সর্বজিৎ সরকার
কিছু কিছু দু অক্ষরের শব্দ আছে যা চরিত্রগত ভাবে বিপজ্জনক। এই শব্দগুলির প্রতিটিই মানুষের মন ও শরীরের মাঝখানের বিভাজন রেখাকে প্রায়শই অস্বীকার করে এবং আক্রান্ত হলেই প্রতিআক্রমণে যায়। কোন শব্দ? প্রেম, কাম আর ক্ষুধা। প্রেমকে যদিও বা কিছুটা বিমূর্ত ভাবতে পারি, কাম বা ক্ষুধার ক্ষেত্রে সে সুযোগ নেই। বাধা পেলে, প্রতিহত হলে, অভুক্ত থাকলে বা উপেক্ষিত হলে সে প্রতিশোধ নেবেই। সেটা আক্রমণকারীর ওপরে হতে পারে অথবা নিজের ওপরেও। আর সেই শোধ, সময়ের ব্যবধানে, যে কোনও স্থায়ী নিয়ন্ত্রিত সুগঠিত ব্যবস্থাকেও ভেঙেচুরে দিতে পারে। কামকে তবু হয়ত নানা কারচুপি করে কিছুদূর অবধি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কিন্তু ক্ষুধা বা মুখের ভাষায় যাকে বলি খিদে, সে এত বেশি জৈবিক, রোজকার, প্রতি মুহূর্তের, প্রতি মানুষের, যে তাকে ঠেকিয়ে রাখা অসম্ভব। ফলত বিপজ্জনক। এবং ভয়ের কারণ।
কার ভয়? না, প্রশ্নটা কার ভয় নয়। ওটা হবে, কাদের ভয়? ভয়টা আমাদের, এই আমরা যারা চাইলেই খেতে পারি। অন্তত খাওয়ার মতো সঙ্গত আয়োজন আর ব্যবস্থা যাদের আছে। খিদে পাওয়ার আগেই আমরা যারা জানি প্রচুর আছে। অনেক আছে। অনেক রকম আছে। খেতে পাব না এটা তো আমদের সমস্যা নয়। আমাদের সমস্যা হল, কোনটা খাব? এটা খাব, না ওটা খাব? বেশি খাব না কম খাব? তাও বেশি কমের তারতম্যটা আসলে খেলে বেশি মোটা হব না হব না, সেই সংশয়ের ভিত্তিতে। খাবার নেই বলে কখনই নয়। তো সেই আমাদের একটা ভয় আছে কেননা আমরা আবছাভাবে জানি যে এই একই সময়ে, একই পৃথিবীতে এমন বহু, বহু মানুষ আছে যারা একবেলা একমুঠো ভাতও পায় না। আবছাভাবে জানাটাই ভাল। তার বেশি জানতে গেলে আমাদের খুব মুশকিলে পড়তে হয়। তাদের নিয়ে নয়। নিজেদের নিয়ে। কী যেন একটা ভেতরে ভেতরে খচখচ করতে থাকে। মধ্যবিত্ত তো, যতই হোক।
আমরা তাই খবর রাখি না। খবর রাখতেও চাই না। যে এই মুহূর্তে সারা বিশ্বে প্রায় কুড়ি লক্ষের বেশি মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। অন্তত চারটে দেশের নাম করা যায় যেখানে যে কোনও সময়ে দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। নাইজিরিয়া, সোমালিয়া, সাউথ সুদান আর ইয়েমেন। গ্লোবাল হাংগার ইন্ডেক্স-এর এই বছরের রিপোর্ট অনুযায়ী একশো পয়েন্ট এর নিরিখে খাদ্যাভাব ও অপুষ্টির মান ২১.৫। সংখ্যা অনেক কিছু বলে তবু প্রায় কিছুই বলে না। বলে না যে এই সব অঙ্কের আড়ালে যে সব মানুষ আছেন তাদের শীর্ণ হাড় বের করা আঙুলগুলো দুমুঠো খাওয়ার সময়ে কতটা উঠছে নামছে। বলে না যে সে হাত মুঠির ভেতর ভাতের ডেলা কিংবা রুটির টুকরোটাকে কতটা শক্ত করে ধরে আছে। বলে না যে সে হাতের গায়ে সারা দিনের খাটাখাটনির, ধুলো ঘাঁটা, কালি মাখা, কালচে রঙ ধরে আছে। হাজারবার সাবান দিলেও হয়ত সে রঙ উঠবে না। কালো রঙ, ছাই রঙ, ধূসর সব বর্ণেরা যেন তাদের নিয়তির মতো বেঁধে রেখেছে। যে কথাটা সেই সব মানুষেরা জানেন না যে এই অনাহার, এই অভুক্ত থাকা, এই একমুঠো ভাত বা একটা রুটি জোগাড় করতে পারা বা না পারার যে নিয়ন্ত্রণ, সেটা তাদের হাতে নেই, অন্য কারও হাতে আছে। আর সেই অদৃশ্য অন্য হাতগুলো এদের ধুলোকাদার ঠিকানাহীন পরিসর থেকে এতটাই দূরে থাকে যে তাদের এরা চেনেও না, জানেও না, দেখতেও পায় না।
বহুদূরের সেই সব নিয়ন্ত্রক হাত, আসলে হাত নয় হাতের সমষ্টি, অনেক বেশি সঙ্ঘবদ্ধ। সংগঠিত। হিসেবী। তথ্য ও তত্ত্বে সমৃদ্ধ। পরিকল্পনা ও প্রয়োগে পারদর্শী। ভাগ করতে জানে। যুক্তি জানে। প্রযুক্তি জানে। নজরদারি জানে। শাসনে লোকলস্কর নিয়োগের ক্ষমতা রাখে। নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে তাদের প্রয়োগ করতেও জানে। দখল জানে। সীমানা ভাগ করতে জানে। ভাগ বাঁটোয়ারা, নিজের দখল, খাদ্যের ভাণ্ডার, শস্যক্ষেত, জমি, কল কারখানা, উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা, বণ্টন ব্যবস্থার সংস্থাপন, দ্রুততম যোগাযোগ ব্যবস্থার পত্তন ও তার প্রয়োগের কারিগরি জানে। বাজার জানে। জানে যে মুদ্রা সর্বশক্তিধর। প্রতীকী ক্ষমতা। তাকে কায়েম রাখতে যুদ্ধ প্রয়োজন, শোষণ প্রয়োজন, জাতিভেদ জাতিবিদ্বেষ, বৈষম্য, প্রজাতির উচ্ছেদ ও ধ্বংস, প্র্রয়োজন। জানে যে শুধু ভাল ভাল কথা, জ্ঞান, দর্শন ও প্রজ্ঞার চর্চায় নিজেদের খাদ্যের ভাঁড়ার উপচে উঠবে না। উ্দ্বৃত্ত তৈরি হবে না। এই সব নিয়ন্ত্রক অদৃশ্য হাতের ওই উদ্বৃত্তের যে বড় প্রয়োজন। তা নাহলে, তাদের আজকের ক্ষুধার নিবৃত্তি হয়ত কোনওভাবে হয়ে যাবে, কিন্তু আগামীকালের খিদে যে মিটবে না! আর যদি তার সংস্থান করাও যায় তবু তারপরেও তো সেই খিদে, খিদের ভয়, তাকে তাড়িয়ে বেড়াবে। আর তা ছাড়া, আরও চাই, আরও বেশি বেশি চাই, অন্য সকলের থেকে অনেক বেশি চাই, এই তাড়না থেকেই বা সে কী করে ছুটকারা পাবে? সুতরাং সে দল পাকায়, উপনিবেশ গড়ে, সঙ্ঘ বানিয়ে শাসন ও শোষণ করে। শিরা বার করা অন্ন মুখে তুলতে থাকা হাতের ছবি তাকে অস্বস্তি দেয়। খবরের কাগজে, ম্যাগাজিনে, ইন্টারনেটে, এমন কোনও ছবি যদি হঠাৎ সামনে চলে আসে, লাস্যময়ী ঝকঝকে চকচকে, উজ্জ্বল রঙিন ছবিদের পাশাপাশি, তাহলে সে তার সুঠাম, পরিষ্কার, নিপুণভাবে নখ কাটা আঙুলের দ্রুততম সঞ্চালনে সেই পাতাটাকে উলটে দিয়ে পরের পাতায় চলে যায়। সারা পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ভোগবাদ তাকে এই শিক্ষাই দিয়েছে। গভীরে যেও না। উপরে উপরে থাকো। ভাসো। ভোগ হল ভয়ের ওঝা। ভয় তাড়ায়। তাতে যদি বেশ কিছু মানুষ না খেতে পেয়ে মরে, জন্তুর থেকে খারাপ অবস্থায় বাঁচে, তাতে বড় জোর একটু আধটু আহা উহু করা যেতে পারে। তার বেশি কিছু ভাবতে যেও না। বিশ্ব জুড়ে বাড়তে থাকা ক্ষুধার মানচিত্রকে আবছা করে দেওয়ার জন্যে, মুছে দেওয়ার জন্যে, আমরা তো আছি। আমাদের সমাজব্যবস্থা আছে, আমাদের বিচারব্যবস্থা আছে, আমাদের সৈন্যদল আছে, শাসনব্যবস্থা আছে, তার আধিকারিকরা আছে, অর্থনীতিবিদরা, ধর্মধ্বজাধারীরা, রাজনীতিকরা, তাদের মস্তানেরা, সকলেই আছে। ভয় কীসে্!
ক্ষুধা এই অর্থে এমন একটি শব্দ যা তার অন্তরালে একটি সুপরিকল্পিত নিয়ন্ত্রক জ্যামিতিকে ধারণ করে আছে। তার কেন্দ্রে যদিও একটি জৈবিক তৃষ্ণা আছে, কিন্তু তাকে ঘিরে আছে আমাদের সভ্যতার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থপরতা। সংক্ষেপে বললে, ‘ক্ষমতা’। যার অধিকার ও প্রয়োগবিধির নিয়ামক আমরা। আমরা যারা সঠিক অর্থে কাকে ক্ষুধা বলে ঠিক ঠিক জানি না।
এবং এই অর্থে, শ্রদ্ধেয় পাঠক, আপনি জানবেন যে, এই যে লেখাটা আমি লিখছি, সেই লেখাটা আসলে একটা জাল লেখা। বানানো লেখা। মিথ্যে লেখা। সে লেখা অভুক্ত থাকার যে মুচড়ে ওঠা যন্ত্রণা, মাথা ঘোরা, বমি পাওয়া, দুর্বল লাগা, মাথা ভার হয়ে আসা, এসব সত্যিকার অর্থে কোনওদিন অনুভব করেনি। কেননা এই লেখকও সেই সুবিধাভোগী শ্রেণির মধ্যেই আছে যারা জানে যে এই মুহূর্তে খেতে না পেলেও আমার খাবারটা ঠিকই রাখা আছে।
পোটাটো ইটার্স, ভিনসেন্ট ভ্যান গঘ
তবু, মধ্যবিত্তদের এক সাঙ্ঘাতিক খারাপ কুটকুট করা স্বভাব আছে। যাকে তারা মাঝে মাঝে বিবেক বলে ডাকে। খুব ছোটবেলায় বাড়িতে একটা ম্যাগাজিন ছিল। লাইফ। এখন বোধহয় বন্ধ হয়ে গেছে। সেটা খুব সম্ভবত ছিল কোনও স্পেশাল ইস্যু। বিষয় ছিল, মানুষের যাপন। প্রতি পাতায় ছবি। সারা পৃথিবীর অসংখ্য মানুষের জীবনযাপনের নানা মুহূর্তের। বাবার ছিল ফোটোগ্রাফির শখ। পত্রিকাটা কিনে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল। আমি প্রায়ই দেখতাম। প্রতিটা ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। অসাধারণ সব ছবি ছিল সে পত্রিকায়। অনেক ছবির কথাই মনে আছে, কিন্তু তার মধ্যে দুটো ছবির কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে খুব। প্রথমটা এক অশীতিপর বৃদ্ধার। মাথার সাদা চুলে উসকোখুসকো জট পাকানো। সারা মুখে অসংখ্য বলিরেখা। কুঁচকে যাওয়া শুকনো চামড়ায় ঢাকা প্রায় হাড় জিরজিরে দুটো হাতে একটা থালা থেকে একমুঠো ভাত তুলছেন। পাতে আর অন্য কিছু নেই। শুধু সাদা ভাত। খুব সামান্য। দু হাতের শিরাগুলো অতটুকু ভারেই স্ফীত হয়ে উঠেছে। বৃদ্ধার দাঁত নেই। কিন্তু তোবড়ানো ভাঙা গালে, হাতে ভাত নিয়ে, কোটরে বসা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে যেভাবে তিনি হাসছিলেন, আমি চোখ ফেরাতে পারিনি। সম্মোহিত হয়েছিলাম। হয়ত তখনও কিশোর বয়সী ছিলাম। বিস্ময়বোধ অপার ছিল তখনও। সে জন্যেই। সুবিধাভোগী শিক্ষিত পূর্ণবয়স্ক হইনি তখনও, তাই। ছবিটা তাই এখনও মাথায় গেঁথে আছে।
অন্য ছবিটা একটা বছর তিনেকের শিশুর। সম্পূর্ণ উলঙ্গ। সর্বাঙ্গে ধুলো ভর্তি। গায়ে ছোপ ছোপ দাগ। উবু হয়ে মাটিতে বসে। সামনে একটা তোবড়ানো এনামেলের থালা। তাতে কিছুটা গলা গলা ভাত। যদিও তাকে ভাত বলে ঠিক চেনা যায় না। বাচ্চাটা কোনওদিকে তাকাচ্ছে না। একমনে পুরো মনোযোগ দিয়ে তার ছোট্ট মুঠোয় যতটুকু ভাত ধরা যায় ততটকুই প্রায় মুঠো শুদ্ধুই মুখে পুরে দিচ্ছে। ছোট হাত, ছোট মুঠো, কতটুকুই বা একসাথে উঠবে। দু একটা ভাতের দানা তাই মুখ টপকে, হাত টপকে, মাটির ওপরে শূন্যে, ফোটোগ্রাফার শাটার টেপার অব্যর্থ মুহূর্তে, স্থির হয়ে রইল ছবির ফ্রেমে। ক্ষুধা বড় মহাকালব্যাপী। মুহূর্তে জন্মায়, ঠিকই, কিন্তু টেনে নিয়ে যায় অনন্ত অবধি। এ ছবিটাও থেকে গেল তাই।
তবু, আমাদের জ্ঞানচর্চা আছে, চর্যা কোথাও নেই। শুভবোধ আছে, তবু তা ক্ষণিকের। মঙ্গলকামনার ধারাবাহিকতাকে আত্মস্থ করতে গেলে যে শক্ত শিরদাঁড়া লাগে তা ক্রমাগত কেমন ঝুঁকে পড়ছে। রিডেম্পশন নেই। শুধু মাঝে মাঝে ভ্যান গগের ছবিটার কথা মনে পড়ে। সেই যে ‘পোটাটো ইটার্স’। কী হবে বাংলায়? ‘আলুখেকোরা’! ন্যুএন-এর কয়লা খনির শ্রমিক পরিবার। ঝুপড়ি ঘরের প্রায় অন্ধকার টেবিল ঘিরে বসে ক্ষয়াটে কালি মাখা আঙুলে করে শুকনো দলা পাকানো আলু সেদ্ধ খাচ্ছে। ক্লান্তি, গ্লানি, নুয়ে পড়া অন্ধকার ভবিষ্যৎ তাদের তোবড়ানো হেরে যাওয়া মুখে, চোখে, হাতের ওপর, খেলা করছে। আর একজন, নিজের একটাও ছবি বিক্রি না করতে পারা শিল্পী, একটু দূরে দাঁড়িয়ে, ওই মানুষগুলোর যন্ত্রণাকে নিজের অস্তিত্বের মধ্যে চালান করে দিতে দিতে তাদের হারিয়ে যেতে থাকা গল্পগুলোকে ছবির ভাষায় লিখে রাখছেন।
এইটুকুই যা চেনাতে পারে আমাদের, নিজেকে, মানুষ বলে।
চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর এবারের রিজার্ভড বগির অন্য লেখাগুলি মস্তিষ্ক দিয়ে হৃদয়ে পৌঁছয়, এই লেখা সরাসরি হৃদয়ে টান দেয়।
মন্তব্যটা যে আমার হৃদয় ছুঁল, এটাও তো বড় কথা।