শচীন-কুমার জৈন
ভূপাল, মধ্যপ্রদেশের ‘ভিকাস সম্বাদ’-এর সচিব ও অধ্যক্ষ শচীন কুমার জৈন ‘রাইট টু ফুড’ বা খাদ্যের অধিকার মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রাজ্য-উপদেষ্টা। শচীন রাজ্য সরকারের সোশ্যাল অডিট সোসাইটির অন্যতম সদস্য।
অনুবাদ : অপর্ণা ঘোষ
আমরা মনে হয় এক অভিশপ্ত সমাজে পরিণত হচ্ছি প্রতিদিন, যে সমাজ তার নিজেরই কৃতকর্মের ফলশ্রুতিগুলির থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকে। যে সমস্যা ও ঘটনাবলীর মুখোমুখি হচ্ছি প্রতিনিয়ত, তার বৈজ্ঞানিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কার্যকারণ ও ফলাফলগুলোকে স্বীকার করতে না-পারার ব্যর্থতাই আমাদের সমাজের চারিত্র্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স রিপোর্ট-এর ক্রমতালিকায় ভারতের স্থান ৫০ না ১০০, র্যাঙ্কিং-এর পদ্ধতি সঠিক না বেঠিক, পাকিস্তান ভারতের আগে না পরে – ‘ক্ষুধা’-বিষয়ক যাবতীয় আলোচনা বা বিতর্ক এই লজ্জাজনক পরিসরেই আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। বোঝা যায়, আমাদের মনোযোগ সরে গিয়েছে ক্ষুধার প্রকৃত কারণ থেকে অন্য নানা দিকে।
সবার প্রথমে গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স বিষয়টিকে একটু তলিয়ে বোঝা দরকার। ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউশন (আইএফপিআরআই) বেশ কয়েক বছর ধরেই এই সমীক্ষা-রিপোর্ট প্রকাশ করে আসছে। গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স ক্ষুধার মান মূল্যায়নের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে শিশুর পুষ্টির দিকটিতে গুরুত্ব আরোপ করেছে। এটা অত্যন্ত জরুরি, কারণ সাধারণভাবে বৃদ্ধিকেন্দ্রিক উন্নয়নের হুল্লোড়ে শিশুদের ছবিটা বাদ পড়ে যায়। সত্যিটা হল, গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স-এর বিষয়টিকে জীবনচক্র ও সামাজিক-অর্থনৈতিক কাঠামো ও নীতির প্রেক্ষিতে বোঝা দরকার। আর তখনই এই পরিসরটি অনেক বৃদ্ধি পায়। লিঙ্গবৈষম্য, শিশুবিবাহ, নিরাপদ মাতৃত্ব, এবং জন্মদানসংক্রান্ত অধিকার, মাতৃত্বকালীন অধিকার, প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণ, এবং জনসম্প্রদায়ের এই সম্পদের ওপর অধিকার, আত্মপরিচয়ের অধিকার, সম্প্রদায় ও জাতভিত্তিক অস্পৃশ্যতা ও হিংসা থেকে মুক্তি এবং কৃষক শ্রমিকের অধিকার রক্ষা এই সবই আলোচনার অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে।
ভারতবর্ষে ১০০.৪ মিলিয়ন মানুষ তফশিলি ও উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত। তাঁদের নিজস্ব সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিচয় ও জীবনযাত্রার স্বকীয়তা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রাকৃতিক সম্পদের সুচিন্তিত ব্যবহারের মধ্য দিয়ে তাঁরা খিদেকে জয় করে এসেছেন। কিন্তু বেশ কিছু বিশ্বায়িত অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনা তাঁদের নিজস্ব জমি-জল-জঙ্গলের বাস্তু থেকে উচ্ছেদ করেছে। তাঁরা হারিয়েছেন তাঁদের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার।
ইউনিসেফ-এর ২০১৬-১৭-র প্রতিবেদন ‘এ রিপোর্ট অন নিউট্রিশন সিচুয়েশন অফ ইন্ডিয়া’জ ট্রাইব্যাল চিলড্রেন’ আমাদের জানায়, যখন পরিবার ও সমাজ খাদ্যের নিরাপত্তার অভাবে ভোগে তখন অপুষ্ট শিশুর জন্ম অবশ্যম্ভাবী। এ এমনই এক অপুষ্টির ছবি যাকে সহজে বদলে ফেলা যায় না। বিশ্বের অনূর্ধ্ব ৫ বছর বয়সি শিশুমৃত্যুর এক-তৃতীয়াংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অপুষ্টির কারণে ঘটে। এই পরিস্থিতির পেছনে রয়েছে গার্হস্থ্য অভাব, খাদ্য নিরাপত্তার অনুপস্থিতি, মেয়েদের পর্যাপ্ত পুষ্টি না-মেলা, শিশুর জন্য অপর্যাপ্ত মাতৃদুগ্ধ এবং অপরিকল্পিত জীবনযাত্রা। উল্লেখ্য, জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার চতুর্থ পর্যায়ের রিপোর্টে (২০১৫-১৬) কিন্তু আদিবাসী সম্প্রদায়ের কতজন শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে, তার হিসেব পাওয়া যায় না।
জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার তৃতীয় পর্যায়ের রিপোর্ট (২০০৫-০৬) অবশ্য বলছে, উপজাতি সম্প্রদায়ভুক্ত শিশুদের ৫৪% (৬.২ মিলিয়ন) ধারাবাহিক ক্ষুধার কবলে, এবং অপুষ্টিজনিত রোগ ও অস্বাস্থ্যের শিকার। বেশ কিছু রাজ্য – অন্ধ্রপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, ওডিশা, রাজস্থান, তেলেঙ্গনায় ক্ষুধাজনিত অস্বাস্থ্যের শিকার ৪.৭ মিলিয়ন শিশু।
সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব হল উপজাতি সম্প্রদায়কে ক্ষুধার কবল থেকে মুক্ত করা। ২০০৬ সালে ভারতীয় সংসদ তফশিলি উপজাতি এবং অন্যান্য বনবাসী আইন (অরণ্যের অধিকার-বিষয়ক আইন) প্রণয়ন করে। আইনের মুখবন্ধে বলা হয়েছে, আদিবাসী উপজাতি সম্প্রদায় ঐতিহাসিক অবিচারের শিকার। ফলত ভারত সরকার এই আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বঞ্চিত উপজাতি সম্প্রদায়ের পুনর্বাসন ও অরণ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে চায়। এই আইনটি বলে, উপজাতি ও অন্যান্য বনবাসী সম্প্রদায়ের ১০ একর অরণ্যভূমির ওপর আইনসঙ্গত অধিকার থাকা উচিত। এই আইনে সম্প্রদায়ের অন্যন্য অধিকারকে এই অধিকারের সঙ্গে সমন্বিত করার কথা বলা হয়েছে, যাতে ছোটখাটো বনজ দ্রব্য – শুকনো কাঠ, ভেষজ, মাছ এবং অন্যান্য জলজ উৎপাদন, ফল ও শাকসবজির ওপর অবাধ অধিকার তাঁরা ভোগ করতে পারেন। বলা বাহুল্য, আদিবাসী উপজাতিদের জন্য মর্যাদার সঙ্গে জীবনযাপনের ব্যবস্থা করা এবং খিদের কবল থেকে তাঁদের মুক্ত করাটা সরকারের এক অবশ্যপালনীয় সাংবিধানিক কর্তব্য।
উপজাতি উন্নয়ন মন্ত্রকের প্রকাশিত তথ্যানুসারে, এই বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত ৪১.৬৫ লাখ ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়ের দাবি নথিভুক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১৮.৪৭ লাখ দাবি খারিজ হয়েছে, যার বেশিরভাগ মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড় এবং কর্নাটক থেকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রত্যাখ্যানের কোনও কারণ দর্শানো হয়নি। উপজাতি সম্প্রদায়ের সামনে এখনও দীর্ঘ পথ, দেশে বিদ্যমান ঔপনিবেশিক অবশেষের পীড়ন থেকে মুক্তি পেতে যা তাকে অতিক্রম করতে হবে।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করতে হবে দেশকে, খুব জরুরি ভিত্তিতে – কর্মসংস্থান ছাড়া আদৌ খাদ্য নিরাপত্তা অর্জন করা সম্ভব কিনা। আন্তর্জাতিক শ্রম দফতরের ‘ওয়ার্ল্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল আউটলুক’ (২০১৭)-র প্রতিবেদন বলছে, ২০১৬ সালে ভারতে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ছিল ১.৭৭ কোটি। প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়েছে যে, কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতার ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে বাধ্য। কয়েক লাখ পরিবার এবং কয়েক কোটি শিশু দিনের পর দিন অনাহারে থাকতে বাধ্য হবে। অন্যদিকে গ্রামের মানুষের শহরমুখি অভিযাত্রা ক্রমাগত বাড়বে। দুঃখজনক সত্যিটা হল, নগরোন্নয়ন নীতিগুলো সরকার ও সমাজকে বাধ্য করবে এই শহরমুখি মানুষগুলিকে অপরাধী ও কদর্য হিসেবে চিত্রিত করতে। কৃষিসমস্যা ও কৃষকদের আত্মহত্যা ক্ষুধাসূচকের হারকে আরও ঊর্ধ্বগামী করবে।
২০০৮ থেকে ২০১৫, এই আট বছরে ৬২.৪০ লাখ সদ্যোজাত শিশু প্রাণ হারিয়েছে। উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান, বিহার এবং মধ্যপ্রদেশ – এই চারটি রাজ্যে খাদ্য নিরাপত্তার অভাব সবচেয়ে বেশি এবং সদ্যোজাতের মৃত্যুর ৫৬%-এর কারণ খাদ্যাভাব। এই আট বছরে ১.১১ কোটি শিশু এই চার রাজ্যে তাদের পাঁচ বছরের জন্মদিনের মুখ অবধি দেখেনি। উল্লেখ্য, ২০১৪-১৫-র বাজেটে একটি বিশেষ ক্ষেত্র রাখা হয়েছে, ৩১৮৯০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে নারী ও শিশুকল্যাণে যা ২০১৬-১৭-এর মধ্যে ব্যয় করার কথা। অথচ ৭৯৫১ কোটি টাকা এখনও কাজে লাগানোই হয়নি।
ভারতবর্ষে প্রায় ২.৮ কোটি গর্ভবতী মহিলা প্রতিবছর নথিভুক্ত হন যার মাত্র ৫১.২% মহিলা প্রসূতির জন্য বরাদ্দ চারটি চেক আপের সুযোগ পান। খুবই আশ্চর্যজনক যে, সরকার মাতৃত্বকালীন এই সামান্য সুবিধেগুলির জন্যও সীমারেখা টেনেছেন প্রসূতির কেবল একটি শিশুর জন্যই। আর প্রসূতির বয়স অবশ্যই হতে হবে ১৯-এর বেশি। বয়স এর কম হলে এবং দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের সময় এই সুবিধে আর পাওয়া যাবে না। এই অদ্ভুত সংস্থানটি বিধৃত আছে জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনে।
জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার (২০১৫-১৬)-র তথ্যানুসারে ৪১.৬% শিশু প্রথম মাতৃদুগ্ধ পায় জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যে এবং ৫৪.৯% শিশু শুধুমাত্র মাতৃদুগ্ধের ওপর নির্ভর করে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত। মাত্র ৪২.৭% শিশু ৬-৮ মাস বয়সের মধ্যে মায়ের দুধ ছাড়া অন্য পরিপূরক খাবার পায়। মাত্র ৮.৭% শিশু ৬ মাস থেকে ২ বছরের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিপূরক খাবার পায়। এই অদ্ভুত ফারাকই চোখ খুলে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
এই রকম একটা পরিস্থিতিতে ক্ষুধার সঙ্গে লড়াই করার একটা রাস্তা খোলা আছে। তা হল, স্থানীয় সংস্থাগুলিকে সিদ্ধান্ত ও নীতি নির্ধারণের ক্ষমতা প্রদান করা এবং পুষ্টি কর্মসূচিতে সংযুক্ত করা। মুশকিল হল, সরকার বিশেষ করে নারী ও শিশু উন্নয়ন দফতর এবং খাদ্যপ্রক্রিয়াকরণ দফতর নিজেরাই নারীগোষ্ঠী এবং বৃহৎ অর্থে সমাজের ওপর ভরসা রাখে না। এদের প্রাইভেট সেক্টরকে তোল্লাই দেওয়া বা উন্নয়ন প্রকল্পে ‘ডিরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার’ নীতির গুণগান করার প্রবণতাকে ধ্বংস করাটা আশু প্রয়োজন।
হাম দো হামারে দো- কে যদি সরকারের ঘোষিত নীতি হিসেবে স্বীকার করে নিই, সেক্ষেত্রে প্রসূতিকে দ্বিতীয় গর্ভের জন্য সুযোগসুবিধে না দেওয়াটা চূড়ান্ত অমানবিক ও অগণতান্ত্রিক।