শ্রুবাবতী গোস্বামী
বিজ্ঞানী, ফিজিক্যাল রিসার্চ ল্যাবরেটরি, আমেদাবাদ
গত ২৫ অক্টোবর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতীয় বৈজ্ঞনিক ডঃ রোহিণী গোডবোলে প্রয়াত হন। এটি আন্তজার্তিক এবং ভারতীয় বিজ্ঞানমহলের একটি অপূরণীয় ক্ষতি। ডঃ রোহিণী গোডবোলে আজীবন সক্রিয় বিজ্ঞানচর্চায় যুক্ত ছিলেন। গত জুন মাসে তিনি IISER কলকাতার সমাবর্তন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত হয়েছিলেন। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে তিনি একটি বক্তৃতাও প্রদান করেন, যা তাঁর শেষ বক্তৃতা হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিজ্ঞানচর্চার পাশাপাশি, তিনি বিজ্ঞানে মহিলাদের উপস্থিতি বাড়ানোর এবং লিঙ্গসমতা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছেন।
ডঃ গোডবোলের জন্ম ১৯৫২ সালের ১২ নভেম্বর পুনের একটি উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে। তিনি পুনের একটি প্রসিদ্ধ মেয়েদের স্কুলে পড়াশুনা করেছিলেন। তিনি যখন সপ্তম শ্রেণিতে তখন রাজ্য সরকার থেকে একটি বৃত্তি পান। এই পরীক্ষার জন্য তাঁকে আলাদাভাবে বিজ্ঞানের বিশেষ প্রশিক্ষণ নিতে হয় কারণ তাঁদের স্কুলে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের কোনও বিজ্ঞান পড়ানো হত না— শুধু গৃহবিজ্ঞান পড়ানো হত। এই সময়ে রোহিণী গৃহবিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের বিজ্ঞানের পঠনপাঠনের উপযোগিতা নিয়ে তাঁর স্কুল-কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠি লেখেন। মহিলাদের বিজ্ঞানশিক্ষার পথ প্রশস্ত করার এই প্রচেষ্টা ডঃ রোহিণী গোডবোলে সারা জীবন করে গেছেন।
১৯৬৯ সালে তিনি জাতীয় বিজ্ঞান প্রতিভা অন্বেষণ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর তিনি পুনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক এবং আইআইটি মুম্বাই থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি ডক্টরেট করতে আমেরিকার স্টোনিব্রুক বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং ১৯৭৯ সালে ডক্টরেট সম্পন্ন করেন। পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণার জন্য রোহিণী ইউরোপের অনেক জায়গা থেকে ডাক পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি মনস্থ করেন ভাৱতে ফিরে আসার। ভারতে এসে তিনি মুম্বাইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ-এ পোস্ট-ডক্টরাল ফেলো হিসেবে যোগদান করেন। এর তিন বছর পরে মুম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে স্থায়ী অধ্যাপিকা পদে যোগ দেন। এই সময়ে রোহিণী সমান দক্ষতার সঙ্গে অধ্যাপনা এবং গবেষণার কাজ চালিয়ে যান। এরপর ১৯৯৫ সালে তিনি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স বেঙ্গালুরুতে যোগদান করেন এবং ২০২১ সালে সেখান থেকে অবসর নেওয়ার পরে এমেরিটাস প্রফেসর হিসেবে শেষ দিন পর্যন্ত যুক্ত থাকেন। তাঁর তত্ত্বাবধানে অনেক ছাত্রছাত্রী গবেষণা করে নিজেদের বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
তিনি উচ্চশক্তি কণা-পদার্থবিদ্যায় উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেছেন। কণা-পদার্থবিদ্যার মূল উদ্দেশ্য হল মৌলিক কণাদের ধৰ্ম এবং তাদের মিথষ্ক্রিয়া অধ্যয়ন করা। এটি যে বৈজ্ঞানিক পরিকাঠামোতে করা হয় তাকে বলা হয় স্ট্যান্ডার্ড মডেল। এই মডেলে যে-সমস্ত মৌলিক কণা অন্তর্ভুক্ত আছে তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভর যে কণার তার নাম টপ্ কোয়ার্ক। রোহিণী তাঁর সহগবেষকদের সঙ্গে এই টপ কোয়ার্ককে গবেষণাগারে কীভাবে আবিষ্কার করা যাবে সেই বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন। তাঁদের এই কাজের ভিত্তিতেই পরবর্তীকালে আমেরিকার ফার্মি এক্সেলারেটর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিতে টেভাট্রন কোলাইডার-এ টপ কোয়ার্ক আবিষ্কৃত হয়। এছাড়াও তিনি কোলাইডার-সংক্রান্ত অনেক উচ্চমানের গবেষণা করেছেন এবং আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। এর মধ্যে একটি অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য কাজ হল উচ্চশক্তির ফোটনের গঠনের উপর আলোকপাত করা। তাঁর এবং তাঁর সহগবেষক জার্মানির ম্যানুয়েল ড্রিস-এর নামে এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় “Drees-Godbole Effect”। উচ্চশক্তির কোলাইডারের পরিকল্পনায় এই প্রক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়াও তিনি হিগস বোসন-এর ধর্মের বিষয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা করেছেন। তিনি সুপারসিমেট্রি তত্ত্বের উপরে, বিশেষত সুপারসিমেট্রির উপস্থিতি অনুসন্ধান করার পদ্ধতি নির্ধারণ করার গবেষণায় বিশেষ অবদান রেখেছেন। তাঁর কাজ কণা-পদার্থবিজ্ঞানে নতুন দিশা দেখিয়েছে।
বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে বিজ্ঞানচর্চায় লিঙ্গসাম্য, বিশেষ করে মহিলারা যাতে বিজ্ঞানচর্চার সুযোগ এবং উপযুক্ত স্বীকৃতি পান সেই নিয়ে ডঃ গোডবোলের ভূমিকা অগ্রগণ্য। ২০০২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ ফিজিক্স অ্যান্ড অ্যাপ্লায়েড ফিজিক্স (IUPAP) পদার্থবিজ্ঞানে কর্মরতা মহিলাদের জন্য প্যারিসে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজন করে। এই সম্মেলনে ডঃ রোহিণী গোডবোলেকে একজন সফল এশিয়ান মহিলা বিজ্ঞানী হিসেবে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রণ করা হয়। ডঃ গোডবোলে লিখেছিলেন যে তাঁর বক্তৃতার পরে মালয়েশিয়া, ঘানা ইত্যাদি বহু দেশের মহিলা গবেষকরা তাঁকে বলেন যে তাঁরা ডঃ গোডবোলের অভিজ্ঞতার সঙ্গে নিজেদের অনেক মিল খুঁজে পেয়েছেন। এই সম্মেলনের পরে রোহিণীর মনে হয় যে ভারতবর্ষে যে-সমস্ত মহিলা বৈজ্ঞানিক নানা প্রতিকূলতার মধ্যে গবেষণা করছেন তাঁদের কথা সবার কাছে পৌঁছানো দরকার। এই ভাবনা থেকেই ২০০৮ সালে ডঃ রাম রামস্বামী এবং ডঃ রোহিণী গোডবোলে সম্পাদিত “Leelavati’s Daughters” ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স থেকে প্রকাশিত হয়। এখানে প্রায় ১০০ জনের মতো প্রাক্তন এবং সমসাময়িক মহিলা বিজ্ঞানীদের জীবনকাহিনি ও আত্মকথন তুলে ধরা হয়েছিল। মহিলা বৈজ্ঞানিকদের নিয়ে এই ধরনের কোনও বই ভারতবর্ষে এর আগে প্রকাশিত হয়নি। সেইদিক দিয়ে এই বইটি একটি অনুপ্রেরণামূলক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। এছাড়াও রোহিণী বিভিন্ন বিজ্ঞান অ্যাকাডেমির মাধ্যমে ভারতবর্ষে মহিলাদের বিজ্ঞানচর্চার পরিবেশ অনুকূল করার প্রয়াস করেছেন এবং বিভিন্ন পরিসংখ্যান এবং প্রতিবেদন লেখার সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন। রোহিণী ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্স-এর “Women in Science” প্যানেলের প্রথম চেয়ারপার্সন ছিলেন, ইন্টার-অ্যাকাডেমি প্যানেল অফ সায়েন্স-এর কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যও ছিলেন। ইন্ডিয়ান ফিজিক্স অ্যাসোসিয়েশন-এর জেন্ডার ইন ফিজিক্স ওয়ার্কিং গ্রুপের সঙ্গেও তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।
এছাড়াও তিনি দেশের এবং বিদেশের বিভিন্ন অ্যাকাডেমিক ইনস্টিটিউট-এর পরিচালনা পর্ষদের সদস্য ছিলেন।
২০০৭ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের মন্ত্রিসভার বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন। তাঁর বিশিষ্ট অবদানের জন্য তিনি অনেক পুরস্কার এবং সম্মান পেয়েছেন। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল ভারত সরকারের প্রদত্ত পদ্মশ্রী সম্মান এবং ফরাসি সরকারের Ordre National du Mérite সম্মাননা। তিনি ভারতের তিনটি ন্যাশনাল অ্যাকাডেমির এবং “The World Academy of Science”-এর নির্বাচিত সদস্য (Fellow)।
তাঁর প্রয়াণের সঙ্গে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানজগতের এক অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্রের বিদায় ঘটল। ডঃ রোহিণী গোডবোলের জীবন কেবলমাত্র একটি ব্যক্তিগত সাফল্যের উদহারণ নয়— ভারতীয় বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান, বিশ্বব্যাপী বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা এবং সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতার জন্য তিনি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রেরণার এক অবিস্মরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন।