‘বিশ্বকর্মা’য় ফিরছে জন্মগত বর্ণাশ্রমের ধারণা— আজকের ‘একলব্য’দের রুখতে মোদির পদক্ষেপ?

অমর্ত্য বন্দ্যোপাধ্যায়

 


মোদির ভারতবর্ষে গুহক চণ্ডালকে রামচন্দ্র আলিঙ্গন করবেন ঠিকই। কিন্তু গুহকের গৃহে তাঁর পাত পড়বে না। একাধিক রামায়ণের বয়ান অনুসারে, বাস্তবের রামচন্দ্রও ঠিক তেমনটিই করেছিলেন। বিপরীতে মোদির ভারতে, কর্ণ-সমতুল কোনও চরিত্রের প্রবেশ নিষেধ। কর্ণের কবচ-কুণ্ডল ঘুরপথে ভাঙিয়ে নেওয়া ইন্দ্র অথবা একলব্যের আঙুল কেটে নেওয়া দ্রোণাচার্য জাতীয় ব্রাহ্মণেরাই আমাদের আরাধ্যপুরুষ। একালের কর্ণ-একলব্যদের সঠিক জায়গাতে, নিজেদের ওজন বুঝিয়ে ঠেকিয়ে-দাবিয়ে, অথবা ছোট করে রেখে, নিচু চোখে দেখে— সামাজিক পরিসরে চিরতরে তাঁদের নামিয়ে রাখার গূঢ়তর প্রয়োজনেই কি তবে দ্রোণাচার্য-মোদির এই ‘বিশ্বকর্মা’-বাণ?

 

ওরা যত বেশি পড়ে, যত বেশি জানে— তত কম মানে!

হীরকরাজের এই সংলাপ আজকের পৃথিবীতে প্রকাশ্যে উচ্চারণ করতে বোধ করি কোনও রাজনীতিকই আর সাহস দেখাবেন না। কিন্তু, ঘুরপথে আবার এই সংলাপেরই বাস্তবায়ন করতে তাঁরা যে প্রত্যেকেই যথেষ্টরকমে সচেষ্ট হবেন, সেও আর আলাদা করে বলার অপেক্ষা রাখে না। কাজেই আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি মহাশয়ও সেই একই পথে অগ্রসর হয়েছেন। তাঁর নতুনতর বিশ্বকর্মা প্রকল্পের মাধ্যমেই।

এই প্রকল্পের মাধ্যমে ঠিক কী পরিষেবা ঘোষণা করা হয়েছে একটু দেখে নেওয়া যাক। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বলা হয়েছে, পেশাগত ক্ষেত্রে পারিবারিকভাবে একই পেশায় কাজ করে চলেছেন যাঁরা— তাঁরা প্রত্যেকেই এককালীন তিন লক্ষ টাকা অবধি ঋণ নিতে পারবেন, এবং সরকারের তরফে তাঁদের নিজ নিজ পেশায় উন্নতির জন্য নির্দিষ্ট কর্মশালা, ব্যবসায়িক দক্ষতায় উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সরাসরি সংশ্লিষ্ট বাজারের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ ঘটিয়ে দেওয়া, ইত্যাদি বিষয়ে সহায়তা করা হবে। এই অবধি শুনলে পরে বেশ উৎসাহব্যঞ্জক বলে মনে হয়। কিন্তু এরই মধ্যে অন্তত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আড়ালে থেকে যাচ্ছে।

১) কেবলমাত্র তাঁরাই এই প্রকল্পের সুবিধা নিতে পারবেন, যাঁরা কিনা পারিবারিকভাবে একই পেশায় রয়েছেন ও তাঁদেরকে জানাতে হবে, গুরু-শিষ্য পরম্পরার মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের অধীত জ্ঞান অর্জন করেছেন।

২) ১৮-ঊর্ধ্ব যে-কেউই এই প্রকল্পের আওতায় চলে আসতে পারেন, এবং এই প্রকল্পের আওতায় আসতে গেলে কোনওরকম নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন পড়বে না!

৩) প্রধানত এই প্রকল্পের মাধ্যমে হস্তশিল্প ও সংশ্লিষ্ট পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষ (মন্দিরের পুরোহিত, স্বর্ণকার, কামার, কুমোর, তাঁত অথবা জরির শিল্পী, মুচি)— এমন সব নাগরিক পরিষেবা প্রদানকারী পেশাকেই বৃত্তিমূলক ধরে নিয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে।

এই প্রসঙ্গে তাহলে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়,

১) কোনওরকম নূন্যতম শিক্ষাগত যোগ্যতা-ব্যতীত, এমন অনায়াসেই যদি এই প্রকল্পের আওতায় চলে আসা যায় ও নগদ টাকা ঋণ হিসেবে পাওয়া যায়— সেক্ষেত্রে বিরাট অংশের এমন সুবিধাভোগীরা কি আর কোনওদিন পড়াশোনার মাধ্যমে, অথবা অন্য কোনওভাবে পরিশ্রম করে নিজেদের উত্তরোত্তর আর্থিক উন্নতিতে সচেষ্ট হবে? বিশেষত যেখানে স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে, প্রকল্পের সুবিধা নিতে গেলে পারিবারিক পেশাতেই টিকে থাকতে হবে। পেশা-বদল অথবা লেখাপড়া শিখে নতুন কোনও বিষয়ে আরও উন্নত ও আধুনিক হয়ে ওঠার সুযোগ, পাশাপাশি এই দুটি বিষয়কেই এই প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি জনমানসে গুরুত্বহীন করে দেওয়া হল।

২) গুরু-শিষ্য পরম্পরা ও নির্দিষ্ট পেশায় প্রত্যেক সুবিধাভোগীকে আটকে দেওয়ার এই যে সিদ্ধান্ত, তা কি পরবর্তী-বৈদিক যুগে প্রচলিত পেশাগত বর্ণাশ্রম ধর্মের পরিবর্তে জন্মগত বর্ণাশ্রম ধর্মের যে ধারণা— যার মাধ্যমে জন্মসূত্রে এক নির্দিষ্ট জাতিরই আওতায় একজন মানুষকে চিরতরে আবদ্ধ রাখার যে কুৎসিত বদভ্যাস তৎকালীন সমাজে বলবৎ ছিল— তারই সমতুল নয়? আদতে কি এই প্রকল্প তারই এক সুসজ্জিত, পরিমার্জিত, রঙিন মোড়কে সাজানো, কেমন জানি সব গিলে নেওয়া, পুঁজিবাদ ও হিন্দুত্বের ভয়ানক রাক্ষস দ্বারা আপনহস্তে সংশোধিত রূপ নয়?

৩) এমনিতেই তফশিলি জাতি ও জনজাতি-ভুক্ত জনসংখ্যায় স্কুলছুটের হার যথেষ্ট। তদুপরি স্কুলশিক্ষা অথবা অন্য যে-কোনও প্রকার প্রাথমিক শিক্ষা ব্যতীতই, ঋণ হিসেবে হলেও, সরাসরি হাতে এমন নগদ অর্থ এসে পড়া, এর ফলে পরোক্ষে এই প্রকল্পেরই মাধ্যমে পরবর্তীতে এমন স্কুলছুটের হার, দেশজুড়ে যে ক্রমশই আরও বাড়তে থাকবে সেই বিষয়েও আর সামান্যতম সন্দেহের অবকাশ থাকছে না।

৪) শেষত, পেশাগত ক্ষেত্রে এমন এক প্রকল্পের ঘোষণা হল বটে, এমনকি বিরাট অঙ্কের এক অর্থও সরাসরি এই খাতে বরাদ্দ করা হল, কিন্তু জনগণনা অথবা অন্য কোনও নির্দিষ্ট সমীক্ষার মাধ্যমে দেশজুড়ে এমন বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের, পেশা-ভিত্তিক জনসংখ্যা কত, কিই বা বণ্টন-বিন্যাস তাঁদের— এই বিষয়ে কোনও সামগ্রিক তথ্য অবধি কোথাও সংগৃহীত হল না। “রাজা ‘নেত্য’ করিতে বলিয়াছেন বলিয়াই” প্রকল্প ঘোষণা ও বাজেট বরাদ্দ সকলই সেরে ফেলা গেল। বাস্তবায়ন কেমনভাবে সম্ভব সেই বিষয়ে কোনও সদর্থক আলোচনার অবকাশটুকুও কোথাও দেখা গেল না।

নামটিও যে দেবতার অর্থাৎ বিশ্বকর্মার নামে দেওয়া হয়েছে, তাতেও বিশেষ বিচলিত হওয়ার কারণ দেখছি না। নিচুজাতের কেউ উপরে উঠে আসতে চাইলে, পুরাণবর্ণিত দেবদেবী অথবা দেবতুল্য একেকজন চরিত্রের মাধ্যমে তাঁদেরকে যে অজস্রবার কীভাবে কার্যত ‘শায়েস্তা’ করে দেওয়া হয়, একলব্য থেকে শুরু করে তেমন উদাহরণ আমরা অঢেল সংখ্যাতে বিভিন্ন প্রাচীন সাহিত্যেই পেয়েছি অনেকবার। নয়া-হিন্দুত্ববাদের ভারতবর্ষে এমন প্রকল্পের অভাবনীয়তা বিষয়ে তাই মন্তব্য করা বাতুলতা। বরং এমন প্রকল্পের ঘোষণাই ক্রমশ বাস্তব, ক্রমশ সমকালীন হয়ে উঠতে চলেছে। আমার দেশের যে বৃহত্তর চরিত্র, বিবিধের মাঝে মিলনের যে সুপ্রাচীন অভ্যাস, বিগত দশ বছরের শাসনে আমরা কেবলই তার বিপরীতে, এক রাক্ষুসে একমুখিতার দিকে হেঁটেছি। বহুত্বের বাগান তছনছ হয়ে গিয়েছে। ‘বিশ্বকর্মা’র প্রকল্প-বরাদ্দ, আজ কেবল সেই রাক্ষুসে একমুখিতার অভিমুখেই এক নতুন সংযোজন।

মোদির ভারতবর্ষে গুহক চণ্ডালকে রামচন্দ্র আলিঙ্গন করবেন ঠিকই। কিন্তু গুহকের গৃহে তাঁর পাত পড়বে না। একাধিক রামায়ণের বয়ান অনুসারে, বাস্তবের রামচন্দ্রও ঠিক তেমনটিই করেছিলেন। বিপরীতে মোদির ভারতে, কর্ণ-সমতুল কোনও চরিত্রের প্রবেশ নিষেধ। কর্ণের কবচ-কুণ্ডল ঘুরপথে ভাঙিয়ে নেওয়া ইন্দ্র অথবা একলব্যের আঙুল কেটে নেওয়া দ্রোণাচার্য জাতীয় ব্রাহ্মণেরাই আমাদের আরাধ্যপুরুষ। একালের কর্ণ-একলব্যদের সঠিক জায়গাতে, নিজেদের ওজন বুঝিয়ে ঠেকিয়ে-দাবিয়ে, অথবা ছোট করে রেখে, নিচু চোখে দেখে— সামাজিক পরিসরে চিরতরে তাঁদের নামিয়ে রাখার গূঢ়তর প্রয়োজনেই কি তবে দ্রোণাচার্য-মোদির এই ‘বিশ্বকর্মা’-বাণ? সমাজতাত্ত্বিকদের এই প্রসঙ্গ ভেবে দেখা উচিত।


*মতামত ব্যক্তিগত

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4889 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...