প্রবুদ্ধ ঘোষ
গুকেশ, প্রজ্ঞানন্দ, অর্জুনরা তো বটেই তাঁদের জুনিয়র দাবাড়ুরাও তৈরি হচ্ছেন আনন্দের অ্যাকাডেমিতে। শীর্ষস্থানীয় দাবাড়ুদের মধ্যে ভারতীয়রা উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে রয়েছেন। অর্জুন এরিগাসি সম্প্রতি ২৮০০ রেটিং-ক্লাবের সদস্য হয়েছেন। গুকেশ দোম্মারাজুর বিশ্বখেতাব জয় দাবা-মানচিত্রের এই সাম্প্রতিক বদলের এক ঝলক মাত্র। ভারতীয় দাবা আপাতত নির্ভরযোগ্য হাতে রয়েছে
দোম্মারাজু গুকেশের বিশ্ববিজয় কোনও অপ্রত্যাশিত ঘটনা নয়। অন্তত আমার কাছে। তার প্রধান তিনটি কারণ— ভারতীয় দাবার সাম্প্রতিক উড়ান, গুকেশের ধীরস্থির উত্থান এবং ডিং লিরেনের হতাশাজনক ফর্ম। ২০২৩ সালে ম্যাগনাস কার্লসেন স্বেচ্ছায় বিশ্বখেতাব ফিরিয়ে দেওয়ার পরে চিনের ডিং লিরেন এবং রাশিয়ার ইয়ান নেপোমনিয়াৎশি পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছিলেন। ডিং লিরেন টাইব্রেকারে নেপোমনিয়াৎশিকে হারিয়ে খেতাব জেতেন। ২০২৩-এর মে মাসে রোমানিয়ার ক্লাসিকাল দাবা প্রতিযোগিতায় আশ্চর্যজনক খারাপ ফল করেন। সদ্য বিশ্বচ্যাম্পিয়নের থেকে এমন ফল অপ্রত্যাশিত। তারপর থেকেই মনস্তাত্ত্বিক অসুস্থতার কারণে নিজেকে পেশাদারি দাবামহল থেকে সরিয়ে নেন ডিং। ২০২৪ সালে মাত্র তিনটি প্রতিযোগিতায় খেলেছিলেন। সবকটিতেই প্রায় শেষ স্থান। নরওয়ে দাবায় একটাও ক্লাসিকাল গেম জিততে পারেননি। সেপ্টেম্বরে বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত অলিম্পিয়াডে একটাও ক্লাসিকাল গেম জিততে পারেননি। কার্লসেন-জমানার অন্যতম সমীহ-জাগানো দাবাড়ু ডিংয়ের মানসিক স্বাস্থ্য তাঁর স্বাভাবিক রণনীতির সঙ্গ দিচ্ছিল না। ভুলে গেলে চলবে না কার্লসেনের ঠিক আগে একটানা শতাধিক ম্যাচে অপরাজিত থাকার ঈর্ষণীয় রেকর্ড ছিল তাঁর দখলে। দীর্ঘদিন অভিজাত ২৮০০-রেটিং ক্লাবের সদস্য ছিলেন তিনি। ২০১৯ সালের সিঙ্কেফিল্ড কাপের ফাইনাল— ডিং বনাম ম্যাগনাসের টাইব্রেকার। কার্লসেনকে পর্যুদস্ত করে খেতাব জিতেছিলেন ডিং। কার্লসেনের সেরা সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে এমন রেকর্ড কজন দাবাড়ুর আছে? ২০১৫ সালে দোহায় প্রতিযোগিতা শুরুর আগে ম্যাগনাস ডিং লিরেনকে ব্যক্তিগত আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন একসঙ্গে অনুশীলন করবেন বলে। বিশ্বচ্যাম্পিয়নের আমন্ত্রণে তাঁর সঙ্গে এক সপ্তাহের অনুশীলনের বিরল সুযোগ ডিংকে কার্লসেন-জমানার অন্যতম সেরা হিসেবে পরিচিত করিয়েছিল। ২০২০। লকডাউন। অনলাইনে ডিং বনাম ম্যাগনাসের খেলায় হঠাৎ ডিংয়ের ইন্টারনেট বিগড়োল। নিয়ম অনুযায়ী হেরে গেলেন ডিং। ঠিক তার পরের গেমেই দ্বিতীয় দানে ইচ্ছকৃত কুইন ব্লান্ডার দিয়ে পরাজয় স্বীকার করলেন কার্লসেন। ফলাফল ১-১। শীর্ষস্তরের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নজিরবিহীন ঘটনা। কার্লসেন বলেছিলেন, “খেলোয়াড় এবং মানুষ ডিং লিরেনকে আমি সম্মান করি। ওঁর বিরুদ্ধে আমি ভাল দাবা খেলে জিততে চেয়েছি।” এহেন ডিং বিগত দেড় বছরেরও বেশি সময় নিজের খেলা থেকে বহু দূরে সরে গেছেন।
অন্যদিকে দোম্মারাজুর যাত্রা এক আশ্চর্য ভোরের মতো। ক্যান্ডিডেটস দাবার শুরুটা ভাল হয়নি। ডাবল রাউন্ড-রবিন প্রতিযোগিতায় ইরানের আলিরেজা ফিরুজার বিরুদ্ধে প্রথম লেগে হেরে গেছিলেন। শেষ মুহূর্তের ব্লান্ডারে অকল্পনীয় হার, কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। ততক্ষণে অভিজ্ঞ নাকামুরা, কারুয়ানা, নেপোমনিয়াৎশিরা আলো ছড়াচ্ছেন। ষষ্ঠ রাউন্ড থেকে গুকেশের প্রত্যাবর্তন শুরু হল। ফিরুজাকে দ্বিতীয় লেগে নিখুঁত দানপর্যায়ে হারিয়ে বদলা নিলেন। ক্রমশ গুকেশের শান্ত, স্থির গতির সামনে ম্লান হয়ে যেতে লাগলেন খেতাবজয়ের অন্য দাবিদাররা। ক্যান্ডিডেটস জিতে বিশ্বখেতাবের সর্বকনিষ্ঠ চ্যালেঞ্জার হওয়ার পরে যে-কটা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন, সবকটিতেই প্রতিভার প্রতি সুবিচার করেছেন গুকেশ। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ভারতীয় দলের হয়ে ওলিম্পিয়াডে অপ্রতিরোধ্য পারফরম্যান্স। রেটিং বেড়ে ২৭৮৩। আর, বিগত ছ-মাসে খেলা গুকেশের গেমগুলি প্রমাণ করে গুকেশ তত্ত্বগতভাবে এবং মানসিকভাবে বিশ্বখেতাব জয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। হার না-মানা মনোভাব গুকেশের অন্যতম জোরের জায়গা। এন্ডগেমকে পিষে পিষে কাঙ্খিত পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া গুকেশের রণনীতির অঙ্গ। ইক্যুয়াল পজিশন থেকে ওঁত পেতে শত্রুর ভুলের জন্য অপেক্ষা করে তারপর জয়ের জন্য ঝাঁপানো গুকেশের অন্যতম পরিকল্পনা। বিশ্বখেতাবি লড়াইতে এর সঙ্গে যোগ হল আক্রমণাত্মক মনোভাব। চেনা ওপেনিং-শাখার মূলধারা থেকে সরে এসে স্বল্প-পরীক্ষিত ধারায় খেলা। আর, যতদূর সম্ভব সহজ ড্রয়ের কৌশল এড়িয়ে যাওয়া। বিশ্বখেতাবি লড়াইয়ের গেমগুলি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, গুকেশের ওপেনিং প্রস্তুতি ডিং লিরেনের চেয়ে অনেকটাই বেশি ছিল। কোনও ওপেনিং থেকে মিডলগেমে প্রবেশের মধ্যবর্তী পর্যায়ে গুকেশের পরিকল্পনা অনেক বেশি অনুশীলিত ছিল। তবে, গুকেশের যেটার অভাব ছিল, তা হল অভিজ্ঞতা। ডিং যতই এখন খারাপ ফর্মে থাকুন, শীর্ষস্তরীয় দাবাড়ুদের বিরুদ্ধে অনুশীলন, সর্বোপরি একটি বিশ্বখেতাবি লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা তাঁর ঝুলিতে। বেশ কিছু গেমে পিছিয়ে পড়েও তাই ড্র বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন ডিং। নিজে সামান্য ভুল দান (ইনঅ্যাকুরেসি) দিলেও কয়েক দান পরে গুকেশের সামান্য ভুলের সুযোগে গেমে ফিরে এসেছেন। বস্তুত এই বিশ্বখেতাবি লড়াইয়ে সেই আগের ক্ষুরধার মেধা ও প্রস্তুতিসম্পন্ন ডিংয়ের ঝলক দেখা গেছিল। প্রথম গেম এবং দ্বাদশ গেমে ডিং লিরেন গুকেশকে যেভাবে হারিয়েছেন, তাতে পুরনো শান্ত অথচ আগ্রাসী ডিংকে মনে পড়তে বাধ্য। যে ডিং একদা টানা ১০০টি ক্লাসিকাল গেমে অপরাজিত ছিলেন।
ত্রয়োদশ রাউন্ডের কথাই ধরা যাক। গুকেশের ওপেনিং-প্রস্তুতি তাঁর বর্ম হয়ে উঠেছিল। প্রথম রাউন্ডে কিং-পন ওপেনিং খেলে ডিংয়ের ফ্রেঞ্চ প্রতিরক্ষা শাখার মোকাবিলা করেছিলেন গুকেশ। কিন্তু ডিংয়ের নিয়ন্ত্রিত প্রতি-আক্রমণের সামনে তাঁর আক্রমণ সাফল্য পায়নি। হেরে গেছিলেন। ত্রয়োদশ রাউন্ডেও সাহস করে প্রায় একই ওপেনিং খেললেন গুকেশ। পাঁচ নম্বর দানে খেললেন a3, যে রকমফেরে খুব বেশি গেম এর আগে খেলা হয়নি। গুকেশের আক্রমণাত্মক রণনীতির বিরুদ্ধে পিস-পনের মহড়া সাজাতে যথেষ্ট সময় ব্যয় করতে হচ্ছিল ডিংকে। দাবা-ইঞ্জিনের হিসেবে দুজনেরই ভাল দান তথা ইনঅ্যাকুরেসি হয়েছে। কিন্তু গুকেশ ধীরে ধীরে মাঝছক এবং গুরুত্বপূর্ণ ই-ফাইল দখল করে নিলেন। সময়ের চাপে ৩১ নম্বর দানে ভুল রণকৌশল না নিলে গুকেশ হয়তো সামান্য সুবিধাজনক অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে জিততে পারতেন। কিন্তু, ডিংয়ের অভিজ্ঞতা এখানেই কাজে লেগে গেল। গুকেশের ভুল দানবাছাইয়ের সুযোগ নিয়ে গেমটাকে ড্রয়ের দিকে নিয়ে গেলেন তিনি। কুইন+রুক এন্ডগেমে একটা পন বেশি নিয়ে গুকেশ জেতার জন্য ছটফট করতে লাগলেন। কিন্তু অভিজ্ঞ ডিং জানেন কীভাবে রুক এন্ডগেমে ঢুকিয়ে নিয়ে সাদার জেতার সম্ভাবনা নির্মূল করতে হয়।
বিশ্বখেতাবি লড়াইয়ের শেষ রাউন্ডের এন্ডগেমটা ঠিক এখান থেকেই শুরু করলেন গুকেশ। কালো নিয়ে। একই রঙের বিশপ+রুক এন্ডগেম। কিং-সাইডে একটা পন বেশি। তত্ত্বগতভাবে ড্র। দাবার ইঞ্জিনও দেখাচ্ছে ড্র। গোটা প্রতিযোগিতায় সিংহভাগ সময়ে রক্ষণাত্মক নীতিতে জোর দিয়েছেন ডিং। বিশ্বখেতাবি লড়াইয়ের ফলাফল প্রলম্বিত করেছেন। নিজে ভুল করেছেন। গুকেশের ভুলের সুযোগ নিয়েছেন। ডিং সম্ভবত চেয়েছিলেন ক্লাসিকাল দাবার ১৪টি গেমের ফলাফলে সমতা রেখে টাইব্রেকে যেতে। র্যাপিড এবং ব্লিৎজ দুই ধরনেই ডিংয়ের দক্ষতা ও রেকর্ড গুকেশের থেকে ভাল। চাপের মুখে ডিং লিরেনের সেরা খেলাটা বেরিয়ে আসে, এমন মিথও ক্রীড়াবিশ্বে ঘোরে। ডিংয়ের সর্বোচ্চ ব্লিৎজ রেটিং ২৮৭৫, ২০১৬ সালের শীর্ষ র্যাঙ্কিং। তাঁর সর্বোচ্চ র্যাপিড রেটিং ২৮৩৫। ক্লাসিকালের চাপ পেরিয়ে র্যাপিড ও ব্লিৎজে গেলে হয়তো নিজের সেরা খেলা খুঁজে পাবেন এমনই বিশ্বাস ছিল তাঁর। কিন্তু ওই ১৪ নম্বর রাউন্ড ডিংয়ের পরিকল্পনায় বাধ সাধল। তত্ত্বগতভাবে ড্র আর সত্যিকারের ড্রয়ের মধ্যে যে সূক্ষ্ম ব্যবধান, সেখানেই শেষ বাজি মেরে বেরিয়ে গেলেন গুকেশ। যে-কোনও ক্রীড়ার সহজ সত্য হচ্ছে, ফলাফল তত্ত্ব দিয়ে বা বিশ্লেষণ দিয়ে নির্ধারিত হয় না, তা ক্রীড়াক্ষেত্রের বাস্তবতায় নির্ধারিত হয়। সম্ভাব্য ফলাফল আপাতদৃষ্টিতে সহজ মনে হলেও, তা এমনি এমনি হয়ে যায় না, ফলাফল হওয়াতে হয়, যুদ্ধের পরিণতির দিকে নিয়ে যেতে হয়। ডিং এখানেই ব্যর্থ হলেন। যে-পজিশনে Rf2 চরম ভুল দানটা ডিং দিলেন, তা একজন বিশ্বচ্যাম্পিয়নের থেকে কাম্য না। ওই একই পজিশনে ৯৯টা গেম ডিং ড্র করবেন নিশ্চিতভাবেই, কিন্তু যে একটি গেম হারবেন, সেটিই হারলেন বিশ্বখেতাবি লড়াইয়ের ১৪তম রাউন্ডে গুকেশের বিরুদ্ধে। এন্ডগেমে অপ্রত্যাশিত সময় ব্যয় করছিলেন ডিং। দানপর্যায় গণনা করতে কী যেন হাতড়াচ্ছিলেন। গুকেশের লক্ষ্য সরল— ডিংকে সর্বশক্তি দিয়ে ড্রয়ের জন্য ঝাঁপাতে হবে, কিন্তু গুকেশ নিজের স্বাভাবিক ছন্দে একটা অতিরিক্ত পন আর অগ্রণী কিং দিয়ে চাপ বাড়িয়ে যাবেন। স্নায়ুযুদ্ধে পরাজিত হলেন ডিং।
#
শীর্ষপর্যায়ের দাবা শুধুমাত্র একার খেলা থাকে না আর। সেকেন্ড অর্থাৎ সহকারীদের সঙ্গে নিত্যনতুন দানপর্যায় নিয়ে গবেষণা করে আর তত্ত্বের নয়া সম্ভাবনার প্রয়োগের প্রস্তুতি সেরে একজন দাবাড়ু ক্যান্ডিডেটস, বিশ্বখেতাবি যুদ্ধ লড়তে যান। গুকেশের সেকেন্ড হিসেবে ছিলেন জাঁ ক্র্যস্টফ ডুডা, ভিনসেন্ট কেমার, পেন্টালা হরিকৃষ্ণা, র্যাডোস্ল ওইতাসজেক। ২০২১ সালের বিশ্বখেতাবি লড়াইয়ে কার্লসেন সেকেন্ড হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ড্যানিইল ডুবভকে, কারণ ডুবভের তুখোড়-কৌশলী দানগণনা এবং ঝুঁকিপ্রবণ-কিন্তু-অনন্য দানভাবনা দাবা-ইঞ্জিনের মাপা দানপর্যায়কে হতচকিত করে দিতে পারে। নেপোমনিয়াৎশিকে হারাতে ডুবভের পরামর্শ অন্যতম অস্ত্র ছিল কার্লসেনের। ভিনসেন্ট কেমারের ক্ষুরধার ও ঝুঁকিপ্রবণ দানগণনা গুকেশের অস্ত্র হয়ে উঠল। এর সঙ্গে ছিলেন আরও দুজন। দক্ষিণ আফ্রিকার প্যাডি আপটন। প্যাডির পরামর্শ আর সাহচর্য ২০০৯ থেকে ২০১১ সালের ভারতীয় ক্রিকেট দলের মনস্তাত্ত্বিক শক্তি বাড়িয়েছিল। বিশ্বখেতাবি লড়াইয়ের মানসিক চাপ কম না। শারীরিক ও মানসিক সক্ষমতার চূড়ায় না থাকলে এই লড়াইতে জেতা যায় না। গুকেশের জন্যও একই কাজ করেছেন প্যাডি আপটন। শুরুর রাউন্ডে হেরে যাওয়া বড় ধাক্কা। কিন্তু, গুকেশ দু-ম্যাচের মধ্যে প্রত্যাঘাত করলেন। বিশ্বখেতাবি লড়াইয়ে এমন প্রত্যাঘাতের জন্য মানসিক দৃঢ়তা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। উপরন্তু দীর্ঘ ১৮ দিনের লড়াইয়ে মানসিক ও শারীরিক ক্লান্তির কোনও স্থান নেই; জেতার জন্য দাবাড়ুকে সবসময় মুখিয়ে থাকতে হবে; দীর্ঘায়ত গেমের (তা ৭-৮ ঘণ্টাও হতে পারে) প্রতিটা দানে অবসন্ন না হয়ে সমান পরিশ্রম করতে হবে— প্যাডি আপটন এবং বাকি সেকেন্ডরা এই বিষয়গুলি নিশ্চিত করেছিলেন। আর, গুকেশের বিশ্বজয়ের চিত্রনাট্য লেখায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান যে মানুষটার, তাঁর নাম বিশ্বনাথন আনন্দ।
ভারতীয় তরুণ প্রজন্ম বিশ্বদাবায় এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন বিশ্বদাবায় ভারতীয়ের একমাত্র উপস্থিতি— বিশ্বনাথন আনন্দ। নব্বই দশকের শেষার্ধে কাসপারভ এবং কারপভের বিরুদ্ধে সাহসী লড়াই লড়েও হেরে গেছিলেন আনন্দ। তারপর ২০০০ সালে প্রথমবার বিশ্বখেতাব জয়। এরপর আরও চারবার। বস্তুত সোভিয়েত ও রাশিয়ার দাবা-সাম্রাজ্যে তাৎপর্যপূর্ণ আঘাত হানতে সক্ষম হয়েছিলেন মুষ্টিমেয় যে কজন তাঁদের অন্যতম আনন্দ। রাশিয়ার শেষ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন ভ্লাদিমির ক্রামনিককে হারানোর পরে ২০০৭-২০১৩ ছ-বছর বিশ্বখেতাব ধরে রাখার কৃতিত্ব তাঁর। শেষবার ২০১৪ সালে ম্যাগনাস কার্লসেনের বিরুদ্ধে বিশ্বখেতাবি লড়াইতে পরাজিত হলেন। কিন্তু ততদিনে ভারতের নতুন প্রজন্মের সদলবলে দাপিয়ে বেড়ানোর রোডম্যাপ তৈরি হয়ে গেছে। দাবা শুধু আর শখের খেলা নেই। পেশাদার দাবাড়ুরা পুরনো ধ্যানধারণাকে প্রতিস্পর্ধা জানাতে শুরু করলেন। ভারতীয় দাবাড়ুরা বিশ্ব ক্রীড়ামানচিত্রে নজরে আসতে শুরু করেছেন। শীর্ষ গুণমানের প্রশিক্ষক, দেশীয় প্রতিযোগিতার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং তৃণমূলস্তর থেকে প্রতিভাবান দাবাড়ু তুলে আনার উদ্যোগ ভারতের দাবাদর্শন পাল্টাতে শুরু করল। এই প্রগতিশীল দাবাদর্শনের অন্যতম হোতা বিশ্বনাথন আনন্দ। ওয়েস্টব্রিজ আনন্দ চেস অ্যাকাডেমি তৈরির প্রস্তুতি ছিল ২০১৯ সাল থেকে। সোভিয়েত দাবানীতির কিয়দংশ তথা বিশ্বনন্দিত সোভিয়েত দাবা-ইস্কুলের ভাবনায় এই প্রশিক্ষণকেন্দ্র তৈরি করেছেন আনন্দ। বাংলার সন্দীপন চন্দ, পোল্যান্ডের গ্রেজগর্জ গ্যাজেওস্কি, সোভিয়েত-জার্মান আর্তুর য়ুসুপভ সেখানে প্রশিক্ষণ দেন। গুকেশ, প্রজ্ঞানন্দ, অর্জুনরা তো বটেই তাঁদের জুনিয়র দাবাড়ুরাও তৈরি হচ্ছেন এই অ্যাকাডেমিতে। শীর্ষস্থানীয় দাবাড়ুদের মধ্যে ভারতীয়রা উল্লেখযোগ্য স্থান অধিকার করে রয়েছেন। অর্জুন এরিগাসি সম্প্রতি ২৮০০ রেটিং-ক্লাবের সদস্য হয়েছেন। গুকেশ দোম্মারাজুর বিশ্বখেতাব জয় দাবা-মানচিত্রের এই সাম্প্রতিক বদলের এক ঝলক মাত্র। ভারতীয় দাবা আপাতত নির্ভরযোগ্য হাতে রয়েছে। ভারতের ক্রীড়া ভবিষ্যতের জন্য এমন অনেক সুখবর আগামীদিনে এলে অবাক হব না।