
সুশান্ত ঘোষ
ইংল্যান্ডে অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে রবার্ট বার্নস, উইলিয়াম ব্লেক প্রভৃতি সাহিত্যিকরা ক্লাসিসিজ়মের বিরোধিতার মাধ্যমে রোমান্টিকতাবাদের সূচনা করেন। পরে মিল্টন, ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ, কোলরিজ, সাউদি, শেলি, কিটস, বায়রন প্রভৃতি সাহিত্যিকরা রোমান্টিকতাবাদকে বহুদূর বিকশিত করেন। জার্মানি থেকে শুরু হওয়া রোমান্টিকতাবাদ ক্রমশ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাংলা ভাষাতেও তার প্রভাব পড়ে। ক্লাসিকতাবাদী চিন্তাধারার বিরোধিতাই রোমান্টিকতাবাদের বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন নাটকে রোমান্টিকতাবাদের গভীর প্রভাব লক্ষ করা যায়
রোমান্টিকতাবাদ একটি আন্দোলন যা গড়ে উঠেছিল ক্লাসিসিজ়ম বা ধ্রুপদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। রোমান্টিকতা বলতে শুধু প্রেম, আবেগ, প্রকৃতির সৌন্দর্য বর্ণনা ইত্যাদিকে বোঝায় না, প্রকৃতপক্ষে রোমান্টিকতাবাদের অর্থ অনেক ব্যাপক। ক্লাসিসিজ়মের অর্থাৎ ধ্রুপদী সংস্কৃতির সামগ্রিক বিরোধিতা থেকেই রোমান্টিকতাবাদের উদ্ভব।
ক্লাসিকতাবাদ
সপ্তদশ শতকে ইউরোপ ও আমেরিকায় সঙ্ঘটিত শিল্পবিপ্লবের ফলে কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থার স্থানে গড়ে ওঠে শিল্পনির্ভর সমাজ। এর সঙ্গে যুক্ত হয় উপনিবেশবাদ। এর ফলে সমাজে দুটি শ্রেণির উদ্ভব হয়— পুঁজিপতি ও তাদের সহযোগীদের নিয়ে গঠিত ধনী অভিজাতশ্রেণি এবং কৃষক থেকে শিল্পশ্রমিকে পরিণত ও উপনিবেশ থেকে নিয়ে আসা ক্রীতদাসদের নিয়ে গঠিত দরিদ্রশ্রেণি। এইসময় অভিজাতশ্রেণির দ্বারা সৃষ্ট সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য প্রভৃতি শিল্পকলাকে বলে ধ্রুপদী বা ক্লাসিক সংস্কৃতি এবং এই যুগকে বলে ক্লাসিক যুগ। ধ্রুপদী বা ক্লাসিক সংস্কৃতি সৃষ্টির চিন্তাধারাকে বলে ক্লাসিকতাবাদ। অভিজাতশ্রেণি দ্বারা সৃষ্ট এই সংস্কৃতি ছিল কেবল শিক্ষিত অভিজাত সম্প্রদায়ের জন্য যা সাধারণ মানুষের বোধগম্য হত না। ইংরেজি সাহিত্যের জন ড্রাইডেন, জন লকে, আলেকজ়ান্ডার পোপ, জোনাথন সুইফট, স্যামুয়েল জনসন প্রভৃতি ছিলেন বিখ্যাত ক্লাসিক সাহিত্যের স্রষ্টা। ক্লাসিক সংস্কৃতি সৃষ্টি করার মতবাদ হল ক্লাসিসিজ়ম বা ক্লাসিকতাবাদ।
এই যুগের ক্লাসিক সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য হল:
১. অতিশয় মার্জিত ভাষায় কেবলমাত্র শিক্ষিত অভিজাত সম্প্রদায়ের জন্য লেখা,
২. আবেগবর্জিত সাহিত্য,
৩. প্রেম, দয়া, মায়া, মমতা ইত্যাদি প্রায় বর্জিত,
৪. কল্পনা (ইমাজিনেশন) ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বর্ণনা-বর্জিত,
৫. প্রাচীন পুঁথি, প্রাচীন শাস্ত্র, প্রাচীন ধর্মগ্রন্থ, গোঁড়ামি, ধর্মান্ধতা, পুরোহিততন্ত্র, জ্যোতিষবিদ্যা, অলৌকিকতা ইত্যাদিকে গুরুত্ব দেওয়া,
৬. সমাজের দরিদ্র ও নিম্নশ্রেণির মানুষ এবং উপনিবেশের বাসিন্দাদের হেয় জ্ঞান করা, ইত্যাদি।
রোমান্টিকতাবাদ
ইংল্যান্ডে অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে রবার্ট বার্নস, উইলিয়াম ব্লেক প্রভৃতি সাহিত্যিকরা ক্লাসিসিজ়মের বিরোধিতার মাধ্যমে রোমান্টিকতাবাদের সূচনা করেন। পরে মিল্টন, ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ, কোলরিজ, সাউদি, শেলি, কিটস, বায়রন প্রভৃতি সাহিত্যিকরা রোমান্টিকতাবাদকে বহুদূর বিকশিত করেন। জার্মানি থেকে শুরু হওয়া রোমান্টিকতাবাদ ক্রমশ সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে এবং বাংলা ভাষাতেও তার প্রভাব পড়ে। সাহিত্য, চিত্রকলা, ভাস্কর্য প্রভৃতি শিল্প ও সংস্কৃতির সব ক্ষেত্রেই রোমান্টিকতাবাদের প্রভাব পড়ে। ক্লাসিকতাবাদী চিন্তাধারার বিরোধিতাই রোমান্টিকতাবাদের বৈশিষ্ট্য।
রবীন্দ্রনাথের নাটকে রোমান্টিকতাবাদ
রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন নাটকে রোমান্টিকতাবাদের গভীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। এই পরিসরে তাঁর নাটকে রোমান্টিকতাবাদের দিকগুলি সংক্ষেপে উল্লেখ করা হল:
১. দয়া, মায়া, স্নেহ, ভালবাসা প্রভৃতি মানবিক প্রবৃত্তিগুলিকে প্রকাশ করা কোনও দুর্বলতা নয়। প্রকৃতিবিরুদ্ধভাবে এগুলিকে দমন করে ঈশ্বরলাভের চেষ্টা অর্থহীন। এগুলিকে স্বীকার করেই অনন্ত আনন্দ লাভ করা যায়, তার মধ্যেই আছে ঐশ্বরিক অনুভূতি।
ক) ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকের একটি সংলাপ:
প্রথম দস্যু। আরে দাঁড়া দাঁড়া, এত ব্যস্ত হলে ফসকাবে শিকার
সাবধানে ধরো বাণ, সাবধানে ছাড়ো বাণ
বাল্মীকি। রাখ রাখ ফেল ধনু ছাড়িসনে বাণ
হরিণ শাবকদুটি প্রাণভয়ে ধায় ছুটি
চাহিতেছে ফিরে ফিরে করুণ নয়ান………।
খ) ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’ নাটকের সংলাপ:
বালিকা। পিতা, পিতা, কোথা তুমি পিতা!
সন্ন্যাসী। কে রে তুই!…….. চিনিনে, চিনিনে, তোরে, ফিরে যা ফিরে যা। আমি কারও কেহ নই। আমি যে স্বাধীন।
বালিকা। আমারে যেও না ফেলে, আমি নিরাশ্রয়, শুধায়ে শুধায়ে সবে……. বহুদূর হতে পিতা এসেছি যে আমি।
সন্ন্যাসী। (ফিরিয়া আসিয়া) আয় বাছা, বুকে আয়, ঢাল অশ্রুধারা, ভেঙে যাক এ পাষাণ তোর অশ্রুস্রোতে।
অর্থাৎ সন্ন্যাসী ভেবেছিলেন প্রকৃতিবিরুদ্ধভাবে স্নেহ, দয়া, মায়া ইত্যাদি বিসর্জন দিয়ে প্রকৃতির উপরে জয়ী হয়ে একান্ত বিশুদ্ধভাবে অনন্তকে লাভ করবেন। একটি বালিকা তাঁকে স্নেহপাশে বদ্ধ করে অনন্তের ধ্যান থেকে সংসারে ফিরিয়ে আনে।
—জীবনস্মৃতি, রবীন্দ্রনাথ
২. ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস, ধর্মরক্ষার নামে নির্দয়তা ও হিংস্রতা, ধর্মগুরু ও পুরোহিতদের নিষ্ঠুর বিধান— এই সবের স্বরূপ উন্মোচন রোমান্টিকতাবাদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন নাটকে এর পরিচয় পাওয়া যায়:
ক) ‘বিসর্জন’ নাটকের সংলাপ:
গোবিন্দমাণিক্য (রাজা)। ক্ষুদ্র ছাগশিশু দরিদ্র এ বালিকার স্নেহের পুত্তলি। তারে নাকি কেড়ে আনিয়াছে মার কাছে বলি দিতে? এ দান কি নেবেন জননী……..।
জয়সিংহ। …. হ্যাঁ গা, কেন তুমি কাঁদিতেছ? আপনি নিয়েছে যারে বিশ্বমাতা, তার তরে ক্রন্দন কি শোভা পায়।
অপর্ণা। কে তোমার বিশ্বমাতা? মোর শিশু চিনিবে না তারে। … কোলে করে নিয়ে তারে ভিক্ষা অন্ন ভাগ করে খাই। আমি তার মাতা। … রাক্ষসী নিয়েছে তারে।
আবার পরবর্তী অংশে রাজ-আদেশে বলিদান প্রথা বন্ধ হলে ক্ষিপ্ত পুরোহিত রাজাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। সংলাপ:
রঘুপতি (রাজপুরোহিত)। রাজরক্ত চান দেবী। রাজরক্ত আগে আন…………।
নক্ষত্ররায়। পাব কোথা!
রঘুপতি। ঘরে আছে গোবিন্দমাণিক্য। তাঁরি রক্ত চাই!
[……]
রঘুপতি। ….জয়সিংহ, সেই দুই দিন যেন ব্যর্থ নাহি হয়। সেই দুই দিন …….. রাজরক্তে রাঙা করে তবে যেন যায়………।
জয়সিংহ। রাজরক্ত চাহে দেবী, তাই তারে এনে দিব…..।
শেষপর্যন্ত রঘুপতিকে নিরস্ত করতে জয়সিংহ (রঘুপতির পালিত পুত্র এবং রাজবংশেরই সন্তান) আত্মবলি দেয়। সংলাপ:
গোবিন্দমাণিক্য। (মন্দিরে) এ কি রক্তধারা!
রঘুপতি। এই শেষ পুণ্যরক্ত এ পাপমন্দিরে। জয়সিংহ নিবায়েছে নিজ রক্ত দিয়ে হিংসারক্তশিখা।
খ) ‘মালিনী’ নাটকে সনাতন ধর্ম রক্ষার নামে হিংসার আশ্রয় নেওয়ার বিরুদ্ধে রোমান্টিকতাবাদী রবীন্দ্রনাথ বৌদ্ধ ধর্মের অহিংসা ও ক্ষমার আদর্শকে তুলে ধরেছেন। সুপ্রিয় সনাতন ধর্মরক্ষার অঙ্গীকার করেও ক্রমশ বৌদ্ধ ধর্মে আকৃষ্ট হলে ক্ষেমঙ্কর বন্ধুকে হত্যা করতে প্রবৃত্ত হয়। সংলাপ:
ক্ষেমঙ্কর। এসো তবে, এসো বুকে ….. লহো বন্ধু হস্তে করুণ বিচার— এই লহো (শৃঙ্খল দ্বারা সুপ্রিয়র মস্তকে আঘাত)।
সুপ্রিয়। দেবী (ক্ষমার আদর্শে বিশ্বাসী ও সুপ্রিয়র প্রেমিকা রাজকন্যা মালিনীকে) তব জয়। (সুপ্রিয়র মৃত্যু)…..
রাজা। (সিংহাসন ছাড়িয়া) কে আছিস ওরে আন খড়্গ।
মালিনী। মহারাজ, ক্ষমো ক্ষেমঙ্করে। (মূর্ছা)।
গ) ‘অচলায়তন’ নাটকে দেবতা ও শাস্ত্রের বিধান বলে প্রায়শ্চিত্তের নামে ছাত্রদের উপর চরম অত্যাচারের কাহিনি তুলে ধরা হয়েছে। সংলাপ:
উপাধ্যায়। আচার্যদেব, সুভদ্র আমাদের আয়তনের উত্তরদিকের জানলা খুলে বাইরে দৃষ্টিপাত করেছে।
আচার্য। উত্তরদিকটা তো একজটা দেবীর।
উপাধ্যায়। সেই তো ভাবনা। আমাদের আয়তনের মন্ত্রপূত রুদ্ধ বাতাসকে সেখানকার হাওয়া কতটা দূর পর্যন্ত আক্রমণ করেছে বলা তো যায় না।
[…]
উপাধ্যায়। মহাপঞ্চক সব শুনেছ বোধ করি।
মহাপঞ্চক। সেইজন্যেই তো এলুম; আমরা এখন সকলেই অশুচি, বাহিরের হাওয়া আমাদের আয়তনে প্রবেশ করেছে।
উপাচার্য। এর প্রায়শ্চিত্ত কী, আমাদের কারও স্মরণ নেই— তুমিই বলতে পারো।
মহাপঞ্চক। ……..একমাত্র ভগবান জ্বলনানন্তকৃত আধিকর্মিক বর্ষায়নে লিখেছে অপরাধীকে ছয় মাস মহাতামস সাধন করতে হবে।…..আলোকের এক রশ্মিমাত্র সে দেখতে পাবে না। কেননা আলোকের দ্বারা যে অপরাধ অন্ধকারের দ্বারাই তার ক্ষালন।
[…..]
আচার্য। শোনো, প্রয়োজন নেই।….. সুভদ্রকে কোনও প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে না, আমি আশীর্বাদ করে তার…
মহাপঞ্চক। এও কি কখনও সম্ভব হয়? যা কোনও শাস্ত্রে নেই … এরকম দুর্বলতা তো আপনার কোনওদিন দেখিনি। এই তো সেবার অষ্টাঙ্গশুদ্ধি উপবাসে তৃতীয় রাত্রে বালক কুশলশীল ‘জল জল’ করে পিপাসায় প্রাণত্যাগ করলে কিন্তু তবু তার মুখে যখন একবিন্দু জল দেওয়া গেল না তখন তো আপনি নীরব হয়ে ছিলেন। তুচ্ছ মানুষের প্রাণ আজ আছে কাল নেই, কিন্তু সানাতন ধর্মবিধি তো চিরকালের।
৩. শিক্ষাদানের নামে ছাত্রদের প্রকৃতির আনন্দ থেকে বঞ্চিত করে, প্রাচীন ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাস, গোঁড়ামি, যুক্তিহীন ভ্রান্ত ধারণা, নিম্নবর্ণ, দরিদ্র, কৃষক ও শ্রমিকদের হেয় জ্ঞান করতে শেখানো এইসব ক্লাসিকতাবাদী চিন্তার বিরুদ্ধে, রবীন্দ্রনাথ রোমান্টিকতাবদী চিন্তাধারাকে তুলে ধরেছেন।
ক) ‘অচলায়তন’ নাটকের কয়েকটি সংলাপ:
i) পঞ্চক। এ মন্ত্রটার ফল কী?
মহাপঞ্চক। এ মন্ত্র প্রত্যহ সূর্যোদয়-সূর্যাস্ত ঊনসত্তরবার জপ করলে নব্বই বৎসর পরমায়ু হয়।
পঞ্চক। এটা জপ করতে গিয়ে আমার এক বেলাকেই নব্বই বছর মনে হয়।……..
ii) পঞ্চক। পাপ করেছিস? কী পাপ?
সুভদ্র। আমি আমাদের আয়তনের উত্তরদিকের … জানালা খুলে বাইরেটা দেখে ফেলেছি। কোন প্রায়শ্চিত্ত করলে আমার পাপ যাবে?
দ্বিতীয় বালক। আমাদের আয়তনের উত্তরদিকটা যে একজটা দেবীর।
তৃঃ বাঃ। সেদিক থেকে যদি একটুও হাওয়া ঢোকে
প্রঃ বাঃ। ওতে মাতৃহত্যার পাপ হয়।
পঞ্চক। মাতৃহত্যা করলুম না অথচ মাতৃহত্যার পাপটা করলুম! সেই মজাটা দেখতে আমার অনেক কৌতূহল।
সুভদ্র। আমার কী হবে?
পঞ্চক। তোমার জয়জয়কার হবে। … তিনশো পঁয়তাল্লিশ বছরের আগল তুমি ঘুচিয়েছ।
iii) অস্পৃশ্যতা এবং অন্ধবিশ্বাস নিয়ে সংলাপ:
আচার্য। (পঞ্চককে) … তুমি কি অচলায়তনের বাইরে গিয়ে শোনপাংশু জাতির সঙ্গে মেশো?…. শোনপাংশুরা যে অত্যন্ত ম্লেচ্ছ। তাদের সহবাস কি….
iv) পঞ্চক। (শোনপাংশুদের প্রতি) তোরা যে খেসারি ডাল চাষ করছিস আবার লোহাও পিটোচ্ছিস, এখনও তোরা কোনও দিক থেকে পাঁচ চোখ কিংবা সাত মাথাওয়ালার কোপে পড়িসনি?
প্রথম শোনপাংশু। যদি পড়ি তবে আমাদেরও লোহা আছে। তার কোপ বড় কম নয়।
৪। উপনিবেশবাসীদের প্রতি সাম্রাজ্যবাদীদের মনোভাব, তাদের শোষণ আর উৎপীড়নের চিত্র রবীন্দ্রনাথ তুলে ধরেছেন। ‘মুক্তধারা’ নাটকের কিছু সংলাপ:
ক) রণজিৎ(রাজা)। বিভূতি কী করেছে এরা সবাই জানে তো?
ছেলেরা। (লাফাইয়া হাততালি দিয়া) জানি, শিবতরাইয়ের খাবার জল বন্ধ করে দিয়েছেন।
রণজিৎ। কেন দিয়েছেন?
ছেলেরা। (উৎসাহে) ওদের জব্দ করার জন্য। ওরা যে খারাপ লোক।
গুরু। ওদের ধর্ম খুব খারাপ আর ওরা আমাদের মতো
ছেলেরা। নাক উঁচু নয়।
(অর্থাৎ শিশুকাল থেকেই উপনিবেশবাসীদের ঘৃণা করতে শেখানো হয়)
খ) উপনিবেশবাসীদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদ (রোমান্টিকতাবাদ):
i) দূত। এতকাল ধরে তুমি আমাদের মুক্তধারার ঝর্ণাকে বাঁধ দিয়ে বাঁধতে লেগেছ। বারবার ভেঙে গেল, কত লোক ধুলোবালি চাপা পড়ল, কত লোক বন্যায় ভেসে গেল। আজ শেষে…
বিভূতি। তাদের প্রাণ দেওয়া ব্যর্থ হয়নি। আমার বাঁধ সম্পূর্ণ হয়েছে।
দূত। শিবতরাই (উপনিবেশ)-এর প্রজারা …. এখনও এ-খবর জানে না আর সপ্তাহ পরেই তাদের চাষের ক্ষেত… সেই ক্ষেত শুকিয়ে মারাই কি তোমার বাঁধ বাঁধার উদ্দেশ্য ছিল না?
বিভূতি: বালি-পাথর-জলের ষড়যন্ত্র ভেদ করে মানুষের বুদ্ধি হবে জয়ী, এই ছিল উদ্দেশ্য। কোন চাষির ভুট্টার ক্ষেত মারা যাবে সে কথা ভাববার সময় ছিল না।
[…..]
দূত। অভিশাপের ভয় নেই তোমার?
বিভূতি। …. উত্তরকূটে যখন মজুর পাওয়া যাচ্ছিল না তখন রাজার আদেশে চণ্ডপত্তনের প্রত্যেক ঘর থেকে আঠারো বছরের উপর বয়সের ছেলেকে আমরা আনিয়ে নিয়েছি। তারা তো অনেকেই ফেরেনি। …. কত মায়ের অভিশাপের উপর আমার যন্ত্র জয়ী হয়েছে।
ii) রণজিৎ। এ যে সঞ্জয়। অভিজিৎ কোথায়?
সঞ্জয়। যুবরাজ মুক্তধারার বাঁধ ভেঙেছেন। …. ওই বাঁধের একটা ত্রুটির সন্ধান কী করে তিনি জেনেছিলেন। সেইখানে যন্ত্রাসুরকে তিনি আঘাত করলেন, যন্ত্রাসুর তাঁকে সেই আঘাত ফিরিয়ে দিলে। তখন মুক্তধারা তাঁর সেই আহত দেহকে মায়ের মতো কোলে তুলে নিয়ে চলে গেল!
(রোমান্টিকতাবাদী অভিজিৎ আত্মাহুতি দিয়ে উপনিবেশবাসী মানুষ ও প্রকৃতিকে রক্ষা করল)
৫। প্রকৃতিপ্রেম: রবীন্দ্রনাথের প্রতিটি নাটকেই প্রকৃতিপ্রেমের নিদর্শন বর্তমান। সামগ্রিকভাবেই রবীন্দ্রনাথকে একজন প্রকৃতিপ্রেমিক বলা হয়। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হল:
ক) বাল্মীকিপ্রতিভা:
বাল্মীকি। এই-যে হেরি গো দেবী আমারই
সব কবিতাময় জগৎ চরাচর
সব শোভাময় নেহারি।
ছন্দে উঠিছে চন্দ্রমা, ছন্দে কনকরবি উদিছে
ছন্দে জগমণ্ডল চলিছে……
খ) প্রকৃতির প্রতিশোধ:
সন্ন্যাসী। জগতের মুখে আজি এ কী হাস্য হেরি!
আনন্দ তরঙ্গ নাচে চন্দ্রসূর্য ঘেরি।
আনন্দহিল্লোল কাঁপে লতায় পাতায়
আনন্দ উচ্ছ্বসি উঠে পাখির গলায়
আনন্দ ফুটিয়া পড়ে কুসুমে কুসুমে।
গ) ‘শারদোৎসব’ নাটকটি শরৎপ্রকৃতির রূপবর্ণনায় সমৃদ্ধ। ‘ফাল্গুনী’ এবং ‘বসন্ত’ নাটকদুটিও বসন্তপ্রকৃতির রূপের বর্ণনায় পরিপূর্ণ।
ঘ) ‘অচলায়তন’ নাটকে ‘দূরে কোথায়, দূরে দূরে’, ‘ঘরেতে ভ্রমর এল গুনগুনিয়ে’ এবং ‘আলো আমার আলো ওগো’ এই গানগুলি আছে যেগুলি প্রকৃতির রূপের বর্ণনায় মুখর।
ঙ) রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ ও ‘রক্তকরবী’ নাটক দুটি প্রকৃতি ও মানুষের সম্পর্ক নিয়ে রচিত। এই দুটি নাটক পৃথকভাবে আলোচিত হচ্ছে।
৬। রোমান্টিকতাবাদী নাটক ‘ডাকঘর’:
রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’ নাটক ক্লাসিসিজ়ম অর্থাৎ ধ্রুপদী মতবাদের বিরুদ্ধে রচিত এক আনবদ্য সৃষ্টি। এই রূপক নাটকে তিনি শিশু অমলের মাধ্যমে নিজের রোমান্টিকতাবাদী চিন্তাধারা মেলে ধরেছেন।
ক) পুঁথিসর্বস্ব জ্ঞানের বিরোধিতা: সংলাপ:
অমল। কিন্তু পিসেমশাই, আমাকে কেন বেরোতে দেবে না?
মাধব দত্ত। কবিরাজ যে বলেছে বাইরে গেলে তোমার অসুখ করবে।
অমল। কবিরাজ কেমন করে জানলে?
মাধব। বলো কী অমল!…. সে যে এত বড় বড় পুঁথি পড়ে ফেলেছে।
অমল। পুঁথি পড়লেই কি সমস্ত জানতে পারে?
মাধব। বেশ! তাও বুঝি জানো না!
অমল। আমি যে পুঁথি কিছুই পড়িনি— তাই জানিনে।
মাধব।…..অমলবাবু, তুমিও বড় হলে পণ্ডিত হবে….।
অমল। না না পিসেমশাই, তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমি পণ্ডিত হব না……। [ক্লাসিকতাবাদের বিরোধিতা]
মাধব। …. যদি পণ্ডিত হতে পারতুম, তাহলে আমি বেঁচে যেতুম।
অমল। আমি, যা আছে সব দেখব— কেবলি দেখে বেড়াব।
খ) প্রকৃতিপ্রেম, আবেগ ও কল্পনা এবং অজানা প্রকৃতিকে জানার আগ্রহ: সংলাপ:
অমল। আমাদের জানালার কাছে বসে সেই যে দূরে পাহাড় দেখা যায়— আমার ভারি ইচ্ছে করে ওই পাহাড়টা পার হয়ে চলে যাই।
মাধব। … পাহাড়টা যখন মস্ত বেড়ার মতো উঁচু হয়ে আছে তখন তো বুঝতে হবে ওটা পেরিয়ে যাওয়া বারণ।
অমল। … আমার ঠিক বোধহয় যে পৃথিবীটা কথা কইতে পারে না, তাই ওমনি করে নীল আকাশে হাত তুলে ডাকছে।
[…]
অমল। … কবে আমি ভাল হব?
মাধব। আর তো দেরি নেই বাবা!
অমল। … ভাল হলেই কিন্তু আমি চলে যাব।
মাধব। কোথায় যাবে?
অমল। কত বাঁকা বাঁকা ঝর্ণার জলে আমি পা ডুবিয়ে ডুবিয়ে পার হতে হতে চলে যাব…..।
গ) ক্লাসিকতাবাদীদের মতো সাধারণ মানুষকে হেয় জ্ঞান করা নয়, তাদের ভালবাসা, সবার মধ্যে সুন্দরের সন্ধান করা, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলা— এই রোমানটিকতাবাদী চিন্তার নিদর্শন:
i) অমল। (দইওয়ালাকে) … কীরকম করে তুমি বলো— দই দই, ভাল দই। আমাকে সুরটা শিখিয়ে দাও।
দইওয়ালা। হায় পোড়াকপাল! এ সুরও কি শেখবার সুর!
অমল। না, না, ও আমার শুনতে খুব ভাল লাগে। আকাশের খুব শেষ থেকে যেমন পাখির ডাক শুনলে মন উদাস হয়ে যায়— তেমনি ওই রাস্তার মোড় থেকে ওই গাছের সারির মধ্যে দিয়ে যখন তোমার ডাক আসছিল…।
ii) প্রহরী। অমন করে ডাকাডাকি করছ কেন? আমাকে ভয় করো না তুমি?
অমল। কেন, তোমাকে কেন ভয় করব?
প্রহরী। যদি তোমাকে ধরে নিয়ে যাই।
অমল। কোথায় ধরে নিয়ে যাবে? অনেক দূরে? ওই পাহাড় পেরিয়ে?
প্রহরী। একেবারে রাজার কাছে যদি নিয়ে যাই।
অমল। রাজার কাছে? নিয়ে যাও-না আমাকে! কিন্তু আমাকে যে কবিরাজ বাইরে যেতে বারণ করেছে। … তুমি ঘন্টা বাজাবে না প্রহরী?
প্রহরী। এখনও সময় হয়নি।
অমল। ……আচ্ছা, তুমি ঘন্টা বাজিয়ে দিলেই তো সময় হবে?
প্রহরী। সে কী হয়! সময় হলে তবে আমি ঘন্টা বাজিয়ে দিই।
অমল। বেশ লাগে তোমার ঘন্টা— আমার শুনতে ভারি ভাল লাগে …. ঢং ঢং ঢং, ঢং ঢং ঢং। তোমার ঘন্টা কেন বাজে?
প্রহরী। ঘন্টা এই কথা সবাইকে বলে, সময় বসে নেই, সময় কেবলই চলে যাচ্ছে।
অমল। কোথায় চলে যাচ্ছে? কোন দেশে?
প্রহরী। সে কথা কেউ জানে না।
অমল। আচ্ছা ওই যে রাস্তার ওপারের বড় বাড়িতে নিশেন উড়িয়ে দিয়েছে…. ওখানে কী হয়েছে?
প্রহরী। ওখানে নতুন ডাকঘর বসেছে।
অমল। ডাকঘর? কার ডাকঘর?
প্রহরী। ডাকঘর আর কার হবে? রাজার ডাকঘর!
অমল। রাজার ডাকঘরে রাজার কাছ থেকে সব চিঠি আসে? [শিশু অমলের মনে রাজা কি মানুষের পরিত্রাতা, পরম বন্ধু?]
প্রহরী। আসে বৈকি। দেখো একদিন তোমার নামেও চিঠি আসবে।
অমল। বেশ হবে। আমি কবে চিঠি পাব? আমাকেও তিনি চিঠি লিখবেন তুমি কেমন করে জানলে?
প্রহরী। তা নইলে তিনি ঠিক তোমার এই খোলা জানলাটার সামনেই অত বড় একটা সোনালি রঙের নিশেন উড়িয়ে ডাকঘর খুলতে যাবেন কেন?
অমল। আচ্ছা, রাজার কাছ থেকে আমার চিঠি এলে আমাকে কে এনে দেবে?
প্রহরী। রাজার যে অনেক ডাকহরকরা আছে, দেখোনি ….. তারা ঘুরে বেড়ায়।
অমল। আচ্ছা, কোথায় তারা ঘোরে?
প্রহরী। ঘরে ঘরে, দেশে দেশে…….।
অমল। বড় হলে আমি রাজার ডাকহরকরা হব।
ঘ) আবেগ আর কল্পনার চূড়ান্ত নিদর্শন (রোমান্টিকতা):
অমল। কে তুমি মল ঝম্ ঝম্ করতে করতে চলেছ— একটু দাঁড়াও না ভাই।
বালিকা। আমার কি দাঁড়াবার জো আছে। বেলা বয়ে যায় যে।…. আমি সুধা।
অমল। তুমি কী করো?
সুধা। সাজি ভরে ফুল তুলে নিয়ে এসে মালা গাঁথি। এখন ফুল তুলতে চলেছি।
অমল। ….তাই তোমার পা দুটি অমন খুশি হয়ে উঠেছে— যতই চলেছ মল বাজছে ঝম্ ঝম্ ঝম্। আমি যদি তোমার সঙ্গে যেতে পারতুম তাহলে উঁচু ডালে যেখানে দেখা যায় না সেইখান থেকে আমি তোমাকে ফুল পেড়ে দিতুম।……. অমি সাত ভাই চম্পার খবর জানি। আমার মনে হয় আমাকে যদি সবাই ছেড়ে দেয় তাহলে আমি চলে যেতে পারি খুব ঘন বনের মধ্যে যেখানে রাস্তা খুঁজে পাওয়া যায় না। সরু ডালের সব আগায় যেখানে মনুয়াপাখি বসে বসে দোলা খায় সেইখানে আমি চাঁপা হয়ে ফুটতে পারি।
ঙ) কূপমণ্ডুকতা নয়, অজানাকে জানার জন্য সারা পৃথিবী ঘুরে ঘুরে দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা (রোমান্টিকতা):
অমল। এবারে তুমি কোথায় গিয়েছিলে ফকির?
ঠাকুরদা। আমি ক্রৌঞ্চদ্বীপে গিয়েছিলুম— সেইখান থেকেই এইমাত্র আসছি।
মাধব দত্ত। ক্রৌঞ্চদ্বীপে?
ঠাকুরদা। এতে আশ্চর্য হও কেন? তোমাদের মতো আমাকে পেয়েছ? আমার তো যেতে কোনও খরচ নেই। আমি যেখানে খুশি যেতে পারি।
অমল। (হাততালি দিয়া) তোমার ভারি মজা। আমি যখন ভাল হব তখন তুমি আমাকে চেলা করে নেবে বলেছিলে, মনে আছে ফকির?
ঠাকুরদা। খুব মনে আছে। বেড়াবার এমন সব মন্ত্র শিখিয়ে দেব যে সমুদ্রে পাহাড়ে অরণ্যে কোথাও কিছুতে বাধা দিতে পারবে না।
চ) জাগতিক বস্তু নয়, রোমান্টিকতাবাদী আকাঙ্ক্ষা:
অমল। আচ্ছা ফকির, যাঁর ডাকঘর তুমি সেই রাজাকে জানো?
ঠাকুরদা। জানি বৈকি। আমি যে তাঁর কাছে রোজ ভিক্ষা নিতে যাই।
অমল। ….ভাল হয়ে উঠলে আমিও তাঁর কাছে ভিক্ষা নিতে যাব। …..আমি তাঁর দরজার সামনে পথের ধারে দাঁড়িয়ে জয় হোক বলে ভিক্ষা চাইব….
ঠাকুরদা। ….তুমি কী ভিক্ষা চাইবে?
অমল। আমি বলব অমাকে তোমার ডাকহরকরা করে দাও, আমি…. ঘরে ঘরে তোমার চিঠি [কল্যাণের বার্তা?] বিলি করে বেড়াব।
জ) রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ অসাধারণ রোমান্টিকতাবাদী রূপক নাটক। এই নাটকে তিনি শিল্পবিপ্লব-উত্তর সমাজের ক্লাসিকতাবাদী সংস্কৃতির সর্বাত্মক বিরোধিতা করেছেন। রোমান্টিকতাবাদের সর্বপ্রকার বৈশিষ্ট্য এই নাটকে বর্তমান। মানুষ ও প্রকৃতির চরম অনিষ্টকারী শিল্পনির্ভর সমাজব্যবস্থার চেয়ে কৃষিনির্ভর সমাজব্যবস্থা অনেক কল্যাণকর, এই রোমান্টিকতাবাদী চিন্তাই নাটকটির মূল বক্তব্য। বৈশিষ্ট্যগুলি সংলাপ-সহ আলোচনা করা হল:
১। প্রকৃতির চরম ক্ষতি হবে, সমগ্র মানবজাতির ক্ষতি হবে জেনেও শিল্প থেকে প্রাপ্ত প্রচুর অর্থের লোভে সুবিধাভোগী মানুষ মোহ ত্যাগ করতে পারে না— সংলাপ:
i) নন্দিনী। অবাক হয়ে দেখছি সমস্ত শহর মাটির তলাটার মধ্যে মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে অন্ধকার হাতড়ে বেড়াচ্ছে। পাতালে সুড়ঙ্গ খুদে তোমরা যক্ষের ধন বের করে আনছ। সে যে অনেক যুগের মরা ধন, পৃথিবী তাকে কবর দিয়ে রেখেছিল।
ii) নন্দিনী। পৃথিবী আপনার প্রাণের জিনিস আপনি খুশি হয়ে দেয়। কিন্তু যখন তার বুক চিরে মরা হাড়গুলোকে ঐশ্বর্য বলে ছিনিয়ে নিয়ে আসো, তখন অন্ধকার থেকে একটা কানা রাক্ষসের অভিসম্পাত নিয়ে আসো।
২) শিল্পের অধীশ্বররা বোঝে যে প্রকৃতিকে ধ্বংস করে শিল্প গড়ে অনেক অর্থবান হওয়া যায় কিন্তু প্রকৃতির হাসি আর ফিরে পাওয়া যায় না। সংলাপ:
i) নেপথ্যে (রাজা)। …. পৃথিবীর নিচের তলায় পিণ্ড পিণ্ড পাথর, লোহা, সোনা, সেইখানে… জোরের মূর্তি। উপরের তলায় একটুখানি কাঁচামাটিতে ঘাস উঠেছে, ফুল ফুটেছে সেইখানে… জাদুর খেলা। দুর্গমের থেকে হীরে, মানিক আনি; সহজের থেকে ওই প্রাণের জাদুটুকু কেড়ে আনতে পারিনে।
ii) নেপথ্যে। নন্দিনী, তুমি কি জানো, বিধাতা তোমাকেও রূপের মায়ার আড়ালে অপরূপ করে রেখেছেন? তার মধ্যে থেকে ছিনিয়ে তোমাকে আমার মুঠোর ভিতর পেতে চাচ্ছি, কিছুতেই ধরতে পারছিনে।
iii) নেপথ্যে। নিজেকে গুপ্ত রেখে বিশ্বের বড় বড় মালখানার মোটা মোটা জিনিস চুরি করতে বসেছি। কিন্তু যে দান বিধাতার হাতের মুঠির মধ্যে ঢাকা, সেখানে তোমার চাঁপার কলির মতো আঙুলটি যতটুকু পৌঁছায় আমার সমস্ত দেহের জোর তার কাছ দিয়ে যায় না।
৩) শিল্পশ্রমিকদের দূরবস্থার চিত্র— স্বাধীন কৃষক থেকে কেবল সংখ্যায় পরিণত মানুষ। সংলাপ:
বিশু। তাল তাল সোনা তুলে আনছি… যক্ষপুরে অঙ্কের পর অঙ্ক সার বেঁধে চলেছে… ওদের কাছে আমরা মানুষ নই কেবল সংখ্যা…
ফাগুলাল। পিঠের কাপড়ে দাগা আছে আমি ৪৭ফ।
বিশু। আমি ৬৯ঙ।
৪) শাসনযন্ত্রের নির্দয়তার চিত্র— যেখানে ধর্মগুরু শাসকের অনুগত হাতিয়ার:
i) নন্দিনী। গোঁসাইজি, এই লোকটি (অত্যাচারে মৃতপ্রায়)-র একটা ব্যবস্থা করো। এর জীবনের আর কতটুকুই বা বাকি?
গোঁসাই। সব দিক ভেবে যে পরিমাণ বাঁচা দরকার আমাদের সর্দার নিশ্চয় ওকে ততটুকু বাঁচিয়ে রাখবে।
ii) নন্দিনী। আহা পাগলভাই, ওরা কি তোমাকে মেরেছে! এ কিসের চিহ্ন তোমার গায়ে?
বিশু। চাবুক মেরেছে, যে চাবুক দিয়ে ওরা কুকুর মারে। যে রশিতে এই চাবুক তৈরি সেই রশির সুতো দিয়েই ওদের গোঁসাইয়ের জপমালা তৈরি।
iii) সর্দার। প্রভুপাদ বরঞ্চ ও-পাড়ায় নাম শুনিয়ে আসুন, সেখানে করাতীরা যেন একটু খিটখিট শুরু করেছে।
গোঁসাই। কোন পাড়া বললে সর্দারবাবা?
সর্দার। ওই যে ট-ঠ পাড়ায়। সেখানে ৭১ট হচ্ছে মোড়ল। মূর্ধন্য ণ-এর ৬৫ যেখানে থাকে তার বাঁয়ে ওই পাড়ার শেষ।
গোঁসাই। বাবা, দন্ত্য-ন পাড়া যদিও নড় নড় করছে, মূর্ধন্য-ণরা ইদানিং অনেকটা মধুর রসে মজেছে। মন্ত্র নেওয়ার মতো কান তৈরি হল বলে। তবু আর কটা মাস পাড়ায় ফৌজ রাখা ভাল। কেননা, নাহংকারাৎ পরো রিপুঃ। ফৌজের চাপে অহঙ্কারটা দমন হয়, তারপরে আমাদের পালা।
৫) এই নাটকে শিল্পের কারাগারে আবদ্ধ শ্রমিকদের এবং অন্য সবাইকে মুক্ত করে স্বাধীন কৃষিব্যবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে আগমন হয়েছে নন্দিনীর। সে সুন্দরের প্রতিমূর্তি এবং তার সঙ্গী রঞ্জনের আদর্শে উদ্বুদ্ধ। সে সবার মনে কৃষিসভ্যতার আদর্শের বীজ বপন করে শিল্প কারাগারের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলতে চায়। রঞ্জন এখানে শৃঙ্খলমুক্তির প্রতীক। সংলাপ:
i) নন্দিনী। দূর থেকে ওই গান শুনতে পাচ্ছ? … পৌষের গান। ফসল … কাটতে হবে, তারি ডাক। … তুমিও বেরিয়ে এসো রাজা, তোমাকে মাঠে নিয়ে যাই।
নেপথ্যে। আমি মাঠে যাব? কোন্ কাজে লাগব।
নন্দিনী। মাঠের কাজ তোমার যক্ষপুরীর কাজের চেয়ে অনেক সহজ।
নেপথ্যে। সহজ কাজটাই আমার কাছে শক্ত। সরোবর কি ফেনার নূপুর পরা ঝর্ণার মতো নাচতে পারে?
ii) নন্দিনী। (বিশুকে) আমি এসেছি এখান থেকে তোমাকে বের করে নিয়ে যাব।
বিশু। তুমি যখন এখানকার রাজাকে পর্যন্ত টলিয়েছ, তখন তোমাকে ঠেকাবে কিসে?
৬) শাসনের যন্ত্র একসময় রাজার নিয়ন্ত্রণ উপেক্ষা করে সুবিধাভোগীদের হাতে চলে যায়। তারা রাজার অদেশ না শুনে তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। রাজা বুঝতে পারে যে সে আসলে অত্যাচারী শাসনযন্ত্রের একটা আংশ মাত্র। শেষপর্যন্ত রাজা নিজের ভুল বুঝতে পেরে মানুষের সংগ্রামে যোগ দেয়। সংলাপ:
রাজা। ঠকিয়েছে। আমাকে ঠকিয়েছে এরা। সর্বনাশ! আমার নিজের যন্ত্র আমাকে মানছে না।……
নন্দিনী। রাজা, এইবার সময় হল।
রাজা। কীসের সময়?
নন্দিনী। আমার সমস্ত শক্তি নিয়ে তোমার সঙ্গে আমার লড়াই।
রাজা। তাহলে কাছে এসো। চলো আমার সঙ্গে। আজ আমাকে তোমার সাথী করো, নন্দিনী।
নন্দিনী। কোথায় যাব?
রাজা। আমার বিরুদ্ধে লড়াই করতে, কিন্তু আমারই হাতে হাত রেখে…….।
৭) শেষ দৃশ্যে ফরাসি বিপ্লবের ছায়া দেখা যায়:
ফাগুলাল। তুমি কী করে এলে?
বিশু। আমাদের কারিগররা বন্দিশালা ফেঙে ফেলেছে। তারা ওই চলেছে লড়তে। আমি নন্দিনীকে খুঁজতে এলুম। সে কোথায়?
ফাগুলাল। সে গেছে সকলের আগে এগিয়ে।
[নাটকের শেষে দূরে ফসল কাটার অর্থাৎ কৃষিসভ্যতার গান শোনা যায়।]
পরিশেষে জানাই রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন নাটককে সমালোচকেরা প্রকৃতিপ্রেম, অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে, যন্ত্রসভ্যতার বিরুদ্ধে ইত্যাদি নানা নামে অভিহিত করেছেন। এগুলি সবই রোমান্টিকতাবাদের বিভিন্ন দিক। প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথের নাটকগুলি রোমান্টিকতাবাদী চিন্তার ফসল।