নিছক সমাপতন ছাড়া একে আর কীই বা বলা যেতে পারে! ২৮ সেপ্টেম্বর ঝাড়খণ্ডের সিমডেগায় ১১ বছরের সন্তোষী কুমারীর অনাহারে মারা যাওয়ার খবর নিয়ে হইচই শুরু হওয়ার দু’সপ্তাহ না-পেরোতেই ১১ অক্টোবর ‘ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউট’ (আইএফপিআরআই) ২০১৭-র ‘গ্লোবাল হাঙ্গার ইনডেক্স রিপোর্ট’ প্রকাশ করল। পৃথিবীর ১১৯টি অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে ক্ষুধার চেহারাটা ঠিক কেমন, তা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনায় দেখা গেল ভারতের স্থান ১০০ নম্বরে – এমনকী প্রতিবেশী বাংলাদেশেরও পিছনে।
ঠিক কী হয়েছিল সন্তোষীর? সিমডেগার করিমাটি গ্রামের বেশ কয়েকটি পরিবারের রেশন কার্ডে আধার ‘লিঙ্ক’ করা হয়নি। ফলে প্রায় ছ’মাস আগে থেকেই রেশন আটকে দেওয়া হয়েছিল তাদের। কোনওমতে খেয়ে না-খেয়ে দিন কাটছিল। এরই মধ্যে পুজোর ছুটি পড়ে যাওয়ায় স্কুলে মিড-ডে মিলও বন্ধ হয়ে যায়। মারা যাওয়ার আগে শেষ এক সপ্তাহ আক্ষরিক অর্থেই কোনও খাবার জোটেনি মেয়েটির। ওর মায়ের কথায়, একেবারে ঝিমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত বারবার দু’টো ভাত খাওয়ার ইচ্ছে জানিয়েছিল সন্তোষী। কিন্তু ঘরে দানাটুকুও ছিল না।
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘রাইট টু ফুড ক্যাম্পেন’ ও ‘এনআরইজিএ ওয়াচ’-এর স্থানীয় শাখার কর্মীদের অভিযোগ, গ্রামের রেশন ডিলার তাদের বরাদ্দ চাল দিতে অস্বীকার করে, কারণ, তাদের রেশন কার্ডে আধার নম্বর লিঙ্ক করা ছিল না। সিমডেগা জেলার জলডেগা ব্লক অফিসও এই অভিযোগের সত্যতা স্বীকার করেছে। দেশের সর্বোচ্চ আদালত যেখানে ২০১৩ সালেই পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছে যে, আধার নম্বর না-থাকার কারণে উপভোক্তাদের কোনও উন্নয়নমূলক কর্মসুচি থেকে, বিশেষ করে ভর্তুকিপ্রদত্ত খাদ্যবণ্টন কর্মসুচির আওতা থেকে কোনওভাবেই বাদ দেওয়া যাবে না, সেখানে এধরনের ঘটনা একদিকে যেমন ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘন, অন্যদিকে তেমনই চূড়ান্ত আদালত-অবমাননারও সামিল। কিন্তু বাস্তব চিত্র হল, শুধু ঝাড়খণ্ড নয়, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র-সহ বেশ কয়েকটি রাজ্যেই আধার লিঙ্ক না-থাকার কারণে দরিদ্র ও অতি-দরিদ্র তালিকাভুক্তদের রেশন দিতে অস্বীকার করার ঘটনা আকছারই ঘটছে।
ঘটনাচক্র এমনই, সেপ্টেম্বরেরই ৭ তারিখ ঝাড়খণ্ডের খাদ্য দফতরের সচিব সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়েছিলেন, রাজ্য রেশন কার্ডে আধার সংযুক্তিকরণের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করেছে। প্রশ্ন হল, রাজ্য যদি রেশন কার্ডে আধার সংযুক্তিকরণের ক্ষেত্রে ১০০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করে ফেলেই থাকে, তা হলে সন্তোষীর পরিবার এল কোথা থেকে? বলা বাহুল্য, এ প্রশ্নের জবাব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি রঘুবর দাসের সরকার। উলটে জানিয়ে দিয়েছে, সন্তোষীর মৃত্যুর কারণ ভুখমরি নয়, তার অন্য রোগ ছিল। হাস্যকর প্রস্তাব, কিন্তু প্রশাসনের কি রসবোধ থাকতে নেই?
… সন্তোষীরা কোথায় থাকে, কোথা থেকে আসে, প্রশাসনিক নথিতে আদৌ ধরা থাকে কিনা তাদের ইতিহাস-ভূগোল – সরকার সহজবোধ্য কারণেই সেসব প্রশ্নের উত্তর দিতে চায় না। কিন্তু দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার নিরিখে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর আপনা থেকেই স্পষ্ট হয়ে আসতে থাকে। যদি মনে রাখি আমাদের দেশে না-খেয়ে মরে যাওয়ার বিধিলিপি কেবল ১১ বছরের কিশোরীটির একার নয় বরং অনাহার-মৃত্যুর মিছিলে সে কেবল আরও একটি সংযোজন-মাত্র, যদি মনে রাখি গত পাঁচবছরে বিদর্ভে কৃষকদের আত্মহত্যার পরিসংখ্যান, যদি মনে রাখি ডুয়ার্সের বন্ধ চা-বাগানগুলোতে শ্রমিকদের অর্ধাহার-যাপনের বিবর্ণ চালচিত্র, যদি মনে রাখি ওডিশায়-ছত্তীসগঢ়ে-মধ্যপ্রদেশে-বিহারে-উত্তরপ্রদেশে শিশুদের অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর অন্তহীন খতিয়ান – অনায়াসে বুঝে নেওয়া সম্ভব কেন বিশ্বের ক্ষুধার মানচিত্রে ১১৯ দেশের মধ্যে ভারতকে ১০০ নম্বরে জায়গা পেতে হয়, কেন এমনকী যুদ্ধদীর্ণ ইরাকও সে তালিকায় আমাদের পিছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারে। কেন আমাদের বসতে হয় আফ্রিকার দক্ষিণ-সাহারা অঞ্চলের সঙ্গে একই সারিতে – যা কিনা বিশ্বের ক্ষুধার্ততম মহাদেশ বলে পরিচিত…
অস্বস্তিকর অথচ এড়াতে না-পারা সেসব কূটপ্রশ্নের উত্তরের চারপাশে জমে থাকা অন্ধকারে ফুটে উঠতে থাকে অপুষ্টিতে ভোগা আরও অনেক সন্তোষীর অনাহারক্লিষ্ট, শীর্ণ মুখ। সেইসব সন্তোষী ও তাদের বাবামায়েরা – মাথায় পোঁটলাপুটলি, কোলে-কাঁখে অসংখ্য সন্তানসন্ততি আর গলা থেকে নাভি পর্যন্ত জ্বলতে থাকা বুভুক্ষার আগুন নিয়ে গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ পার হয়ে হেঁটে আসা এই চৌকো উপমহাদেশের নামগোত্রহীন সব মানুষ… সন্দেশখালি দু’নম্বর থেকে সার ভাটায় মাতলা পেরিয়ে ডকঘাটের কাদা ভেঙে হেঁটে আসা সুমিত্রা ঘোড়ুই, সরস্বতী জানা… সুদূর রঙ্গারেড্ডি থেকে, পূর্ব গোদাবরী থেকে, কালাহান্ডি থেকে, কন্ধমাল থেকে এককাপড়ে হেঁটে আসা জানকীবাঈ, পার্বতীচরণ সোয়াইঁ… মছলন্দপুর থেকে, মেহেন্দিপট্টম থেকে, লাতেহার থেকে, ভবানীপটনা থেকে, জগদলপুর থেকে, অবুঝমাঢ় থেকে, দান্তেওয়াড়া থেকে, রায়পুর থেকে হেঁটে আসা অপুষ্টি আর অনাহারের সেই মিছিল ক্রমে দীর্ঘ, দীর্ঘতর হয়ে উঠতে থাকে…
অনন্ত ভুখমিছিলের সেই অসংখ্য মানুষকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের ডিসেম্বর সংখ্যার মূল বিষয়-ভাবনা, শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার সেই অমোঘ উচ্চারণ থেকে ধার নিয়ে যার নাম আমরা দিয়েছি ‘ভাত নেই, পাথর রয়েছে’। ডাক্তার বিনায়ক সেন, সাংবাদিক-সমাজকর্মী শচিন কুমার জৈন-সহ আরও অনেকের লেখা নিবন্ধগুচ্ছের মধ্যে দিয়ে যেমন ধরতে চাওয়া হয়েছে ক্ষুধার বহিরঙ্গের ক্লিন্নতাকে, তেমনই বুঝতে চেষ্টা করা হয়েছে তার সামাজিক-আর্থনীতিক কার্যকারণ, সেসবের আড়ালে থাকা রাজনীতির সুদূরপ্রসারী ইঙ্গিত ও করুণাঘন বুভুক্ষাব্যবসায়ীদের কূট অবস্থানটিকেও।
বাঃ… দারুণ সম্পাদকীয় তো বটেই… তার সাথে আপনাদের কাগজ বেশ ইউজার ফ্রেন্ডলি হয়ে উঠছে ক্রমশ। আগের সংখ্যা থেকেই সূচিপত্র পেয়েছিলাম, এবার সম্পাদকীয়তেই সরাসরি লিংক দেওয়া অনেক লেখার… চমৎকার… অভিনন্দন…
স্টেশনমাস্টারের এই ঘোষণালিপিটিকে অনায়াসে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রবন্ধ বলা যেতে পারে, যা একইসাথে পাঠকের চাহিদাকে উঁচু তারে বেঁধে দেয়। শুরু করা যাক।
বাঃ… দারুণ সম্পাদকীয় তো বটেই… তার সাথে আপনাদের কাগজ বেশ ইউজার ফ্রেন্ডলি হয়ে উঠছে ক্রমশ। আগের সংখ্যা থেকেই সূচিপত্র পেয়েছিলাম, এবার সম্পাদকীয়তেই সরাসরি লিংক দেওয়া অনেক লেখার… চমৎকার… অভিনন্দন…