স্মৃতিপরব: পর্ব ১

নীহারকান্তি হাজরা

 

সানুদেশের দিন

জাতের পাড়া, পাড়ার জাত

টকটকে লাল পশ্চিম বাঁকুড়া। ছোট্ট জনপদ খাতড়া। এই স্থানটিতে কখন কোন সময় আমার পিতৃদেব এসেছিলেন, আমার সঠিক জানা নেই। শিথিলভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বেশ আগে। আর এইখানেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগের বছরটিতেই আমার জন্ম— অগাস্ট, ১৯৩৮। পরিপার্শ্ব আমার বোধে আখর দিতে দিতে কাটিয়েছে চারটি বছর, আর এর পর থেকেই আমাদের বাড়ি-ঘর, আমাদের মধ্যের সম্পর্কগুলো পৃথক করতে পারছি। খিড়কি দরোজা খুললে, যেখানে ছেলেধরা ঘুরে বেড়ায়, তাদের অনেক দূরে লালধুলোর পথ। আর তারপরেই উঁচু নিচু মাঠ, মাঠ, নিচু হয়ে নেমে গিয়ে আমার ডানদিকে চলে গেছে সেইখানে. যেখানে আকাশের তলাটা মুছে দিয়ে যেটা আধো শুয়ে আছে সেটার নাম পাহাড়। লেদি পাহাড়। আমার সামনে সামান্য বাঁদিকে এমনই আরও একটা, কিন্তু আরও বড় অমনি পাহাড়। মশক পাহাড়। পরে একটু বড় হলে, এদের শরীরে পা রাখব যখন, এরা আমার সেই সময়ের বর্ধমান প্রাণে এনে দেবে আকুল হয়ে ওঠা বিস্ময়রস। এদের মাঝখানের নির্জন দূরত্ব, ভেসে আসা গাছগাছালির একটা বোবা নিবিড় গন্ধের সঙ্গে মিশে যাওয়া নানা রঙের মাটিকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরা নামহীন লতাগুল্মের প্রাকৃত রস আমার প্রাণে-মনে জড়িয়ে যায়। মাটির বাড়ির উঠোন পার হয়ে ডানদিকে খোলে সদর দরোজা যার প্রায় গা ঘেঁষে একটা বড় মাঠকে মাথায় রেখে দুটো সমান্তরাল তালগাছ। এরা দিবারাত্র ছুঁচলো ডগায় আকাশটাকে আঁচড়ায় আর অজস্র চড়াইপাখিকে কোটরে রেখে নানা মাত্রার ধ্বনি তোলে। এখন কথা বলতে পারি। এটা চন্দ্র ময়রার ঘর। ভাড়া ঘর।

 

আমার বোধে পরিচিতির একটা মাত্রা তৈরি হয়, পরে বুঝব সেটা জাতি পরিচয়— সামনের মাঠটার ওপারে উৎকলদের বাড়ি, বাঁদিকে মিত্তির পুকুর, তারও নিচে নেমে একটা উঁচু পাড়ের উপরে যেখানে কটু গন্ধের গাছে আকাশি নীল ফুলের ঝোপ— শুঁড়িদের পুকুর। জনপদের খণ্ড স্থানগুলোর মধ্যেও জাতি পরিচয় যে সেঁটে আছে তার সঙ্গে পরিচিত হব বয়সের মাত্রা ধরে— শুঁড়িপাড়া, কায়স্থপাড়া, বদ্দিপাড়া. বামুনপাড়া, বাউরিপাড়া, হাঁড়িপাড়া, ডোমপাড়া এই সব। তবে সবার ওপরে রাজাপাড়া। এখানে রাজা থাকেন। রানি থাকেন। এর একটা আলাদা বৃত্তান্ত আছে। সামনের দিকে এগুলো আরও প্রসারিত হবে। তবে এখন এই মহাদূরত্বের ব্যবধানে দেখতে পাচ্ছি বর্ণাশ্রমগত বৃত্তিগুলো অন্তত নিম্নশ্রেণির মধ্যে অটুট রয়ে গেছে সেকালে। জনপদের অবস্থানও এইভাবেই। তবে বাউরিদের জাতিগত বৃত্তি সঠিক কিছু ছিল না। এটা কেন জানব আরও অনেক পরে।

 

মন্বন্তর

কিন্তু একদিন কাছারি থেকে ফিরে বাবা বেশ একটা ভয় পেয়ে যাওয়া গলায় মাকে বলল, আর চাল পাওয়া যাবে না। ট্রাকে করে চাল এনে গোডাউনগুলো বোঝাই হচ্ছে। গ্রামের কোথাও চাল নেই। ইলিয়াস বলছিল মানুষেরা গাছের পাতা খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। গরিব বড়লোক কেউ বাদ নেই। ইলিয়াস বাবার পিয়ন।

এর কিছুদিন পরেই দুপুরের একটু আগে হঠাৎ রোদ নিভে গেল। কোথাও মেঘ নেই। সকলে উঠোনে নেমে উপরে তাকিয়ে দেখি পিছনের আকাশটা ঢেকে দিয়ে বাড়ির চালার খানিকটা উপর দিয়ে তীব্র পুরু স্রোতে উঠে আসছে একটা ভয়ানক জীবন্ত সচল মেঘ। ভয়ানক বিদঘুটে প্রাণীর ধূসর-কালো স্রোত শূন্যতাটা খুবলে চলেছে। এর পর সেগুলো পড়তে শুরু করল উঠোনে মায়ের লাগানো গাছগুলোর ডগায়। চোখ বন্ধ করে খুলতেই দেখি গাছগুলোর সর্বস্ব তারা খেয়ে নিয়ে কখন উড়ে গেছে সেই স্রোত ধরে। দুটো একটা পড়ে আছে উঠোনে। আর তাদের ডিম। সেখান থেকে ফেটে বেরোচ্ছে সেগুলোর বিদঘুটে শাবক। রং খয়েরি-ঘেঁষা ধূসর। মাঝেমাঝে একটা করে গোলাকার বিন্দু। খানিকক্ষণ পড়ে থেকে শাবকগুলোও চালায় উঠে গেল। ধরবে সেই প্রাণীর স্রোত। এর মধ্যে খিড়কি দরোজা খুলে দেখি লেদি আর মশক পাহাড়ের উপরের ঢালু আকাশের তলাটা তখনও ঢাকা। এর মধ্যেই চন্দ্র ময়রার নিজের বাসঘরের গাছগুলো, সামনের উকিলবাবুর অনেকগুলো কাঁঠাল আর আমের গাছ, একটা বড় শিমূলগাছ, যেটা এই সকালেও বহুটা আকাশ জুড়ে ঘন হয়ে ছিল এখন আর নেই। তারপর জনপদ শেষ করে কোথায় উড়ে চলে গেল আজ আর আমার জানা নেই। কিন্তু পরের দিন বাবার মুখে আবার শুনব ইলিয়াস বলেছে গ্রামের পর গ্রামে কোথাও আর সবুজ বলে কিছু নেই। মানুষের শেষ খাদ্যটুকুও তারা খেয়ে গেছে। আরও শুনব এগুলো স্রোতে ওড়ার সময়ই ডিম পাড়ে। শাবকগুলো বেরিয়েই উড়তে শুরু করে। ক্রমাগত এরা বেড়ে চলেছে অগণন সংখ্যায়। শুনব যেগুলো পড়ে রয়ে গেছে ডানা ভেঙে, মানুষেরা পুড়িয়ে খাচ্ছে। আমাদের বাড়িতে জোৎস্না নামের যে মেয়েটি কাজ করত তার ভাই নিয়ে এল একটা প্রাণী— পঙ্গপাল।

এর পর দেখব গোডাউন। বাঁধানো অনেকটা লম্বা মেঝের উপর অনেক উঁচু গোল করে বাঁকানো টিনের ছাদ, যার দুই প্রান্ত বাঁধানো মেঝের উপর নেমেছে। আর সেখানে দুই দিকে আছে বাঁধানো নালা। ছাদের জল বয়ে নিয়ে যাবে। দুই দিকে বড় মাপের ভাঁজ করা লোহার দরোজা। চাল বোঝাই লরি ঢোকা এবং বেরোনোর উপযুক্ত। জনপদের পশ্চিমে বেশ কয়েকটা গোডাউনে ছাদ পর্যন্ত বোঝাই চালের বস্তা। জেলা শহরের পাশে, যেখানে শুনেছি আমাদের দেশ, সেখানে পৌঁছনোর রাজপথের সংলগ্ন বিভিন্ন গঞ্জে এরকম গোডউনে তখন চাল বস্তাবন্দি হয়ে পড়েছে। এই সঙ্গেই শোনা গেল যুদ্ধ লেগেছে। সরকারি কর্মচারীর পরিবারের রেশনবদ্ধ জীবনে এর তেমন কোনও আসর তখনও অনুভবে এল না।

কিন্তু এর পরই সাক্ষী হয়ে যাব সেই ভয়ানক ঘটনার— খিড়কি দরোজার পিছনের দিকে একটা ‘নাকি‘ সুরের কোলাহল। উঠোন-ঘেঁষা বারান্দার এক প্রান্তে, যেখানে রান্না করে আমার মা, আর ভাতের ফেনটা ঢেলে দেয় বারান্দার নিচে একটা নালায়, যেটা গড়িয়ে চলে যায় পাঁচিলের বাইরে সেখানে প্রায় উলঙ্গ, নানা বয়সের মানুষ— কারও কোলে তার হাতের হাড়ে জড়ানো সন্তানের পাঁজরের হাড়, তার গলনালীর উপরে খাড়া চুল একটি শিশুর মুণ্ড। এরকম কাতারে কাতারে। দরোজার ওপারে ওইসব পাহাড়ের দিক থেকে আসছে মানুষের স্রোত। লুটোপুটি খাচ্ছে। তারপরে দেখি দীর্ঘদিনের জমে থাকা ফেনের ভাগ নিয়ে অঙ্গের হাড় বাজানো কাড়াকাড়ি। সেই শিশু-মুণ্ডের আড়ষ্ট হাঁ-তে ভ্রূক্ষেপ নেই জননীর, কাদামাটিতে জড়ানো ফেন পশুর মতো উপুড় হয়ে উদরে তুলছে। ভূতের মতো রঙের সেই কালো আঁকাবাঁকা উলঙ্গ স্রোত একটার পর একটা বাড়ির দিকে এগোচ্ছে। শুকনো পেটের তলা থেকে উঠে নাকের ভিতর দিয়ে একটা আকুল আগ্রহের বাতাস বার হচ্ছে, সেটা অনুমানগত হয়ে আকার পাচ্ছে— “একটু ফেন দাও মা। একটু…”

এই দৃশ্যটা, একটা সময় আরও ঘন হয়ে এসে তারপরে শেষ ধাপটাতে পৌছল। পাহাড়গুলোর তলার নীল-বেগুনি একটা অস্পষ্ট আড়ষ্টতার ভিতর থেকে অগণন মানুষের গলিত স্রোত বন্যার ঢেউয়ের মতো এই জনপদের সর্বাঙ্গে ছেয়ে গেল। এই শেষটুকু পরের অনুমান, কারণ খিড়কি দরোজার বাইরের প্রসারিত ক্রমশ পিছনে ঢালু হয়ে যাওয়া নীল আকাশের তলাটুকুই আমার সেই মুহূর্তের ঘটমান বর্তমান। আমার সেই বয়সে দেখছি বাড়িতে কেমন ভয়। বড়দের মধ্যে আর তাদের স্বাভাবিক উচ্চগ্রামে কথাবার্তা নেই। দরোজা জানালার খিল ছিটকিনি অধিকন্তু মেরামত হয়ে গেল। এমনকি রাত্রি জাগাও শুরু হল ঘরে ঘরে, কিন্তু আরও, আরও পরে এই খবর রটে যাবে— পথে পড়ে মরল এরা, কিন্তু একটা ঘরেও চুরি হল না, লুট হল না সেই সময়ের সবচেয়ে দামি বস্তু— এক মুঠো চাল! এত সবের মধ্যে স্বাভাবিক রইল কেবল আমার মেজদা। তার হাতে ব্লিচিংয়ের পোঁটলা আর একটা জলের বালতি। সারাদিন বাইরে ঘুরে সন্ধেয় ফেরে। উঠোনের একপ্রান্তে জামাকাপড়গুলো খুলে লাইফবয় সাবানে কাচে, স্নান সারে, তারপর খেতে বসে মার সঙ্গে যে কথাগুলো হয় তার একটা ছবি আমার আড়ষ্ট বোধে আসে। মেজদার এসব নিয়ে মার নিষেধ, কান্নাকাটি এসব শুনি। বেশ কিছুদিন একই কথা শুনে যাই। তারপর একদিন আমার ওপরের দিদির সঙ্গে সামনের দরোজাটার বাইরে এসে দেখি সেই চতুষ্কোণ মাঠের এখানে-ওখানে, ডানদিকের লাল ধুলোর রাস্তাটার ওপরে আমার দৃষ্টির ফ্রেমের মধ্যে নানা আকারের কঙ্কালেরা শুয়ে আছে। যুবকেরা তাদের চারপাশে ছড়িয়ে দিচ্ছে ব্লিচিং আর বালতি থেকে মগে করে মুখে দিচ্ছে একটু করে জল। একটা তীব্র দুর্গন্ধ বাতাসে লেপটে রয়ে গেছে। আমার মেজদাও অন্য কোথাও এই কাজই করে চলেছে। এতকাল পরেও একটা ভয়ানক ছবি আপন অক্ষ-দণ্ডে স্থির করে দেয়: কয়েক বছর পরে দুই মুখ হাট করে খুলে দেওয়া রঙ্কিনীতড়ার গোডাউনগুলোর মেঝের উপরে থাকা ক্রমশ গাঢ়-গাঢ়তর সবুজের জমাট একটা স্তর নির্লিপ্ত পুরু গুমোট গন্ধ নিয়ে পড়ে, আর তার ভিতর থেকে ঝরে পড়া সবুজ ধুলো— একদার মুঠো মুঠো চাল!

একটা সময় এই জনপদের বিভিন্ন পাড়ার গরিব মানুষেরা— হাঁড়ি-বাউরি আর ডোমেরা বাড়ি বাড়ি দল বেঁধে চাইছে একটু ফেন। এক মুঠো ভাত। জনপদের বাবুরা এদের জন্য কিছু করতে চাইছেন। একদিন আমার ওপরের দিদির ফ্রকের প্রান্ত ধরে আদালত চত্বরে এলাম। নাম কাছারি। আমার বাবার কর্মস্থল। মুনসেফ্‌’স কোর্ট। এখানে অনেকগুলি বটের সঘন অচঞ্চল ছায়া। তারই মধ্যে অসংখ্য কাক বক শালিখের আশ্রয়। তাদের অবিরাম স্বর-স্বরান্ত বিনিময়ের আবহ। মাটিতে অর্ধভুক্ত গাঢ় লাল বটফল আর তার সঙ্গে জড়ানো পক্ষিপুরীষের গুমোট গন্ধ। এরই পাশে একটি বেশ চওড়া বারান্দা-সহ লম্বা চারচালা ঘর। সরস্বতী মেলা। বারান্দায় পেল্লায় হাঁড়িতে হাঁড়িতে খিচুড়ি পাক হচ্ছে। কাঠি দিয়ে জুড়ে দেওয়া গোলাকার শালপাতার স্তূপ মজুত। মেলার সামনে অনেকটা খালি জায়গা। ঠিক বিপরীতে একটা পাকা নাটমঞ্চ। ওই খালি জায়গাটাকে শূন্য ধরে চারপাশ দিয়ে উঠে এল সেইরকম মানুষের দল। খিচুড়ির পাক চূড়ান্ত হয়ে ওঠার সমকালে খণ্ডযুদ্ধের আকার পেল বসার স্থান নিয়ে। বালতি আর হাতা হাতে পরিবেশনকারী স্বেচ্ছা-সেবকের দল তাদের হাতার থেকে বাষ্পভর একটা পিণ্ড পাতায় ফেলা মাত্র সেটা ক্ষুধার্ত পেটের গহ্বরে পড়তেই তীব্র আর্তনাদ করে অনেকে দাঁড়িয়ে পড়ল আর তারপর লুটিয়ে পড়ল পাতার উপরে। পরে মা বলেছিল, ওদের নাড়ি শুকিয়ে গেছে, ওরা আর বাঁচবে না। এটিই আমার প্রথম দেখা নরনারায়ণ সেবা। ‘নরনারায়ণ’ এবং ‘সেবা’, এই দুটো শব্দ শেখা প্রথম।

 

[চলবে…]

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4892 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...