পদ্মনাভ দাশগুপ্ত: মার্কসবাদে আধারিত ব্যাপ্ত মনন

আশীষ লাহিড়ী

 

…চুরাশি বছর বয়সে সদ্য-প্রয়াত পদ্মনাভ দাশগুপ্ত (১৯৪০-২০২৪) ছিলেন সেই হারিয়ে-যাওয়া ঘরানার মানুষ। বৃহৎ যৌথ মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। নিপাট ভদ্রলোক। অনুচ্চকিত, মৃদুভাষী, আদর্শবাদী মার্কসবাদী। পদার্থবিজ্ঞানের ভাল ছাত্র। পাইকপাড়ায় থাকবার সময় বিখ্যাত সেতারি মুস্তাক আলি খাঁ সাহেবের কাছে সেতার শিখেছিলেন, আধুনিক মার্কসবাদী মন নিয়ে সেই সঙ্গীতের ইতিহাস ও চরিত্র বিশ্লেষণ করেছিলেন, ছিলেন বিজ্ঞানের ইতিহাসের মার্কসবাদী ব্যাখ্যায় উৎসাহী, লিখতেন একটু ক্লাসিক-ধর্মী, প্রসাদগুণসম্পন্ন গদ্য। ছিলেন বিষ্ণু দে-র ভক্ত, সাহিত্যপত্র পত্রিকায় ‘বৈষ্ণব’ অরুণ সেনের সহযোগী। রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশ্রুত শিক্ষক প্রসূন দাশগুপ্ত তাঁর বন্ধু ও ভগ্নীপতি। এবং এত সবকিছুর পরেও অত্যন্ত জনপ্রিয় ছাত্রদরদি এক মাস্টারমশাই। স্মরণসভায় কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের পুরনো ছাত্ররা একবাক্যে সে-কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। নিজের খ্যাতি নিয়ে এতই উদাসীন যে বাংলায় এতদিন তাঁর একটিও বই বেরোয়নি। উনিশশো ষাট-সত্তরের বালখিল্য আমরা অবশ্য তাঁর ভক্ত ছিলাম। আমাদের মতো অনুজদের খানিক প্রশ্রয়ও দিতেন। কম লিখতেন। এক্ষণ, সাহিত্যপত্র এইরকম গুটি দুই-তিন পত্রিকায় কখনও-সখনও তাঁর প্রবন্ধ বেরোত। চিন্তাশীল, সংহত, মৌলিক। পঞ্চাশ-ষাট বছরের বেড়া ডিঙিয়ে সেইসব প্রবন্ধগুলি এতদিন পর আবার ছাপার অক্ষরে দেখতে পেয়ে ভাল লাগল। একটু দীর্ঘনিঃশ্বাস আর অপার আনন্দের সঙ্গে গালিলিও, চণ্ডালিকা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (নির্ঝর) বইটিকে দু-হাত পেতে গ্রহণ করলাম। প্রকাশক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় একটি ঐতিহাসিক কর্তব্য সম্পাদন করলেন।…

 

বিশ শতকের পঞ্চাশ-ষাট দশকের ভদ্রলোক বাঙালি মার্কসবাদী সাহিত্যিকদের একটি বিশিষ্ট চরিত্রলক্ষণ ছিল। মোটামুটি মার্কসীয় অর্থনীতি ও দর্শন, বিজ্ঞান, সাধারণভাবে শিল্প-সাহিত্য-নাটক-সিনেমা এবং বিশেষভাবে রবীন্দ্রনাথ আর ভারতীয় ও পাশ্চাত্য উচ্চ অঙ্গের সঙ্গীতে তাঁদের আগ্রহ ছিল, কারও কারও ব্যুৎপত্তিও ছিল। সাধারণত তাঁরা বাংলা ও ইংরেজি দুটো ভাষাতেই সিদ্ধ ছিলেন, কেউ কেউ আরও কোনও কোনও ভাষায়। তারপর কমিউনিস্ট পার্টি ছিন্ন থেকে ছিন্নতর, ভিন্ন থেকে ভিন্নতর হতে হতে একসময় এই ধরনের ব্যাপ্ত সংস্কৃতির মানুষরা কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন। হয়তো গুটিয়ে নিলেন নিজেদের। মার্কসবাদ চর্চার সঙ্গে সংস্কৃতি চর্চার যোগটা ক্রমে খুব প্রকোষ্ঠবদ্ধ এবং ফর্মুলা-নিবদ্ধ হয়ে পড়ল। একজন লেখক একই সঙ্গে শ্রেণিসংগ্রাম, বিজ্ঞান, সাহিত্য, চিত্রকলা আর উচ্চ অঙ্গের সঙ্গীত নিয়ে ভাবছেন বা লিখছেন, এটা আজ অভাবনীয়। সঙ্গীতের আলোচনা মূলত গানের বাণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ, মার্গসঙ্গীত তো কার্যত ব্রাত্য। অনেকে আবার অক্ষম রাজনৈতিক সাফাই দিয়ে বলেন, মার্গসঙ্গীত তো সামন্ততান্ত্রিক সংস্কৃতির আবর্জনা, আগামী জনগণতান্ত্রিক যুগে ওগুলি অপ্রয়োজনীয়। মার্কসীয় দর্শন যে একটা বিশ্বদর্শন; মানুষের কোনও মহৎ সৃষ্টিই যে তার কাছে অপাংক্তেয় হতে পারে না; স্বয়ং মার্কস যে বেঠোফেন, মোৎজার্ট, হান্ডেল, হেইড্‌ন প্রমুখ সঙ্গীতকারদের প্রতি অসীম শ্রদ্ধা পোষণ করতেন; এঙ্গেল্‌স নিজে হার্মনি নিয়ে চর্চা করেছিলেন— এসব তথ্য বোধহয় আজ সংবাদই।

চুরাশি বছর বয়সে সদ্য-প্রয়াত পদ্মনাভ দাশগুপ্ত (১৯৪০-২০২৪) ছিলেন সেই হারিয়ে-যাওয়া ঘরানার মানুষ। বৃহৎ যৌথ মধ্যবিত্ত পরিবারের মানুষ। নিপাট ভদ্রলোক। অনুচ্চকিত, মৃদুভাষী, আদর্শবাদী মার্কসবাদী। পদার্থবিজ্ঞানের ভাল ছাত্র। পাইকপাড়ায় থাকবার সময় বিখ্যাত সেতারি মুস্তাক আলি খাঁ সাহেবের কাছে সেতার শিখেছিলেন, আধুনিক মার্কসবাদী মন নিয়ে সেই সঙ্গীতের ইতিহাস ও চরিত্র বিশ্লেষণ করেছিলেন, ছিলেন বিজ্ঞানের ইতিহাসের মার্কসবাদী ব্যাখ্যায় উৎসাহী, লিখতেন একটু ক্লাসিক-ধর্মী, প্রসাদগুণসম্পন্ন গদ্য। ছিলেন বিষ্ণু দে-র ভক্ত, সাহিত্যপত্র পত্রিকায় ‘বৈষ্ণব’ অরুণ সেনের সহযোগী। রবীন্দ্রসঙ্গীতের বিশ্রুত শিক্ষক প্রসূন দাশগুপ্ত তাঁর বন্ধু ও ভগ্নীপতি। এবং এত সবকিছুর পরেও অত্যন্ত জনপ্রিয় ছাত্রদরদি এক মাস্টারমশাই। স্মরণসভায় কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের পুরনো ছাত্ররা একবাক্যে সে-কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। নিজের খ্যাতি নিয়ে এতই উদাসীন যে বাংলায় এতদিন তাঁর একটিও বই বেরোয়নি। উনিশশো ষাট-সত্তরের বালখিল্য আমরা অবশ্য তাঁর ভক্ত ছিলাম। আমাদের মতো অনুজদের খানিক প্রশ্রয়ও দিতেন। কম লিখতেন। এক্ষণ, সাহিত্যপত্র এইরকম গুটি দুই-তিন পত্রিকায় কখনও-সখনও তাঁর প্রবন্ধ বেরোত। চিন্তাশীল, সংহত, মৌলিক। পঞ্চাশ-ষাট বছরের বেড়া ডিঙিয়ে সেইসব প্রবন্ধগুলি এতদিন পর আবার ছাপার অক্ষরে দেখতে পেয়ে ভাল লাগল। একটু দীর্ঘনিঃশ্বাস আর অপার আনন্দের সঙ্গে গালিলিও, চণ্ডালিকা ও অন্যান্য প্রসঙ্গ (নির্ঝর) বইটিকে দু-হাত পেতে গ্রহণ করলাম। প্রকাশক সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় একটি ঐতিহাসিক কর্তব্য সম্পাদন করলেন। তিনি জানিয়েছেন, একটি লেখাও পদ্মনাভদার কাছে ছিল না। বহু কষ্টে সে-সব জোগাড় করে তাঁকে দেখিয়ে নিতে হয়েছে। কিছু অদলবদলও করেছেন। শরীর পটু থাকলে হয়তো আরও কিছু সংযোজন করতে পারতেন। শেষপর্যন্ত মৃত্যুশয্যায় বাক্‌রুদ্ধ অবস্থায় তিনি বইটি হাতে নিতে পেরেছিলেন, এটকুই সান্ত্বনা।

অন্য কিছু বলার আগে বইটির মর্যাদাবান প্রচ্ছদের জন্য সুস্নাত চৌধুরীকে একটু বিশেষ প্রশংসা করতেই হয়। নিম্নার্ধে কৃষ্ণাভ মহাকাশে গ্যালাক্সি আর তারা, আর উপরার্ধ্বে ঈষৎ কালচে লালের ঠাসা পটভূমিতে সাদা রঙে হাতের লেখার ধাঁচে নামলিপিটি বইয়ের ধীরোদাত্ত মেজাজটি সুন্দরভাবে ধরিয়ে দিয়েছে।

নাম থেকেই অনুমান করা যায়, প্রবন্ধ সংগ্রহটি দুটি পর্যায়ে বিভক্ত। প্রথম ভাগটিতে (পৃষ্ঠা ১৩-৯৭) বিজ্ঞানের ইতিহাস আর বিজ্ঞানের দর্শন বিষয়ে আটটি প্রবন্ধ। দ্বিতীয় ভাগে (৯৯-১৯৩) সঙ্গীত বিষয়ে এগারোটি প্রবন্ধ। একটি পরিশিষ্ট: ‘বিষ্ণু দের একটি প্রবন্ধ সম্পর্কে’ (১৯৪-২০১)। একটি সযত্নরচিত নির্দেশিকা বইটির ব্যবহারযোগ্যতা বাড়িয়েছে। বইতে আলোচিত অজস্র ব্যক্তি ও বিষয় সম্পর্কে কিছু টীকা থাকলে বইটি সর্বার্থে অনিন্দ্য হত।

 

বিজ্ঞানের ইতিহাস

এক অর্থে বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধগুলির খুঁটি হচ্ছেন গালিলিও। ১৯৬৮তে এক্ষণ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘মণ্ডলাকার, গালিলিও, ব্যক্তিনিরপেক্ষতা’ সে-সময়ে প্রভূত সাড়া জাগিয়েছিল। বিজ্ঞানের তত্ত্ব যে সরলরেখায় উদ্ভূত হয় না, ‘অসামান্য বিজ্ঞানী গালিলিওর পক্ষেও স্ববিরোধমুক্ত হওয়া সম্ভব হয়নি’— এই চমকে-দেওয়া বাক্যটিই তাঁর মনোভাব চিনিয়ে দেয়। কী ভুল করেছিলেন গালিলিও? তিনি ‘পতনশীল বস্তুর গতিপথ বিশ্লেষণকালে বৃত্তাকার গতির স্থায়িত্ব ও স্বাভাবিকত্ব স্পষ্টভাষায় কল্পনা করেছেন।’ গালিলিওর মতো মানুষেরও এমন ভুল কেন হয়; তার পিছনে কী-কী বদ্ধমূল ধারণা কাজ করে এবং কেন; নির্দিষ্ট যুগের সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি-দর্শন কীভাবে তার পিছনে সক্রিয় থাকে; তার এক চমকপ্রদ উন্মোচন এই প্রবন্ধ। যুগের নির্দিষ্ট পটভূমিতেই যে-কোনও যুগোত্তীর্ণ মানুষের সিদ্ধি ও ব্যর্থতার বিচার, এই সত্যটি মনে করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, ‘এসব কথা অবশ্য মার্কসবাদ বা অনুরূপ বস্তুবাদে বিশ্বাসী যে-কোনও ব্যক্তির কাছে নিতান্তই সাধারণ প্রাথমিক সত্য।’ ১৯৬০-৭০-এর দশকে হয়তো তাই ছিল। বের্টোল্ট ব্রেখ্‌ট একদা অভিযোগ করেছিলেন, গালিলিও বিজ্ঞানে যে-নতুন যুগের সূচনা করেছিলেন, ‘জনগণের কাছে সেটার কোনও বিশেষ তাৎপর্য নেই। তারা থেকে গেল দুর্গতির প্রাচীন অন্ধকারে।’ ব্রেখটের অভিযোগ মানতে পারেননি তিনি, কারণ ‘ইউরোপখণ্ডে আধুনিক বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের অনিবার্যতার প্রশ্নটি শেষ অবধি থেকেই যায়। … বিজ্ঞানের সমর-সম্পর্কিত সম্ভাবনাগুলো, জনগণকে শোষণ করবার উদ্দেশ্যে নতুন নতুন উৎপাদন যন্ত্র উদ্ভাবনের সম্ভাবনাগুলো বিজ্ঞানকে ধনতন্ত্রের কাছে অপরিহার্য করে তুলেছিল এবং এই ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই সঙ্ঘটিত হয়েছিল বৈজ্ঞানিক বিপ্লব।’ (‘বৃহস্পতির উপগ্রহ ও শ্রমজীবী মানুষ’)। এককথায়, মানুষের অন্য সকল কর্মকাণ্ডের মতো বিজ্ঞানও শ্রেণি-বিশ্লেষণের অধীন। বলা বাহুল্য বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই বহিঃপ্রভাবের দৃষ্টিভঙ্গির দুই প্রধান প্রবক্তা জোসেফ নিড্‌হ্যাম এবং জন ডেসমন্ড বার্নাল তাঁকে বিশেষ প্রভাবিত করেছিলেন, বিশেষ করে প্রথমজন। অথচ এর পাশাপাশি কার্ল ম্যানহাইম কিংবা ম্যাক্স ভেবার-এর মতো অ-মার্ক্সবাদী পণ্ডিতদের রচনার নিবিড় পাঠেরও অজস্র প্রমাণ ছড়িয়ে আছে এই প্রবন্ধগুলিতে। রবীন্দ্র-আইনস্টাইন ‘কথালাপ’ নিয়ে তাঁর আলোচনাটি তাঁর বাস্তবসম্মত, যুক্তিনিষ্ঠ, দর্শন-স্নাত এবং সঙ্গীত-ঋদ্ধ মননের পরিচয়বাহী। বস্তুত বিজ্ঞান বিভাগের প্রতিটি প্রবন্ধই বাংলা বিজ্ঞান-সাহিত্যের রত্ন।

 

সঙ্গীত

সঙ্গীত বিভাগের প্রবন্ধগুলি দু-ভাগে বিভক্ত। হিন্দুস্তানি মার্গসঙ্গীত নিয়ে পাঁচটি এবং রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য বাংলা গান নিয়ে ছ-টি। হিন্দুস্তানি মার্গসঙ্গীত নিয়ে যে-গভীরতায় ও যে-অনুপুঙ্খে তিনি আলোচনা করেছেন তা আমাকে বড়জোর মুগ্ধ করতে পারে, কিন্তু তার বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা আমার নেই। তাই এ-বিষয়ে অধিকারী দু-একজন বন্ধুর সঙ্গে কথা বলে যা জানলাম সেটাই লিখছি।

‘জয়পুর-সেনিয়া সেতার পরম্পরা’ প্রবন্ধে তিনি সেনিয়া সেতারশৈলীর বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর সেতারের গুরু মুস্তাক আলি খান ছিলেন ওই ঘরানারই ষষ্ঠ প্রজন্ম। এই ঘরানার নানান বিষয় ব্যাখ্যা করে পদ্মনাভবাবু অমৃতসেন, বরকতুল্লাহ খাঁ, আশিক আলি খাঁ, মুস্তাক আলি খাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনী দিয়েছেন। পরবর্তীকালে নিতাই বসু, দেবু চৌধুরী ও নির্মল গুহঠাকুরতা যেভাবে জয়পুর-সেনিয়া সেতার পরম্পরার প্রচার ও প্রসার করেছেন, তার কথা বলেছেন। এই ঘরের শিল্পীদের বাজে ধ্রুপদাঙ্গের মীড়ের প্রাধান্যের কথা বলেছেন এবং সে বাজের কালানুক্রমিক বিবর্তনের একটি চমৎকার বিবরণ দিয়েছেন। প্রবন্ধটি শেষ হয়েছে সেনিয়া পরম্পরায় ধ্রুপদের পরিমিতিবোধ ও সংযমের দর্শন নিয়ে আলোচনা করে এবং তার মধ্যে একটি অদ্ভুত অন্বেষণের কথা বলে। ওয়ালেস স্টিভেন্‌স-এর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি একটি অমোঘ সত্যের উল্লেখ করেছেন— কলাকার যতই প্রতিভাবান হোন না কেন তিনি সঙ্গীতের ঊর্ধ্বে নন। তাঁর মতে সেনিয়া ঘরানা এই সত্যের অনুসারক। অন্যান্য সব জিনিসের মতো মার্গসঙ্গীতও যে বাজার অর্থনীতির দ্বারা আক্রান্ত, সে-কথাও উল্লেখ করেছেন পদ্মনাভবাবু।

এই বিভাগে তাঁর একটি মূল্যবান লেখা ‘গীতসূত্রসার ও ভারতবর্ষের সঙ্গীতচিন্তা’ (পরিচয়, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ১৯৭৬)। এখানে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে। কৃষ্ণধন বন্দোপাধ্যায় তাঁর গীতসূত্রসার-এ ভারতীয় ওস্তাদদের খাপছাড়া শিক্ষাপ্রণালীর ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ার কথা ব্যক্ত করেছিলেন এবং স্বরলিপি এবং সঙ্গীতগ্ৰন্থাদির প্রতি ওস্তাদদের বিরূপতারও সমালোচনা করেছিলেন। এগুলি নিয়ে আলোচনা করার পর পদ্মনাভবাবু প্রশ্ন তুলেছেন, রাগসঙ্গীতের ওস্তাদদের শিক্ষাগত যোগ্যতা কম থাকা সত্ত্বেও কী করে রাগসঙ্গীতের প্রবাহ এমন অক্ষুণ্ন থাকল। তাহলে কি সে শিক্ষার ভিত্তি শুধুই এম্পিরিকাল, না তার ঔপপত্তিক ভিত্তি ছিল? এছাড়া রাগসঙ্গীতে স্বরগুলির গাণিতিক ও বৈজ্ঞানিক সম্পর্কটির কথাও আলতো করে ছুঁয়ে গেছেন, যদিও খুব বিস্তারে যাননি, তবে অমিয়নাথ সান্যালের গবেষণার কথা অন্তর্টীকায় উল্লেখ করেছেন। প্রসঙ্গক্রমে লক্ষণীয়, এই প্রবন্ধে না হলেও অন্যত্র তিনি ‘শ্রুতি-সপ্তক স্কেল’ বিষয়ে অসিত দে-র অপেক্ষাকৃত সাম্প্রতিক মৌলিক গবেষণার উল্লেখ করেছেন। প্রবন্ধের শেষে পদ্মনাভবাবুর আক্ষেপ, আধুনিক কালে কলাকার ও শাস্ত্রকারদের মধ্যে অনতিক্রম্য দূরত্ব রাগসঙ্গীতের তাত্ত্বিক চিন্তাশীলতার দিকটার ক্ষতি হয়েছে। কুমার গন্ধর্বকে খেয়ালে নবযুগের প্রবক্তা আখ্যা দিয়ে তিনি যে-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন তার সঙ্গে আজ হয়তো অনেকে একমত হবেন না, কিন্তু এখানেও তাঁর যুগপৎ যুক্তিবাদী এবং রসগ্রাহী মনের প্রকাশ ঘটেছে। অনুরূপভাবে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী প্রসঙ্গে বাংলা খেয়াল বিষয়ে তাঁর মত ব্যক্ত করেছেন: খেয়ালে প্রচলিত দুই স্তবকের বদলে ‘জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ ও ভীষ্মদেবের গানে দুইয়ের জায়গায় চার স্তবক এসে গেছে, ধ্রুপদের অনুপ্রেরণায় শুধু নয়, বাংলা গীতিকবিতার প্রস্ফুটনের প্রয়োজনেও।’ উদাহরণ দিয়েছেন বেহাগ রাগে জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদের সুপরিচিত ‘আমায় বোলো না ভুলিতে বোলো না’ গানের।

রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে তাঁর ‘নৃত্যনাট্য ও চণ্ডালিকা’ একটি ব্যতিক্রমী প্রবন্ধ। শেফালী মৈত্র রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলি নিয়ে গভীরদর্শী আলোচনা করলেও, সুর বিষয়ে বিশেষ কিছু বলেননি। পদ্মনাভ দাশগুপ্তর লেখায় এই দিকটা যথাযথ গুরুত্ব পেয়েছে। একটা উদাহরণ: ‘তারসপ্তকের গান্ধারে’ ক্ষমা করো প্রভু ক্ষমা করো মোরে ‘ভৈরবীতে আশ্রয় করে এবং পরমুহূর্তে একই রাগিণীতে মধ্যসপ্তকের ধৈবতে, গান্ধারে আনন্দের উত্তর যে মানব আমি সেই মানব তুমি কন্যা করুণার প্রলেপ, স্নিগ্ধ।’ আবার তারপরই শুধু একটি গণ্ডূষ জল ‘রবীন্দ্রনাথের একান্ত নিজস্ব ভঙ্গিতে করা কীর্তনের সুরে, নবজন্ম লভের আনন্দে কি উজ্জ্বল।’ চণ্ডালিকার দৃশ্য-পরিকল্পনা নিয়েও তাঁর ভাবনা মৌলিক। রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যগুলির বিশ্লেষণে আলোচকরা পাশ্চাত্য অপেরার প্রভাবকে একটু বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন বলে তিনি মনে করেন। ভরতের নাট্যশাস্ত্র-র উল্লেখ করে তিনি বলছেন, ‘নাটকের সঙ্গে সঙ্গীতের যোগাযোগ ভারতবর্ষে প্রাচীন ব্যাপার। … অভিনয়ে নৃত্য বা গীত কোনওটাই কৃত্রিম মনে হয় না ভারতবাসীর কাছে।’ তাঁর উল্লেখযোগ্য পর্যবেক্ষণ: বাল্মীকিপ্রতিভা, কালমৃগয়া প্রভৃতিতে রবীন্দ্রনাথ যখন বিলিতি গানের সুর ব্যবহার করেন, তখন সেটা প্রকৃতপক্ষে পরিণত হয় বাংলা গানে, অন্যান্য গানের সঙ্গে মিশে যায় চমৎকার।’

জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের নবজীবনের গান প্রসঙ্গে ‘বজ্রের স্বরলিপি’ প্রবন্ধে তিনি নিজস্ব ঢঙে ওই অমর সৃষ্টির সাঙ্গীতিক, সামাজিক, তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক উপাদান ও বৈশিষ্ট্যগুলি নিপুণভাবে মেলে ধরেছেন। সেখানেও পাশ্চাত্য সুর কীভাবে দেশি সুরের সঙ্গে মিলেছে তার উদাহরণ দিয়েছেন: ‘…মহাযুদ্ধের ঝড় এনে দেয় “দামামা বেজেছে”— যাতে অনিবার্যভাবে আমাদের মনে পড়ে যায় [বেঠোফেনের] মহান নবম সিম্ফনির দ্বিতীয় সঞ্চারের কথা— যদিও গানটি বাঁধা হয়েছে হিন্দোলের স্বরগ্রামে।’ নবজীবনের গান-এর একেবারে ‘শেষ পর্বে ‘অসহ্য’ শব্দটি তিনবার উচ্চারিত পুনরায় বেঠোভেনের ভঙ্গিতে … এবং তারপরেই অবশ্যম্ভাবী সংগ্রামের ঘোষণায় মহৎ ফিনালে-র মতো ‘ভাঙো ভাঙো ভেঙে ফেলো এই কারাগার!’

এক বহুসমন্বিত সাংস্কৃতিক বোধ; সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জনীয় এক বিচ্ছিন্নতা-মুক্ত ভবিষ্যতের স্বপ্ন; মানুষের যা কিছু মহৎ সৃষ্টি সবই কোনও না কোনওদিন ব্যাপক জনগণের ভোগ্য হবে, এই প্রত্যয়— এইসবই পদ্মনাভ দাশগুপ্তর প্রবন্ধগুলিকে আজ রাজনৈতিক অর্থেও প্রয়োজনীয় করে তুলেছে, বিশেষ করে সংস্কৃতিহীনতার উৎসবে মাতাল আজকের এই পশ্চিমবঙ্গে।


*মার্গসঙ্গীত অংশের মন্তব্যগুলির জন্য আমি ডঃ শুভময় দত্তর কছে কৃতজ্ঞ।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5006 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...