হিন্দুত্ব-রাজনীতিতে টান বলেই কি নগদ-নির্ভরতা?

শুভাশিস মৈত্র

 


বিজেপি নেতারা মহারাষ্ট্রে এবং ঝাড়খণ্ডে একই ধরনের উগ্র হিংসায় ভরা হিন্দুত্ববাদী ভাষণ দিয়েছেন। হয়তো তা কিছুটা কাজ করেছে মহারাষ্ট্রে কিন্তু ঝাড়খণ্ডে যে করেনি তা বোঝা যাচ্ছে ভোটের ফলে। ২০২২ সালের ১৬ জুলাই উত্তরপ্রদেশে বুন্দেলখণ্ড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন “রেউড়ি” (উপঢৌকন) বিতরণ করে ভোটে জেতার চেষ্টা চলছে, এটাকে যেভাবেই হোক বন্ধ করতে হবে। বিজেপি কিন্তু মাত্র দু-বছরেই মোদির সেই ঘোষণা থেকে বহু দূরে সরে এসেছে। তাহলে কি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ধার কমছে, তাই প্রয়োজন হচ্ছে ভিন্ন পথের?

 

এরকম মনে হতে পারে, মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ড দুই রাজ্যের বিধানসভার ফল দু-রকম হয়েছে। মহারাষ্ট্রে বিজেপির নেতৃত্বে শিবসেনা (শিন্ডে) এবং এনসিপি (অজিত)-এর জোট মহাযুতি আর অন্যদিকে ঝাড়খণ্ডে বিজেপিকে পরাজিত করে কংগ্রেস-জেএমএম জোট ক্ষমতায় এসেছে। যদিও দুই রাজ্যের ভোটের ফলে মিলও রয়েছে। প্রথম মিল এখানেই, দুই রাজ্যেই শাসকদল ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছে।

মহারাষ্ট্রের এই ফল উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা এবং শারদ পাওয়ারের এনসিপিকে অস্তিত্বের সঙ্কটের দিকে ঠেলে দিতে পারে যদি তারা আসন্ন পুরসভাগুলিতেও এমনই খারাপ ফল করে। একই সঙ্গে সম্ভাবনা প্রবল যে ২০২৫-এ, দলত্যাগ বিরোধী আইনের চার দশক পূর্তিতে, এই দলগুলি থেকে, অর্থাৎ উদ্ধব ঠাকরের শিবসেনা এবং শরদ পাওয়ারের এনসিপি থেকে বড় রকমের দলত্যাগের ঘটনা ঘটতে পারে।

লোকসভা ভোটে বিজেপি একটা ধাক্কা খেয়েছিল। হরিয়ানা এবং মহারাষ্ট্রে ক্ষমতা ধরে রেখে বিজেপির মনোবলই শুধু বাড়ল না, আগামী ফেব্রুয়ারিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিহার বিধানসভা ভোটে বিজেপি-জেডিইউ জোট প্রথম থেকেই কিছুটা এগিয়ে থাকবে। ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতেও ভোট। সেখানে আপ-কংগ্রেস জোট না হলে আপ আগের মতোই একতরফাভাবে জিতবে কিনা, এখনই বলা কঠিন।

কংগ্রেস, শিবসেনা (ইউবিটি) এবং এনসিপি (শরদ পাওয়ার)-এর মহাবিকাশ আঘাড়ি (এমভিএ) জোটের থেকে বিজেপির মহাযুতি জোট ১৪ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছে এবারের বিধানসভা ভোটে। এই ধরনের বৃদ্ধি অসম্ভব না হলেও বিরল। মাত্র কয়েক মাস আগে লোকসভায় এমভিএ ভোট পেয়েছিল ৪৩.৭১ শতাংশ, মহাযুতি ভোট পেয়েছিল ৪৩.৫৫ শতাংশ। অর্থাৎ এমভিএ ০.১৬ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছিল মহাযুতির থেকে। ছ-মাসের মধ্যে এই দুই জোটের ফারাক কী করে ১৪ শতাংশ হয়ে গেল? মহাযুতি বিধানসভায় ভোট পেয়েছে ৪৯.০৮ শতাংশ, এমভিএ ৩৫.১৬ শতাংশ। এর খুব স্পষ্ট উত্তর আমাদের কাছে নেই। তবে কয়েকটি সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।

বিজেপি এক ধরনের আগ্রাসী হিন্দুত্বের রাজনীতি করে। গত লোকসভা ভোটে উন্নয়ন এবং হিন্দুত্ব ছিল বিজেপির প্রচারের প্রধান অবলম্বন। তার বিপরীতে কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়া জোট “সংবিধান আক্রান্ত” এবং কাস্ট সেনসাসের দাবিকে সামনে নিয়ে ভোট লড়েছিল। তৃতীয়বার ক্ষমতায় এলেও বিজেপি আগ্রাসী হিন্দুত্ব দিয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়। ইন্ডিয়া জোট সক্ষম হয় এনডিএ-কে একটা রাজনৈতিক আঘাত হানতে। যদিও একটা কথা মাথায় রাখতে হবে লোকসভা ভোটে কংগ্রেস যে ৯৯টি আসন জিতেছে তার ৫৬টি এসেছে শরিকদের সঙ্গে জোট বেঁধে। যেখানে একা লড়াই করেছে, সেখান থেকে মাত্র ৪৩টি আসন জিততে পেরেছে কংগ্রেস।

মহারাষ্ট্রে বিজেপি যেখানে ১৪৯টি আসনে লড়ে ১৩২টি (৮৪ শতাংশ) আসন জিতেছে কংগ্রেস সেখানে ১০২টি আসনে লড়ে জয়ী হয়েছে মাত্র ১৬টি আসনে। কংগ্রেসকে অন্য পথ নিয়ে ভাবতে হবে। কেবল সংবিধান এবং কাস্ট সেনসাসের দাবি নিয়ে খুব বেশি দূর এগোনো যাচ্ছে না।

প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষা এবং একজিট পোল-এও মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডের ফল নিয়ে যে-সব আভাস দেওয়া হয়েছিল, তার প্রায় কোনওটাই মেলেনি। হরিয়ানার বিধানসভা নির্বাচনের সময়ও এই ধরনের ঘটনা ঘটতে দেখা গিয়েছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল লোকসভা ভোটের ক্ষেত্রেও। কেন নির্বাচনী সমীক্ষা বারবার ভুল হচ্ছে সেটা অবশ্যই একটা ভেবে দেখার মতো ব্যাপার। তবে এর একটা কারণ হতে পারে মানুষ নিজেদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা থেকে মিডিয়াকে আগের চেয়ে অনেক কম বিশ্বাস করে। ফলে মিডিয়ায় প্রকাশিত হবে এমন সমীক্ষায় তারা মনের কথা খুলে বলছে না। এছাড়া প্রাক-নির্বাচনী সমীক্ষাকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করা হচ্ছে এমন অভিযোগ রয়েছে, এই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ড, দুটি রাজ্যেই শাসকদল ক্ষমতায় থেকে গেল তার একটা কারণ বলা হচ্ছে সরাসরি আর্থিক সহায়তার বিনিময়ে মহিলাদের ঢালাও সমর্থন আদায় করে ক্ষমতা ধরে রেখেছে দুই রাজ্যের দুই শাসকদল।

ভোটের মুখে ভোটারদের হাতে সরাসরি বিনামূল্যে কিছু ধরিয়ে দেওয়াটা শুরু করেছিলেন ১৯৮৩-৮৪ সালে এনটি রামারাও। তিনি দু-টাকা কিলো চাল দেওয়ার কথা বলে টানা দশ বছরের কংগ্রেস শাসনের পতন ঘটিয়েছিলেন অন্ধ্রপ্রদেশে। সবাইকে চমকে দিয়ে সিনেমার নায়ক এনটিআর রাজনীতিতে যোগ দিয়েই দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন জিতে ক্ষমতায় এসেছিলেন। তার পর রঙিন টেলিভিশন, মিক্সি-গ্রাইন্ডার হয়ে এখন সরসরি টাকা দেওয়া হচ্ছে। আর এইসব টাকা-প্রকল্প প্রায় সব সময়ই ঘোষণা হয় ভোটের আগে। অনেক সময়েই আগাম বাজেটে ঘোষণা করা হয় না। মহিলাদের হাতে সরাসরি টাকা দেওয়ার পথ দেখিয়েছেন প্রথম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২১-এর বিধানসভা ভোটের আগে শুরু করে ২০২৪-এর ভোটের আগে সেই টাকার পরিমাণ নতুন করে বাড়ানো হয়েছে। তারপর একে একে ওড়িশা, তেলেঙ্গানা, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র-সহ বেশ কয়েকটি নির্বাচনে মহিলাদের জন্য সরাসরি টাকা দেওয়ার প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। এই ধরনের ঘোষণায় এখনও পর্যন্ত বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পেয়েছে শাসকদল। বিরোধীদলগুলির একই ধরনের ঘোষণায় কেন কম কাজ হচ্ছে? এর একটা জবাব, বনের পাখির তুলনায় হাতের পাখিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার প্রবণতা মানুষের বরাবরের।

মহিলা ভোটারদের ভোটদানের হারে যে-ধরনের বৃদ্ধি দেখা গিয়েছে মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খণ্ডে, তা থেকে অনেকেই এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে মহিলারাই এক্স-ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে এই দুই রাজ্যের ভোটে। তথ্যগুলো এখন অনেকেরই জানা তবু লেখার স্বার্থে আরেকবার বলতেই হচ্ছে। মহারাষ্ট্রে পাঁচ বছর আগে ২০১৯-এর বিধানসভা ভোটে মহিলাদের ভোটদানের হার ছিল ৫৯.২ শতাংশ এবং পুরুষদের ৬২.৭৭ শতাংশ, ফারাক ছিল ৩.৫৭ শতাংশ। এবারের ভোটে ৬৫.২১ শতাংশ মহিলা ভোটার ভোট দিয়েছেন আর পুরুষদের ক্ষেত্রে ভোটদানের হার ৬৬.৮৪ শতাংশ, অর্থাৎ ফারাক কমে হয়েছে মাত্র ১.৬৩ শতাংশ।

ঝাড়খণ্ডে এবারের ভোটে মহিলাদের ভোটদানের হার ৭০.৪৬ শতাংশ, আর পুরুষ ভোটারদের ভোটদানের হার ৬৫.০৬ শতাংশ। মহিলারা পুরুষদের থেকে অনেক বেশি সংখ্যায় ভোট দিয়েছে। এটা দ্বিতীয় মিল দুই রাজ্যের ভোটে। কেন হঠাৎ মহিলারা বেশি সংখ্যায় ভোট দিচ্ছে? প্রায় সর্বসম্মত মত হল, মহিলাদের জন্য যে ডাইরেক্ট ক্যাশ ট্র্যান্সফার স্কিম ঘোষণা করা হয়েছে মহারাষ্ট্রে এবং ঝাড়খণ্ডে, তারই ফল এটা। অনেকে এটাকে ঘুষ দিয়ে ভোট কেনার সঙ্গেও তুলনা করছেন। তবে ভিন্ন মতও রয়েছে।

টাকা বা অন্য কোনও কিছুর বিনিময়ে ভোট কেনার বিষয়টি কিন্তু ভারতে নতুন নয়। এবারের লোকসভা ভোটের সময় গত ১৮ মে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে নির্বাচন কমিশন জানিয়েছিল তারা টাকা, মদ, মাদক, সোনা মিলে প্রায় ৯০০০ কোটি টাকা বাজেয়াপ্ত করেছে। এটা হল ধরা পড়ে যাওয়া টাকা। ধরেই নেওয়া যায় এর বেশ কয়েকগুণ বেশি টাকা ধরা পড়েনি। এই ঘুষ কিন্তু প্রায় পুরোটাই যায় পুরুষদের হাতে। আরেকটি মত হল, মহিলাদের এক বিরাট অংশ বাড়িতে, মাঠে, পরিবারের ছোট উৎপাদনকেন্দ্রে বিনা মজুরিতে কাজ (আনপেইড জব) করে। ফলে সরকার যদি তাদের হাতে কোনও অর্থ দেয় সেটা যথেষ্টও নয়, অনৈতিকও নয়। যদিও এই নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। কিন্তু যদি এটাই ঠিক হয়, তাহলে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন মহারাষ্ট্র নির্বাচন তুলে দিল।

বিজেপি নেতারা মহারাষ্ট্রে এবং ঝাড়খণ্ডে একই ধরনের উগ্র হিংসায় ভরা হিন্দুত্ববাদী ভাষণ দিয়েছেন। হয়তো তা কিছুটা কাজ করেছে মহারাষ্ট্রে কিন্তু ঝাড়খণ্ডে যে করেনি তা বোঝা যাচ্ছে ভোটের ফলে। ২০২২ সালের ১৬ জুলাই উত্তরপ্রদেশে বুন্দেলখণ্ড এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন “রেউড়ি” (উপঢৌকন) বিতরণ করে ভোটে জেতার চেষ্টা চলছে, এটাকে যেভাবেই হোক বন্ধ করতে হবে। বিজেপি কিন্তু মাত্র দু-বছরেই মোদির সেই ঘোষণা থেকে বহু দূরে সরে এসেছে। তাহলে কি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির ধার কমছে, তাই প্রয়োজন হচ্ছে ভিন্ন পথের? এর উত্তরের জন্য আমাদের আরও কয়েকটি ভোট দেখতে হবে।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...