স্মৃতিপরব: পর্ব ২

নীহারকান্তি হাজরা

 

সানুদেশের দিন

পর্ব ১

ছেদামবুড়িপাই

আমাদের জনপদের নাটমঞ্চের ঠিক পাশেই একটা রেশনের দোকান। মোটা চাল, মুসুরডাল, চিনি আর কেরোসিন। কয়েক টাকার বিনিময়ে এগুলি পাওয়া যেত। টাকার ভাগটা ছিল এরকম: সর্বনিম্নে ছেদাম। চার ছেদামে এক পয়সা। পয়সাটি ছিল একটি তামার চাকতি। ছেদামগুলি এর চারভাগের একভাগ মাপের, ধাতুর গোলাকার মুদ্রা। অনেক পরে পয়সার মাঝখানে শিশুদের কড়ে আঙুল গলে যায় এমন মাপে কেটে নেওয়া হল— ফুটো পয়সা। পরে বুঝব এটা হল যুদ্ধে তামার প্রয়োজনে। চার পয়সায় এক আনা। আনা ছিল কিনারায় ঢেউ তোলা একটা গোলাকার চাকতি— ধাতুটা মিশ্র জার্মান সিলভার। সামনে রাজা, পিছনে মূল্যমান। এর নিচে ছিল ‘আদানি’। আধ আনি > আদানি। এটা ছোট চৌকো, উজ্বল সাদা— ধাতু একই। দু-আনিটাও ছিল চৌকো। কোনাগুলো গোল। পিতলের রং, হলুদ। এর উপরে সিকি। এটা গোলাকার রুপোর। সিকির উপরে আধুলি বা আট আনা। এটাও গোলাকার। রুপো। সবার উপরে এক টাকা। এটা রুপোর। এর আর একটা মান স্যাঁকরার দোকানের এক ভরি। ষোলো আনায় এক টাকা। মুদ্রার এই মান চলে এল সমাজব্যবস্থার নানা প্রয়োজনে। কোনও বিষয়ে পাড়ার সকলে ঐকমত্য হলে এটার প্রকাশভঙ্গি— ষোলো আনার মত। কোনও সম্প্রদায়ের দুর্গাপুজো বা সামাজিক অবস্থান— পোদ্দারপাড়া ষোলো আনা। পুকুরে জাল ফেলে ধরা মাছের ভাগ— এক আনা, চার আনা, এক পয়সা বা মুদ্রামানের ষোলো আনার যে-কোনও অংশ। মাছ ধরার পরে পুকুরের পাড়ে প্রাপ্য অংশ অনুযায়ী ভাগ। ষোলো আনা চলে এল জমির ভাগেও। জমি বা ফসলের আরও সূক্ষ্ম ভাগ জানব রজনী পণ্ডিতের পাঠশালায়।

ঠিক পাঁচ বছর বয়সে আমার ওপরের দিদির হাত ধরে যাতায়াত শুরু হল রজনী পণ্ডিতের পাঠশালায়। ১৯৪৩। ভয়াবহ সে-বছরের কিছু স্মৃতির কথা আগেই বলেছি। পাঠশালাটি জনপদের একেবারে শেষ প্রান্তে— রাজাপাড়ায়। বিদ্যাসাগর মশায়ের বেগুনি রঙের মলাটের, আকারে ছোট, বর্ণপরিচয় আর ধারাপাত, একটি স্লেট আর পেন্সিল, আর একটি বসবার আসন। একটি চারকোনা কাপড়ে সবগুলি ভাঁজ করা। কাপড়টির একটি কোনায় বাঁধা দড়ি দিয়ে চৌকো কাপড়টিকে খামের মতো ভাজ করে বেঁধে নিলে তার নাম হল ‘পাততাড়ি’। পাঠশালার শেষে তা রোজই আমাদের গুটিয়ে নিতে হত, যদিও এই ‘পাততাড়ি গুটোনো’-র বৃহত্তর অর্থ বুঝেছিলাম অনেক পরে। পাঠশালাটি বসে খড়ের একটি প্রশস্ত চালায়। পণ্ডিতমশায় বসেন একটি জলচৌকিতে সেই চালাঘরের প্রশস্ত মেঝের একটি কোণায়। বেশ ভারি চেহারা। খাটো ধুতির উপর ফতুয়া। কাঁচাপাকা খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর খাড়া চুল। তাঁর হাতে একটি হাত দেড়েক লম্বা ছড়ি। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ছাত্ররা সঙ্কীর্ণ ফাঁক রেখে মেঝের উপর বসে। একই পরিসরে চারটি শ্রেণির সমবেত অসমস্বর উচ্চকণ্ঠ বাগবিন্যাসের আবর্তমান ঢেউয়ের মধ্যেও এর পৃথকীকরণের ক্ষমতা ধরেন পণ্ডিতমশায়— কোন শ্রেণির ছাত্রটি ভুল পড়ছে। তাঁকে কখনও কারও অঙ্গ স্পর্শ করতে দেখিনি। সেটি সংসাধন করত তাঁর বেত্রদণ্ড। তাঁর আনুমামের সময়-পর্বই ছিল তাঁর পাঠদানের সময়কাল। শেষ পর্যায়ে কোনও শ্রেণির একটি নির্দিষ্ট ছাত্র তার শ্রেণির সামনে দাঁড়িয়ে পণ্ডিতমশায়ের নির্দিষ্ট পাঠ দিত এবং নিত। আর একটা আবশ্যিক বিষয় ছিল ‘নামতা ঘোষা’। ঘোষক ছাত্রের রোজ বদল হত। সে বলার পর আমরা সবাই একসঙ্গে বলতাম। গুণের ভাগের পরে আসত গন্ডার ভাগ। তারপর ‘বুড়ি কিয়া’। এক বুড়ি, দুই বুড়ি, তিন বুড়ি, চার বুড়িতে এক গন্ডা। চার গন্ডায় এক পণ। চার পণে এক কাহন। চার কাহনে এক আড়া। আবার শলি কিয়া। এটা হত পাই মাপ ধরে। পাইটা হল কাঠের গোলাকার একটা নির্দিষ্ট মাপের পাত্র। মাঝখান থেকে ক্রমসঙ্কীর্ণ হয়ে একটু ওপরে বৃত্ত শেষ করেছে। তলা থেকে উচ্চতা ছয় ইঞ্চির মতো। এটা দিয়ে যাবতীয় ফসল মাপা হত। জেলায় দু-ধরনের পাই চলত— বাঁকড়ি পাই আর রাজহাটি পাই। বাঁকড়ি পাই আকারে একটু বড়। কিন্তু কোথায় এই রাজহাট? এটা জানার জন্য আমাকে পরে বেশ সিঁড়ি ভাঙতে হবে।

মাঠের ফসল মালিকের খামারে তুলত ভাগচাষিরা। তারপর যখন ধানের ভাগ হত, তখন জমির মালিক একটু বেশি পেত— মধ্যসত্ত্ব। বাঁকড়ি পাইতে সেই ভাগ হত। আবার অভাবের সময় যখন চাষিরা ধান ঋণ নিত, তখন জমির মালিক দিত রাজহাটি পাইতে। কিন্তু ফেরত নিত বাঁকড়ি পাইতে, তার সঙ্গে যোগ হত ‘বাড়’। এই ‘বাড়’ হল সুদ। পাইয়ের নিচে ছিল এক পোয়া আর এক ছটাক। এগুলো রাজহাটি পাইয়ের মতো হত— পিতলের। ছটাক সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম মান। চার ছটাকে এক পোয়া। এক পাই সমান এক সের। এই সের মাপ চলত মুদির দোকানের যাবতীয় বস্তু কেনায় দাঁড়িপাল্লা ধরে। কিন্তু তার আগে রজনী পণ্ডিতের শলি কিয়া। সমস্ত উৎপন্ন শস্য আর মুড়ি বেচাকেনা হত শলির মাপে। কুড়ি পাইতে এক শলি। আট শলিতে এক ‘মাপ’। আবার ধানের খড়ের মাপ: চার আঁটিতে এক গন্ডা। চার গন্ডায় এক পণ। ষোলো পণে এক কাহন। এই সব হিসেবগুলো দরকার পড়ত ঘর-গৃহস্থের। যাদের এখনও গরু আছে, এখনও তাদের বোধহয় খড় কিনে রাখতে হয় গন্ডা আর পণ মাপে। গ্রামাঞ্চলের গভীরে এখনও চলে পাই মাপ। যারা মুড়ি ভেজে বিক্রি করে সেখানে চলে পাই মাপ। আর সের মাপের বাটখারা ছিল। এটা একটা নির্দিষ্ট মাপের পুরু চ্যাপ্টা গোলাকার চাকতি। চলতি নাম ছিল পড়েন। এর নিচে ছিল— আধসের, এক পোয়া আর এক ছটাক। উপরে— পাঁচ, দশ, পঁচিশ আর চল্লিশ সের। চল্লিশ সেরে ছিল এক মণ। মুদির দোকানে এই মাপগুলোর জন্য পৃথক দাঁড়িপাল্লা ছিল। প্রথম দিকটায় পাইপের মতো সছিদ্র একটা কাঠের দণ্ডের ভিতরে দড়ি গলিয়ে দু-পাশে পাল্লা ঝোলানো হত। এই সময়টায় মুদি খুচরো পয়সা কম পড়লে পয়সার মাপে কড়ি দিত। সামুদ্রিক এই কড়িগুলো বস্তায় রাখা থাকত। বহু যুগ পরে এর রকমফের আমরা দেখব সরকারি প্রতিষ্ঠান ছাড়া সর্বত্র। এমনকি সিনেমা হলের টিকিটেও পাওনা মেটানো হত চকলেট দিয়ে। আরও পরে এল লোহার কাঁটা দেওয়া দাঁড়িপাল্লা।

তখন খড়িমাটিও বিক্রি হত পাই মাপে! জনপদ ছাপিয়ে যে পথটা চলে গেছে রঙ্কিনীতড়া পার হয়ে লেদি পাহাড়ের প্রসারিত অংশ ভেদ করে পশ্চিমে, সেখানে ডানহাতে ছিল একটা ডুংরি— অনুচ্চ সাদা-মাটির পাহাড়: খড়িডুংরি। এটা গর্ত করে তোলা হত খড়িমাটি। গরুর গাড়ি বোঝাই করে বিক্রি চলত পাই মাপে লোকের দরোজায় দরোজায়। দুর্গাপূজার আগে প্রত্যেক সদর দরোজার বাইরেটা সাদা রং করার প্রয়োজন পড়ত, এর উপর গিরিমাটি দিয়ে লেখা হত, ‘‘এসো মা আনন্দময়ী দীনের কুটিরে”।

 

বনজ ফলার— পিয়াল-বেঁচ-ভুঁড়ুর-কুসুম

সে-সময় পাঠশালা বা স্কুলে টিফিন নিয়ে যাওয়ার কোনও রীতি ছিল না। তবে রজনী পণ্ডিতের পাঠশালার ফিরতি পথে দিদি রাজাপাড়ার পথের ধারে আধপয়সায় এক খালা করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে কিনত হয় পিয়াল, নয় ভুঁড়ুর, বেঁচ (বৈঁচি) কিংবা গাছে পাকা সুমিষ্ট কেঁদ, এইসব বনজ ফল। পিয়ালের প্রসিদ্ধি আছে, কিন্তু ভুঁড়ুর আদৌ স্বাদু নয়, বেঁচ মোটামুটি। বনভূমিতে ঢোকার আগের কোনও উচ্চভূমিতে চিকন সবুজ পাতার ঝোপালো গাছ এই ভুঁড়ুর। বসন্তে চমৎকার সুবাস নিয়ে সাদা চতুষ্পর্ণী ফুল সেই উচ্চভূমিকে আলো করে ফুটে থাকত। তারপর হত ভুঁড়ুর ফল, হরিতকির মতো। পাকলে ওপরের ত্বক নরম হয়ে যায়। এর ওপর চাপ দিলেই ভেঙে দু-আধা হয়ে পড়ে। এর ভিতরের শাঁস খাদ্য। বেঁচও মিষ্টি ফল। এগুলির আহরণ পরিশ্রমসাধ্য। উচ্চভূমি বা পাহাড়ের পাদদেশ জুড়ে লম্বা কাঁটাবহুল বনঝোপ। বনভূমিতে পা রাখলেই মনে হত, বসন্তের ডাক এরাই প্রথম শুনতে পায়। ঋতুর সংক্রমণ ঘটলেই পুরনো বাস ফেলে দিয়ে এরা শাখাসার হয়ে যায়। তারপর একটু একটু করে শুরু হয় রং ধরার কাজ। ছোট প্রায় গোল পাতাগুলি ক্রমে স্বচ্ছ লাল, বেগুনি, বেগুনি-হরিৎ, ফিকে সবুজ আর তার অনেক পরে সবুজ হয়। বনভূমিতে রঙের বাহার। এর পর আসে পুঞ্জ-কেশর ফুল। তারপর ফল। গাঢ় বেগুনি গোল ছোট ফল। সুমিষ্ট। আর একটি ফল পাওয়া যেত— আধ-পয়সায় এক খালা। কুসুম। গাছটি বনস্পতি। চিরহরিৎ। এর শাখার পাতাগুলি বসন্তের শুরুতে লাল রঙের বহু স্তর রেখে তারপরে সবুজ হয়। চোখের আকারের এই ফল অম্লমধুর। আর পাওয়া যেত কাঁচা তেঁতুল আর কাঁচা আম, আঁটিসার খেজুর আর জাম। এটা আবার দু-ধরনের— ছোট আর বড়। ছোটগুলির নাম কাদাজাম আর বড়গুলি নোড়াজাম। শীতে পাওয়া যেত বুনো কুল। ইজেরের পকেটে রাখা নুন-লঙ্কা গুঁড়ো-সহ এর চোখ ছোট হয়ে আসা স্বাদ জিভের ডগার টুসকির সঙ্গে কিশোর বয়সের পরিনামী সত্য আর সেই লাল ধুলোর দুপুর একাকার হয়ে যেত। পথের পাশে তাদের একান্ত মূল্যবান ফলগুলি নিয়ে উবু হয়ে বসা সাঁওতাল মেয়েদের কলরবহীন বিপণি সেকালের কচি-কাঁচাদের এক এবং একমাত্র স্বাদু আশ্রয়স্থল ছিল। আমাদের একমাত্র টিফিন। এই জনপদের উচ্চ-বিদ্যালয়েও কেউ টিফিন নিয়ে যেত বলে কোনও স্মৃতি আমার নেই।

[ক্রমশ…]

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4954 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Trackback / Pingback

  1. স্মৃতিপরব: পর্ব ৩ – ৪ নম্বর প্ল্যাটফর্ম

আপনার মতামত...