মণিপুরি নৃত্য— এক ব্যতিক্রমী, বিপন্ন উচ্চাঙ্গ নৃত্যশৈলী

সুরশ্রী চৌধুরী

 


বর্তমান আগ্রাসী সনাতনী হিন্দুত্বের প্রতিনিধিরা মণিপুরের হিন্দুত্বের নমনীয়তা আর নিবেদনের ভাবটি বুঝতে অক্ষম। এর মধ্যে প্রকৃতিপূজার ধ্রুবপদটি সেই প্রাচীন সানামাহি ধর্মাচরণ থেকে এসেছে— আকাশভরা সূর্যতারা, বিশ্বভরা প্রাণ। এঁদের মধ্যে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি তীব্র ঘৃণার মনোভাব স্বাভাবিকভাবে অনুপস্থিত, যদি না তাকে কৃত্রিমভাবে উসকে তোলা হয়। যেটা মণিপুরে করা হয়েছে সচেতনভাবেই। বিগত দু-বছরের রক্তপাত কেবল প্রাণ নয়, অনেকটা কেড়ে নিয়েছে মণিপুরের আত্মাকেও। পবিত্র অরণ্যের অধিবাসী দেবতারা  জ্বলে যাওয়া গ্রামের বাসিন্দাদের অর্ঘ্যের অপেক্ষায়। সেই পূজা না হলে কেবল মঞ্চের উপস্থাপন আর প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা মণিপুরি নৃত্যশৈলীকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে কি?

 

প্রায় চল্লিশ বছর আগেকার কথা। কোনও এক বসন্তের সূর্যকরোজ্জ্বল দুপুরে একটি এরোপ্লেন নামছে মণিপুরের ইম্ফল বিমানবন্দরে, তার আসনে বসা মুগ্ধচোখ এক কিশোরী— আশ মিটিয়ে দেখে নিচ্ছে ধূসরনীল পাহাড় পেরিয়ে হঠাৎ ঝলসে ওঠা টিনের চালের খেলনাবাড়ি, নীলকান্তমণির মতো জলাশয়, চোখজুড়োনো সবুজ গালিচা বিছানো এক রূপকথার দেশ, যেখানে গন্ধর্বদের বাস। এখন ষাটের কোঠায় পৌঁছোনো সেই মেয়ে ভাবে, আজও তো এমনি প্লেন নামে। সেই এরোপাখির চোখে এখন দেখা যায় জ্বলে-যাওয়া গ্রাম, শহর। রিলিফ ক্যাম্পে অসহায় মানুষ। আর কি হবে লাইহারাওবা উৎসব? নৃত্যপূজা হবে কী করে গ্রামসংলগ্ন পবিত্র অরণ্যের অধিবাসী দেবতাদের, যখন গ্রাম-কে-গ্রাম উজাড় হয়ে গেছে দাঙ্গায়?

মণিপুরকে বাইরের পৃথিবী এক ডাকে চেনে মণিপুরি নাচের ধাত্রীভূমি বলে। আমাদের দেশে যে আট প্রকারের উচ্চাঙ্গ নৃত্যশৈলী প্রচলিত— ভরতনাট্যম, কুচিপুড়ি, মোহিনীআট্যম, কথাকলি, ওড়িশি, সত্রিয়া, কত্থক এবং মণিপুরি সেটা সবারই জানা আছে। উৎপত্তি ও বিকাশের ধরন, এবং চর্চার দিক দিয়ে বিচার করলে প্রথম সাতটির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা এই তালিকার শেষের নামটি— মণিপুরি, যা বস্তুত এক ‘জনসাধারণের’ উচ্চাঙ্গ নৃত্য। কীভাবে এই সোনার পাথরবাটি সম্ভব হল তা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে মণিপুরের ইতিহাস এবং সামাজিক গঠনের কথা অবধারিতভাবেই চলে আসে। এই নৃত্যধারার উৎপত্তি ও বিকাশ, মণিপুরের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে একেবারে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, যা তাকে অনন্য করেছে। মণিপুরি নৃত্যের ক্ষেত্রেও একটা সময়ের পর থেকে রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা মিলেছিল বটে, কিন্তু এই নৃত্যের প্রায় দু-হাজার বৎসরাধিক ইতিহাস বলে যে তার উৎপত্তি ও বিকাশের মূল অনুপ্রেরণা ছিল কৌমের যূথবদ্ধ ধর্মীয় ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান পালন।

 

মণিপুর, ভারতের উত্তর-পূর্বের ‘সাত বোন’-এর অন্যতম এক প্রদেশ, যার উত্তরে নাগাল্যান্ড, দক্ষিণে মিজোরাম, পশ্চিমে আসাম আর পূর্বে বর্মাদেশ। চারিদিকে পাহাড়, তার মাঝে বয়ে গেছে ইম্ফল নদী, তার অপূর্ব সুন্দর সবুজ উপত্যকা। পাহাড়ি অঞ্চলে বিভিন্ন নাগা, মিজো, কুকি ইত্যাদি জনজাতির বাস, আর সমতলে, ইম্ফল উপত্যকায় থাকেন মূলত মেইতেইরা, যাঁরা নিজেদের দেশকে ঐতিহ্যপূর্ণ নাম, কাংলেইপাক বলেই ডাকতে ভালবাসেন। আরেক নাম, সানালেইবাক, অর্থাৎ সোনার দেশ। সোনার খনি নেই। চাষআবাদ করে, শিকার করে, মাছ ধরে সমৃদ্ধ, সুখী এ-দেশের মানুষ, তাই এই আদরের ডাকনাম। ‘সোনার বাংলা’র মতো।

আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে এই ভূমিখণ্ডের অধিবাসীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক আদানপ্রদান করে এসেছেন। মধ্য এশিয়া থেকে শুরু করে সাইবেরিয়া, পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ, এমনকি মাইক্রোনেশিয়া, পলিনেশিয়া অবধি বিস্তৃত সেই এলাকা। এই সংযোগ সর্বদা বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল না, হামেশাই আগ্রাসনের রূপে এসেছে। সেজন্য মণিপুরের অধিবাসীরা সর্বদাই সচেষ্ট থেকেছেন নিজেদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিচয়টি অক্ষুণ্ণ রাখতে। এই ভূমি নানান সংস্কৃতি থেকে আহরণ করেছে, সমৃদ্ধ হয়েছে, নিজস্বতাটুকু কিছুমাত্র না হারিয়ে। মণিপুরি নৃত্যশৈলী সম্পর্কেও সেই কথা খাটে।

মেইতেই-দের দেশ, কাংলেইপাক শাসন করতেন নিংথৌজা বংশের রাজারা, মহারাজা পাখংবা ৩৩ খ্রিস্টাব্দে সেই রাজত্বের সূচনা করেছিলেন। ইম্ফল নদীর ধারে কাংলা-তে, যেখানে তিনি রাজধানী স্থাপন করেছিলেন, পরবর্তীকালে সেখানেই কাংলা দুর্গটি গড়ে ওঠে, যা মণিপুরের রাজকীয় ক্ষমতার পীঠস্থান ছিল, যতদিন রাজতন্ত্রের অস্তিত্ব ছিল। তারপর দীর্ঘদিন ভারতীয় সেনাবাহিনির অবস্থানের পর বর্তমানে সেটি মণিপুর সরকারের দখলে, এবং এর একাংশ এখন ইউনেস্কো-র World Heritage Site. এই কাংলা দুর্গের সামনেই ভারতীয় সেনার অত্যাচারের বিরুদ্ধে নগ্ন হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন মণিপুরের মেয়েরা। “Indian Army, Rape Us”— লেখা সেই পোস্টারের কথা অনেকেরই মনে পড়বে।

প্রায় ১৭০০ বছর, হয়তো বা তারও আগে থেকে মেইতেই-রা সর্বপ্রাণবাদী বহুদেবতাবাদী ‘সানামাহি’ ধর্মের অনুশীলন করে এসেছেন, এখনও যার কিছু অনুষ্ঠান তাঁদের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনের অঙ্গ হয়ে আছে, এমনকি যাঁরা পরবর্তীকালে বৈষ্ণবীয় হিন্দু বা অন্য কোনও ধর্ম অবলম্বন করেছেন, তাঁদেরও। সর্বপ্রাণবাদ (Animism) এমন এক বিশ্বাস যা মনে করে সমস্ত জড়বস্তু, স্থান, উদ্ভিদ এবং প্রাণীর একটি স্বতন্ত্র আধ্যাত্মিক রূপ রয়েছে। মেইতেইদের এই ধর্ম প্রাণী, গাছপালা, পাথর, নদী সবকিছুর মধ্যে দেবত্ব আরোপ করে। সানামাহি ধর্মাচরণের অঙ্গ ছিল বিভিন্ন দেবদেবীর মূর্তি অথবা প্রতীক নিয়ে পূজারী, পূজারিণী এবং ভক্তবৃন্দের শোভাযাত্রা, নৃত্যগীতসহকারে পূজার্চনা, এবং ভরগ্রস্ত পূজারিণীদের মুখে দৈবাদেশ শোনা। রাজা সমাজের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও, সামাজিক জীবনের মূল চালিকাশক্তি ছিল এইসব যৌথ ধর্মাচরণ।

সানামাহি ধর্মের মূল দেবতারা হলেন সিদবা মাপু ও লেইমারেল সিদবী (সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টিকর্ত্রী), তাঁদের বড়ছেলে, সর্বজীবের পালনকর্তা— লাইনিংথৌ (দেবরাজ) সানামাহি, তাঁদের ছোটছেলে— দুষ্টের দমনকারী পাখংবা; ধনসম্পদ-প্রদায়িনী দেবী ইমইনু আহোংবী, যিনি লেইমারেল সিদবীর আরেক রূপ। গ্রামের নিকটে পবিত্র অরণ্যখণ্ডে পূজিত হন বনদেবতা— উমং লাই। আরও আছেন পূর্বপুরুষ-দেবদেবীরা। এঁদের নিয়ে নিয়মিত যৌথ নৃত্যগীত, পূজা ও আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিশ্বসৃষ্টি আর জীবনচক্রের এক আনন্দময় উদযাপন, তৎসহ আধ্যাত্মিক উন্নতির প্রয়াস মেইতেই সমাজে বরাবরই প্রচলিত ছিল। নৃত্যগীতচর্চা এঁদের পক্ষে শুধুমাত্র ‘সংস্কৃতিচর্চা’ নয়, কৌমের জীবনের অঙ্গ। সেই রীতিকেই আজকের বিদগ্ধজনেরা চিহ্নিত করেন উচ্চাঙ্গ মণিপুরী নৃত্যশৈলীর উৎস হিসেবে।

পঞ্চদশ শতক থেকেই মূলধারার হিন্দুধর্ম মণিপুরে প্রবেশ করতে থাকে, কখনও সরাসরি বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা, ওড়িশা থেকে আসা ধর্মগুরু ও তাঁদের অনুগামীদের মাধ্যমে, কখনও বা বর্মা থেকেও। রাজকীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলেও কিন্তু হিন্দু দেবদেবীরা প্রাচীন সানামাহি দেবদেবীদের স্থান অধিকার করতে পারেনি। সানামাহি দেবদেবীদের কেউ কেউ পরবর্তীকালে বিষ্ণু, লক্ষ্মী, শিব, পার্বতীর অবতার রূপেও পূজিত হয়েছেন।

 

 

মণিপুর নামটি এসেছে অনেক পরে। অষ্টাদশ শতকে নিংথৌজা বংশের মহারাজ পামহৈবা রামানন্দী বৈষ্ণবীয় হিন্দুধর্মে দীক্ষা নেন, আর এই ধর্মকে জোর করেই রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসাবে ঘোষণা করেন। তিনিই ‘কাংলেইপাক’-এর বদলে দেশের নতুন নাম রাখেন ‘মণিপুর’। মজার কথা হচ্ছে, মহাভারতে বর্ণিত যে মণিপুরের রাজা চিত্রবাহনের কন্যাকে অর্জুন বিবাহ করেছিলেন, তার সঙ্গে ভারতের যে প্রদেশের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যগুলি মেলে তা হল ওড়িশা! তবু সেখানকার অনেক মানুষ দীর্ঘদিন ধরে বিশ্বাস করে এসেছেন যে তাঁদের দেশই সেই মহাভারতের মণিপুর, যার রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদাকে নির্বাসিত তৃতীয় পাণ্ডব বিবাহ করেছিলেন। ঠিক মহাভারতের গল্প নয়, অন্যরকম একটি লোককাহিনি, মেইতেই ভাষায় যাকে বলে সৈরেং, প্রচলিত আছে এই নিয়ে। মণিপুররাজ চিত্রবাহনের সভায় নৃত্য পরিবেশনকালে তাঁর কন্যা চিত্রাঙ্গদার তালভঙ্গ হয়েছিল। কুপিত রাজার অভিশাপে তিনি সর্পে পরিণত হন। পরে বনবাসী অর্জুনের স্পর্শে তিনি আবার মনুষ্যরূপ ফিরে পান, এবং অর্জুন তাঁকে বিবাহ করেন।

মণিপুরের আরেকটি প্রচলিত উপকথায় আছে যে, এই স্থানে শিব ও পার্বতী সাতদিনব্যাপী রাসলীলার অনুষ্ঠান করেন, যার সঙ্গীত সহযোগী ছিলেন অন্যান্য দেবতারা এবং গন্ধর্বেরা। রাত্রিবেলার অনুষ্ঠানের জন্য নাগরাজ অনন্তদেব তাঁর মাথার মণি দিয়ে আলোকিত রেখেছিলেন। সেই থেকে এই দেশের নাম হয় মণিপুর।

মহারাজ পামহৈবার পৌত্র মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র ছিলেন নিষ্ঠাবান কৃষ্ণভক্ত, মণিপুরে তিনি চৈতন্যদেব-প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের প্রচলন করেন। ১৭৫৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজপদে অভিষিক্ত হওয়ার তিন বছর পর তাঁরই এক পিতৃব্যের চক্রান্তে বর্মার রাজা মণিপুর দখল করে নেন। ভাগ্যচন্দ্র, রানি এবং কিছু বিশ্বস্ত অনুগামীর সঙ্গে আহোম (আসাম) রাজ্যে আশ্রয় নেন। পরে আহোম রাজার সৈন্যসাহায্যে তিনি আবার মণিপুর অধিকার করতে পেরেছিলেন। মণিপুরের লোককথায় আছে যে ভাগ্যচন্দ্র যখন রাজ্য হারিয়ে আহোমরাজের আশ্রয়ে প্রবাসে ছিলেন তখন স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ স্বপ্নে আবির্ভূত হয়ে তাঁকে অভয় দিয়ে বলেন যে তাঁর হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধার হবে। মণিপুরে নতুন করে রাজ্যাভিষেকের আগে স্বপ্নাদেশ মেনে ভাগ্যচন্দ্র ইম্ফলে গোবিন্দজির মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। গোবিন্দজির আদেশ ছিল যে এই মন্দিরে নৃত্যগীতের মাধ্যমে পূজা হবে। রাজকন্যাকে রাধার ভূমিকায় রেখে অন্য নৃত্যশিল্পীদের গোপিনী সাজিয়ে এক পূর্ণিমার রাতে সেই মন্দিরে রাসলীলার নৃত্যাভিনয় দিয়ে সেই মন্দিরের উদ্বোধন হয়েছিল। ধর্মপ্রাণ মেইতেইদের বিশ্বাস, এই নৃত্যের যাবতীয় পদচারণা, হস্তচালনা, দেহভঙ্গি, এমনকি পোশাকের খুঁটিনাটি ও সঙ্গীতানুষঙ্গ অবধি মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র স্বপ্নে শিক্ষা পেয়েছিলেন, তাঁর আরাধ্যদেবতা গোবিন্দজির কাছে। এমন কাহিনি মণিপুরে প্রচলিত থাকা খুব স্বাভাবিক মনে হয়, কারণ মেইতেইরা তো নথিবদ্ধ ইতিহাসেরও আগের সময় থেকে সমবেত নৃত্যগীতের মাধ্যমেই প্রাচীন দেবদেবীদের পূজার্চনা করে এসেছেন, পূজারিণীর মুখে দৈবাদেশ শুনেছেন। সেই প্রাচীন ধর্মের অনুশীলন রাজা পামহৈবার সময় থেকে প্রায় শতাব্দীকাল বাধাপ্রাপ্ত হয়েছিল। ভাগ্যচন্দ্রের পরবর্তী এক রাজা, চন্দ্রকীর্তি সিংহ লাইহারাওবার পুনঃপ্রচলন করেন।

 

মণিপুরি নৃত্যশৈলীর মধ্যে দুটি ধারাকে পরিষ্কারভাবে চিহ্নিত করা যায়। একটি মহারাজ ভাগ্যচন্দ্র-প্রবর্তিত বৈষ্ণবীয় ধারা, যার মধ্যে রয়েছে সঙ্কীর্তন ও রাসনৃত্য, যা মূলত মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয়, ইম্ফলের গোবিন্দজির মন্দির যার পীঠস্থান। আরেকটি প্রাক-বৈষ্ণব ধারা, যা মেইতেই জনজীবনের অচ্ছেদ্য অঙ্গ— সানামাহি ধর্মাচরণ থেকে উদ্ভূত ‘লাই-হারাওবা’— দেবতাদের আনন্দোৎসব। এ-ও নৃত্যপূজা উৎসব। তবে এই নৃত্যধারাটি একেবারেই ‘মেঠো’ প্রকৃতির। প্রতি জনপদের অধিবাসীরা তাঁদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য বজায় রেখে বৎসরের নির্দিষ্ট সময়ে অস্থায়ী পরিকাঠামো রচনা করে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।

ভাগ্যচন্দ্রের আগের জমানায় রাজারা লাই-হারাওবা উৎসবের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন বটে, কিন্তু সেই সমবেত নৃত্যপূজার মূল উদ্গাতা, ধারক ও বাহক আপামর জনসাধারণ। তার হস্তচালনা, পদচারণা ইত্যাদি নিয়মবদ্ধ হলেও তার মধ্যে এক ধরনের সারল্য রয়েছে যা সমবেত নৃত্যের পক্ষে উপযুক্ত। সাধারণ মানুষের যূথবদ্ধ জীবনযাপনের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা এই লাই-হারাওবা নৃত্যশৈলীর গভীর প্রভাব অনিবার্যভাবে পড়েছে পরবর্তীকালে প্রবর্তিত বৈষ্ণবীয় রাসনৃত্যের ওপর। তাই মণিপুরি মূলত সমবেত নৃত্য, যার অনু্প্রেরণা আধ্যাত্মিক আর ভাব মূলত ভক্তিভাব। গোবিন্দজির মন্দিরের রাস হোক বা পাড়ার মাঠের লাইহারাওবা উৎসব, সমবেত নৃত্য হলেও তা আধ্যাত্মিক আবেগের সংযত প্রকাশে অনিন্দ্যসুন্দর। মেইতেইদের কিছু আচরণগত বৈশিষ্ট্য, যা তাঁদের গোষ্ঠীগত আধ্যাত্মিক জীবনযাত্রা থেকে উৎসারিত, তারই প্রকাশ ঘটেছে এই নাচে। এই ‘মণিপুরিত্ব’ই অনন্য করেছে এই নৃত্যশৈলীকে, যার উৎস প্রকৃতি-কেন্দ্রিক সানামাহি ধর্মাচরণ। যার মূল কথা হল বিশ্বচরাচরের সামনে, প্রকৃতির সামনে নতজানু হওয়া।  সমগ্র দেহভঙ্গির মাধ্যমে সেই প্রণতির, humility-র প্রকাশ।

‘লাইহারাওবা’ উৎসব মূলত সৃষ্টিতত্ত্ব ও মানবজীবনের বর্ণনা ও উদযাপন, তার দেবদেবীরাও পরবর্তীকালে শিব-পার্বতীর অবতার হিসেবে বর্ণিত, fertility cult-এর দেবদেবী। মণিপুরের অঞ্চলভেদে নানা ধরনের লাইহারাওবা উৎসব হয় যা পরিচালনা করেন মৈবা (দেবদাস) ও মৈবী (দেবদাসী)-রা। মণিপুরের প্রাচীন সৃষ্টিতত্ত্ব বলে যে আদি পৃথিবী যখন জলমগ্ন ছিল, সেখানে সাতজন দেবী নৃত্য করছিলেন। সেই নৃত্যরতা দেবীদের পদক্ষেপেই পৃথিবীতে স্থলভাগের সৃষ্টি। লাইহারাওবা উৎসবের প্রারম্ভিক পর্যায়ে মৈবা-মৈবীরা নিকটস্থ কোনও জলাশয়ে নেমে বিশ্বসৃষ্টির প্রতীকী অভিনয় করেন। তারপর দৈবশক্তিতে আচ্ছন্ন মৈবা-মৈবীদের সঙ্গে গ্রামবাসীরা শোভাযাত্রা করে গ্রামে ফিরে আসেন। এরপরের পর্যায়ে মৈবীরা দেবতাদের আবাহন ও প্রতিষ্ঠা করেন। শেষে নানা ধরনের লোককাহিনি-নির্ভর নৃত্যে অংশগ্রহণ করেন একেবারে সাধারণ মানুষজন, কোনও বিশিষ্ট শিল্পীর আলাদা স্থান নেই সেখানে।

 

অষ্টাদশ শতকের মধ্যভাগে মহারাজ ভাগ্যচন্দ্রের শাসনকালে যখন রাসনৃত্যের প্রবর্তন হল, তার উপজীব্য বিষয় হিসেবে এল পুরাণের রাধাকৃষ্ণ-বিষয়ক নানান উপাখ্যান। তার প্রথম পর্যায়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণব রীতি অনুসরণে খোল ও করতালের সহযোগে পরিবেশিত হয় সঙ্কীর্তন। অনেকটা লাইহারাওবার প্রথমে দেববন্দনার আদলে। তারপর রাস। ভাগ্যচন্দ্র রাসনৃত্যকে নাট্য আঙ্গিকে সাজান। কার্তিক পূর্ণিমায় হয় মহারাস, চৈত্র মাসের পূর্ণিমায়  বসন্তরাস, আশ্বিন মাসে কুঞ্জরাস। গোষ্ঠরাস ও উলখুল রাস অনুষ্ঠিত হয় কার্তিক মাসে, যাতে শ্রীচৈতন্যের বন্দনা ও কৃষ্ণের বাল্যলীলা নৃত্য-গীত সহযোগে অভিনীত হয়। রাসের অভিনয়ে ভাবপ্রকাশ সংযত ও সীমিত। এমনকি, দর্শকের সঙ্গে কোনওরকম দৃষ্টিবিনিময়ও নিষিদ্ধ। শ্রীরাধা ও গোপিনীদের মুখ পাতলা সাদা ওড়না দিয়ে আবৃত থাকে, তাঁদের নৃত্যাভিনয়ে মুখের অভিব্যক্তি দেখানোর কোনও প্রয়োজনই নেই। হস্তচালনা মূলত আলঙ্কারিক, মুদ্রার ব্যবহার খুবই সীমিত, এবং তার ব্যবহারের উদ্দেশ্য প্যান্টোমাইম নয়। পরবর্তীকালে মঞ্চে উপস্থাপন শুরু হবার পর কিছু কিছু মুদ্রার ব্যবহার প্রচলিত হয়েছে বটে, কিন্তু তাও খুব কম। পোশাকপরিচ্ছদ ও আভরণের মধ্যেও রয়েছে একইরকম সংযমের প্রকাশ। ভাগ্যচন্দ্রের পরবর্তী সময়ে রাসনৃত্য আরও সমৃদ্ধ হয়েছে। জয়দেব, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস প্রমুখ বৈষ্ণব কবিদের পদ অবলম্বনে রাসলীলার সঙ্গীত রচিত হয়েছে। বাংলার কীর্তনের প্রভাবও পড়েছে এর সুরে, কিন্তু তার গায়কিতে মণিপুরের প্রাচীন সঙ্গীতের স্পষ্ট স্বাক্ষর।

 

১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের এক যুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার মণিপুর অধিকার করার পর থেকেই নানাভাবে ইম্ফল উপত্যকাবাসী মেইতেইদের সঙ্গে পাহাড়ি এলাকার জনজাতিদের একটা বিভেদ সৃষ্টি করার চেষ্টা চলতে থাকে। কুকিরা বর্মাদেশ থেকে আগত হলেও সানামাহি বা বৈষ্ণবীয় হিন্দু ধর্মাচরণের বিরোধিতা করেননি, কিছু কিছু সঙ্ঘাত সত্ত্বেও মোটের ওপর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরিস্থিতিই বজায় ছিল, কারণ তাঁরা পাহাড়ি এলাকাতেই থাকতেন। পরবর্তীকালে খ্রিস্টান মিশনারিদের সাংস্কৃতিক প্রভাব কুকি ও নাগাদের মধ্যে অনেক বেশি পড়েছে। মেইতেই সমাজ সে প্রভাব এড়িয়েছে নিজ সংস্কৃতির প্রতি অতুলনীয় ভালবাসায়, গর্বে। ভারতের স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরে মণিপুরে রাজতন্ত্রের শেষ হল। কিন্তু প্রজাতন্ত্রের স্বাদ মূল ভারতীয় ভূখণ্ডের অন্য প্রদেশগুলির মতো পায়নি মণিপুর, যে আশাভঙ্গের কারণে বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথা চাড়া দিয়েছে। ভারত সরকারও সর্বদাই চেষ্টা করেছে নানান বিভেদ জিইয়ে রাখতে। Armed Forces Special Powers Act-এর মতো দমনমূলক আইন বজায় থেকেছে বছরের পর বছর। এর বলি হয়েছে মণিপুরের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা।

নৃত্য-উৎসবগুলি কিন্তু তবু বেঁচেছিল, যা তাঁদের জীবনধারনের অনুপ্রেরণাস্বরূপ। স্বাধীনতাপ্রাপ্তির কিছু আগে থেকেই হতে থাকে মণিপুরি নৃত্যের মঞ্চায়ন, আর বিশ্বায়নও। প্রবাদপ্রতিম গুরু মৈস্নাম আমুবী সিংহ মণিপুরি নৃত্যের অসাধারণ মঞ্চোপযোগী রূপদান করছিলেন। উদয়শঙ্করের সঙ্গে তাঁর কাজ মণিপুরি নৃত্যের ক্ষেত্রে এক নতুন যুগের সূচনা করেছিল। প্রাচীন গুরুগৃহ রইল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠল ‘জওহরলাল নেহরু মণিপুর ডান্স অ্যাকাডেমি’র মতো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাক্ষেত্র। মণিপুরের বাইরে আসামে, ত্রিপুরায় মণিপুরি সমাজের মধ্যে এই নাচের চর্চা তো ছিলই। রবীন্দ্রনাথের উৎসাহে শান্তিনিকেতনেও মণিপুরি নাচের চর্চা শুরু হয়েছিল। বাংলার সঙ্গে দীর্ঘদিনের সাংস্কৃতিক যোগাযোগের কারণে তা সহজেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কিন্তু এতসব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মণিপুরের বাইরে মণিপুরি নাচের রূপায়ণে একরকম সূক্ষ্ম তফাত চোখে পড়বেই অভিজ্ঞজনের। এর কারণ সেই অলৌকিক ‘মণিপুরিত্ব’, যা মণিপুরের সামাজিক জীবন থেকে উৎসারিত এক অন্তঃসলিলা, যার জল না পেলে যত অর্থ, পরিকাঠামো হোক না কেন, বাঁচবে না মণিপুরি নৃত্যশৈলী।

বর্তমান আগ্রাসী সনাতনী হিন্দুত্বের প্রতিনিধিরা মণিপুরের হিন্দুত্বের নমনীয়তা আর নিবেদনের ভাবটি বুঝতে অক্ষম। এর মধ্যে প্রকৃতিপূজার ধ্রুবপদটি সেই প্রাচীন সানামাহি ধর্মাচরণ থেকে এসেছে— আকাশভরা সূর্যতারা, বিশ্বভরা প্রাণ। এঁদের মধ্যে অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি তীব্র ঘৃণার মনোভাব স্বাভাবিকভাবে অনুপস্থিত, যদি না তাকে কৃত্রিমভাবে উসকে তোলা হয়। যেটা মণিপুরে করা হয়েছে সচেতনভাবেই। বিগত দু-বছরের রক্তপাত কেবল প্রাণ নয়, অনেকটা কেড়ে নিয়েছে মণিপুরের আত্মাকেও। পবিত্র অরণ্যের অধিবাসী দেবতারা  জ্বলে যাওয়া গ্রামের বাসিন্দাদের অর্ঘ্যের অপেক্ষায়। সেই পূজা না হলে কেবল মঞ্চের উপস্থাপন আর প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা মণিপুরি নৃত্যশৈলীকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে কি?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4989 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. অত্যন্ত ব্যতিক্রমী চমৎকার লেখা।
    হীরক সেনগুপ্ত

আপনার মতামত...