আতঙ্কের কাহিনি, জাবালিয়া থেকে

হুসাম মারুফ

 


স্পষ্টতই মানুষগুলিকে অনাহারে মারার লক্ষ্য নিয়ে ইজরায়েল এই অঞ্চলে সমস্ত মানবিক সাহায্য আসা আটকে দিয়েছে। অবাধে বোমাবর্ষণ করে এখানে গত চার সপ্তাহে ১২০০-রও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে গত ৩০ অক্টোবর বেইট লাহিয়ার উদ্বাস্তুদের একটি বাড়ির ওপর একটি বোমা ফেলে ১০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা, গত ২৪ অক্টোবর জাবালিয়ায় ১০টি বাড়ির ওপর নাগাড়ে বোম ফেলে ১৫০ জনকে হত্যা করার মতো নারকীয় ঘটনা

 

কেয়ামত।

এইভাবেই জাবালিয়া এবং উত্তর গাজার অধিবাসীরা তাঁদের অবস্থা বর্ণনা করছেন। ইজরায়েলের হানাদারি দ্বিতীয় মাস পূর্ণ করতে চলল।

ইজরায়েল সমস্ত অধিবাসীকে দক্ষিণে যেতে হুকুম দিয়েছে[1], আবার একই সঙ্গে সেদিকে জায়গায় জায়গায় চেকপোস্ট তুলে মানুষকে যেতে বাধা দিচ্ছে।

অক্টোবরের শুরুতে যখন এই হানাদারি শুরু হয় তখন উত্তর গাজায় হিসেবমতো ৪,০০,০০০ মানুষ ছিলেন। এখন যা জানা যাচ্ছে তার মধ্যে ১,০০,০০০-এর কিছু বেশি মানুষ রয়েছেন।[2]

স্পষ্টতই মানুষগুলিকে অনাহারে মারার লক্ষ্য নিয়ে[3] ইজরায়েল এই অঞ্চলে সমস্ত মানবিক সাহায্য আসা আটকে দিয়েছে।[4]

অবাধে বোমাবর্ষণ করে এখানে গত চার সপ্তাহে ১২০০-রও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।[5] এর মধ্যে রয়েছে গত ৩০ অক্টোবর বেইট লাহিয়ার উদ্বাস্তুদের একটি বাড়ির ওপর একটি বোমা ফেলে ১০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা,[6] গত ২৪ অক্টোবর জাবালিয়ায় ১০টি বাড়ির ওপর নাগাড়ে বোম ফেলে ১৫০ জনকে হত্যা করার মতো নারকীয় ঘটনা।

“আপনারা ভাবতে পারবেন না জাবালিয়ায় কী ঘটছে,” ৬৯ বছরের নাদিয়া আল-কাফারনা বলছিলেন, “আকাশ এখানে কালো ধোঁয়ায় ঢাকা, মাটি পুরো ঝলসানো।”

নাদিয়া দ্য ইলেকট্রনিক ইন্তিফাদা-র সঙ্গে ফোনে কথা বলছিলেন, যদিও নেটওয়ার্কের অবস্থা খুবই শোচনীয়। ইজরায়েলি ফৌজ তাঁকে জাবালিয়া রিফিউজি ক্যাম্পের আশ্রয় থেকে গত ১৭ অক্টোবর হটিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তিনি এখনও গাজা শহরের উত্তরেই রয়েছেন।

ভয়ার্ত, বিধ্বস্ত নাদিয়া বলছিলেন— “কোনও কিছুই ধ্বংসের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না, বিস্ফোরণের শব্দগুলো ভয়ানক। প্রতিটি শব্দ আগেরটার চেয়ে আলাদা। বীভৎস। হাড়ের ভেতর কাঁপুনি ধরিয়ে দেয়। মনে হয় যেন সেগুলো শরীরটাকে টুকরো টুকরো করে দেবে।”

“আমি যা দেখেছি এবং দেখে চলেছি সেই আতঙ্ক থেকে আমার ভেতরের সমস্ত কিছুই ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। এমনকি এই এখনও, ভয়াবহ আতঙ্কে আমি আমার হৃদপিণ্ডটা খামচে ধরে বসে আছি।”

কেয়ামত, তিনি বললেন। “আমি কেয়ামতের আতঙ্ক দেখেছি।”

 

অবিরাম আগ্রাসন

নাদিয়া বলছিলেন সৈন্যরা “কোনও দয়া দেখাচ্ছে না… ক্যাম্পে, বাড়িতে, রাস্তায় সর্বত্র মহিলা এবং শিশুদের ছিন্নভিন্ন দেহ পড়ে রয়েছে।”

ইজরায়েলি বাহিনি কাউকেই ছাড়ছে না। গাজার সিভিল ডিফেন্স-এর মাহমুদ বাসাল বলছিলেন, ইজরায়েলি ফৌজের হামলার কারণে তাঁদের উত্তরাঞ্চলের সমস্ত কাজ বন্ধ রাখতে হয়েছে।[7] কাজ করতে গিয়ে তাঁদের অন্তত তিনজন আহত হয়েছেন, অনেককে আটক করা হয়েছে।

ক্যাম্পগুলিতে খাবার এবং জল প্রায় নেইই। রাষ্ট্রসঙ্ঘ জানাচ্ছে সেপ্টেম্বর মাসে ইজরায়েল ৮৩ শতাংশ মানবিক সাহায্য উত্তরে ঢুকতে দেয়নি। জাবালিয়ার মানুষজন ক্ষুধায় যন্ত্রণাদায়করকম কাতর— অনেকেই প্রাচীন ধর্মবিশ্বাস[8] অনুযায়ী পেটে পাথর বেঁধে ক্ষুধার যন্ত্রণা উপশম করতে চাইছেন।

ক্যাম্পের বাসিন্দারা চরম পিপাসার্তও। প্রতিদিন একটি সীমিত পরিমাণ জলই কেবল ক্যাম্পে ঢুকতে পারছে। পরিস্থিতি এমনই যে সেভ দ্য চিলড্রেন ইন্টারন্যাশনাল-এর র‍্যাচেল কামিংস তাকে “সম্পূর্ণ অসহনীয়” বলে বর্ণনা করছেন।[9]

“মানুষের ওপরে বিমান থেকে সমানে বোমাবর্ষণ করা হচ্ছে। আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি যে সেখানে খাবার এবং জল মোটেও পর্যাপ্ত নেই। কিন্তু খাবার আর জলের কনভয়গুলিকে উত্তরে যেতেই দেওয়া হচ্ছে না… সম্পূর্ণ অসহনীয় একটা অবস্থা”— কামিংস বলছিলেন।

নাদিয়ার কথায় বোমাবর্ষণ বিরামহীন।

“বোমাবর্ষণ কখনও থামে না। দিনে-রাতে কখনও। দয়া বা মানবতার কোনও প্রশ্নই নেই। আমরা নিরন্তর প্রার্থনা করে যাই। বিস্ফোরণের প্রতিটি শব্দে মনে হয় মৃত্যু আরও কাছে এগিয়ে এল,” তিনি দ্য ইলেকট্রনিক ইন্তিফাদা-কে বলছিলেন।

“দিনগুলো দুর্বিষহ রকমের লম্বা হয়ে উঠেছে। আমি আর আমার পরিবার ক্ষুধা, তৃষ্ণা আর আতঙ্কের সঙ্গে যুঝে চলেছি। বাড়ির ভেতরে খোলা চুল্লিতে আমরা রুটি সেঁকে নিই, তারপর সেগুলোই টুকরো টুকরো করে ক্ষুন্নিবৃত্তির চেষ্টা করি। দু-সপ্তাহের বেশি আমরা এই রুটি আর জাতার-এর ওপর বেঁচে রয়েছি।”

 

কেয়ামত

নাদিয়া জাবালিয়ার কেয়ামতের এক নগ্ন চিত্র এঁকে দিয়েছেন: বাচ্চারা— বিনিদ্র রাত কাটানোর ফলে মুখচোখ ফ্যাকাশে, হাতে নিজেদের নাম লেখা যাতে শনাক্ত করা যায়, এবং আতঙ্কে সর্বদা তটস্থ।

তাঁদের ঘর ছাড়ার কথা বলছিলেন নাদিয়া। বলছিলেন তাঁদের— তিনি, তাঁর তিন ছেলে, ছেলেদের স্ত্রীরা এবং বাচ্চারা, সবার হাতে নিজের নাম লেখা— এই পুরো পরিবারটিকে সেনারা এসে মাত্র দশ মিনিটের মধ্যে ঘর ছাড়তে ফরমান দিয়েছিল।

“আমরা যখন বেরিয়ে আসছি তখন আমি বহু মানুষের সমবেত আতঙ্কের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। বাবা-মায়েরা ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিল। আমি আমার ছেলেদের আর নাতি-নাতনিদের মুখগুলো দেখতেই থাকছিলাম। মনে হচ্ছিল, এই শেষবারের মতো আমি ওদের দেখছি।”

অন্যদের কাহিনি[10] শুনেও বোঝা যাচ্ছে, জাবালিয়া ছাড়ার ঘটনাটা এখন নিজেই একটা ভয়াবহ আতঙ্ক-কাহিনি।

“আমাদের গলিটার মুখে ট্যাঙ্কগুলো জড়ো হয়েছিল, আর প্রচুর সেনা। দৃশ্যটা পুরো একটা কসাইখানার মতো। পুরুষদের এক জায়গায় জড়ো করা হয়েছে, অন্তর্বাস ছাড়া আর শরীরে কিছু নেই তাদের, হাতগুলো পিছমোড়া করে বাঁধা। তারপর তাদের চোখও বেঁধে দেওয়া হল। কাছেই একটা গভীর কুয়োর মধ্যে মহিলাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাদের বাচ্চাদের ছাড়া। বাচ্চারা কাঁদছে আর চিৎকার করছে তৃতীয় আর একটা জায়গা থেকে।”

আরও একটা চতুর্থ জায়গাও ছিল— যোগ করলেন নাদিয়া।

“একটা চতুর্থ স্তূপও ছিল। আমার এক প্রতিবেশীর বাড়ির দরজার সামনে ডাঁই করে রাখা একটা লাশের স্তূপ। আগে হত্যা করা হয়েছে এমন পঞ্চাশটারও বেশি প্রায়-নগ্ন মৃতদেহ ঢিবি করে রাখা হয়েছিল সেখানে। হায়… আমাকে যদি সেটা দেখতে না হত!”

একজন সেনা লাউডস্পিকারে নাদিয়াকে হুকুম দিচ্ছিল।

“সে আমাকে দক্ষিণে যেতে আদেশ দিচ্ছিল আর ভয় দেখাচ্ছিল যে আমি যদি তাড়াতাড়ি না যাই সে আমাকে মেরে ফেলবে। আমি যখন সাহস করে আমার মেয়ে, ছেলের বৌরা, আর বাচ্চাদের কথা বললাম তখন সে আমাকে তাদের নিয়ে যেতে দিল। কিন্তু পরিবারের সব ছেলেরা পড়ে রইল পেছনে, জানি না তাদের অদৃষ্টে কী ঘটল, তারা রয়ে গেল ঘাতকদের হাতে।”

 

একটা মির‍্যাকল

এমডি, ৫৭ বছর বয়স, প্রতিহিংসার ভয়ে নিজের আসল নাম বলতে চাইলেন না। তাঁর বিশ্বাস, তিনি এবং তাঁর ১৫ বছরের ছেলে যে ইজরায়েলি ফৌজ এবং জাবালিয়া ক্যাম্পে আছড়ে পড়া ড্রোনগুলির হাত থেকে বেঁচে গেছেন, এ “স্রেফ একটা মির‍্যাকল”।

“যখন আমরা শুনলাম যে ইজরায়েলি বাহিনি আমাদের পাশের এলাকার দিকে এগিয়ে আসছে, তখন আমি আর আমার ছেলে ক্যাম্পের ভেতর দিয়ে একটা ঘুরপথ ধরে উত্তর গাজার এক তুলনামূলক নিরাপদ এলাকার দিকে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ি। ঠিক যখন আমরা ভাবতে শুরু করেছি যে আর বিপদ নেই, তখনই আবিষ্কার করি যে আমরা যে-রাস্তাটা ধরেছি ফৌজ সেই রাস্তার মুখটা বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা একটু পিছিয়ে আসি এবং একটা দরজা-ভাঙা বাড়িতে আশ্রয় নিই।”

সেই বাড়ির ভেতরে— তিনি দ্য ইলেকট্রনিক ইন্তিফাদা-কে জানালেন— তাঁরা চারটি লাশ দেখতে পান।

“দুজন পুরুষ এবং একজন মহিলা, তাঁদের গুলি করে মারা হয়েছে, আর একটা ঘরে একজন বয়স্ক মহিলাকে ফেলে রাখা হয়েছিল অনাহারে মৃত্যুবরণ করবার জন্য। তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল শয্যাশায়ী, দুর্বল স্বাস্থ্য, একা পড়ে ছিলেন মৃত্যুর সঙ্গে যুঝবার জন্য। আমরা গোটা রাতটা সেই শবদেহগুলির সঙ্গে কাটাতে বাধ্য হলাম। না পারলাম ঘুমোতে, না পারলাম পালাতে। দরজার বাইরেই বসে ছিল সেনারা। হাসছে, খেলছে। যেন সেখানে একটা পিকনিক হচ্ছে।”

যখন সৈন্যদের শিফট-চেঞ্জ হয়, তখন তাঁরা হাতে একটু সময় পেয়ে যান।

“আমরা রাস্তা পার হয়ে পালাতে পারলাম এবং গাজা শহরের দিকে রওনা দিলাম। আমার বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে আমি বেঁচে গিয়েছি! মনে হচ্ছিল, আমার নবজন্ম হল যেন!”

কিন্তু তা সত্ত্বেও, এমডি বলছিলেন, এই ভয়ানক অভিজ্ঞতা তাঁকে ত্রস্ত করে রেখেছে। নিজের বেঁচে যাওয়ার কথায় তাঁর বক্তব্য ওই মৃতদেহগুলির সঙ্গে একটা রাত কাটানো বা মৃত্যু এবং ধ্বংস প্রত্যক্ষ করাই কিন্তু তাঁর চরমতম অভিজ্ঞতা নয়।

“আমি আমার ছেলেকে নিরাপত্তার কোনও বোধ দিতে ব্যর্থ হয়েছি। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে কানে কানে বলেছি, “সব ঠিক হয়ে যাবে।” কিন্তু ও খুব সামনে থেকে মৃত্যু আর ভয়ানক যন্ত্রণা প্রত্যক্ষ করেছে। অনেকদিন হল ও কোনও কথা বলে না। একটা ভয়াবহ যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছে ও।”

জাবালিয়ার বেশিরভাগ অধিবাসীই শহর ছেড়ে যেতে চাইছেন না। তাঁদের কাছে এই চলে যাওয়া অযৌক্তিক। তাঁরা বলছেন তাঁরা তাঁদের নিজস্ব মাটি ছাড়বেন না।

এসকে, ৪৯, যিনিও নিজের আসল নাম জানাতে চাইলেন না, যাঁরা জাবালিয়া ছেড়ে যেতে চাননি তাঁদেরই একজন। তিনি জানালেন তাঁর বাড়ি ঘিরে রাখা হয়েছে।

“ইজরায়েলি সৈন্যরা মাত্র ১০০ মিটারের মধ্যে রয়েছে। এরা তারাই যারা ঠান্ডা মাথায় নারী-শিশু-বৃদ্ধদের খুন করে, অবলীলায় নিরীহ মানুষের মাথার ওপর কংক্রিট বা স্টিলের চাঙড় ফেলে দেয়। এই পেশাদারি সৈন্যদের অভিধানে দয়ামায়া বলে কোনও শব্দ নেই। আমাদের এই যুগে শয়তানের ড্রাগন এরাই।”

 

ড্রাগন

এসকে নিজের বাড়িতে থাকার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।

“আমাকে আমার বাড়ি থেকে জোর খাটিয়ে উৎখাত করার পেছনে কোনও যুক্তি নেই। ক্যাম্পটা যুদ্ধক্ষেত্র নয়। আমি আমার বাড়ি এবং আমার পূর্বপুরুষদের বাসভূমি ছাড়ব না। এখানে আমি সেই বনস্পতির মতো থেকে যাব যে প্রতিদিন আরও গভীরে নিজের শিকড় চারিয়ে দেয়। একমাত্র মৃত্যু ছাড়া আমাকে উৎপাটন করা যাবে না।”

কিন্তু তাঁর এই দৃঢ়তার জন্য তাঁকে মূল্য চোকাতে হচ্ছে বিস্তর, কারণ ইজরায়েলি ফৌজ জাবালিয়ার মানুষকে না খেতে দিয়ে মারার ব্যবস্থা করেছে।

“বেশিরভাগ সময়েই এখন আমার মাথা ঘোরে”— দ্য ইলেকট্রনিক ইন্তিফাদাকে বলছিলেন এসকে। “খাবারের অভাবে আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে। খালি রুটি আর জাতার খেয়ে কাটাচ্ছি আমরা। যখনই আমি ভাবি যে আমার বাচ্চাগুলো কী ভীষণ বঞ্চনা আর বিপদের সঙ্গে যুঝে চলেছে, আমার কান্না পেয়ে যায়। বাচ্চাদের প্রতি এই নিষ্ঠুরতা কোনওভাবেই কি মেনে নেওয়া যায়?”

তিনি বলছিলেন ইজরায়েলি বাহিনি জাবালিয়ার মানুষকে সন্ত্রস্ত করে রেখেছে। তাদের চোখে ঘুম নেই।

“বিশ্বাস করুন, যখন থেকে এই ক্যাম্প খালি করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তখন থেকে আমরা আর কেউ ঘুমোইনি। বোমাবর্ষণ চলছে নাগাড়ে, শেলগুলো বিকট শব্দ করে ফাটছে, আর সেই শব্দ আমাদের আতঙ্কে দিশাহারা করে দিচ্ছে। নিজের সারা শরীরে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সারাক্ষণ পিন ফোটার অনুভূতি কল্পনা করুন। এই আতঙ্কের সঙ্গেই আমাদের দিন কাটছে।”

ক্যাম্পের ওপরের আকাশে সমানে ড্রোন চক্কর মারছে, বাড়িগুলির মধ্যে দিয়ে ঘুরছে, ওপরে উঠছে-নিচে নামছে, কিছু নড়াচড়া করলেই সেটাকে টার্গেট করছে— তিনি বলছিলেন। অগণিত শবদেহ পড়ে আছে ইতিউতি, পরিত্যক্ত। জীবজন্তুদের— গাধা, বিড়াল, ঘোড়া— দেহও পড়ে রয়েছে দিনের পর দিন। দেহগুলি পচতে শুরু করেছে।

“আমরা বাড়ির বাইরে বেরোতে, জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে বা রাতে আলো জ্বালতে ভয় পাই। এখানে সমস্ত কিছুই টার্গেট। ড্রোন আমাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমাদের বাড়ি থেকে কয়েক মিটার দূরেই একটা লাশ পড়ে আছে। আমি বেরিয়ে গিয়ে তাকে গোর দিতেও পারছি না। ক্যাম্পের রাস্তা এবং বাড়িগুলিতে অসংখ্য মানুষ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে পড়ে মৃত্যুর দিন গুনছে।”

এইরকম সর্বগ্রাসী হত্যালীলা সত্ত্বেও নিজেদের ঘর না ছাড়ার অনমনীয় রোখ থেকে বোঝা যায় জাবালিয়ার মানুষদের কাছে ১৯৪৮-এর নকবা-র স্মৃতি এখনও কতটা দগদগে। সেই সময়ে তাঁদের বাবা-মা বা দাদু-দিদারা বাধ্য হয়েছিলেন নিজেদের বাড়ি এবং জায়গা ছেড়ে যেতে, যে-জায়গায় আর তাঁরা কখনও ফিরতে পারেননি। জাবালিয়ার এই মানুষগুলি চান না তাঁদের পরিণতিও তেমনটাই হোক।

“আতঙ্কটা যে চরমে পৌঁছেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু কোনও পরিস্থিতিতেই আমি আমার বাড়ি ছাড়ব না,” দ্য ইলেকট্রনিক ইন্তিফাদা-কে বললেন এসকে। “মনে হচ্ছে আমরা জাজমেন্ট ডে-র সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। আমরা নিরাপদ নই। মৃত্যুভয় আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে। যদিও আমরা কিন্তু কোনও যুদ্ধ করছি না। আমরা স্রেফ এখানে মরে যাচ্ছি। কেউ আমাদের বাঁচাতে আসছে না।”

 


[1] Almanssi, Asil. Escaping Jabaliya. The Electronic Intifada. Oct 28, 2024.
[2] Israel again bombs Gaza’s Beit Lahiya hours after killing 93 in one strike. Al Jazeera. Oct 30, 2024.
[3] Estrin, Daniel & Batrawy, Aya. Israel threatens to starve out northern Gaza, U.N. aid agencies say. NPR. Oct 15, 2024.
[4] Palestinians ‘starving to death’ in northern Gaza due to Israeli siege. Al Jazeera. Oct 28, 2024.
[5] Majed, Mohamed. Israel killed over 1,200 Palestinians in northern Gaza in 4 weeks: Health Ministry. AA. Nov 1, 2024.
[6] Barrows-Friedman, Nora. Israel carries out series of massacres in northern Gaza. The Electronic Intifada. Oct 31, 2024.
[7] Jabalia: Israeli assault forces Palestinian civil defence to cease operations. MEE. Oct 24, 2024.
[8] Elias, Abu Amina. Hadith on Hunger: The Prophet suffers in poverty with his companions. Daily Hadith Online. Oct 28, 2020.
[9] Over 50 children killed in Israeli strikes in Gaza’s Jabalia in 2 days: UN. Al Jazeera. Nov 3, 2024.
[10] দ্রষ্টব্য, টীকা ১।


হুসাম মারুফ গাজার সাংবাদিক, কবি এবং লেখক। লেখাটি দ্য ইলেকট্রনিক ইন্তিফাদা-য় গত ৪ নভেম্বর ইংরেজিতে প্রকাশিত।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4881 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...