যতীন্দ্রমোহন বাগচীর শিশুতোষ কবিতা

ঈশিতা ভাদুড়ী

 


তাঁর নিপুণ চিত্রশিল্পীর দক্ষতা এবং শিশুতোষ-কবিতার ছন্দময় প্রকৃতি শিশুদের ভাবনাকে বৈচিত্র্যময় এবং প্রসারিত করেছে। তাঁর এই কবিতাগুলি শিশুদের জন্য একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। কয়েকটি শব্দ-চিত্র প্রয়োগে এবং ভাষার স্বচ্ছতায় এই শিশুতোষ কবিতাগুলি এমন সজীব করতে যতীন্দ্রমোহন বাগচী সার্থক ছিলেন

 

রবীন্দ্রোত্তর যুগের অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক কবি যতীন্দ্রমোহন বাগচীর মধ্যে একটি শিশুমন ছিল। সেই মন নিয়ে তিনি একাধিক কবিতা লিখে শিশুদের মধ্যে কল্পনার জাল বুনে দিতেন। মানব-জীবনে কবিতার একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, এবং এটি বারংবার প্রমাণিত হয়েছে যে শিশুতোষ ছড়া-কবিতা বাচ্চাদের মনোজাগতিক বিকাশে বিস্তর সহায়তা করে, এতে শিশুদের দক্ষতা বৃদ্ধি হয়। শিশুসাহিত্য যতটা নীতিমূলক হওয়া প্রয়োজন ততটাই কল্পনাপ্রসূত হওয়ার প্রয়োজন। যতীন্দ্রমোহন বাগচী গ্রামের তুলনায় শহরেই বেশিদিন থেকেছেন, তবু তাঁর জন্মস্থান, তাঁর শৈশব কখনওই বিস্মৃত হয়নি তাঁর সত্তা থেকে। যতীন্দ্রমোহনের জন্মসংস্কার এবং শিশুর প্রতি মুগ্ধ ভালবাসা সম্মিলিতভাবে অনেক উল্লেখযোগ্য কবিতার সৃষ্টি করেছে।

ওই যে গাঁটি যাচ্ছে দেখা ‘আইরি’ খেতের আড়ে—
প্রান্তটি যার আঁধার করা সবুজ কেয়াঝাড়ে,
পুবের দিকে আম-কাঁঠালের বাগান দিয়ে ঘেরা,
জট্‌লা করে যাহার তলে রাখাল বালকেরা—
ওইটি আমার গ্রাম, আমার স্বর্গপুরী,
ওইখানেতে হৃদয় আমার গেছে চুরি…

তাঁর ‘জন্মভূমি’ কবিতাতে শিশুদের কোমল মনে জন্মভূমির প্রতি অমোঘ টান তিনি রোপন করতে চেয়েছেন। প্রকৃতির প্রতি আকর্ষণ বিস্তার করতে চেয়েছেন কবি তূলির নিপুণ টানে। তিনি চাইতেন শিশুরা এইভাবেই পূর্ণাঙ্গ মানুষ হয়ে উঠুক।

তাঁর দৌহিত্রীকে নিয়ে ‘দুষ্টু’ নামে কবিতা লিখেছিলেন—

দুষ্টুমি— সে যে এমন মিষ্টি, জানিতাম নাক আগে,
বিস্বাদ মুখে সুস্বাদ তার সুধারই মতন লাগে;
বই কেড়ে নেয়, খাতা ছিঁড়ে দেয়, কালি ফেলে উল্‌টিয়ে,
বিছানার মোর কি যে দশা করে, দেখ যদি চোখ দিয়ে!
লেখার সময় কলমটা নিয়ে মুখে পোড়ে অনায়াসে,
অভাবের দিনে ভাবও পালায় দৈবে যদি বা আসে!…

কবিতাটির মধ্যে দিয়ে শিশুদের প্রতি স্নেহ ঝরে পড়ছে ছত্রে ছত্রে। বই কেড়ে নিচ্ছে, খাতা ছিঁড়ে দিচ্ছে, কালি উল্‌টিয়ে ফেলছে, বিছানার দশা হুলুস্থুলু করছে, লেখার সময় কলমটা নিয়ে মুখে পুড়ে দিচ্ছে, হাঁটতে হাঁটতে দশবার পড়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে দুষ্টুমির এক সুন্দর মিষ্টি চিত্র এঁকেছেন। শিশুদের জন্য তিনি এরকমই আরও অনেক কবিতা রচনা করেছেন।

সিন্ধুতীরে খেলে শিশু বালি নিয়ে খেলা;
রচি গৃহ, হাসিমুখে ফিরে সন্ধ্যাবেলা
জননীর অঙ্ক ’পরে। প্রাতে ফিরে আসি
হেরে— তার গৃহখানি কোথা গেছে ভাসি!
আবার গড়িতে বসে— সেই তার খেলা,
ভাঙা আর গড়া নিয়ে কাটে তার বেলা!
এ যে খেলা— হায়, এর আছে কিছু মানে?
যে-জন খেলায় খেলা— সেই বুঝি জানে!

‘খেলা’ কবিতায় সমুদ্রে-পাড়ে শিশুদের বালি নিয়ে খেলাধুলোর বর্ণনা দিয়েছেন। ভাঙা-গড়া নিয়ে এই চিত্র আমাদের খুবই পরিচিত।

টলমলিয়ে ডিঙা আমার চলে তারি কোলে!
জলের গায়ে সিঁদুর ঢেলে সূর্যি ওঠে পুবে,
দিনের খেয়া সেরে আবার পশ্চিমেতে ডুবে;
বারোমাসে একটি দিনও ছুটি কামাই নাই,
তারি সাথে আমি আমার ঘাটের ডিঙা বাই

শিশু-সারল্যে এবং মমত্বে ‘খেয়াডিঙি’র মতো কবিতা আমাদের হৃদয়ে ব্যাপ্ত হয়েছে, একই সঙ্গে যথাযথ নিসর্গ বর্ণনা, প্রকৃতির বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে মানব-জীবনের আনন্দ-বেদনার উপলব্ধি। সহজ করে সহজ কথা বলে পাঠকের হৃদয় অধিকার করতে জানেন যতীন্দ্রমোহন।

কহিতে জানে না কথা— মুখে ভাঙা ভাষ,
চলিতে পারে না, সদা চলিবার আশ;
হাসি কি জানে না, মুখে হাসি আছে ফুটে,
কান্না অর্থহীন, চুম্বনে কেঁদে উঠে;
ভাবুক নহেকো তবু খেয়ালেতে আছে,
আকাশের চাঁদেরে সে মিতা করিয়াছে;
ভালো মন্দ নাহি বুঝে, যা পায় তা খায়
মায়ে মারে, তবু ফিরে মারই কাছে যায়;
রাত দিন ধুলো মাখে তবুও সুন্দর,
হাসিতে ফুটিয়া উঠে কলিকা কুন্দর;
ধর্মের ধারে না ধার— কৃষ্ণ কিংবা যিশু,
লজ্জাহীন নগ্নকায় অধার্মিক শিশু!
সর্বলোক-শিশু-পিতা বিধাতার বরে,
অকলঙ্ক শিশুবেশে মানবের ঘরে!

এই ‘শিশু-রহস্য’ কবিতায় কী সহজ ভাষায় একটি শিশুর রহস্য চিত্রিত করেছেন! এই কবিতাটিতে কোনও পাণ্ডিত্যপূর্ণ বিশ্লেষণ নেই, তত্ত্ব বা ভাষার আতিশয্যও নেই। অথচ শিশুর পূর্ণ চিত্র অঙ্কনে কেমন পারদর্শিতার ছাপ রেখেছেন কবি।

আরেকটি বিখ্যাত কবিতা, ‘দিদিহারা’। কবিচিত্তের সহৃদয়তা দিয়ে শিশুমনের বেদনাকে প্রকাশ করেছেন তাঁর এই কবিতায়—

বাঁশবাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ওই—
মাগো, আমার শোলোক-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুরধারে নেবুর তলে থোকায় থোকায় জোনাই জ্বলে,
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, একলা জেগে রই;
মাগো, আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?…

ইলাবাসে বসে কবি তাঁর এই বিখ্যাত কবিতা লিখেছিলেন। যখন সন্ধ্যার আঁধার নেমে আসে, আকাশে চাঁদ ওঠে তখন শিশুটি দিদির কাছে শ্লোক শুনত, একসঙ্গে খাবার খেত, গল্প করত, পুতুলের বিয়ে দিত। অর্থাৎ কাজলাদিদি ছিল শিশুটির সারাক্ষণের সাথী। কিন্তু সহসা দিদিকে কাছে না পেয়ে সে মাকে বার বার প্রশ্ন করে, দিদি কই, কবে আসবে? মা এই জটিল প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে রাখেন। যতীন্দ্রমোহনের নিজস্ব ভাষায় এই কবিতায় কাজলাদিদির হারিয়ে যাওয়ার তীব্র বেদনা আমাদের সকলের হৃদয় স্পর্শ করেছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। সহজ ভাষায় লেখা এই কবিতাটি অত্যন্ত হৃদয়গ্রাহী, কাজলাদিদির শোকে কাতর ভাইটি কেমন প্রত্যেক পাঠকের পাঁজরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে! এই কবিতাটি প্রসঙ্গে নবনীতা দেবসেন লিখেছেন—

কবিতাটি পড়তে পড়তে আমার মনে ভীষণ কষ্ট হত। অনেক বছর পরে, যখন আমি বড়, কাজলাদিদির গানের রেকর্ড বেরিয়ে গেছে, গানটি শুনলেই আমার ভেতরে ভেতরে ছোটবেলার মতোই কান্না পেত। তারপরে দেখি, আমার দুই কচি কচি কন্যারও কাজলাদিদির রেকর্ডটি শুনলেই ঠোঁট কেঁপে যায়— টলটলে জল এসে যায় চোখে— ওরাও ওই গানটি শুনতে পারে না, আবেগতাড়িত হয়ে পড়ে। অবিকল আমারই মতন। এই কবিতাটি প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে যে ছোটদের চোখে জল আনছে, জীবনে এরকম একটি মাত্র কবিতা লিখতে পারা এক কবির পক্ষে কম কীর্তি নয়। আমি তো এরকম হলে কবি-জীবন সার্থক মনে করব।

এই কবিতাটি সম্পর্কে দ্বিজেন্দ্রলাল বলেছিলেন—

কাজলাদিদির কবিতাটি সোনার অক্ষরে ছাপানো উচিত ছিল।

এই কবিতার ব্যাকগ্রাউন্ড ইতিহাস বলি। কবিতাটি মূলত তাঁর কন্যা ইলা মারা যাওয়ার পর শোকে কাতর হয়ে কবি লিখেছিলেন। প্রতিভা বসুর কাছে শুনেছি এই কবিতা লিখে নাকি কবি দলা পাকিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন, বাড়িরই কেউ তুলে রেখেছিলেন। পরের কথা তো সবাই জানে এই কবিতা কেমনভাবে মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।

তাঁর নিপুণ চিত্রশিল্পীর দক্ষতা এবং শিশুতোষ-কবিতার ছন্দময় প্রকৃতি শিশুদের ভাবনাকে বৈচিত্র্যময় এবং প্রসারিত করেছে। তাঁর এই কবিতাগুলি শিশুদের জন্য একটি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। কয়েকটি শব্দ-চিত্র প্রয়োগে এবং ভাষার স্বচ্ছতায় এই শিশুতোষ কবিতাগুলি এমন সজীব করতে যতীন্দ্রমোহন বাগচী সার্থক ছিলেন।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4884 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...