কেয়া মুখোপাধ্যায়
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কেয়া মুখোপাধ্যায় ইউনিভার্সিটি অফ টেক্সাসে বিজ্ঞানী হিসেবে কর্মরত। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখার পাশাপাশি বেড়ানো আর গান শোনায় কাটে ছুটির অবকাশ। মনের আনাচ-কানাচ থেকে কুড়িয়ে নেওয়া খেয়ালখুশির রঙচঙে টুকরো কাচের বর্ণময়তাকে অক্ষরে অক্ষরে ধরে রেখেছেন প্রকাশিত বই ‘ঠিক যেন ক্যালেইডোস্কোপ’-এর পাতায়।
‘আপনি যখন এই পত্রখানি পাবেন, তখন জন্মদিনের মধ্যে সেরা আমাদের প্রিয় ৩০শে নভেম্বর তারিখটি এসে যাবে।
‘অনন্তকাল ধরে ওই দিনটি ধন্য হোক — ওই শুভ দিনটিকে অনুসরণ করে ফিরে আসুক মাধুর্য ও পবিত্রতায় পূর্ণ আরও বহু বহু দিন। বাইরে দেখা যাচ্ছে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের খোদাই করা বিরাট প্রতিমূর্তি, তাঁর নামের নীচে শুধু লেখা আছে ‘লা পাত্রে’ (দ্য ফাদার)। আমি সেই অনাগত দিনটির কথা ভাবছিলাম, যখন ওই কথাগুলি আপনার নামের নীচে নীরব বাণী হয়ে থাকবে। আধ্যাত্মিকতার দিক থেকে ইতিমধ্যেই আপনি এক হয়ে গেছেন তাঁর সঙ্গে, এক হয়ে গেছেন সেই সব মহৎ অভিযাত্রীদের সঙ্গে — যাঁরা নিজ নিজ জাতির কল্যাণ সাধনায় অজানা সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছেন।
‘চির বিজয় লাভ করুন। জাতির সম্মুখে আপনার জীবন এক আলোকবর্তিকার মতো পথ দেখাক, তাদের কল্যাণে প্রদীপের মতো নিবেদিত হোক। আপনার অন্তর শান্তিতে পরিপূর্ণ হোক। আপনিই আধ্যাত্মিক জগতের শ্রেষ্ঠ নাবিক — আবিষ্কার করে চলেছেন নব নব জগত।’
১৯১০ সালের ৩০ শে নভেম্বর সুদূর জেনোয়া থেকে সুগভীর প্রীতি ও শুভেচ্ছার এই চিঠিখানি সিস্টার নিবেদিতা পাঠিয়েছিলেন তাঁর ‘ম্যান অফ সায়েন্স’, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুকে। জন্মদিনে।
পিছিয়ে যাওয়া যাক কয়েক বছর।
১৮৯৭-এর এপ্রিল মাস। ইউরোপে প্রথম বৈজ্ঞানিক সফর সেরে ফিরে এসেছেন জগদীশচন্দ্র। বিশ্বসভায় বাংলার তথা ভারতের মুখ উজ্জ্বল হয়েছে। দেশ বিদেশের নানা সংবাদপত্রে প্রকাশিত সেই গৌরবগাথা। রবীন্দ্রনাথ লিখলেন,
“বিজ্ঞানলক্ষ্মীর প্রিয় পশ্চিমমন্দিরে
দূর সিন্ধুতীরে
হে বন্ধু, গিয়েছ তুমি; জয়মাল্যখানি
সেথা হতে আনি
দীনহীনা জননীর লজ্জানত শিরে
পরায়েছ ধীরে।
বিদেশের মহোজ্জ্বল-মহিমা-মণ্ডিত
পণ্ডিতসভায়
বহু সাধুবাদধ্বনি নানা কণ্ঠরবে
শুনেছ গৌরবে।
সে ধ্বনি গম্ভীরমন্দ্রে ছায় চারি ধার
হয়ে সিন্ধু পার…।”
ইউরোপ সফরের সাফল্য নতুন করে অনুপ্রেরণা দিল জগদীশচন্দ্রকে। শুভার্থী রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাৎ হল দেশে ফিরে। পরাধীন দেশে অজস্র প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজের মেধা আর সৃজনশীলতাকে পাথেয় করে ইউরোপ আর আমেরিকার উন্নততর গবেষণাগারের বিজ্ঞান গবেষণাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে নতুন উদ্যমে বিজ্ঞান সাধনায় নিয়োজিত হলেন জগদীশচন্দ্র। এই বছরেই লন্ডনের রয়্যাল সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হল তাঁর তিনটি রিসার্চ পেপার।
পরের বছর। ১৮৯৮-এর ২৮শে জানুয়ারি। মোম্বাসা জাহাজ এসে লাগল কলকাতা জেটিতে। ইউরোপের স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা জীবন ছেড়ে আসা মিস মার্গারেট এলিজাবেথ নোবল চেয়ে দেখলেন তাঁর স্বপ্নের ভারতবর্ষকে। তাঁকে নিতে এসেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। গৈরিক বস্ত্র পরিহিত সেই সন্ন্যাসী, দু’বছর আগে যাঁর সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ আমূল বদলে দিয়েছে মার্গারেটের জীবনের গতিপথ। কয়েকমাস আগে এক অকপট চিঠিতে যিনি তাঁকে আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, মিস নোবলের মতো মহীয়সী নারীকে বড় দরকার ভারতবর্ষের।
কে এই মিস নোবল? ১৮৯৮ সালে তিনি যখন সুদূর প্রাচ্যে পাড়ি দিলেন, সেই সময় ‘Margaret Noble was a brilliant young woman of thirty and eager educationist.’ (ওয়েস্ট মিনিস্টার গেজেট)। কলকাতার দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার এক সময়ের সম্পাদক এস কে র্যাটক্লিফ-এর কথায়, ‘Margaret Noble was known in London twenty years ago as perhaps the most eager and brilliant member of a group of new educationists, who, among other things, founded the Sesame Club.’
কলকাতায় এসে ভারতীয়দের সঙ্গে পরিচয়ের সূচনাতেই শিক্ষিত, সুপ্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্মসমাজের সংস্পর্শে এলেন মিস নোবল। ১৮৯৮ সালের ১১ মার্চ স্টার থিয়েটারে রামকৃষ্ণ মিশনের উদ্যোগে এক সভার আয়োজন করলেন স্বামী বিবেকানন্দ। উদ্দেশ্য, বাংলার বিদ্বান ব্যক্তিদের সঙ্গে মার্গারেটকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। সে সভায় মার্গারেট বক্তৃতা দিলেন ইংল্যান্ডে ভারতীয় অধ্যাত্ম্য-ভাবনার বিস্তার নিয়ে। বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র উপস্থিত সেখানে। মার্গারেটের দৃপ্ত ভাষণ শুনলেন তিনি। কিন্তু সেদিন নয়, তাঁর সঙ্গে মার্গারেটের পরিচয় হবে আরও কিছুদিন পরে।
১৮৯৮-এর ২৫শে মার্চ। শুক্রবার। বেলুড় মঠে বিবেকানন্দ হিন্দুধর্মে দীক্ষা দিলেন মার্গারেটকে। মানবতার জন্য নিবেদিত হলেন তিনি। মার্গারেট এখন নিবেদিতা, দ্য ডেডিকেটেড। ভারতবর্ষ তাঁর প্রাণ।
১৮৯৮-এর শেষ দিকে ‘শিক্ষা’ প্রসঙ্গে প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ব্রাহ্মসমাজে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন নিবেদিতা। সেখানে আসতেন ব্রাহ্মসমাজের শিক্ষিতা মেয়েরা। রবীন্দ্রনাথের ভাইঝি ইন্দিরা দেবী, ভাগনি সরলা দেবী, জগদীশচন্দ্রের বোন লাবণ্যপ্রভা।
নিবেদিতা যখন ভারতে এলেন, সেই একই সময়ে সময় স্বামী বিবেকানন্দের আরও দু’জন বিদেশি শিষ্যা, মিসেস সারা বুল ও মিস ম্যাকলাউডও ভারতভ্রমণ করছিলেন। ১৮৯৮-এর ডিসেম্বরে কলকাতার আমেরিকান কনসালের আতিথ্য নিলেন তাঁরা। আমেরিকান কনসালের স্ত্রীর মাধ্যমে কলকাতার কিছু বিশিষ্ট ব্রাহ্ম ব্যাক্তিত্বের সঙ্গে পরিচয় হল তাঁদের। রবীন্দ্রনাথ আর জগদীশচন্দ্রের মতো দুই ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত হয়ে বিমুগ্ধ তাঁরা।
১৮৯৮-এর ডিসেম্বরেই আমেরিকান দূতাবাসের এক পার্টিতে সারা বুলের উৎসাহে নিবেদিতার সঙ্গে প্রথম আলাপ হল জগদীশচন্দ্রের। অল্প বয়স থেকে বিজ্ঞানের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ছিলেন নিবেদিতা। পশ্চিমেও বিশিষ্ট জ্ঞানী-গুণিজনদের সঙ্গে পরিচয় ছিল তাঁর। বিজ্ঞানমনস্কতার জন্য সুবিদিত ছিলেন তিনি। জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান-প্রতিভার দ্যুতি মুগ্ধ করল তাঁকে। অন্তরের দূরদর্শিতায় নিবেদিতা বুঝতে পারলেন, বিজ্ঞানচর্চা ছাড়া ভারতের ব্যবহারিক জীবনের উন্নতি অসম্ভব। তাই পরাধীন ভারতবর্ষের প্রেক্ষাপটে এই বিজ্ঞানসাধক মানুষটির গবেষণার গুরুত্ব অপরিসীম।
প্রথম পরিচয়ের দিনেই ব্রাহ্মদের অদ্বৈত-তত্ত্বের পক্ষে বিজ্ঞানের প্রমাণ চাইলেন নিবেদিতা তাঁর কাছে। অনুভব করলেন, জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান সাধনার পথ পশ্চিমের বিজ্ঞানীদের চেয়ে একেবারে আলাদা। অগাধ সম্ভাবনাময় এই মানুষটির গবেষণার মূল সুরটির উৎস অনুভূতি বা প্রত্যক্ষ দর্শন, যা ভারতীয় অধ্যাত্মবাদের শাশ্বত ধারাটির ওপর আধারিত।
আর জগদীশচন্দ্র? তাঁর কী মনে হল? বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রতি পদে প্রতিকূলতা, সরকারের চূড়ান্ত উদাসীনতা এমনকি অসহযোগিতার সম্মুখীন হতে হতে বিপর্যস্ত জগদীশচন্দ্র বুঝলেন তাঁর গবেষণায় নিবেদিতার অপার আগ্রহ। মনের ক্ষীণ আশার প্রদীপটি জ্বলে উঠল আবার। নিঃসন্দেহে নিবেদিতার সঙ্গে পরিচয়ের মুহূর্তটি জগদীশচন্দ্রের জীবনে এক মোড় পরিবর্তনের সূচনা করল। প্রথমদিনের সেই পরিচয় ক্রমে পরিণত হল এক ব্যতিক্রমী গভীর বন্ধুত্বে।
১৮৯৯। গোলকোণ্ডা জাহাজে করে ইংল্যান্ডে যাত্রা করলেন বিবেকানন্দ। এ তাঁর দ্বিতীয়বার বিদেশ যাত্রা। নিবেদিতা আর তুরীয়ানন্দ তাঁর সঙ্গী। ইংল্যান্ডে নিবেদিতার ছোট বোন মে-র বিয়ের উৎসবে যোগ দেবার পর তাঁরা গেলেন আমেরিকা। সেখানে ভারতীয় আদর্শ প্রচারের কাজে স্বামী বিবেকানন্দকে সাহায্য করেন নিবেদিতা। অর্থ সংগ্রহ করার চেষ্টা করেন বোস পাড়া লেনে সারদা মায়ের আশীর্বাদে প্রতিষ্ঠা করে আসা নিজের স্কুলের জন্য।
এর মধ্যেই সময় হয়ে এল স্বামী বিবেকানন্দ ও নিবেদিতার প্যারিস যাত্রার। সেখানে ধর্ম নিয়ে আলোচনা করবেন স্বামীজি। জুলাই মাসে সায়েন্স কংগ্রেসে নিজের আবিষ্কারের পেপার পড়তে জগদীশচন্দ্রও পৌঁছলেন প্যারিস। বসু দম্পতির সঙ্গে নিবেদিতার সাক্ষাৎ হল সেখানে।
স্ত্রী-শিক্ষার উন্নতির জন্য কাজ করতেন জগদীশচন্দ্রের স্ত্রী অবলা বসু। শিক্ষিতা, সমাজ-সচেতন অবলার কাজ দেখে নিবেদিতার ভাল লেগেছিল আগেই। তাঁর সঙ্গেও সখ্য তৈরি হল নিবেদিতার। প্যারিসে মিসেস লেগেটের বাড়িতে নিবেদিতার নিয়মিত দেখা হত বিবেকানন্দ, নিবেদিতা, জগদীশচন্দ্র, অবলা বসু আর সারা বুলের। প্যারিসে বসু দম্পতির সঙ্গে নিবেদিতার ঘনিষ্ঠতা বাড়ল।
নিবেদিতা আসার আগেই কলকাতার টাউন হলে জগদীশচন্দ্র যন্ত্রের সাহায্যে অদৃশ্য আলোকরশ্মির অস্তিত্ব প্রমাণ করে দেখিয়েছিলেন দর্শকদের। কিন্তু যত সফলই তিনি হোন, তাঁর কাজে প্রতি পদে তৈরি করা হয় বাধা। তাঁর আবিষ্কারগুলি ধামাচাপা দেবার চেষ্টা হয় প্রতিনিয়ত। বিদেশে যাবার অনুমতি পাওয়া যায় না সহজে। গবেষণার যথেষ্ট সময় যাতে তিনি না পান, তাই কলেজে পড়ানোর রুটিনের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয় তাঁর ওপর। তাছাড়া ব্রিটিশ অধ্যাপকদের সমতুল বেতনও দেওয়া হয় না তাঁকে। বিদেশি বিজ্ঞানীদের সুযোগ-সুবিধের ছিটেফোঁটাও পান না জগদীশচন্দ্র।
এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও প্যারিসের বিজ্ঞান কংগ্রেস প্রত্যক্ষ করল জগদীশচন্দ্রের আশ্চর্য সাফল্য। বিবেকানন্দের মতো সুবক্তা নন তিনি। কিন্তু সে সভায় কখনো অনায়াস বিজ্ঞান ব্যাখ্যায় আবার কখনও বা নিপুণ পরিহাসে জগদীশচন্দ্র জয় করে নিলেন উপস্থিত শ্রোতাদের। সকলে উচ্ছ্বসিত তাঁর কৃতিত্বে। নিবেদিতা স্থির করলেন, জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞান সাধনায় সর্বতোভাবে সাহায় করবেন তিনি। পাশে থাকবেন।
প্যারিসের পর ইংল্যান্ডের ব্র্যাডফোর্ড অ্যাসোশিয়েশনে পেপার পড়বেন জগদীশচন্দ্র। স্কুলের জন্য অর্থ সংগ্রহে নিবেদিতাও যাবেন ইংল্যান্ড। বিবেকানন্দ তখনও প্যারিসে। তারপর গ্রিস, মিশর হয়ে ফিরে যাবেন ভারতে। একসঙ্গে ভারত থেকে যাত্রা করেও এবার বিবেকানন্দ আর নিবেদিতা — দু’জনের পথ দু’দিকে। আলাদা।
ইংল্যান্ড থেকে নিবেদিতার লেখা এক চিঠির উত্তরে প্যারিস থেকে বিবেকানন্দ লিখলেন:
‘তোমার চিঠি পড়ে মনে হল তুমি ভেবেছ তোমার নতুন বন্ধুদের আমি বুঝি ঈর্ষা করি। তোমাকে বলি, আমার আর যাই দোষ থাক না কেন, জন্ম থেকেই আমার ঈর্ষা নেই।’
ক্রমশ সব কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন বিবেকানন্দ। মঠের দায়িত্বও ছেড়ে দিলেন। ওদিকে নিবেদিতা আর বসু দম্পতি তখনও ইংল্যান্ডে। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন জগদীশচন্দ্র। ১৯০০ সালের ডিসেম্বরে বেলুড় থেকে নিবেদিতাকে স্বামীজি লিখলেন:
‘মহাদেশগুলির একপ্রান্ত থেকে একটি স্বর তোমাকে প্রশ্ন করছে: কেমন আছ?’
রয়্যাল সোসাইটিতে পেপার পড়ার পর সে বছর ডিসেম্বর মাসের মাঝামাঝি অপারেশন হল জগদীশচন্দ্রের। তারপর নিবেদিতা তাঁকে নিয়ে গেলেন নিজেদের উইম্বলডনের বাড়িতে। নিবেদিতা আর অবলা বসুর আন্তরিক সেবায় সুস্থ হলেন জগদীশচন্দ্র।
১৯০১ সালের ৪ঠা জানুয়ারি মিস ম্যাকলাউডকে নিবেদিতা লিখলেন:
‘ডঃ বসু এখন প্রায় সুস্থ। মা তাঁর ছোট বাড়িটি তাঁদের ও আমার জন্য ছেড়ে দিয়েছেন। তাই আমরা এখন উইম্বলডনে।’
১৯০১ সালে ইংল্যান্ডে থাকার সময় থেকে জগদীশচন্দ্রের গবেষণার কাজে সাহায্য করতে শুরু করলেন নিবেদিতা। সরকার আর বিদেশি বৈজ্ঞানিকদের সঙ্গে জগদীশচন্দ্রের নিরন্তর সংগ্রামকে নিবেদিতা উল্লেখ করতেন Bose war বলে। তাঁর এই অবস্থা দেখে খুব কষ্ট পেতেন নিবেদিতা।
প্রতিনিয়ত বর্ণবৈষম্যের শিকার হওয়া। তার ওপর শরীরও ভাল নয় জগদীশচন্দ্রের। সব মিলিয়ে মাঝে মাঝেই হতাশা গ্রাস করত তাঁকে। মুষড়ে পড়তেন পেপার প্রস্তুত করার সময়। সেই সব অবসাদের মুহূর্তে কখনও জননীর মতো কোমল স্নেহ দিয়ে আবার কখনও উৎসাহ দিয়ে তাঁকে আগলে রাখতেন নিবেদিতা।
সাধারণত নিবেদিতা তাঁকে ‘ম্যান অফ সায়েন্স’ বলতেন। কিন্তু এই সময় থেকেই নিবেদিতার চিঠিতে আর ডায়েরিতে জগদীশচন্দ্র সম্পর্কে ‘Bairn’ সম্বোধনটিরও উল্লেখ দেখা যায়। স্কটিশ ভাষায় এর অর্থ হল ‘A Child’ বা খোকা। জগদীশচন্দ্রের থেকে দশ বছরের ছোট ছিলেন নিবেদিতা। কিন্তু অবসাদগ্রস্ত হলে একটি অসহায় শিশুর মতোই নিবেদিতার মুখাপেক্ষী হতেন তিনি। লিখেছেন: ‘হতাশ ও অবসন্ন বোধ করিলে আমি নিবেদিতার নিকট আশ্রয় লইতাম।’
১৯০২ থেকে ১৯০৭-এর মধ্যে প্রকাশিত জগদীশচন্দ্রের তিনটি বিখ্যাত বই, ‘Living and Non-living’, ‘Plant Response’, ‘Comparative Electro-physiology’, আর পরবর্তী বই ‘Irritability at Plants’ এবং রয়্যাল সোসাইটি পরিচালিত Phylosophical Transactions পত্রিকায় ধারাবাহিক হিসেবে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলি শুধু নিবেদিতার সম্পাদিতই ছিল না, ইংরেজি ভাষায় অসামান্য দখল থাকায় সেগুলি প্রণয়নেও অত্যন্ত গুরুত্বপূণ ভূমিকা ছিল নিবেদিতার।
ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর প্রায় প্রতিদিন নিবেদিতার বোসপাড়া লেনের বাড়িতে আসতেন জগদীশচন্দ্র। ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে লেখা চলত। নিমগ্ন সাধিকার মতো লেখায় নিবিষ্ট থাকতেন নিবেদিতা। বিজ্ঞান আলোচনা করতেন জগদীশচন্দ্র। কাজ শেষ হতে দেরি হলে কখনও কখনও সেখানেই আহারাদি সম্পন্ন করতেন তিনি।
১৯০২-এর ফেব্রুয়ারি। নিবেদিতা ভারতে পৌঁছলেন। প্রথমে মাদ্রাজ। সেখানকার মহাজন সভা নিবেদিতাকে সংবর্ধনা দিল। কিছুদিন পরে ভারতে এলেন ওকাকুরা। ক্রিস্টিন আর ওকাকুরাকে নিয়ে নিবেদিতা গেলেন মায়াবতী। ফিরে এলেন ২৬শে জুন।
নানা ব্যস্ততায় স্বামীজির থেকে দূরে দূরে দিন কাটছে নিবেদিতার। কিন্তু ওদিকে সময় শেষ হয়ে আসছে দ্রুত।
২রা জুলাই বেলুড় মঠে গেলেন নিবেদিতা। সামান্য আহারের পর নিবেদিতার হাতে জল ঢেলে হাত মুছিয়ে দিলেন বিবেকানন্দ।
তারপর এল সেই অমোঘ ৪ঠা জুলাই। সকালবেলা সারদানন্দের চিঠি পৌঁছল নিবেদিতার কাছেঃ
‘My Dear Nivedita, The end has come. Swamiji has slept night at 9 o’ clock, never to rise again.’
স্বামীজির এই আকস্মিক মহাপ্রয়াণ নিবেদিতার সামগ্রিক চিন্তাধারা আর কাজে নিয়ে এল আমূল পরিবর্তন। স্কুলের সীমিত পরিধির মধ্যে শুধু স্ত্রী শিক্ষার গণ্ডিতে আর আটকে থাকা নয়, কারণ তিনি অনুভব করেছেন ভারতের স্বাধীনতার গুরুত্ব। ক্রমে তিনি জড়িয়ে পড়লেন রাজনৈতিক কর্মধারায়। কিন্তু সেই অসম্ভব ব্যস্ততায় স্বামীজির আরব্ধ কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবার পাশাপাশি এক মুহূর্তের জন্যেও বিস্মৃত হননি জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞানসাধনায় তাঁর ভূমিকাটি।
শুধু নিজেই সাহায্য করেননি, অন্যান্য গুণিজনের দৃষ্টি জগদীশচন্দ্রের কাজের প্রতি আকর্ষণ করেছেন। বিজ্ঞানচর্চার জন্য সাহায্য চেয়েছেন। ১৯০৩-এর ১৮ই এপ্রিল, ‘ডিয়ার মিস্টার টেগোর’ সম্বোধনে রবীন্দ্রনাথকে যে চিঠি লিখলেন নিবেদিতা, সে চিঠিও পরিপূর্ণ জগদীশচন্দ্রের কথায়। টেগোর জানতে চেয়েছিলেন জগদীশচন্দ্রের কাজের কথা। তাঁকে সাহায্য করার আবেদন রাখলেন নিবেদিতা রবীন্দ্রনাথের কাছে। নিবেদিতার আর্জি উপেক্ষা করতে পারেননি রবীন্দ্রনাথ। ত্রিপুরার মহারাজের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে তিনি পাঠিয়েছিলেন জগদীশচন্দ্রের গবেষণার কাজে।
তবে সবচেয়ে বড় ভূমিকাটি বোধহয় নিবেদিতা নিয়েছিলেন যখন তাঁর খোকার দায়িত্ব নিতে তিনি অনুরোধ করলেন বিশ্ববিখ্যাত বেহালাবাদক ওলে বুলের স্ত্রী, সারা বুলকে।
অকালে স্বামীকে হারিয়ে উত্তরাধিকার হিসেবে প্রাপ্ত অগাধ ঐশ্বর্যকে ভাল কাজে লাগাতে চেয়েছিলেন সারা। অবুঝ কন্যা ওলিয়াকে নিয়েও সুখী ছিলেন না তিনি। তাঁর সেই অতৃপ্তির কথা জানতেন নিবেদিতা। অন্যদিকে জগদীশচন্দ্রেরও গবেষণার কাজে প্রয়োজন ছিল অর্থের। তাঁর সেই লক্ষ্যসিদ্ধির কথা মাথায় রেখেই নিবেদিতা জগদীশচন্দ্রকে এগিয়ে ছিলেন সারার কাছে। বলেছিলেন, ‘ভারতে তোমার একটি পুত্র আছে, যার সাহায্য চাই, তোমার স্নেহ চাই।’
লিখেছেন, ‘বোসদের আমি কতটা ভালোবাসি তা যদি তোমাকে বোঝাতে পারতাম! আমি দৃঢ়ভাবে আশা করি তুমি ডঃ বসুকে নিজের ছেলের মতো দেখবে। তিনি প্রায়ই তোমার কথা বলেন।’
শেষদিকে সত্যিই জগদীশচন্দ্র সারা বুলের সন্তান হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সন্তান-সুখ প্রত্যাশী সারা বা আপনভোলা জগদীশচন্দ্র — দু’জনের কেউই জানতে পারেননি কেন নিবেদিতার এই পদক্ষেপ। তাঁর স্বপ্ন ছিল জগদীশচন্দ্র বসুর সুমহান নেতৃত্বে গড়ে উঠবে এক শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র। শঙ্করীপ্রসাদ বসুর কথায়, জগদীশচন্দ্রের আরব্ধ বিজ্ঞান সাধনার উন্নতিতে, তথা ভারতের বিজ্ঞান গবেষণার অগ্রগতির জন্য এ ছিল নিবেদিতার এক সুমহান কৌশল।
১৯০১ সাল। সবেমাত্র শুরু হয়েছে নোবেল পুরস্কার দেওয়া। বিশ্বের এক শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীর স্বীকৃতি-স্বরূপ জগদীশচন্দ্রকে নোবেল পুরস্কারের সমতুল অর্থে ভূষিত করার সিদ্ধান্ত নিলেন সারা। ১৯০৬ থেকে ১৯০৯ পর্যন্ত চারটি কিস্তিতে কুড়ি হাজার ডলার দেওয়া হল জগদীশচন্দ্রকে। সেই অর্থেই কেনা হল বসু বিজ্ঞান মন্দিরের জমি। ১৯১০ সালের ১৪ জুলাই অসুস্থ, অশক্ত, মৃত্যুপথযাত্রী সারা লিখিতভাবে আবারও কুড়ি হাজার ডলার দান করে গেলেন সন্তানসম জগদীশচন্দ্রকে।
১৯১১ সালের ১৮ই জানুয়ারি প্রয়াত হলেন সারা। শেষ শয্যায় তাঁর পাশে ছিলেন নিবেদিতা।
ভগ্নহৃদয়ে ভারতে ফিরলেন নিবেদিতা। উইল করে তাঁর জমা টাকা আর বইয়ের রয়্যালটি বেলুড় মঠের ট্রাস্টিদের দিয়ে দিলেন। জাগতিক সব কিছু থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন করে নিলেন নিজেকে।
অক্টোবরে পুজো কাটাতে বসু পরিবারের সঙ্গে দার্জিলিং গেলেন নিবেদিতা। শরীর ভাল নেই। নীলরতন সরকার দার্জিলিং-এ। দেখে যাচ্ছেন তাঁকে। দার্জিলিং-এর আকাশ কুয়াশা-ঢাকা। প্রতিদিন।
১৩ অক্টোবর। আকাশ মেঘমুক্ত। নিবেদিতার ঘর থেকে দেখা যাচ্ছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। কমলা রঙের বস্ত্র পরেছেন তিনি। সূর্যোদয়ের কমলা আলোও কি একবার ছুঁয়ে যাবে তাঁর ঘর? অস্ফুটে বললেন:
“The boat is sinking, still I shall see the sunrise.”
তাঁর শেষ উচ্চারণ।
নিবেদিতা নেই। এ আকস্মিকতার জন্য প্রস্তুতি ছিল না কারও। শান্ত স্বভাবের জগদীশচন্দ্র হৃদয়ে খান খান। দিশাহারা। নিবেদিতার প্রয়াণের কুড়িদিন পরে তাঁর বোন মেরি উইলসনকে জগদীশচন্দ্র লিখলেন:
‘যে বইটি সে আমাকে লিখতে সাহায্য করেছিল, তা আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে আছে।’
লেখা নিয়ে আর এগোনো অসম্ভব তাঁর পক্ষে। সে কথা উল্লেখ করে তিনি আবারও লিখছেন: ‘নিবেদিতা থাকলে কিন্তু এক দণ্ড সময় নষ্ট হতে দিত না। তবে সে তো শরীরিণী নয় — সে মনোময়ী।’
কিন্তু নিবেদিতা না থাকলেও তাঁর রোপিত স্বপ্নের বীজটি বিকাশের পথে বাধা আসেনি কোনও। সারার মৃত্যুকালে প্রতিশ্রুত অর্থ ১৯১৪ আর ১৯১৫ সালে দুটি কিস্তিতে। সারা কন্যা ওলিয়ার বিরোধিতা সত্ত্বেও সে দায়িত্ব সম্পন্ন করেছিলেন সারার ভাই, জোসেফ গিলবার্ট থর্প।
৩০শে নভেম্বর, ১৯১৭। জগদীশচন্দ্রের ৫৯ তম জন্মদিন। আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হল বসু বিজ্ঞান মন্দির। বিজ্ঞানসাধক জগদীশচন্দ্র আর তাঁর আলোক-দিশারী নিবেদিতার স্বপ্ন রূপ পেল বাস্তবে।
সেদিন ভারতীয় বিজ্ঞান গবেষণাকে বিশ্বের দরবারে এক অন্যতর উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা দিলেন নিবেদিতার ‘ম্যান অফ সায়েন্স’। আর পথ প্রদর্শক সেই জ্যোর্তিময়ীকে স্মরণ করে জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞান মন্দিরের দ্বারদেশে প্রাচীরে খোদিত করে রাখলেন দীপ-হাতে অবগুন্ঠিতা নারীমূর্তিটি। নীচে লেখা, ‘লেডি অফ দ্য ল্যাম্প’।
আজও বসু বিজ্ঞান মন্দিরে ঢুকতে গেলেই দৃষ্টি চলে যায় নামহীন সেই মূর্তির দিকে। নামের ক্ষুদ্রতায় তাঁকে বাঁধতে চাননি জগদীশচন্দ্র। কিন্তু অজ্ঞানতার অন্ধকার থেকে বিজ্ঞানের নব দিগন্তের সাধনায় তরুণ গবেষকদের তিনিই দিশারী। আজও আলো দেখিয়ে চলেছেন তিনি অক্লান্ত, ঠিক যেভাবে আলোয় দীপ্তিময় করে তুলেছিলেন পরাধীন ভারতের এক বিজ্ঞানসাধকের দুরূহ যাত্রাপথ।
ঋণ:
দ্য মাস্টার অ্যাজ আই স হিম – সিস্টার নিবেদিতা,
দ্য ওয়েব অফ ইন্ডিয়ান লাইফ — সিস্টার নিবেদিতা,
লোকমাতা নিবেদিতা — শঙ্করীপ্রসাদ বসু,
ভগিনী নিবেদিতা — প্রব্রাজিকা মুক্তিপ্রাণা,
অসামান্য পত্রলেখিকা নিবেদিতা — প্রব্রাজিকা শ্রদ্ধাপ্রাণা
The Dedicated — Lizelle Reymond
An Indian Pioneer of Science: The Life and work of Sir Jagdis C. Bose — Patrick Geddes
অত্যন্ত সুলিখিত প্রবন্ধ। নিবেদিতা-জগদীশচন্দ্রের মেধাবী সখ্যের কথা জানতাম, কিন্তু জগদীশচন্দ্রের বিজ্ঞানসাধনায় তাঁর এই অবদানের কথা অজানা ছিল। জরুরি ছিল এই চর্চা। জগদীশচন্দ্রের কাজ নিয়ে বিবেকানন্দ কী ভাবতেন, জানার কৌতূহল হচ্ছে।
আপনার পাঠ-প্রতিক্রিয়ার জন্য অজস্র ধন্যবাদ।
জগদীশচন্দ্রের কাজ নিয়ে উত্সাহী ছিলেন বিবেকানন্দ। প্রথমদিকে জগদীশচন্দ্রও মুগ্ধ ছিলেন বিবেকানন্দের বাগ্মীতায়। পরবর্তীকালে, জীবনীকারদের কথা অনুযায়ী, এই সমীকরণ কিছু পাল্টে যাবার ইঙ্গিত আছে। পরে কখনও এ বিষয়ে লেখার ইচ্ছে রইল।
লেখাটা খুব ভালো লাগলো।শুধু একটা ছোট correction.ওটা হবে “lady with the lamp”.