইরে থাকতে পারেননি। তিনি তাঁর সোনার নোবেল মেডেল ফ্রান্স সরকারকে দিতে চেয়েছিলেন, যদি তাই দিয়ে যুদ্ধের খরচ কিছু মেটে। যদিও ফ্রান্স সরকার তা নিতে চায়নি।
যুদ্ধের সময় গবেষণা বন্ধ। কিন্তু তাই বলে চুপ করে বসে থাকবেন, মাদাম ক্যুরি সেই পাত্রীই ছিলেন না। তিনি নিজের অর্জিত অর্থে কেনেন বেশ কয়েকটি এক্স-রে যন্ত্র, পোর্টেবল জেনারেটর, কয়েকটি গাড়ি ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। আর তিনি এই সব দিয়ে খোলেন ‘মোবাইল রেডিওগ্রাফি ইউনিট’। কিছু মেয়েদের তিনি শিক্ষা দেন কীভাবে এইসব যন্ত্র চালানো যায়। আর তাই নিয়ে তিনি যুদ্ধের এক ফ্রন্ট থেকে আর এক ফ্রন্টে ঘুরে বেড়ান যাতে আহত সৈনিকদের দ্রুত এক্স-রে করে সার্জারি-র ব্যবস্থা করা যায়। টানা তিন বছর, এই যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি ফ্রেঞ্চ রেডক্রসের রেডিওলজি সার্ভিসের ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করেন। এই প্রচেষ্টায় তিনি তাঁর মেয়ে আইরিনকেও সঙ্গে নেন। উল্লেখযোগ্য যে আইরিন ও তাঁর স্বামী জোলিও দুজনেই পরে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পুরষ্কার পান। মাদাম ক্যুরির এই প্রচেষ্টায় আনুমানিক দশ লক্ষ সৈন্য উপকৃত হয়। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে এই বিপজ্জনক কাজ করতে কেউ তাঁকে বলেনি। এমনকি ফরাসী সরকারও এর জন্য তাঁকে বিশেষ কোনও সম্মান দেয়নি।
মাদাম ক্যুরির চরিত্রের আর এক বিশেষ দিক হল ‘শি নেভার স্যাট অন হার লরেলস’ অর্থাৎ অভূতপূর্ব মান-সন্মান-খ্যাতি পাওয়া সত্বেও তিনি কোনওদিন গবেষণার কাজ বন্ধ করেননি, কেবলমাত্র বিশ্বযুদ্ধের কয়েকটি বছর ছাড়া। নতুন আবিষ্কারের নেশা তিনি কোনওদিন ছাড়তে পারেননি, আর বন্ধ করেননি সেই আবিষ্কারের নানান অভিনব প্রযুক্তি খুঁজে বার করার পথ।
তিনি আবিষ্কার করেন যে রেডিয়াম থেকে একটি তেজস্ক্রিয় গ্যাস বেরোয় যা কোন ক্ষতকে ‘স্টেরিলাইজ’ করে দেয় বা বিষাক্ত হতে দেয় না। সেই গ্যাস দিয়ে তিনি তৈরি করেন ‘ক্যুরি নীডল’, আর তাঁর আবিষ্কৃত এই প্রযুক্তি তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আহত সৈনিকদের ওপর ব্যবহার করেন। আর তার ফল ছিল অভূতপূর্ব। মনে রাখতে হবে যে তখনও পেনিসিলিন আবিষ্কৃত হয়নি। আর সেই সময় অধিকাংশ আহত সৈন্যের মৃত্যু হত তাদের ক্ষতে ব্যাকটিরিয়া জন্মিয়ে বিষাক্ত হয়ে যাওয়ার ফলে।
তেজস্ক্রিয়তা দিয়ে ক্ষতকে ব্যাকটিরিয়াল ইনফেকশন–এর হাত থেকে বাঁচাতে মাদাম ক্যুরির এই পন্থার প্রয়োজন ১৯২৮ সালে অ্যালেকজান্ডার ফ্লেমিং-এর পেনিসিলিন ও পরে আরও বিভিন্ন অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে যায়। কিন্তু মাদাম ক্যুরি তেজস্ক্রিয়তার আর এক অভাবনীয় গুণ আবিষ্কার করেন। তিনি লক্ষ করেছিলেন যে মানুষের দেহ থেকে নেওয়া কোষ (সেল) রেডিয়ামের সংস্পর্শে বেশিক্ষণ রাখলে তারা মরে যায়। কিন্তু তাঁর এর চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ হল যে ক্যান্সার-আক্রান্ত মানুষের টিউমার থেকে নেওয়া সেল-এর মৃত্যুর হার সুস্থ সেল-এর চেয়ে অনেক বেশি। মাদাম ক্যুরির এই পর্যবেক্ষণ ক্যান্সার-চিকিৎসার ক্ষেত্রে এক বিপ্লব নিয়ে আসে। মনে রাখা দরকার যে সেই সময় ক্যানসারের কোনও কার্যকরী চিকিৎসা ছিল না বললেই চলে।
বিগত প্রায় একশো বছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন ক্ষেত্রে, বিশেষ করে মেডিকাল সায়েন্স-এর ক্ষেত্রে অগ্রগতি প্রায় ম্যাজিকের মতো বললে অত্যুক্তি করা হয় না। অতীতের অনেক মারণ-রোগ, যেমন টিউবারকিউলোসিস বা টি-বি আজ প্রায় অবলুপ্ত। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগেও অনেক সাধারণ রোগ, যেমন ডায়াবিটিস, রক্তচাপ, হার্ট ডিজিজ – এসবের কোনও চিকিৎসাই ছিল না, সেইসব রোগের এখন কার্যকরী চিকিৎসা সহজলভ্য।
কিন্তু ক্যান্সার চিকিৎসার ক্ষেত্রে মাদাম ক্যুরির আবিষ্কৃত রেডিয়েশন থেরাপি, বিশেষ করে রেডিয়েশন থেরাপি ও কেমো-থেরাপি ও ড্রাগ-থেরাপি-র সংযোগে যে চিকিৎসা তা আজও অধিকাংশ ক্যান্সারেরই একমাত্র চিকিৎসা। এইভাবেই মাদাম ক্যুরি আজও প্রতিনিয়ত বেঁচে আছেন ও জনগণের উপকার করে চলেছেন।
পৃথিবীর ইতিহাস একটু খুঁজলেই দেখতে পাওয়া যায় যে কোনও কোনও ব্যক্তি তার নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের ওপর অচল থাকার ফলে রাজনৈতিক বা ধর্মীয় শাসকদের রোষ ও অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, এমনকি নৃশংসভাবে খুনও হয়েছেন। এই ব্যতিক্রমী ব্যক্তিদের বেশ কয়েকজন ছিলেন দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও নানা বিষয়ে প্রতিভাধর।
ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী, পদার্থবিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, দার্শনিক, ও প্রযুক্তিবিদ গ্যালেলীয় গ্যালিলীকে আধুনিক বিজ্ঞানের জনক বলা হয়। সতেরোশো শতাব্দীতে তিনি হেলীও সেন্ট্রিসিজম বা ‘সূর্য-প্রধান মহাকাশ’ প্রতিপাদ্য সমর্থন করেন, ও নিজের ধারণা থেকে একচুলও সরে আসতে রাজি হন না। উল্লেখযোগ্য যে ‘সূর্য-প্রধান মহাকাশ’-এর ধারণার শুরু খ্রিস্টপূর্ব তিন শতকের গ্রীক জ্যোতির্বিদ অ্যারিস্টারকাস থেকে। তবু গ্যালেলীয়কে রোমান ক্যাথলিক চার্চের রোষের সম্মুখীন হতে হয় ও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত থাকতে হয় গৃহ-বন্দী হয়ে। ষোড়শ শতাব্দীতে ইতালীয় জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ, দার্শনিক ও কবি জিওর্দানো ব্রুনোকে হেলীও সেন্ট্রিসিজম সমর্থন করার জন্য তক্তায় বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়।
কয়েকশো বছর পর উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে ইউরোপীয় সমাজের যথেষ্ট অগ্রগতি হওয়ার ফলে মেরী ক্যুরিকে তাঁর গবেষণালব্ধ ফলের জন্য সরকার বা চার্চের রোষের সম্মুখীন হতে হয়নি। কিন্তু এক অদৃশ্য পরিহাসে যে বিজ্ঞানের জন্য তাঁর বিশ্বজোড়া সম্মান ও খ্যাতি সেই বিজ্ঞানই কেড়ে নেয় তাঁর জীবনশক্তি।
বর্তমান সমাজে মানুষের শরীরের ওপর তেজস্ক্রিয়তার কুফল ভালোভাবে জানা। এটা জানা যে অনেক সময় ধরে হাই এনার্জি রেডিয়েশন-এর সংস্পর্শে এলে শরীরে ক্যান্সার সংক্রমণের সম্ভাবনা খুব বেশি হয়ে যায়। কিন্তু মাদাম ক্যুরির সময় এই তথ্য জানা ছিল না, ও তিনি এ ব্যাপারে কোনও নিরোধক ব্যবস্থা (প্রোটেকশন) নেননি। যদিও তিনি যে এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না তা বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ সেল-এর ওপরে তেজস্ক্রিয়তার যে মারণ-প্রভাব তা তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন।
আমাদের বেঁচে থাকার জন্য শরীরে যথেষ্ট সংখ্যক সুস্থ রক্তকণিকার উপস্থিতি একেবারে অপরিহার্য কারণ এই রক্তকণিকারাই আমাদের শরীরে সবরকম মলিক্যুল (যৌগ), এমনকি জীবনের জন্য অপরিহার্য অক্সিজেন বয়ে নিয়ে যায় শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে, এমনকি মস্তিষ্কেও। আর আমাদের শরীরের বোন ম্যারো সেলগুলি সেই রক্তকণিকা তৈরি করে। মাদাম ক্যুরি দীর্ঘকাল ধরে, কোনওরকম প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা ছাড়াই তেজস্ক্রিয় পদার্থ নিয়ে নাড়াচাড়া করেছেন। তার ফলে তাঁর শরীরের বোন ম্যারো সেলগুলির যথেষ্ট ক্ষতি হয় ও তারা যথেষ্ট পরিমাণ সুস্থ রক্তকণিকা তৈরি করতে অসমর্থ হয়। এরই ফলে ১৯৩৪ সালে মাদাম ক্যুরির মৃত্যু হয় এপ্ল্যাস্টিক অ্যানিমিয়া রোগে।
তাঁর মৃত্যুর পর জানা যায় যে তাঁর ব্যবহৃত সমস্ত কিছু, এমনকি জামাকাপড়, ল্যাবরেটরির বইপত্র, তাঁর রান্নার বই সবই অত্যন্ত তেজস্ক্রিয় ও বিপজ্জনক। নিঃসন্দেহে জীবনের শেষের দিকে তিনি তেজস্ক্রিয়তার কুফল সম্বন্ধে অবহিত ছিলেন। কিন্তু তিনি থেমে যাননি, এগিয়ে গিয়েছেন সমস্ত বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে। তাই এক অর্থে তিনি ইচ্ছামৃত্যু বরণ করেন বিজ্ঞানের প্রসারের স্বার্থে।
বিজ্ঞান ও সমাজের হিতার্থে নিবেদিতপ্রাণ এই বিজ্ঞানীর সার্ধ জন্মশতবার্ষিকীতে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম।
“Nothing in life is to be feared, it is only to be understood. Now is the time to understand more, so that we may fear less.” Marie Skłodowska Curie.*
*সুত্র: মাদাম ক্যুরির সম্পর্কিত উইকিপিডিয়া ও তার অন্তর্ভুক্ত রেফারেন্স।
ওয়েল্যান্ড, ম্যাসাচুসেটস, উত্তর অ্যামেরিকা
প্রাঞ্জল লেখা। অনেক নতুন তথ্য জানলাম।
Onek dhonyobad. Rahul
লেখাটি খুবই সুন্দর। বিজ্ঞানের বাইরে ওনার স্বামী মারা যাবার পর, ওনার অন্য এক জন পর্দাথবিদের সঙ্গে সম্পর্কের জেরে ওনার প্যারিসের সমাজে, যেভাবে উনি বিচ্ছিন হয়েছিলেন সেটি আলোকপাত করলে আরো ভালো হতো। আবার ও বলি খুবই সুন্দর লেখা।
Paul Lagevine er sathe onar somporko r kotha ta amar kachhe oprasongik legechhe, Jodi o Ete Tanr ekta manobik dik dekha Jai. She was not a heartless scientist hell bent on science only.
Onek dhonyobad.