কোনটা পাখির চোখ? বাংলাদেশের হিন্দুর নিরাপত্তা, নাকি পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুর ভোট?

প্রতীক

 

 


বিপন্ন হিন্দুদের এ-দেশে জায়গা দেওয়ার কথা উঠলেই বিজেপির নেতা-মন্ত্রী এবং তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গরা বলতে শুরু করেন— ভারতবর্ষ ধর্মশালা নয়। বাংলাদেশি হিন্দুদের প্রতি সত্যিই টান থাকলে এই উপমহাদেশের মুসলমান বাদে অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য যে আইন তাদের সরকার তৈরি করেছে, তাতে নির্দিষ্ট এ-দেশে আসার শেষ তারিখটা তুলে দিলেই তো হত। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-র পরে বিপদে পড়া হিন্দুরা কি যথেষ্ট হিন্দু নন? আজ বাংলাদেশে যে হিন্দুরা বিপন্ন, তাঁদের জন্য তাহলে বিজেপির ভারতে কোনও জায়গা নেই? তাঁরা কেবল এ-দেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা উৎপাদন করার খেলায় ব্যবহৃত বোড়ে?

 

একটা দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।

এই কথাটা বলামাত্র সেই ২০১২-১৩ সাল থেকে যেসব আত্মীয়-বন্ধু-সহপাঠী-সহকর্মী রেগে-আগুন তেলেবেগুন হয়েছেন, সম্পর্ক তুলে দিয়েছেন (বা আমিই তুলে দিয়ে বেঁচেছি), হঠাৎ সেদিন আবিষ্কার করলাম তাঁরা সকলে ঠিক ওই কথাটাই বলছেন। দেখে অ্যাইসা ফুর্তি হল যে লতা মঙ্গেশকরের মতো মিহি গলায় শতবর্ষে পা দেওয়া সলিল চৌধুরী রচিত ও সুরারোপিত ‘হঠাৎ ভীষণ ভাল লাগছে’ গানটা গাইতে শুরু করলাম। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে নিজের কানই জানিয়ে দিল যে আমার গলার সঙ্গে লতার গলার তফাত বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে মহাত্মা গান্ধির মতো। ফলে চুপ করে গেলাম। ফুর্তিটাকেও কান ধরে টেনে নামিয়ে আনন্দের বেঞ্চে বসিয়ে দিলাম। একটু আনন্দ তো করাই উচিত। কারণ কবি বলেছেন— কেবল রাত্রির অবসান হলে প্রভাত হয় না। চিত্ত জাগলেও প্রভাত হয়। তা চারপাশে এত মানুষের চিত্ত জেগেছে মানে প্রভাত হয়েছে, অচিরেই প্রভাতফেরি বেরোবে, তার আওয়াজের ঠ্যালাতেই বাকি অন্ধকার দূরীভূত হবে— এরকম ভাবছিলাম আর কি। কিন্তু সে আনন্দও দিন দুয়েকের বেশি টেকানো গেল না। কেন? সে-কথাই বলব।

গোঁফ গজানোর বয়সে আমরা মাধুরী দীক্ষিত বলতে পাগল ছিলাম। যেহেতু বলিউডের হাত অনেক লম্বা, সেহেতু কেবল ভারতে নয়, গোটা উপমহাদেশেই তখন মাধুরী অধরা বলে নানা বয়সের পুরুষদের হৃদয় দাউদাউ করে জ্বলে। এতটাই, যে কাগজে পড়েছিলাম, পাকিস্তানিরা নাকি সকৌতুকে বলত ‘তোমরা মাধুরী আর শচীন তেন্ডুলকরকে দিয়ে দাও, আমরা কাশ্মিরের দাবি ছেড়ে দেব।’ তা সেই মাধুরী নেপালে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে একখানা কেলেঙ্কারি করে বসেছিলেন। আদর-আপ্যায়নে আহ্লাদিত হয়ে বলে বসেছিলেন— নেপাল তো ভারতেই ছিল… ইত্যাদি। সে অবশ্য ১৯৯৮-৯৯ সালের কথা। তখন ভারত সরকারের সঙ্গে নেপাল সরকারের সম্পর্ক মন্দ ছিল না, ফলে নায়িকা ক্ষমা-টমা চাওয়াতেই ব্যাপারটা মিটে গিয়েছিল। মুশকিল হল, বাংলাদেশের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালিরা অনেকে এখনও মাধুরী হয়ে আছেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ তথা বাংলা ভাগ হয়েছে। পরে ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ হয়ে গেছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের অনেকেই এখনও ওটাকে আলাদা দেশ বলে মেনে নিতে পারেন না। আরও সমস্যার কথা হল, যেহেতু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পাশে দাঁড়িয়ে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল, তাই আমাদের অনেকেরই ধারণা— বাংলাদেশের যে-কোনও ব্যাপারে ভারতের ছড়ি ঘোরানোর অধিকার আছে। দুটো দেশের সরকার এবং মানুষের মধ্যে আন্তর্জাতিক রীতিনীতি অনুসারে যেমন সম্পর্ক কাঙ্ক্ষিত, তার বদলে বাংলাদেশের সঙ্গে বড়দাসুলভ ব্যবহার করা উচিত— এমনটাই মনে করেন আমাদের ভাই-বেরাদররা অনেকে। ফলে যে যে-দলেরই সমর্থক হোন, বাংলাদেশে কোনও গোলমাল শুরু হলেই একযোগে আশ্চর্য সব দাবি করতে শুরু করেন এঁরা। যেমন এই মুহূর্তে কলকাতা কর্পোরেশনের বিজেপি কাউন্সিলর সজল ঘোষের মতো অনেক সিপিএম সমর্থককেও ভারতীয় সেনাবাহিনিকে দিয়ে বাংলাদেশ আক্রমণের দাবি তুলতে দেখা যাচ্ছে।

এমনিতে সজলবাবুকে যত গুরুত্ব পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম দেয় তত গুরুত্ব তাঁর নিজের দলের নেতা অমিত শাহও দেন না। দিলে সজলবাবুর আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও কলকাতায় এসে আরজিকর-কাণ্ডে মৃতার বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখা না করেই চলে যেতেন না। সুতরাং সজলবাবুর ওই চ্যানেল গরম করা মন্তব্যে যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ, বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং বা প্রধানমন্ত্রী মোদি কানই দেবেন না তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু দলমতনির্বিশেষে বাঙালিরা যে এই দাবিকে ন্যায্য বলে মনে করছেন— তা যথেষ্ট উদ্বেগজনক। একে তো অন্য একটা দেশ সম্পর্কে এত প্রবল অধিকারবোধ মনের মধ্যে পুষে রেখেছে কয়েক লক্ষ লোক— এই ব্যাপারটাই ভয়ঙ্কর। তার উপর দেখা যাচ্ছে বাম দলগুলোর সমর্থকরাও দাবি করছেন— এখানকার বামপন্থীদের বাংলাদেশের হিন্দুদের জন্যে পথে নামতে হবে, তৃণমূল সমর্থকরা দাবি করছেন তাঁদের দলকেও পথে নামতে হবে। অবশ্য বামেরা যেহেতু ক্ষমতায় নেই, সেহেতু তাঁরা যেমন প্যালেস্তাইনের মানুষের উপর ইজরায়েলি গণহত্যার বিরুদ্ধে মিছিল করেন তেমন বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর আক্রমণের বিরুদ্ধেও মিছিল করা যেতে পারে (যদিও এখন পর্যন্ত প্যালেস্তাইনে ইজরায়েল যা চালাচ্ছে তার সঙ্গে বাংলাদেশের পরিস্থিতির পরিমাণগত বা গুণগত কোনও মিল নেই), তবে দুই মিছিলেরই গুরুত্ব প্রতীকী। কিন্তু বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলকে পথে নামতে হবে— এ আবার কী আবদার? যে-কোনও দলের সরকারকেই ভারতের সংবিধান মেনে চলতে হয় আর সংবিধান অনুসারে বিদেশনীতি কেন্দ্রীয় সরকারের কাজের তালিকাভুক্ত। নেহাত বাংলাদেশ প্রায় এক শতাব্দী আগে একই প্রদেশ ছিল এবং দুই জায়গার ভাষা অভিন্ন, দুইপারে রক্তের সম্পর্কে জড়িয়ে থাকা বহু পরিবার রয়েছে, তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকার সম্পূর্ণ উদাসীন থাকতে পারে না। সেই কারণে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি একখানা বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু তিনি পথে নামতে যাবেন কেন? সত্যিই তো এ-ব্যাপারে কেন্দ্রীয় সরকার যা সিদ্ধান্ত নেবে তা মেনে নিতে তিনি বাধ্য। অথচ এই দাবি কেবল আইনকানুনের ধারণাবিহীন সাধারণ মানুষ সোশাল মিডিয়ায় তুলছেন তা নয়। এবিপি আনন্দের মতো জনপ্রিয় চ্যানেলে বসে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক বিশ্বনাথ চক্রবর্তীও এই কিম্ভূত দাবি তুলে ফেলেছেন।

নিজের এক্তিয়ারের বাইরে গিয়ে কেন এমন কাজ করতে হবে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে? রাজনৈতিক বিশ্লেষক বিশ্বনাথবাবুর দর্শানো কারণটি চিত্তাকর্ষক। এতে নাকি মহম্মদ ইউনুসের সরকারের উপরে চাপ তৈরি হবে এবং বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষজন বুকে বল পাবেন। বাংলাদেশ যত ছোট রাষ্ট্রই হোক, পশ্চিমবঙ্গের মতো একটা অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজের রাজ্যে বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে মিছিল করেছেন বলে চাপে পড়বে কেন? বিশেষত ভারত সমেত পৃথিবীর কোনও বড় রাষ্ট্রই যখন এই তদারকি সরকারকে স্বীকৃতি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়নি? আর বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষজনই বা মমতার মিছিলে আলাদা করে সাহস কেন পাবেন? ইসলামিক মৌলবাদীরা তাঁদের আক্রমণ করলে কি মমতার পুলিশ বা অনুব্রত মণ্ডলের ঢাক তাঁদের বাঁচাতে যাবে? নাকি কেন্দ্রীয় সরকারকে না জানিয়ে, মমতা নিজের সিদ্ধান্তে তাঁদের কাউকে পশ্চিমবঙ্গে আশ্রয় দিতে পারবেন?

কিমাশ্চর্যম অতঃপরম! মমতা এই হাস্যকর দাবি মেনে নিয়ে পথে নামলেন না বটে, আরও এককাঠি সরেস কাজ করলেন। দাবি করে বসলেন যে সম্মিলিত জাতিপুঞ্জকে বাংলাদেশে শান্তিরক্ষা বাহিনি পাঠাতে হবে। তাঁর সঙ্গে প্রায় হুবহু মিলে গেল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা এবং মমতার একদা-স্নেহভাজন শুভেন্দু অধিকারীর বয়ান ‘রাষ্ট্রপুঞ্জের কাছে আবেদন করছি, বাংলাদেশে হিন্দুদের অস্তিত্ব বাঁচানোর জন্য হস্তক্ষেপ করুক’।

বাংলাদেশে গত কয়েকদিনের নতুন অশান্তিতে ঠিক কত মানুষ নিহত, কটা পরিবার বাস্তুহারা, কোনও নারীনির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে কিনা— এসবের কোনও সুনির্দিষ্ট তথ্য কিন্তু ভারতের সংবাদমাধ্যম আমাদের জানাতে পারেনি। সজলবাবু, বিশ্বনাথবাবু, শুভেন্দুবাবু বা আমাদের মুখ্যমন্ত্রীও জানাননি। অথচ ক্রমাগত এরকম আক্রমণাত্মক মন্তব্য বেড়েই চলেছে। এসবের একটাই ফল— বাংলাদেশ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে উত্তেজনা বৃদ্ধি এবং তার ফলে সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা তৈরি হওয়া। যেহেতু বাংলাদেশে শেখ হাসিনার অপসারণের পর থেকেই হিন্দুরা আক্রান্ত হচ্ছেন বলে খবরে প্রকাশ, তাই পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বাঙালি এখন বাংলাদেশ বলতেই মুসলমান ভাবছেন। জুলাই অভ্যুত্থানের সময় থেকেই দেখা যাচ্ছিল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মতোই এবারেও যে লড়াইয়ে লিপ্ত শক্তিগুলো সমসত্ত্ব নয় তা মেনে নিতে পশ্চিমবঙ্গের ভদ্রলোকদের ঘোর আপত্তি। ছাত্রনেতাদের মধ্যে হিন্দু নামগুলোর উপস্থিতিকে তাঁরা অগ্রাহ্য করে যাচ্ছেন, তাতে ধুয়ো দিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতের মূলধারার সংবাদমাধ্যম। যখন বাংলাদেশের রাস্তায় সোজা বুকে গুলি চালিয়ে মানুষ মারছিল হাসিনার পুলিশ, তখনও হাসিনা না থাকলে বাংলাদেশের কী হবে তার আলোচনায় পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম ব্যবহার করে যাচ্ছিল— ‘বাংলাদেশ আফগানিস্তান হওয়ার দিকে এগোচ্ছে’, ‘বাংলাদেশে তালিবানি শাসন প্রতিষ্ঠা হতে চলেছে’ ইত্যাদি শব্দবন্ধ।

পৃথিবীর ইতিহাসে বিদ্রোহ, তারপর নৈরাজ্য এবং অত্যাচারী শাসনের অজস্র উদাহরণ আছে। যেমন বলা যেতেই পারত বাংলাদেশ রোবসপিয়রের গিলোটিনের ফ্রান্স হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। তুলনায় সাম্প্রতিক উদাহরণ দিতে চাইলে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পরে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর কথা বলা যেত। আরও সাম্প্রতিক উদাহরণ দেওয়ার ইচ্ছে থাকলে গৃহযুদ্ধোত্তর সিরিয়া হওয়ার দিকে এগোচ্ছে বললেও চলত। তেমন কিছু না বলে আফগানিস্তান এবং তালিবানের কথা বলার উদ্দেশ্য পরিষ্কার— মাথায় ফেজ পরা, গালে লম্বা দাড়িওয়ালা মুসলমানের ছবি তুলে ধরে আতঙ্ক ছড়ানো, যার সঙ্গে অপরিহার্যভাবে এসে পড়বে বোরখা পরা মহিলাদের ছবি। হিন্দুত্ববাদীরা মুসলমানের ঠিক যে স্টিরিওটাইপ হিন্দুদের গেলাতে চায়। অথচ তদারকি সরকারের প্রধান মহম্মদ ইউনুস কিন্তু কামানো গালের, মাথায় ফেজ না-পরা পুরুষ। তাঁর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের একজন হলেন সাঈদা রিজওয়ানা হাসান, যিনি ২৯ নভেম্বর সাংবাদিক সম্মেলনে জানিয়েছেন যে গ্রেফতার হওয়া সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত হবে, কিন্তু তার জন্যে ইস্কনকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করার কোনও ভাবনা তদারকি সরকারের নেই। রিজওয়ানা বোরখা পরেন না, এমনকি হিজাবও নয়।

 

নিয়মিত নির্বাচন হচ্ছে মানেই যে একটা দেশ গণতান্ত্রিক পথে আছে তা নয়— এ-কথা বুঝতে আজকের ভারতীয়দের অন্তত কোনও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। দেশদ্রোহবিরোধী আইনের দোহাই দিয়ে উমর খালিদ, শার্জিল ইমাম-সহ আরও বহু মানুষকে বিনা বিচারে বন্দি করে রাখার কাজ এ-দেশের ভোটে জিতে আসা সরকারই করে চলেছে দশ বছর ধরে। রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজও করছে বিভিন্ন রাজ্যের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত সরকারগুলোই। কোনও আইনকানুনের তোয়াক্কা না করে, এমনকি সুপ্রিম কোর্টের নিষেধকেও বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জঘন্য পলাতক অপরাধীদের মতো করে প্রতিবাদীদের ছবি দেওয়ালে দেওয়ালে সেঁটে দেওয়ার কাজ করছে ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসা উত্তরপ্রদেশের আদিত্যনাথ সরকার। গত দশ বছরে কতজন সংখ্যালঘুকে গোমাংস খাওয়ার, বিক্রি করার বা স্রেফ বহন করার ‘অপরাধে’ মেরে ফেলা হয়েছে এবং রাষ্ট্র হত্যাকারীদের শাস্তি দেওয়ার বদলে মদত দিয়েছে, তার তালিকা চিনের প্রাচীরের মতো লম্বা হবে। কদিন হল মুসলমানদের উত্যক্ত করার নতুন কায়দা চালু হয়েছে। যে-কোনও মসজিদের নিচেই মন্দির ছিল কিনা মাটি খুঁড়ে দেখার দাবিতে আদালতে মামলা ঠুকে দিচ্ছে হিন্দুত্ববাদীরা, আর আদালত পত্রপাঠ খোঁড়ার নির্দেশও দিয়ে দিচ্ছে। অথচ দেশে স্পষ্ট আইন আছে— ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশের যেখানে যে ধর্মস্থান ছিল সেগুলোর চরিত্র পরিবর্তন করা যাবে না। সে আইনের তোয়াক্কা করছে না এমনকি নিম্ন আদালতগুলোও। এই বেমক্কা রায়ের জেরে হিংসা ছড়িয়ে উত্তরপ্রদেশের সম্ভলে ইতিমধ্যেই কিছু মানুষের প্রাণ গেছে। এখন এমনকি প্রাচীন আজমের শরীফ নিয়েও তেমন একটা মামলা ঠোকা হয়েছে। এমন রায় দেওয়ার পথ কিন্তু খুলে দিয়ে গেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, জ্ঞানবাপী মসজিদে মাটি খুঁড়ে সার্ভে করার অনুমতি দিয়ে। কিন্তু এতে কি প্রমাণ হয় যে ভারতের অধিকাংশ মানুষ, এমনকি অধিকাংশ হিন্দু ভারতীয়, সাম্প্রদায়িক? একেবারেই না।

হাসিনার আমলেও বাংলাদেশে হিন্দু হত্যা ঘটেছে। আর সব ভুলে গিয়ে থাকলেও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের খুনের কথা আশা করি এপারের হিন্দু বা মুসলমান কোনও বাঙালিই ভোলেননি। সেইসময় হিন্দুদের পুজোআচ্চায় আক্রমণ হয়েছে, সম্পত্তি দখল করে নেওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। সুতরাং ভোট হত আর হাসিনা জিততেন মানেই বাংলাদেশ দারুণ গণতান্ত্রিক ছিল— এ-কথা বলার কোনও মানে নেই। আবার সেই আমলে বা এই আমলে বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর আক্রমণও প্রমাণ করে না যে অধিকাংশ বাংলাদেশি, এমনকি অধিকাংশ মুসলমান বাংলাদেশি, সাম্প্রদায়িক।

কিন্তু সোশাল মিডিয়া আর ভারতের মিডিয়ার কল্যাণে ঠিক উল্টো ছবিটাই গাঢ় রঙে আঁকা হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের বাঙালির মনে। তাই ‘একটা দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব’— এই কথাটা তাঁরা আজ যখন বলছেন, তখন বলছেন বাংলাদেশের দিকে মুখ করে। নিজের দেশের দিকে না-তাকিয়ে। তাই আমার আনন্দ টিকল না। দেখলাম বিজেপি সমর্থকরা তো বটেই, সিপিএম সমর্থকরাও গোটা উপমহাদেশে সংখ্যাগুরুবাদের প্রসারের নিন্দা করে পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের বিবৃতিতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছেন। বলছেন, এসব চালাকি। বাংলাদেশের ঘটনার নিন্দা করতে গেলেই সঙ্গে এ-দেশের সংখ্যালঘুদের উপর যে আক্রমণ হচ্ছে তার কথা কেন বলতে হবে? গোদা বাংলায় তাঁদের মত হল— বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সে-দেশের সরকারের দায়িত্ব, কিন্তু এ-দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এ-দেশের সরকারের দায়িত্ব নয়।

এই তো সেদিন এ-রাজ্যের মহিলারা রাত দখল করলেন, ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডের দাবিতে রাস্তায় নামলেন মহিলা মুখ্যমন্ত্রীও, পরে নতুন আইনও পাশ করালেন বিধানসভায়। আন্দোলনকারীদের অনেকেরই বক্তব্য ছিল আরজিকর-কাণ্ডে দোষী একজন নয়, অনেকে। তাদের সকলের শাস্তি চাই। তা নিয়েও টানা আন্দোলন হল। অথচ আজ চিন্ময়কৃষ্ণের বিরুদ্ধে যে শিশুদের যৌন নিপীড়নের অভিযোগ আছে, সে-অভিযোগে তাঁর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তাঁর নিজেরই সংগঠন— তা নিয়ে আলোচনা করতে দেখছি না এমনকি মহিলাদেরও। উনি অবশ্য সেই অভিযোগে গ্রেফতার হননি। কী অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন? তা নিয়েও পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ায় বা সোশাল মিডিয়ায় বিশেষ আলোচনা নেই। অর্থাৎ হয় এখানকার মানুষ জানার প্রয়োজন বোধ করেন না, নয়তো নিঃসংশয়ে জানেন ব্যাপারটা স্রেফ রাষ্ট্রের বদমাইশি। সেটা হওয়া অবশ্যই অসম্ভব নয়। কিন্তু একইরকম অভিযোগে উমর, শার্জিলের জামিনের তো শুনানিই হয় না এ-দেশে। তা নিয়ে কারও এত মাথাব্যথা নেই তো?

সব মিলিয়ে যা বুঝলাম, ‘হঠাৎ ভীষণ ভাল লাগছে’ গানটা আমার নয়, শুভেন্দুবাবুর গাওয়া উচিত। কারণ রাজ্য বিজেপি যতই অন্তর্দ্বন্দ্বে নাজেহাল হোক, যতই লোকসভা নির্বাচনে বা উপনির্বাচনে ভোট কমুক, দেশজুড়ে মোদি-ম্যাজিক যতই ফিকে হয়ে যাক, ঘৃণার জমি এমন চমৎকার চষা হয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গে যে, সঙ্ঘ পরিবারের ফসল তোলা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। সে-ফসল ২০২৬ সালে তোলা হবে, নাকি আরও পরে— সে আলাদা কথা। নিজের মালিকানাধীন হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা বন্ধ করার ঘোষণা করে সজলবাবু আপ্রাণ চেষ্টা করছেন ২০২৬ সালেই ফসল তুলতে। অনেক ডাক্তারও সগর্বে সোশাল মিডিয়ায় ঘোষণা করছেন বাংলাদেশি রোগী দেখবেন না। বহু ঘোষিত বিজেপিবিরোধীও এই সিদ্ধান্তকে বাহবা দিচ্ছেন। কেন? না দেখা গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতের পতাকার অবমাননা করা হয়েছে। ক-জন ওই কাজে লিপ্ত আর তাদের অপকর্মের দায় সমস্ত বাংলাদেশির ঘাড়ে চাপবে কেন— এই যুক্তিতর্কের পরিবেশই আর পশ্চিমবঙ্গে নেই। এ-তথ্যও প্রচারিত হচ্ছে না যে ২৮ নভেম্বরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট হলের প্রভোস্ট ‘অতীব জরুরি বিজ্ঞপ্তি’ জারি করে শিক্ষার্থীদের ওই কাজ করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।

 

যে রাজনৈতিক বিশ্লেষক বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ মানুষকে সাহস দেওয়ার জন্যে মমতাকে মাঠে নামতে হবে বলেছেন, তিনি এই রাজ্যে এমন অমানবিক এবং ডাক্তারি নীতিবোধবিরোধী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে মমতাকে মুখ খুলতে হবে বলে দাবি করেছেন বলে শুনিনি। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হিসাবে মমতা নিজে থেকেও বলতে পারতেন— এ-জিনিস এখানে করতে দেওয়া হবে না, করলে ওই হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বলেছেন কি? তাঁর দলের নেতা ফিরহাদ হাকিম তবু বলেছেন যে এই সিদ্ধান্ত সমর্থনযোগ্য নয়। কিন্তু ফিরহাদ নিজে মুসলমান হওয়ায় যথারীতি তাঁর বক্তব্যকে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরুর প্রতি দরদ বলে দেখা হচ্ছে। সোশাল মিডিয়ায় গালিগালাজ করা হচ্ছে।

 

এসব থেকে একটা জিনিস পরিষ্কার। আমাদের রাজ্যে হিন্দুত্ববাদকে আটকাতে তৃণমূল কংগ্রেসের যাবতীয় কুকর্ম সত্ত্বেও তাদের ভোট দেওয়াই যে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কর্তব্য— এ-কথা যে-যুক্তিতে ২০১৯ সাল থেকে বলা হয়ে আসছে, সেই যুক্তিটাকে আর বিশ্বাস করার মানে হয় না। বিজেপি এ-রাজ্যে ক্ষমতায় আসেনি ঠিকই, কিন্তু তাতে সমাজে সঙ্ঘবাদের প্রসারে কোনও বাধা সৃষ্টি হয়নি। সঙ্ঘ একই মডেলে সর্বত্র লড়ে না। পশ্চিমবঙ্গে সম্ভবত ওড়িশা মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে।

ওড়িশায় কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে তৈরি হওয়া বিজু জনতা দলের নেতা নবীন পট্টনায়ক কংগ্রেসকে শেষ করে বিজেপিকেই তাঁর একমাত্র বিকল্প করে তুলেছিলেন। জাতীয় রাজনীতির ইস্যুগুলোতে তিনি বিজেপিকে ঘাঁটাননি। তৃণমূল সাংসদদের মতোই নবীনের দলের সাংসদরাও বহু বিলে ভোটাভুটির সময়ে হয় ভোট দিতেন না, অথবা সরকারের পক্ষে ভোট দিতেন। ওড়িশায় বিজেপিও তাঁর দলকে হারাতে গা লাগায়নি বহুকাল, কেবল নিচুতলায় আরএসএস নিবিড় কাজ চালিয়ে গেছে। শেষমেশ ২০২৪ সালে এসে নবীনের রথ উল্টে দেওয়া হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস তো বটেই, তার চেয়েও বড় কথা, কমিউনিস্টদের শেষ করার কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে তৈরি হওয়া তৃণমূল কংগ্রেস। নিচুতলায় আরএসএসের বাড়বাড়ন্ত ঠেকাতেও তারা কোনও ভূমিকা নিয়েছে বলে অভিযোগ নেই। এখন বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচার পশ্চিমবঙ্গে আরএসএস-বিজেপির কাজ আরও সহজ করে দেবে। তারপর কবে মমতার রথ উলটানো হবে, কীভাবে হবে— সেসব সিদ্ধান্ত বোধহয় দিল্লি থেকে নেওয়া হবে।

তা শুভেন্দুবাবুরা গান-টান করুন, কেবল হিন্দুদের উদ্দেশে একটা কথা বলে যাই। বিজেপি বা সঙ্ঘ পরিবারের আসল লক্ষ্য যে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুদের ভোট পাওয়া, বাংলাদেশের হিন্দুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা নয়— তা বুঝতে খুব বেশি কষ্ট করার দরকার নেই। তথাগত রায়, তরুণজ্যোতি তিওয়ারি প্রমুখের সোশাল মিডিয়া হ্যান্ডেলে যেসব কথোপকথন চলে সেগুলোতে চোখ রাখলেই বোঝা যায়। তাঁরা কিন্তু সজলবাবুর মতো আবেগপ্রবণ হয়ে বাংলাদেশ আক্রমণ করার কথা-টথা বলেন না। বরং বিপন্ন হিন্দুদের এ-দেশে জায়গা দেওয়ার কথা উঠলেই তাঁরা এবং তাঁদের সাঙ্গপাঙ্গরা বলতে শুরু করেন— ভারতবর্ষ ধর্মশালা নয়। বাংলাদেশি হিন্দুদের প্রতি সত্যিই টান থাকলে এই উপমহাদেশের মুসলমান বাদে অন্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য যে আইন তথাগতবাবুদের সরকার তৈরি করেছে, তাতে নির্দিষ্ট এ-দেশে আসার শেষ তারিখটা তুলে দিলেই তো হত। ৩১ ডিসেম্বর ২০১৪-র পরে বিপদে পড়া হিন্দুরা কি যথেষ্ট হিন্দু নন? আজ বাংলাদেশে যে হিন্দুরা বিপন্ন, তাঁদের জন্য তাহলে বিজেপির ভারতে কোনও জায়গা নেই? তাঁরা কেবল এ-দেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে ঘৃণা উৎপাদন করার খেলায় ব্যবহৃত বোড়ে?


*মতামত ব্যক্তিগত

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...