
প্রতীক
বড়, মেজ আর সেজ পত্রিকায় বছর দেড়েকের মধ্যে ডজনখানেক গল্প বেরিয়েছে, এবার কলকাতা বইমেলায় জনা পাঁচেক পাঠক আর জনা দুয়েক প্রকাশক চিনতে পেরেছে। ফলে আমি বেশ ফুলে উঠেছিলাম, বুঝলেন? গিন্নি পিন ফুটিয়ে দিল। হুঁঃ, ভারি লেখক। আজ পর্যন্ত একটা ঠিকঠাক প্রেমের গল্প লিখে উঠতে পারলে না…
—কেন? ওই যে গল্পটা লিখেছিলাম… একজন অল্পবয়সী বিধবা আর প্রতিবেশী কলেজপড়ুয়া ছেলের প্রেম? তারপর সেই দুজন উকিল, কেউ কাউকে চেনে না, ফেসবুকে ফেক প্রোফাইল থেকে চ্যাট করতে করতে আলাপ…
—ওগুলো প্রেমের গল্প নয়, সেক্সের গল্প। সেক্সও তো জমিয়ে লিখতে পারো না। ন্যাকা ন্যাকা যতসব…
এসব কথা ভাগ্যিস রিনি বাইরে বলে না। বললে যেটুকু নাম হয়েছে সেটুকুও জলে যাবে। সম্পাদককে, পাঠককে টুপি পরানো যায়। সহধর্মিণী শক্ত ঠাঁই। আত্মবিশ্বাসটা প্যারাসিটামল খাওয়ার পরে ভাইরাল জ্বরের মতো পাঁইপাঁই করে নেমে যাচ্ছে দেখে সামাল দেওয়ার জন্যে মিনমিন করে বললাম, গল্পে যৌনতা থাকা কি দোষের নাকি? প্রেমের গল্পে যৌনতা থাকবে না-ই বা কেন? এসব ছুঁতমার্গ ভাল না।
গিন্নি মুখ বেঁকিয়ে বলল, ওসব লেকচার সাহিত্যসভা-টভায় দিও। আমি তোমার সঙ্গে বিশ বছর ঘর করছি। ইটালিয়ান সিনেমা, স্প্যানিশ সিনেমা, নেটফ্লিক্সে কেউ দেখে না এমন দু-চারটে সিরিজের পারমুটেশন কম্বিনেশন করে যেগুলো নামিয়েছ ওগুলো প্রেমের গল্প? তোমার ওই ভূত-পেতনি লেখাই ভাল।
এরপর চেপে যাওয়াই কর্তব্য, নইলে ধুয়ে কাপড় পরিয়ে দেবে। তাই চুপ করে গেলাম। কিন্তু গা ধুতে ঢুকে যাওয়ার আগে গিন্নি এমন একটা খোঁচা দিল যে উত্তর না দিয়ে উপায় থাকল না।
—প্রেম করতে ভুলে গেলে আর প্রেমের গল্প লিখবে কী করে? নিজের বউয়ের দিকে শেষ ঠিক করে তাকিয়েছ সেই যখন মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী ছিল।
আমি মরিয়া হয়ে বললাম, এটা বেশি আনফেয়ার হয়ে গেল। তবে হ্যাঁ, একটু বুড়িয়ে গেছি তো বটেই। সে তো বয়স বাড়লে হবেই। যখন বয়স ছিল তখন কিন্তু মন দিয়ে প্রেমটা করেছি। আজকালকার ছেলেমেয়েরা তো প্রেম করতেই জানে না। এদের নিয়ে আর কী গল্প হবে?
কথাটা শেষ করে বাথরুমে ঢুকতে পারত। বোধহয় সারা পাড়াকে শোনাবে বলেই ঢুকে গিয়ে দুম করে দরজাটা বন্ধ করে ভিতর থেকে চেঁচিয়ে বলল— চোখে ছানি পড়ার মত বুড়ো তো হওনি। রাস্তায় বেরিয়েও মোবাইলে মুখ গুজে থাকলে আর কে কেমন প্রেম করছে দেখতে পাবে কী করে?
খুব গায়ে লেগে গেল। সব সত্যি কথাই যেমন লাগে। আমি উঠতি লেখক দৃপ্ত ঘোষাল, যাকে পরিচিত সিনিয়র লেখকরা বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ বলে চিহ্নিত করে ফেলেছেন, আমি কিনা পথে বেরিয়ে মানুষকে খেয়াল করি না! এত বড় কথা! রিনির গা ধুয়ে বেরোবার অপেক্ষা না করেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়লাম। মোবাইলটা সেন্টার টেবিলের উপরে রেখে। ঝিলের ধারের শচীন মজুমদার রোড ধরে হনহনিয়ে হাঁটতে লাগলাম। সবুজগ্রাম পঞ্চায়েত ঝিলটা পরিষ্কার করিয়েছিল, আমি যে-সময়ে রিনির দিকে শেষবার ঠিক করে তাকিয়েছি বলে ওর অভিযোগ, তার আশপাশেই। উপরন্তু গত কয়েক বছরে ঝিলের ওপারটায় আবর্জনা ফেলা শুরু হয়েছে। তাও কেন কে জানে, পঞ্চায়েতের মনে হয়েছে ওটা একটা চমৎকার রোম্যান্টিক জায়গা। তাই বেশ একটা আলো-টালো লাগানো, রেলিং দেওয়া উঁচু চাতাল বানিয়ে গোটাকতক বেঞ্চি বসিয়ে দিয়েছে। সন্ধের দিকটায় ওখানেই জোড়ায় জোড়ায় অল্পবয়সীরা বসে থাকে। চোখ পড়লেই আমার গ্যাংস অফ ওয়াসিপুর ফিল্মে নওয়াজউদ্দিন আর হুমা কুরেশির প্রেম করার দৃশ্য মনে পড়ে যায়, বিরক্তির চোটে হাসি পায়। তাকিয়ে থাকতে পারি না। কিন্তু রিনি যখন বলছে, তখন একবার গিয়ে বসব ঠিক করলাম। ও কলেজের দিদিমণি বলে কথা। অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ওর রোজ ওঠাবসা। হতে পারে ও ঠিকই বলছে, আমারই নাকউঁচু হয়ে গেছে বলে এখনকার ছেলেমেয়েদের প্রেম করার ক্ষমতা আছে বলে ভাবতে পারছি না। এটাও বুড়িয়ে যাওয়ার লক্ষণ।
চাতালটার ফুট দশেকের মধ্যে পৌঁছে কেমন অস্বস্তি হতে লাগল। সবাই জোড়ায় জোড়ায় বসে আছে। তার মধ্যে আমি, একটা মাঝবয়সী লোক, একা একা গিয়ে বসব? ইশ! কী ভাববে হাঁটুর বয়সী ছেলেমেয়েগুলো? নির্ঘাত আমাকে দর্শনকাম, নোংরা লোক মনে করবে। কিন্তু গল্প তো আমার চাই। বউয়ের কাছে মান রাখতে হবে, তার উপর একটা ওয়েবম্যাগ দোল সংখ্যার জন্যে গল্প চেয়েছে। সেটাও লিখতে হবে। এক ঢিলে দুই পাখি। রাস্তার উল্টোদিকে সার দিয়ে দোকান, প্রায় সব দোকানদারই আমার চেনা। যে-কোনও একটায় ঢুকে আড্ডা জমালেও অবশ্য চলে। এমনিতেই পিতৃপরিচয়ের কারণে এরা আমাকে খাতির করে, ইদানিং আবার আমি যে লেখক সেটা জানতে পেরেছে ফেসবুকের দৌলতে। ফলে খাতির আরও বেড়েছে। গিয়ে বসলেই বাড়ি থেকে রাগ করে যে চা-টা না খেয়ে বেরিয়ে এলাম সেটা বিনামূল্যে খাওয়া হয়ে যাবে, লেখার বিষয়ের দিকে নজরও রাখা যাবে নিরাপদ দূরত্ব থেকে। কিন্তু ওতেও একটা সমস্যা আছে। যেখানেই বসি সেখানেই বকবক করতে হবে। তাহলে আর প্রেমিক-প্রেমিকাদের লক্ষ করব কী করে? মনোযোগ ছাড়া কি এসব হয়?
কী করি, কী করি ভাবতে ভাবতে চোখ পড়ল রতনদার চালের দোকানটায়। মানে যেটা রতনদার চালের দোকান ছিল। সে মারা গেছে বছরখানেক হবে, তারপর থেকে ওটা বন্ধই ছিল। ওর একমাত্র ছেলে কোনওদিনই বাপের ব্যবসার দিকে আসেনি। তার গানবাজনার ঝোঁক ছিল, শুনেছি এখন এক নামকরা গায়কের সঙ্গে বাজায়। আজ দেখছি দোকানটা খুলেছে, তবে বেশ ফাঁকা ফাঁকা, পরিচ্ছন্ন লাগছে। এ তো চালের দোকান নয়! এগিয়ে গেলাম। ও মা! এ তো চায়ের দোকান। তবে একেলে। আশি পাওয়ারের বালব নয়, ঝকঝকে টিউবলাইট জ্বলছে। নোংরা, তুবড়ে যাওয়া সসপ্যানে চা হচ্ছে না। দুটো ইয়াব্বড় ফ্লাস্ক রাখা— একটার গায়ে লেখা TEA, অন্যটার গায়ে COFFEE। কোথাও চা-কফি চলকে পড়েনি, মাছি ভনভন করছে না। বসার জায়গা অবশ্য নেই। তবে দেখলাম ভিতরে টোস্টার, স্যান্ডউইচ মেকার রয়েছে। হোয়াইট ব্রেড, ব্রাউন ব্রেড, টমেটো, লেটুস পাতা, মাখন, গোলমরিচ, টমেটো সসের পাউচ— সব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা আছে। খদ্দেরের নাকের ডগায় প্লাস্টিকের জারে নানারকম বিস্কুট, কেক সাজানো। শোকেসে হরেকরকম পেস্ট্রিও আছে। পটেটো চিপসের প্যাকেটের চেনও ঝুলছে দেয়াল ঘেঁষে। সবচেয়ে বড় কথা বড় বড় হরফে ছাপা একখানা সুদৃশ্য মেনু রাখা আছে শোকেসের উপর। তা থেকে জানলাম ভেজ পকোড়া, চিকেন পকোড়া, মোমো— এসবও পাওয়া যায়। বাইরে একখানা সাইনবোর্ড লাগিয়েছে, তাতে দোকানের নাম লেখা— EVENING MUNCH। দেখে বেশ ভক্তি হয়। এমন চায়ের দোকান আমাদের সবুজগ্রামে এই প্রথম। দেখে শুনে এতই মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম যে দোকানদারের উপস্থিতি খেয়ালই করিনি। কিছু দেব, দীপ্তদা?— শুনে চমকে উঠে দেখি বেশ টুকটুকে, গোলগাল, জিনস আর টপের উপর অ্যাপ্রন পরা বছর পঁচিশেকের একটা মেয়ে।
চট করে কী বলি? স্যান্ডউইচ আর কফিই বললাম।
—ভেজ না নন-ভেজ?
ভর সন্ধেবেলা ভেজ স্যান্ডউইচ খেতে যাব কোন দুঃখে? মেয়েটা ব্যবস্থা করতে লাগল, আর আমি ভাবতে লাগলাম, এ এল কোত্থেকে? আমার নামই বা জানল কী করে? রতনদার ছেলের বউ কি? রতনদার শ্রাদ্ধে আমাকে দেখেছিল? কিন্তু সিঁদুর-টিদুর তো দেখছি না! অবশ্য আজকাল অনেক মেয়েই ওসব পরে না। তার উপর একে দেখে তো লেখাপড়া জানা মেয়ে বলে মনে হচ্ছে। হওয়ারই কথা। রতনদাকে দিয়ে তার ছেলের বউকে বিচার করলে তো চলবে না, কারণ রতনদার বিদ্যে ছিল ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত। তার ছেলে কলকাতার কলেজে পড়েছে, নামকরা গায়কের দলে বাজায়, তার পছন্দ তো এরকমই হবে। হয়তো কলকাতারই মেয়ে। কিন্তু তেমন মেয়ে চায়ের দোকান খুলে বসতে রাজি হল!
স্যান্ডউইচটা উপাদেয়, কফিটাও ভাল। এত ভাল যে কে কার সঙ্গে কেমন প্রেম করছে না করছে সেসব আর খেয়াল করা হল না। টাকা দেওয়ার সময়ে কৌতূহল চাপতে না পেরে জিজ্ঞেস করে ফেললাম— রতনদা তোমার কে হয়? এই প্রশ্নে থমকে গেল কেন বুঝলাম না। টাকা ফেরত দিতে দিতে গম্ভীর মুখে বলল— দোকানঘরটা আমরা ভাড়া নিয়েছি। মানে মানে কেটে পড়লাম।
দুই.
সন্ধের জলখাবার ভাল হলে মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়। ফলে যখন বাড়ি ঢুকলাম, রিনির উপর রাগ পড়ে গেছে। রিনির বোধহয় পড়েনি। তাই ফিরলাম দেখেও কিছু বলল না, মন দিয়ে খাতা দেখতে লাগল। পা ধোব বলে বাথরুমের আলো জ্বেলেছি কি জ্বালিনি, বলল— চা ফ্লাস্কে আছে, খাবার ক্যাসারোলে। তখুনি কিছু বললাম না। বেরিয়ে আসতেই বলল— রাগটা মোবাইলের উপর দেখানোর খুব দরকার ছিল? একটার পর একটা ফোন আসছে…
—তা ধরলেই পারতে।
—ধরে কী বলতাম? কোথায় গেছে জিজ্ঞেস করলে কী বলতাম?
বুঝলাম হাওয়া আরও গরম হয়ে গেছে না বলে বেরিয়ে যাওয়ায়। এখন মিথ্যে না বললে বাঁচব না।
—একদম ভুলে গেছিলাম। সেই ঝিলের ধারে গিয়ে মনে পড়ল। কেবল ফোনটা নিতে আবার এতদূর আসব? তাই আর…
—তা আজ হঠাৎ এই সময়ে বেরোনোর দরকারই বা হল কেন? সন্ধেবেলার খিদে উবে গেল কী করে?
এই সুযোগ। বলে ফেললাম বেরোবার হেতু এবং খিদে কীভাবে মিটল। রাগটা পড়ছে বুঝলাম, কারণ রিনির মুখে হাসি না ফুটলেও নিজেই উঠে গিয়ে ক্যাসারোল খুলে দুজনের জন্যে বাটিতে চিঁড়ের পোলাও নিয়ে এল। হাসি ফুটল কয়েক চামচ খাওয়ার পর।
—আমি যা বলেছিলাম সেটাই কিন্তু প্রমাণ হল।
—কী?
—চারপাশে কী হচ্ছে তাকিয়েও দেখো না।
—কেন?
—মেয়েটা তো তোমার চেনা।
—যাঃ!
—আজ্ঞে হ্যাঁ। ও অনন্তকাকুর মেয়ে মামণি। ওইজন্যেই তোমায় দীপ্তদা বলেছে। সবাই তো তোমার মতো আবাক্কা নয়…
বোঝো! অনন্তকাকু আমার পুরনো পাড়ার লোক। সবুজগ্রাম কলেজের কাছে এই ফ্ল্যাটে উঠে এসেছি বছর দশেক হল, তবে দক্ষিণপাড়ায় আমার পৈতৃক বাড়িটা এখনও আছে। আর কোনওদিন ফিরে যাওয়া হবে না, তবু প্রাণে ধরে বেচে দিতে পারছি না। তাই ভাড়াটে বসানো আছে। অনন্তকাকু আমার ওপাড়ার কাকু। বাবা নেই পনেরো বছর হল, মা নেই তাও পাঁচ বছর। এখনও অনন্তকাকু আমাদের খোঁজখবর রাখে, নিজের বাড়ির গাছের কলা আম পেয়ারা সাইকেলে করে এসে দিয়ে যায়। আমাদের সম্বন্ধে অবশ্য একই কথা বলা যাবে না। রিনি তবু মাঝেমধ্যেই দেখি ফোন করে অনন্তকাকিমার সঙ্গে গল্পগুজব করে, আমার ওসব আসে না। আগে তাও মাসে মাসে ভাড়া নিতে গিয়ে অনন্তকাকুর বাড়িতে খানিকক্ষণ বসতাম। আজকাল ভাড়াটে ফোন পে করে দেয়, ফলে সে পাটও চুকে গেছে। তবে রিনি যা-ই বলুক, অনন্তকাকুর মেয়েকে চিনতে না পারা দোষের নয়। ওকে জন্মাতে দেখেছি, বড় হতে দেখেছি বাড়িতে থাকতে। পাড়াছাড়া হওয়ার পরে আর দেখলাম কোথায়? ও তো বাইরে কোথায় হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়তে গেছিল বেশ কয়েক বছর। তারপরেও যে সময়টায় ওদের বাড়ি যেতাম, তখন হয়তো বাড়িতে থাকত না। তাই দেখিনি অনেককাল। রিনি বলল বলে খেয়াল হল, অনন্তকাকু শেষ আমাদের ফ্ল্যাটে এসেছিল বোধহয় মাস ছয়েক আগে। এতদিন তো না এসে থাকে না! রিনি বলল, হ্যাঁ, আমারও অনেকদিন খোঁজ নেয়া হয়নি। প্রিন্সিপাল রিটায়ার করার পর থেকে কলেজে এত ডামাডোল… মাথায় থাকে না। তখুনি ফোন করা হল এবং পাওয়া গেল দুঃসংবাদ। কাকুর একটা জোরালো স্ট্রোক হয়ে গেছে মাস তিনেক আগে, একটুর জন্যে প্রাণে বেঁচেছে। এখনও বাড়ি থেকে বেরোনো বারণ।
পরদিন রবিবার। সকাল সকাল বাজার সেরে দিয়ে অনন্তকাকুকে দেখতে গেলাম। এক স্ট্রোকেই যে একটা লোকের চেহারা এত ভেঙে যেতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস করতাম না। বারান্দায় বসেছিল, আমাকে গেট দিয়ে ঢুকতে দেখেই চেঁচিয়ে কাকিমাকে বলল, কৃষ্ণা, দু-কাপ চা। দীপ্ত এসেছে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কাকিমা বেরিয়ে এল, আমাদের কুশল সংবাদ নিল। ফেরত যাওয়ার আগে কাকুকে বলল, ওকে চা দিচ্ছি। তুমি আর পাবে না। কাকুর অসন্তুষ্টি মুখে ধরা পড়ল, কিন্তু কিছু বলল না। অবস্থা দেখে আমারই এমন মায়া হল, বললাম— কেন? র চা খাওয়া তো শরীরের পক্ষে ভাল শুনেছি। ডাক্তার বারণ করেছে? কাকিমা বলল, উনি খাবেন দুধছাড়া চা? তাহলেই হয়েছে। ডাক্তার পইপই করে বলে দিয়েছিল, লাল চা খান ক্ষতি নেই। দুধ চা খবরদার খাবেন না। গ্যাস অম্বল হতে পারে, হলেই বিপদ। কিন্তু এনার যা জেদ, চা দিলে দুধ চা-ই দিতে হবে। নইলে যা শুরু করে… পাড়াপ্রতিবেশীর কাছে মানসম্মান থাকে না। তাই ওই সকালে এক কাপ দিই, আর দিই না। আজকে ভেবেছে তোমার নাম করে আরও এক কাপ আদায় করবে।
বলেই কাকিমা চলে যাচ্ছিল, কাকু খুব কর্কশভাবে বলল— মানসম্মান তো তোমরাই ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছ। এখন ঘোমটার নিচে খ্যামটা নাচার দরকার কী? আমার সামনে এভাবে কাকিমার সঙ্গে কথা বলায় স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কাকিমারও খুব মানে লাগল। টলটলে চোখে বলল, তোমার কি মাথাখারাপ হয়ে গেছে? ছেলের বয়সী ছেলের সামনে এইভাবে কথা বলছ? ছিঃ— বলে দৌড়ে চলে গেল। অনন্তকাকু বরাবর গোবেচারা লোক। আমার বাবা বরং মানুষটার সম্পর্কে বলত, অত গোবেচারা হওয়া ভাল নয়। সেই লোক কী কারণে এমন ব্যবহার করে বসল বুঝে উঠতে পারলাম না। শরীরটা খারাপ হয়ে যাওয়াতেই কি মেজাজটা বিগড়েছে এতখানি? কেটে পড়ব ভাবছিলাম। কিন্তু চা না খেয়ে চলে গেলে আবার কাকিমা দুঃখ পাবে। তাই চুপটি করে বসে রইলাম মোবাইলের দিকে তাকিয়ে। খানিকক্ষণ পরে কাকুই কথাবার্তা চালু করল।
—প্রথম স্ট্রোকেই চলে গেলে ভাল হত, বুঝলি দীপ্ত?’
—সে কী! কেন?
—তাইলে এই বয়সে এইসব দেখতে হত না আর কি।
—কী? কী হয়েছে?
—এই যে… ব্রাহ্মণের মেয়ে চায়ের দোকান দিল আর আমায় চেয়ে চেয়ে দেখতে হল।
এবার আমি আরও অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। কী বলি? ম্যানেজ দেওয়ার চেষ্টা করলাম।
—আরে তুমি ওরম ভাবছ কেন? কোনও কাজ ছোট নয়…
—ওসব বইয়ে পড়তে ভাল্লাগে। ও মেয়ের আর আমি বিয়ে দিতে পারব?
অনন্তকাকু নেহাত ভালমানুষ হলেও গলাটা চিরকালই অ-মাইক। ফলে কাকিমার কানে সবই যাচ্ছিল। রান্নাঘর থেকেই জবাব দেওয়া শুরু করল— মেয়েকে যখন হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়তে পাঠালে তখন একথা মনে ছিল না, না? পইপই করে বারণ করেছিলাম। কী ভেবেছিলে? ওই জিনিস পড়ে মেয়ে তোমার রাজরানি হবে?
কাকুও পালটা দিল— মেয়ের পড়তে বসার সময়ে পাড়া বেড়াতে আমি বারণ করিনি? লেখাপড়াটা ঠিক করে করলে তো আমার টাকার শ্রাদ্ধ করে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়াতে হত না।
আমি তখন পালাতে পারলে বাঁচি, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম ঝগড়াটা থামানোও দরকার। সদ্য এত অসুস্থতা কাটিয়ে ওঠা লোকের পক্ষে এত উত্তেজনা মারাত্মক হয়ে যেতে পারে। ফলে কাকিমার বাবা যে অনন্তকাকুর সঙ্গে বিয়ে দিয়েই আসল গোলমালটা পাকিয়েছিলেন, খুব কষ্ট করে এই বাদানুবাদ সেই পর্যন্ত যাওয়া অবধি অপেক্ষা করলাম। ততক্ষণে চা-বিস্কুট নিয়ে কাকিমা এসে পড়ল। আমি পীড়াপীড়ি করে বসালাম। তারপর বোঝালাম— ১) কাকুর শরীরের যা অবস্থা, এর মধ্যে চেঁচামেচি করলে খুব ক্ষতি হয়ে যাবে। বাড়ির সকলকেই উত্তেজনা এড়িয়ে চলা শিখতে হবে। ২) মেয়ে চায়ের দোকান খোলায় মহাভারত অশুদ্ধ হয়নি। এ তো আর যে সে চায়ের দোকান নয়, মডার্ন ব্যাপার। চা, কফি, স্ন্যাকস সবই পাওয়া যায়। আজকালকার ছেলেমেয়েদের চিন্তাভাবনাই অন্যরকম। ওরা অন্য কারও চাকরি করার থেকে নিজে ব্যবসা করা পছন্দ করে। এখন সরকারও সেলফ এমপ্লয়মেন্টে উৎসাহ দিচ্ছে। ও আজ একটা ছোট দোকান দিয়ে শুরু করেছে। কাল হয়তো বিরাট বড় ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে পারে। ব্যারাকপুরের দাদা বৌদির বিরিয়ানি কীভাবে শুরু হয়েছিল? আজকে প্রাসাদের মতো রেস্টুরেন্ট হয়ে গেছে। তাতে কত ভাল ভাল বাড়ির হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়া ছেলেমেয়েরা কাজ করে!
কথাগুলো শুনে কাকিমার মুখ উদ্ভাসিত হল। কাকুও ঠান্ডা হল, কিন্তু খুঁতখুঁত করা ছাড়ল না। সবই বুঝলাম, কিন্তু মেয়েটার তো বিয়ে দিতে হবে…
এই ব্যাপারটা নিয়ে দেখলাম কাকিমাও চিন্তিত। আমি বোঝাতে গেলাম— আরে ও নিয়ে অত ভাবছ কেন? আজকাল কি আর বাবা-মাকে ছেলে খুঁজে দিতে হয়? ও নিজেই পছন্দ করে নেবে ঠিক।
কাকিমা পাত্তা দিল না। সে তোর বউয়ের মতো দেখতে শুনতে ভাল হলে হত। তেমন কপাল তো করিনি… এত ছেলের সঙ্গে লেখাপড়া করল, একজনেরও কি মনে ধরল?
আমার যে আগের দিন সন্ধেবেলায় দেখা চেহারাটা খুব ভাল মনে ছিল তা নয়, তবে নেহাত কুচ্ছিত বলেও মনে পড়ল না। তাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে বলে দিলাম— যাঃ! কী যে বলো, কাকিমা? কী এমন খারাপ দেখতে তোমার মেয়েকে? দিব্যি ফর্সা, স্বাস্থ্য ভাল। আর কী চাই?
এবার দুজনেই হাসল। কাকু বলল— তোদের লেখালিখির লাইনে আজকাল মোটাকে স্বাস্থ্য ভাল বলে নাকি?
কী মুশকিল! আমি যে একটা স্কুলে ইতিহাসের মাস্টার, তার সঙ্গে আমার কথাবার্তার কোনও সম্পর্ক খুঁজে পায় না কেউ। যত আক্রমণ সব সাহিত্যচর্চাকে!
যা-ই হোক, অশান্তি আপাতত মেটানো গেছে। পরের ঝগড়া লাগার আগে কেটে পড়াই শ্রেয়। অতএব বেলা হয়ে যাচ্ছে ইত্যাদি বলে উঠে পড়লাম। রিনি সব শুনে আমি যা যা বলেছি তাতে খুশি হল, কিন্তু মন্তব্য করল, ব্যাপারটা যে চিন্তার সেটা কিন্তু ঠিকই।
—অ্যাঁ! তুমি এই কথা বলছ! একটা মেয়ে নিজে রোজগার করছে… তুমি খুশি নও?
—আমি খুশি হলেই তো হল না, পাত্রপক্ষ মেয়ে চায়ের দোকান চালায় শুনলে যে খুশি হবে না সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই।
—আরে চায়ের দোকান বলবে কেন? বলবে অন্ত্রেপ্রেনেয়র। নিজের ব্যবসা আছে।
শুনে রিনি হেসে কুটিপাটি। বলে, ইয়ার্কি হচ্ছে? এটা কি আমেরিকা না ইউরোপ? সবুজগ্রামে এখন পিৎজা হাট আর হাবিব’স স্যালন হয়েছে বলে কি ভাবো লোকে বিয়েতে ভাংচি-টাংচি দেবে না?
আমি একটু বিরক্তই হলাম। রিনি কলেজে ছাত্রীদের বলে বেড়ায়, নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে, বিয়ে করাই জীবনে সব নয়। এদিকে অনন্তকাকুর মেয়ের বেলায় বিয়ে বিয়ে করে মাথা খারাপ করছে। মেয়েটা যে বিয়ে করার জন্যে পাগল— এ-কথাই বা কে বলল? ও হয়তো স্বাবলম্বী হয়েই খুশি।
—মোটেই তা নয়। মেয়েটার যথেষ্ট ঘর-সংসার করার ইচ্ছে আছে।
—তুমি কী করে জানলে?
—ও আর আমি একই ট্রেনে যাতায়াত করতাম তো একবছর আগে অব্দি। তখন শুনতাম। একটা ছেলের সঙ্গে প্রেম ছিল সেই ম্যানেজমেন্ট কলেজ থেকে। তারপর একই জায়গায় চাকরিও করছিল ওরা। মামণিকে হোটেল স্যাক করে দিল, ছেলেটার চাকরি রয়ে গেল। তারপরে ছেলেটাও ব্রেক আপ করে দিল।
—ও বাবা! তুমি তো ওর বেশ ঘনিষ্ঠ দেখছি!
—ছিলাম। ওর চাকরি চলে যাওয়ার পরে আর রোজ দেখা হয় না, কথাও হয় না অনেকদিন। মাঝে মাঝে হোয়াটস্যাপ হয়, এই ক-মাস সেটাও হয়নি। নইলে তো কাকুর স্ট্রোকের খবরটা সঙ্গে সঙ্গেই পেয়ে যেতাম।
—এক বছর আগে কোথায় যেত বললে?
—কলকাতায় একটা হোটেলে চাকরি করত। চাকরি যাওয়ার পর এক বছর চেষ্টা করেও আর কিছু পেল না, শেষমেশ এই দোকানটা খুলেছে। অনন্তকাকুর খুব আপত্তি ছিল। মা, মেয়ে দুজনে চেঁচামেচি করে অ্যাডভান্সটা দিতে বাধ্য করেছে। মনে হয় ওই অশান্তিতেই কাকুর স্ট্রোক হয়ে গেল।
—যাঃ! প্রেমটা ভেঙে গেল!
—ও হো! তুমি দেখছি আমার কথাটা খুব সিরিয়াসলি নিয়ে নিয়েছ। আমি পেছনে লাগার জন্যে বলেছিলাম। যে যেটা ভাল পারে তার সেটা লেখাই ভাল। বিভূতিভূষণ কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখতে যাননি তো। শরৎচন্দ্রও রহস্য রোমাঞ্চ লেখেননি। তুমি যেটা ভাল পারো সেটাই করো। আমি আসলে বলতে চেয়েছিলাম, মাঝে মাঝে যে প্রেমের গল্প লেখার নোংরা নোংরা চেষ্টা করো, সেগুলো বন্ধ করো।
তিন.
এরকমই হয়, বুঝলেন? প্রেম করে বিয়ে করা বউও বছর বিশেক পরে বলে আপনি যে কেবল প্রেম করতে পারেন না তাই নয়, প্রেমের গল্পও লিখতে পারেন না। খুবই হতাশ হয়েছিলাম, দুঃখও যে হয়নি তা নয়। কিন্তু ভেবে দেখলাম, লেখালিখির ব্যাপারে রিনি ভুল কিছু বলেনি। সবাইকে দিয়ে যে সব জিনিস হয় না— এটা মেনে না নেওয়া এক ধরনের গোঁয়ার্তুমি। সম্পাদকদের ফরমাশে বেশ কয়েকটা প্রেমের গল্প লিখেছি বটে, কিন্তু সেগুলো যে দাঁড়ায়নি সেটা ঠিকই। পরে পড়লে নিজেও বুঝতে পারি, ওতে যা আছে তা হল সুড়সুড়ি। প্রেমও আছে, তবে ছুতো হিসাবে। ফলে দোল সংখ্যার জন্যে ঝুলোঝুলি করেছিল যে সম্পাদক, তাকে বলে দিলাম— প্রেমের গপ্পো-টপ্পো পারব না। তবে দোল নিয়ে একটা ভূতের গল্পের প্লট মাথায় এসেছে, দেখছি নামানো যায় কিনা।
সে গল্প বেরোল, পাঠকদের প্রশংসাও পেল। অনেকেই বললেন বেশ একটা নতুন ব্যাপার হয়েছে। আমার জীবনেও একটা নতুন ব্যাপার হয়েছে ইতিমধ্যে। রিনির বাতিক অনুযায়ী চল্লিশ পেরোবার পর থেকেই বছরে একবার করে দুজনের গাদাগুচ্ছের মেডিকাল টেস্ট করানো হয়। এবারে সেই চক্করে ধরা পড়েছে, আমার কোলেস্টেরল বেশি। ডাক্তার দেখানো হল, তিনি বললেন ওজন অন্তত দশ কেজি কমাতে হবে। এটা খাবেন না সেটা খাবেন না বলে থামলেও কথা ছিল, আদেশ হল— রোজ হনহনিয়ে অন্তত আধ ঘন্টা হাঁটতে হবে। ঘাম ঝরাতে হবে। সকালে সময় হয় না, তাই সন্ধেবেলা হাঁটা শুরু করলাম। প্রায় সব প্রিয় খাবারই ছাড়তে হয়েছে, ক্ষতিপূরণ তো চাই। তাই হেঁটে ফেরার সময়ে অনন্তকাকুর মেয়ে মামণির দোকানে লাল চা খাওয়া চালু করেছি। মাঝেমধ্যে লাল চায়ের বদলে কফি আর একখানা বড় পেস্ট্রিও মেরে দিই। গরম পড়ার পরে ও কোল্ড ড্রিঙ্কও রাখছে। এক-আধদিন তাও মেরে দিই। কথাটা পাঁচকান করবেন না। সত্যি বলছি, খুব বেশি অনিয়ম হয় না। কারণ পরপর দু-তিনদিন এসব ছাইপাঁশ গিললে চতুর্থ দিনে মামণিই বকে দেয়— আজ আর দেব না। চা খাও, বাড়ি যাও। তারপর আমার মুখটা দেখে বোধহয় মায়া হয়, তখন একটা বাপুজি কেক ধরিয়ে দেয়। মামণির সঙ্গে আলাপ জমিয়ে গোপন চুক্তি করেছি, ও রিনিকে এসব বলে না। তার বদলে আমি মাঝেমাঝে গিয়ে অনন্তকাকুর কাছে ওর সুখ্যাতি করে আসি। তিনি যেদিন দোকান চালু হয়েছে সেদিন থেকে ওর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। আমার দৌত্যে ধীরে ধীরে লাভ হচ্ছে। এখনও কথা বলছেন না, তবে ইদানিং রাতে মেয়ে দোকান বন্ধ করে ফিরলে একসঙ্গে খেতে বসছেন।
তা একদিন চা খাচ্ছি, ভানু এসে বাইক দাঁড় করাল প্রেমচাতালের গায়ে। তারপর রাস্তা পেরিয়ে এসে মামণিকে অর্ডার দিল— একটা পেপসি দিন না। মামণি ফ্রিজ খুলে বলল, পেপসি হবে না, থামস আপ দেব? ও মা! ভানু দেখি টলে পড়ে যাচ্ছে। আমি লাফ দিয়ে ধরে ফেললাম, চারপাশ থেকে লোকজন ছুটে এল। ছেলে প্রায় অজ্ঞান। ধরাধরি করে মামণির দোকানের ভিতরে ঢুকিয়ে টুলে বসানো হল। ও কথা বলার অবস্থায় নেই, তাও দেখি ফ্রিজের দিকে আঙুল দেখাচ্ছে। হাতে থামস আপের বোতলটা দিতে গেল মামণি, কিন্তু ও সেটা ধরার অবস্থাতেও তখন নেই। হাঁ করল, মামণি মুখে ঢেলে দিল। চোদ্দ টাকার বোতলটা শেষ করার পর মনে হল আস্তে আস্তে চোখ খুলছে, দরদরিয়ে ঘাম হওয়া কমছে। সোজা হয়ে বসতেও পারল। আমি আর মামণি ওকে বেসিনে নিয়ে গিয়ে চোখে মুখে জল দেওয়ালাম। ধাতস্থ হওয়ার পরে জিজ্ঞেস করলাম কী ব্যাপার।
—সুগার ফল করে গেছিল। আজকে অনেক সকালে বেরিয়েছি তো, ওষুধ খেয়েছিলাম কিনা মনে করতে পারছি না।
—সুগারটা আবার কবে বাধালি? চোখ কপালে উঠে গেল আমার।
—অনেকদিন। মায়ের ছিল, মামাদের ছিল, আর আমার হবে না?
ও বলতেই মনে পড়ল ভানুর মা-বাবাকে। দুজনেই ভানুর মতো লম্বা চওড়া, কিন্তু ওর মাকে দেখলেই অসুস্থ মনে হত। যদিও ভানুর বাবাই মারা গেছেন বছর ষাটেকে, মা তো এই সেদিন প্রায় আশি বছর বয়সে গেলেন। শেষ যেদিন ভানুর সঙ্গে বাজারে দেখা হয়েছিল, সেদিন ওর মাথা ন্যাড়া ছিল। তখনই জানলাম। ভানু আমার প্রাইমারি স্কুলের বন্ধু। দুজনেই সবুজগ্রামের বাসিন্দা হওয়ায় দেখাসাক্ষাৎ বরাবরই চালু, কিন্তু ওই পর্যন্তই। ছোটবেলার গলাগলি বন্ধুত্ব বজায় থাকেনি। সেই আট-ন বছর বয়সে ভাবতাম ভানুকে না দেখে থাকতেই পারব না। ওরও নিশ্চয়ই তাই মনে হত। সারাক্ষণ দুজনে একসঙ্গে থাকতাম বলে এক দিদিমণি নাম দিয়েছিলেন লালু-ভুলু। নাম দিয়ে অবশ্য স্বভাব বিচার করলে হবে না। দুজনেই যথেষ্ট দুরন্ত এবং সেয়ানা ছিলাম। তবে বড় হয়ে দেখলাম ভানু একাধারে লালু এবং ভুলু। লেখাপড়ায় প্রাইমারি থেকে কলেজ— দুজনেই সাধারণ ছিলাম। আমার ধারণা ভানুকেও আমার মতো আর্টস পড়তে দেওয়া হলে ওর ঠিক একটা হিল্লে হয়ে যেত। অন্তত আমার মতো একখানা মাস্টারি ঠিকই জোটাতে পারত। কে জানে কেন কমার্স পড়তে গেল! বিকম পাশ করতে না করতেই ওর বাবা দুম করে মারা গেলেন। ভেবেছিল চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হবে, লেখাপড়া করার আর উপায় থাকল না। ওর বাবা কোনও একটা প্রাইভেট কোম্পানিতে সামান্য চাকরি করতেন, পেনশন-টেনশনের ব্যাপারই ছিল না। মারা যাওয়ার খবর পেয়ে গিয়েছিলাম। শুনলাম তেমন কিছু রেখে-টেখেও যাননি। ভাগ্যে একতলা বাড়িটা নিজেদের ছিল। সেই থেকে ভানু এ কাজ সে কাজ করতে করতে এখন মুদির দোকানে অর্ডার সাপ্লাই করে।
প্রাইমারি স্কুলে আমাদের ক্লাসেই পড়ত আমাদের দক্ষিণপাড়ার সঞ্চিতা। তখনই ভানুর সঙ্গে বেশ ভাব ছিল, হাইস্কুল থেকে প্রেম। ভানুর বাবা মারা যাওয়ার খবর পেয়ে ওদের বাড়িতে গিয়েও সঞ্চিতা আর ওর দাদাকে দেখেছিলাম। তারপর কী হল জানি না, ভানুকে জিজ্ঞেস করতেও সঙ্কোচ হয়েছে। তবে আমার সঞ্চিতার বিয়েতে সবান্ধবে নেমন্তন্ন ছিল, আমার বাবা-মা তখন জীবিত। কয়েক বছর আগে একবার বাজারে শম্ভুদার চায়ের দোকানে আমি আর ভানু একসঙ্গে চা খাচ্ছিলাম, হঠাৎ কী কথায় যেন নিজেই বলল— সঞ্চিতার বরটা ভাল হয়েছে। বেঁচে গেছে মেয়েটা। আমি থ মেরে গেছি দেখে ভানু মুচকি হেসে বলেছিল— আরে ভাই আমার তো পেশারও ঠিক নেই, রোজগারেরও ঠিক নেই। কথাটা যুক্তিপূর্ণ, কিন্তু ভানুর সরকারি চাকুরে কাকা যেভাবে ওকে আর ওর মা-কে ওদেরই বাড়ি থেকে বার করে দিয়ে বাড়িটা প্রোমোটারকে বেচে দিয়ে গাদা টাকা কামিয়ে নিল তাতে আমি কোনও যুক্তি খুঁজে পাইনি। শুনে ভেবেছিলাম নির্ঘাত মামলা-মোকদ্দমা হয়েছিল, ভানু বেচারা ভাল উকিল-টুকিল দিতে পারেনি। ও মা! ওকে জিজ্ঞেস করায় বলল— আসলে বাবা মাকে কি আমাকে কিছু বলে যায়নি, বুঝলি? আমরা তো জানতাম দাদু জমিটা কিনে গেছিল, বাবা বাড়ি করেছে। কাকামণি আমাদের দলিল দেখাল যে জমিটা ওর নাম নামে কেনা। তা কী আর বলি?
—সে কী রে! এত সহজে ছেড়ে দিলি? দলিলটা যদি জাল হয়?
—তাহলে একটা আসল দলিল তো থাকবে। সেটা কই? আমাদের কাছে তো কোনও দলিল নেই।
—আহা তোরা তো ওই বাড়ির পজেশনে ছিলিস, জেদ করে বসে থাকতে পারতিস। তারপর আইন আদালত যা করার তোর কাকা করত। সে মালের তো কলকাতায় ফ্ল্যাট আছে বললি। তোদের তো এটুকুই সম্বল ছিল।
—ওসব ঝামেলায় গিয়ে কী হবে ভাই? মা প্রায় নড়তে চড়তে পারে না আর আমার যা কাজ, না বেরোলে পয়সা নেই। আদালতে ছুটোছুটি করতে গেলে তো সব ডকে উঠে যেত। মামলা লড়ার পয়সাই বা পাব কই?
কাকাটা এত বদ যে প্রোমোটারের থেকে পাওয়া টাকার ভাগও দেয়নি ভানুদের। সুতরাং আমার লালুভুলু বন্ধু ভানু চুপচাপ স্টেশনের কাছে একটা বাড়িতে দুটো ঘর ভাড়া নিয়ে বুড়ি মায়ের সঙ্গে ছিল ১০-১২ বছর ধরে। এখন মা চলে গিয়ে একা। কিন্তু ভানুর মুখ থেকে হাসি কখনও মোছে না, সেই প্রাইমারি স্কুল থেকে দেখছি। দিদিমণির টেবিলে ব্যাং ছেড়ে দিয়েছে, তাই বড়দি স্বয়ং এসে বেত মারছেন। ভানুর মুখে কিন্তু হাসি। আঃ উঃ করছে, কিন্তু কাঁদছে না। তাতে বড়দির মাথা আরও গরম হচ্ছে, মোটা শরীর গলদঘর্ম। তবু ভানুর হাসি যায় না। এই কারণে শুনেছি হাইস্কুলেও অন্যদের থেকে বেশি মার খেত। ওকে মেরে কিছুতেই যে মারছে সে জয়ের সুখটা পেত না, বরং যত মারত তত তার পরাজয়ের গ্লানি বেড়ে যেত। সেই ভানু হিপ পকেট থেকে পার্স বের করে মামণিকে বলল— চোদ্দ তো?
মামণি বলল— না না, দিতে হবে না। আপনি সাবধানে বাড়ি যান।
—আরে ছি ছি, তা কেন? সুগারের রুগীদের এরকম হয় মাঝে মাঝে। আপনিও বিজনেসম্যান, আমিও বিজনেসম্যান। এসব করবেন না।
ভানু দেবেই, মামণিও নেবে না। আমি প্রথমে ভানুর পক্ষ নিয়েছিলাম, কারণ ভানুর যুক্তি এবারেও অকাট্য। ভানু মোটেই গরিব-দুঃখী নয়, খামোকা ওকে চোদ্দ টাকা মাফ করার দরকার কী? কিন্তু বাদানুবাদ একটু চলার পরেই আমাকে দলবদল করতে হল। কারণ মামণি যদি আমার উপর খেপে যায় তাহলে সমূহ বিপদ। ভানুর আত্মসম্মান রক্ষার স্বার্থে আমার যাবতীয় গোপন কার্যকলাপ রিনির কাছে ফাঁস হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নেওয়া যায় না। সে ঝুঁকি যে আছে সেটা ওরই মধ্যে চোখের ইঙ্গিতে মামণি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। আমরা দুজনে মিলে চাপাচাপি করায় ভানু শেষে প্রচণ্ড রেগে গেল। একেবারে আমাদের মুখের সামনে আঙুল নেড়ে বলল— আমি জীবনে অনেক সহ্য করেছি। কিন্তু কারও দয়া নিই না। এই রেখে গেলাম টাকা। না লাগলে ভিখিরিকে দিয়ে দেবেন। বলে হনহন করে দোকান থেকে বেরিয়ে বোঁ করে বাইক ঘুরিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে চলে গেল।
বিপদ কেটে গেছে দেখে মামণিকে বললাম— তুই টাকাটা নিতে চাইলি না কেন বল তো?
(হ্যাঁ, এখন তুই করেই বলি। যে দাদারা ছোটবেলায় কোলে চড়িয়ে ঠাকুর দেখায়, আমাদের সবুজগ্রামে তাদের এখনও একটা আলাদা ইয়ে আছে)।
মামণি ভয়ানক ঝাঁঝিয়ে উঠল— আরে একটা মানুষ মরো মরো অবস্থায় আমার দোকানে এসছিল, এখন টাকার হিসেব করার সময়?
—আরে বাবা কিচ্ছু মরো মরো নয়। সুগারের রুগীদের ওরকম হয়, তখন একটু বেশি মিষ্টি খেলেই ঠিক হয়ে যায়। ওইজন্যেই তোর দোকানে এসে পেপসি চাইল। অত সিরিয়াসলি নেওয়ার কী আছে?
—তুমি বয়স্ক লোক, তুমি লাইট নিতে পারো। আমি অত ইনহিউম্যান হতে পারব না।
বাপ রে! এ মেয়ে যে এত আবেগপ্রবণ, কে জানত? দেখলাম তখনও রাগে ফুলছে, গাল-টাল লাল একেবারে। তাই আর না ঘাঁটিয়ে ফ্ল্যাটের দিকে রওনা হলাম। পঁয়তাল্লিশেই বয়স্ক বলে দেওয়াটা গায়ে মাখলাম না। একেকটা ঘটনা কত লোককে নতুন করে চিনিয়ে দেয়! এই ৪৫ বছরের মধ্যে ভানুকে চিনি অন্তত ৪০ বছর। কিন্তু ওর আত্মসম্মান যে এত প্রবল, ও যে এত রেগে উঠতে পারে— এটাও জানতাম না। মামণি বড় হওয়ার পরে এই যে মাস চারেক ধরে রোজই দেখা হচ্ছে, কথা বলছি, তাতে ও যে শান্ত, মার্জিত, অপরিচিত লোকের সঙ্গে গম্ভীর, দরকার না পড়লে হাসে না— এইসবই বুঝেছি। ওর যে এত নরম মন তা কিন্তু ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি। ফ্ল্যাটের দিকে এক পা এক পা করে এগোতে এগোতে বুঝতে পারলাম, দুজনকেই আরও ভালবাসতে ইচ্ছে করছে।
চার.
দিন সাতেক পরে যথারীতি হাঁটা শেষ করে ঘেমেনেয়ে ফিরছি, ভানু দেখি সাইকেলে করে যাচ্ছে। দাঁড় করালাম। দুটো কথার পরে মামণির দোকানের দিকে দেখিয়ে বললাম, চল, চা খাই।
কেমন ঘাবড়ে গিয়ে বলল— ওখানে?
—কেন? কী হয়েছে?
—আচ্ছা চল।
আমি ফ্যাক করে হেসেই ফেললাম। ভানু রেগে বলল— তুই কি ভাবছিস আমি ভয় পাচ্ছি?
—তুই কী পাচ্ছিস সে আমি কী করে জানব? কিন্তু একটা বাচ্চা মেয়ে তোর কী অবস্থা করেছে সেটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। বড়দি বেত নিয়ে আসছে শুনেও তোর এরকম চেহারা আমি দেখিনি।
ভারি লজ্জা পেয়ে গেল। তাই নিয়ে হাসাহাসি করতে করতে মামণির দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। সে রাস্তার দিকে পিছন ফিরে কিছু একটা করছিল, আমি— দুটো লাল চা দে, একটা চিনি ছাড়া— বলতে ঘুরে তাকিয়ে ভানুকে দেখেই বলল— ও মা! এখন কেমন আছেন? ওষুধ খেতে ভুলে যাচ্ছেন না তো? কথার আন্তরিক সুরটা সত্যি বলতে আমাকেও অবাক করেছিল, কারণ ভেবেছিলাম ও একটু শীতল ব্যবহারই করবে ভানুর সঙ্গে। না হলে দেখেও না দেখার ভান করবে। ভানু দেখলাম একেবারে হাঁ হয়ে গেছে। সামলে নিয়ে বলল, ভাল, ভাল। আপনি ভাল?
কাগজের কাপ দুটো আমাদের সামনে রাখতেই আমি তুলে নিলাম, ভানু হাত দুটো পকেটে ঢুকিয়ে বেশ রেলায় বলল— আজ টাকা নেবেন তো? নইলে খাব না কিন্তু।
আমি মনে মনে বললাম, শালা দিল আজকের সন্ধেটাও চটকে। অথচ মামণি বেশ মিষ্টি হেসে— রোজ রোজ ফ্রিতে আমি খাওয়াই না— বলে নিজে থেকেই আমাদের দুজনকে দুটো টোস্ট বিস্কুট এগিয়ে দিল। আমাকে কিন্তু না চাইলে কোনওদিন দেয় না। আমি যে চায়ের সঙ্গে বিস্কুট খাই না, চা শেষ করে চুপিচুপি কেক খাই, সেটা তো আর এক্ষেত্রে বিবেচ্য হতে পারে না। তাই না? এ মেয়ে যে অপরিচিত লোকের সঙ্গেও হেসে কথা বলতে পারে সেটা শিখলাম। আরও শিখলাম, ভানু শুধু সদাহাস্যময় নয়, বেশ কায়দা করে কথা বলতেও পারে। সে কী কথোপকথন!
—আপনি তো সুগার কমে গেলে কোল্ড ড্রিঙ্ক খান আর সুগার ঠিক থাকলে চা। সলিডও কিছু খান, নাকি শুধুই লিকুইড?
—ছি ছি, কী যে বলেন… লিকুইড আমি ছুঁই না। চা, পেপসি তো সলিডের মধ্যেই পড়ে। দুধ যেমন নিরামিষ।
—ঠাট্টা ছাড়ুন। ডায়বেটিস রুগীর তো খাওয়াদাওয়াও ঠিক করে করা দরকার। আপনাকে দেখেই বোঝা যায় অনিয়ম করেন। বাড়িতে কেউ কিছু বলে না?
—আগে বলত। এখন আর বলে না।
—মানে বুঝে গেছে আপনি কথা শুনবেন না।
—না, ব্যাপারটা তার চেয়েও সোজা।
—মানে?
—মানে এখন আর বলার কেউ নেই।
মামণি একটু থমকে গেল। আপনার বাবা, মা, ভাই, বোন— কেউ নেই?
—আমি এক ছেলে। বাবা মারা গেছে অনেকদিন, মা মারা গেছে মাস ছয়েক।
মামণির মুখটা ম্লান হয়ে গেল ক্ষণেকের জন্য, তারপরেই সামলে নিয়ে বলল, বৌদি কিছু বলেন না?
—বাবা-মার এক ছেলে বললাম যে? আমাকে একটা বৌদিওলা দাদা জোগাড় করে দিন না।
—উফ! আপনি তো হেবি ফাজিল! আপনার বউয়ের কথা জিজ্ঞেস করছি বুঝতে পারছেন না?
—বিয়ে করেনি। ব্যাটাকে একসময় অনেক করে বলেছিলাম করতে, আমি বাধ্য হয়ে বললাম। তখন পাত্তাই দেয়নি। এখন বুঝছে ঠ্যালা।
এ-কথার পরেই ভানুর গলা খাদে নেমে গেল।
—বিয়ে কর বললেই কি করা যায়? নিজের বাড়িঘর নেই… আজ এ ব্যবসা করি তো কাল ও ব্যবসা… কোনও ভদ্রলোকের মেয়েকে এইভাবে বিয়ে করা যায়?
ইয়ার্কি করতে গিয়ে দুর্বল জায়গায় হাত দিয়ে ফেলেছি বুঝে আমি চুপ করে গেলাম। মামণিও অস্বস্তিতে পড়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার ভান করল। চায়ে শেষ চুমুকটা দিয়ে কাগজের কাপটা ডাস্টবিনে ছুড়ে দিতে দিতে প্রায় স্বগতোক্তির মতো ভানু বলল— আর ঠ্যালার কী আছে? মা অনেকদিন অসুস্থ ছিল, বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমাকে পাড়াপ্রতিবেশীর ভরসায় থাকতে হত। সারাক্ষণ চিন্তা— এই বুঝি কোনও এমার্জেন্সি হল, ফোন এল। কতবার যে বহুদূর থেকে হুড়মুড়িয়ে ছুটে আসতে হয়েছে কাজকম্ম ফেলে। মা চলে গিয়ে বরং নিশ্চিন্ত হয়েছি।
মেঘ কাটানোর জন্যে বললাম, তুই তো রান্নাবান্না করতে পারিস, তাই না?
—ফার্স্ট ক্লাস রান্না করতে পারি। তুই একদিন আয় না বউকে নিয়ে। কেমন খাওয়াব দেখবি।
—তোর তো সারাদিন টো টো করে ঘোরা কাজ, কী করে যাব?
—তুই কবে আসবি বল না। একটা দিন ঠিক ব্যবস্থা করে নেব।
এগুলো খেজুড়ে আলাপ। আমিও জানি আমার কোনওদিন যাওয়া হবে না, ভানুও জানে আমি কোনওদিন যাব না। মানে অন্তত আমি খেজুড়ে আলাপ ভেবেই কথাগুলো বলছিলাম। কথার হালকা চাল গোলমাল হয়ে গেল ভানুর আকস্মিক প্রস্তাবে— আপনিও আসুন না, ম্যাডাম।
—আমি!
—হ্যাঁ… মানে আপনি আমার জন্যে সেদিন যা করলেন…
—আমি! কী করলাম?
—না, সেদিন অচেনা লোককে অত যত্নআত্তি করলেন…
—ধুর! যত্নআত্তি আবার কী? একটা মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে আরেকটা মানুষ এইটুকু করবে না?
—করার তো কথা, ম্যাডাম। কিন্তু করে কজন? আমার বাবা মারা গেছিল গরমে সানস্ট্রোক হয়ে, জানেন? হাওড়া স্টেশনের বাইরে বসে বসে মরে গেছিল ভরদুপুরে। হাজার হাজার লোক যাতায়াত করে ওখান দিয়ে। একজন একটু ছায়ায় নিয়ে গিয়ে বসালে, জল-টল খাওয়ালে… বেঁচে থাকতে সাধারণ লোক, মরে গিয়ে ফেমাস হয়ে গেল। পরদিন কাগজে ছবি বেরিয়েছিল।
বলে ভানু মিটিমিটি হাসল। ওর এই অস্বস্তিকর রসবোধটা চিরকাল দেখেছি। খুব করুণ ঘটনা বা খুব গা জ্বালা করার মতো ঘটনার মধ্যেও ও ঠিক একটা মৃদু হাসির উপাদান খুঁজে পায়।
মামণি বলল, আচ্ছা যাবখন। আমি অবাক। সুর শুনে তো মনে হল না কথার কথা বলছে। আবার যোগ করল— দীপ্তদা নিয়ে গেলেই যাব।
—ও আমার এই বাড়ি চেনেই না— বলে ভানু নিখুঁত পথনির্দেশ দিয়ে দিল। মামণিও এমন জিজ্ঞেস করে করে নিশ্চিত হয়ে নিল যে মনে হল কালই গিয়ে পৌঁছবে।
পাঁচ.
অনন্তকাকু বাড়ি থেকে বেরোবার ছাড়পত্র পেতেই মামণির বাড়িতে আরেক প্রস্থ অশান্তি শুরু হল। এবার তার দাবি, সে মেয়ের সঙ্গে দোকানে গিয়ে বসবে। এই দাবিতে গিন্নিকেও পাশে পেয়ে গেছে। মামণির মায়েরও ধারণা একলা মেয়ে দোকানে বসলে নানারকম আজেবাজে লোকের উপদ্রব হতে পারে। বাবা উপস্থিত থাকলে সেসব আপদ হবে না। মামণির দুটো যুক্তি— ১) এক বছর হয়ে গেল একা একা দোকান করছে, অ্যাদ্দিন কিছু হল না। হঠাৎ এখন হতে যাবে কেন? ২) সে প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে। তার নিজের ব্যবসা নিজে চালানোর স্বাধীনতা এবং ক্ষমতা আছে। বাবা কেন খবরদারি করবে? এতদিন পরে বাবা চৌকিদারের মতো দোকানে বসা শুরু করলে তার মানসম্মানই বা কোথায় থাকবে?
দুই পক্ষ থেকেই আমাকে ফোন করে বিহিত চাওয়া হল। আমাকে কাকু-কাকিমা যতই নিরপেক্ষ বলে ভাবুক, কাকুকে দোকানে বসে থাকতে না দেওয়ায় বিলক্ষণ আমার স্বার্থ আছে। অনন্তকাকুর সামনে কেক, পেস্ট্রি গিললে সঙ্গে সঙ্গে রিনির কাছে খবর চলে যাবে (ইদানীং মাসে দু-একবার মামণিকে দাদাসুলভ ধমকধামক দিয়ে মোমোও খাই। এত কিছু ত্যাগ করা যায়, বলুন?)। ফলে আমাকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হল। একা দুজনকে সামলাতে পারব কিনা নিশ্চিত ছিলাম না বলে রিনিকে সঙ্গে নিয়ে ওদের বাড়ি গেলাম। রিনি কাকিমাকে বোঝাল নারীস্বাধীনতা, মেয়ে বড় হয়ে গেলে তার মতামতকে গুরুত্ব দিতে হয়, ঠাকুমা-দিদিমারা সুযোগ করে না দিলে আমাদের মায়েদের লেখাপড়া করা হত না। অতএব আজকের মায়েদের কর্তব্য মেয়েদের আরও বেশি সুযোগ করে দেওয়া, ইত্যাদি যুক্তি দিয়ে ম্যানেজ করে ফেলল। আমি কাকুকে বোঝালাম যে চিন্তার কারণ নেই। আমি প্রায় রোজই সন্ধেবেলা ওই পথে যাতায়াতের সময়ে মামণির উপর নজর রাখি, চা-কফি খাই। তাছাড়া ওখানকার দোকানদাররা সকলেই আমার পরিচিত, মামণিকেও এতদিনে চিনে গেছে। ওরা লোক ভাল। ফলে ওখানে ওকে কেউ বিরক্ত করার সাহসই পাবে না। তাছাড়া মামণির মতো মেয়ে হয় না… এত মায়াদয়া… এই তো কিছুদিন আগে আমার এক বন্ধু ওর দোকানে এসে অসুস্থ হয়ে পড়ল, ও কত সেবাশুশ্রূষা করল। সেই বন্ধুও খোঁজখবর রাখে। তার বিরাট চেহারা। নিয়মিত আসে মামণির দোকানে। কারও কোনও নষ্টামো করার ইচ্ছা থাকলেও তাকে দেখে আর সাহস হবে না ইত্যাদি, প্রভৃতি। শেষে রফাসূত্র যেটা বেরোল, সেটা হচ্ছে কাকু সকালে বাজার করে ফেরার পথে খানিকক্ষণ দোকানে গিয়ে বসবে। মামণি আপত্তি করল না, কারণটা আমাকে কানে কানে বলে দিয়েছে। আসলে সকালে ও দোকান খোলে নিয়মরক্ষার জন্যে। দু-একজন খদ্দের হয়। আসল ব্যবসা হয় সন্ধেবেলা। চা, কফি খেতে বেশি খদ্দের আসে না। প্রেমচাতালের ছেলেমেয়েরাই বেশি আসে স্যান্ডউইচ, পকোড়া, মোমো, পেস্ট্রির টানে। অতএব বাবা সকালে খানিকক্ষণ মাছি তাড়ালে প্রেস্টিজ পাংচার হবে না বলেই মামণির মত।
কিন্তু গল্প সেখানে নয়। মানে আমার ধারণা অনুযায়ী এতক্ষণ কোথাও গল্পের নামগন্ধ ছিল না। কিন্তু সাইকেলে বাড়ি ফেরার পথে রিনি জিজ্ঞেস করল— ভানুদা সত্যিই সেই ঘটনার পর থেকে মামণির দোকানে ঘনঘন আসে?
—ঘনঘন বলা যায় না। ওটা আমি বাড়িয়ে বললাম ইচ্ছে করেই। সপ্তাহে একদিন আসে, তাও প্রতি সপ্তাহে না।
—কী করে এত শিওর হচ্ছ? প্রত্যেকবার তোমার সঙ্গে দেখা হয়?
—প্রায়ই হয়। সবসময় হয় না।
—মানে তোমার সঙ্গে যতবার দেখা হয় তার চেয়ে বেশিবার আসে তো?
—হ্যাঁ মামণি তো গল্প করে— কাল ভানুদা এসছিল, এই বলল তাই বলল…
এসব কথাবার্তার সময়ে রিনির মুখের চেহারাটা আমি খেয়াল করিনি, কারণ ঝটপট বাড়ি ফিরে টিভিটা খুলে বসা দরকার ছিল। ইস্টবেঙ্গল আর বেঙ্গালুরু এফসি মুখোমুখি। ম্যাচের ৯০ মিনিট আর বউয়ের দিকে তাকাইনি, তবে অনেকক্ষণ কানে হেডফোন লাগিয়ে কার সঙ্গে যেন ফোনে কথা বলছিল চোখে পড়েছে। ইস্টবেঙ্গল হেরে গেল, তাই ভারাক্রান্ত হৃদয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিলাম। রিনির মুখ দেখে ভয় পেয়ে গেলাম। কোনও ভূমিকা না করে সটান বলে বসল— মেয়েটা মরেছে। সাসপেন্স তৈরি করার কী অনবদ্য শৈলী! আমার নয়, রিনিরই গল্পকার হওয়া উচিত ছিল। ভর সন্ধেবেলা বলে কিনা মেয়েটা মরেছে! কোন মেয়ে? কোথায় মরল? কী করে মরল? রোগে ভুগে মরল, না হঠাৎ দুর্ঘটনায় মারা গেল? আমি কিছুই ভেবে পেলাম না। তখনও ভাবছি— পেনাল্টিটা মিস না করলে ম্যাচটা অন্তত ড্র হয়ে যেত। রিনি এত বছর আমার সঙ্গে ঘর করছে। ফলে অবস্থাটা ও বুঝতে পারল এবং প্রবল খেপে গেল। বাড়ি কাঁপিয়ে বলল— মামণির কথা বলছিইইইই। ওই চিৎকারে আমার মাথার তালা খুলে গেল, বাড়ি ফেরার সময়ে রিনির করা প্রশ্নগুলো ঝপ করে মনে পড়ল।
—ভানু?
—আর কে…
ব্যাপারটা যে গুরুতর, তা বুঝতে অবশ্য আমার এক মিনিটও লাগল না। ভানু আমার বয়সী, মানে ৪৫। মামণি বড়জোর ২৫-২৬। এ বিয়ে হয় না। তাছাড়া ভানুর বিয়ে-থা করার ইচ্ছে আছে বলেও তো মনে হয় না। এই সেদিনও তো বলল কোনও ভদ্রলোকের মেয়েকে বিয়ে করার অবস্থা ওর নেই। তবে সেটা হয়তো স্রেফ বিয়ে এড়ানোর জন্যে বলা। নইলে দুনিয়ার সব অর্ডার সাপ্লায়ার কি অবিবাহিত? যারা বিয়ে করেছে তাদের কি সংসার চলে না, ছেলেপুলে মানুষ হয় না? নিজের বাড়ি নেই বলে বিয়ে করতে পারছে না এই যুক্তিটাও অকাট্য নয়। আগে তো অনেকে ভাড়াবাড়িতেই সপরিবারে সারাজীবন কাটিয়ে দিত। এখনও যে নিজের বাড়ি না থাকলেই লোকে বিয়ে করে না তা তো নয়। মিঞা-বিবি রাজি হলে ওটাও কোনও বাধা নয়। কিন্তু আজকের দিনে বিশ বছরের বড় ছেলেকে কেউ বিয়ে করে? অনন্তকাকু আর কাকিমাই বা মেনে নেবেন কেন? মামণি না হয় একটু মোটা। তা বলে দেখতে শুনতে এত খারাপ নয় যে সম্বন্ধ করলে পাত্র জুটবে না। অন্তত একমাত্র মেয়ের জন্যে চেষ্টার তো ত্রুটি রাখবেন না ওঁরা। মেয়ের চায়ের দোকান খোলা না হয় অনেক কষ্টে মেনে নিয়েছেন, তা বলে আধবুড়ো ছেলেকে মেয়ে বিয়ে করবে! আমার দৌত্যে বাপের সঙ্গে মেয়ের কথাবার্তা এখন চালু হয়েছে। ভানুর সঙ্গে বিয়ের কথা উঠলে ফের বন্ধ হয়ে যাবে। এক শতাংশও সন্দেহ নেই। আর সব মেনে নিলেও, পারমিতা চক্রবর্তীর সঙ্গে ভানু পালের বিয়ে অনন্তকাকুরা কিছুতেই মেনে নেবেন না।
খেতে বসে এইসব আলোচনা করতে করতে আমরা দুজনেই মহা দুশ্চিন্তায় পড়লাম। রিনি ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল— আর লোক পেল না? কী দেখল ভানুদার মধ্যে? একবার না দুবার বাজারে দেখেছিলাম। খুব হ্যানসাম কি? মনে পড়ছে না তো!
—না, সেরকম কিছু নয়। তবে, ধরো লম্বায় পাঁচ-সাত কি পাঁচ-আট হবে। চওড়াটা তার সঙ্গে মানানসই। ফলে দেখতে মন্দ লাগে না।
—চুল রং করে বয়স কমিয়ে রেখেছে, না?
—তা তো নয়! অর্ধেক চুলই তো পাকা। তার উপর মুখভর্তি কাঁচাপাকা দাড়ি। দেখলে আমার থেকে বড়ই মনে হয়।
—উফ! তাহলে মেয়েটা পেলটা কী?
—আচ্ছা আমি কী করে জানব সেটা? তুমিই তো এতক্ষণ ধরে কথা বললে। কী বলল মামণি?
—গদগদ একেবারে। বলল এরকম পুরুষমানুষ নাকি জীবনে দেখেনি।
—ও, কীরকম পুরুষমানুষ সেটা টেস্ট করাও হয়ে গেছে?
—ধ্যাৎ! তোমার খালি ওইসব চিন্তা। আমি একটা সিনিয়র বৌদি, আমাকে ও এইসব বলবে?
—তা বৌদিদেরই তো এসব বলে মেয়েরা। বৌদিদেরই তো জেনে নেয়া কাজ।
—বাজে ইয়ার্কি না মেরে কী করে মেয়েটাকে বাঁচানো যায় সেটা ভাবো।
—দাঁড়াও দাঁড়াও। আসল কথাটাই জিজ্ঞেস করা হয়নি। ব্যাপারটা একতরফা নয় তো? মানে ভানু কি ওকে প্রোপোজ করেছে?
—তুমি কী ভাবো বলো তো? আমি কিছুই না জেনে এত চিন্তা করছি?
—ভানু বলেছে, আমি তোমাকে ভালবাসি? ওকে এত ইররেসপন্সিবল ছেলে তো মনে হয় না!
—ধুত্তোর! এ কি সিনেমা নাকি? ওরকম কিছু বলেনি। মামণির তো নিজেরই ধুকপুকুনি যথেষ্ট। তাই একদিন জিজ্ঞেস করেছিল, এখন রোজই এদিকে আসেন কী ব্যাপার? তাতে ভানুদা বলেছে, এদিকে আসি না। আপনার কাছে আসি।
—ওব্বাবা! ভানু আবার এসব বলতে জানে! যাকগে, এটা তো ফ্লার্ট করা। ব্যাপারটা নিয়ে যে ও সিরিয়াস তার প্রমাণ কী?
—মামণির দোকান কবে বন্ধ থাকে?
—আর সবার যেদিন থাকে। বৃহস্পতিবার।
—এই বৃহস্পতিবার দুজনে সিনেমা দেখতে গেছিল।
ছয়.
লেখক হয়ে গিয়ে আর পাঠক থাকতে পারিনি, বুঝলেন? নইলে ব্যাপারটা আমার অনেক আগেই ধরতে পারা উচিত ছিল। প্রেমচাতালে প্রেমের গল্পের সন্ধানে গেছিলাম। কবির সেই লাইনগুলো মনে থাকলে এই ভুল হত না— ‘প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে,/কে কোথা ধরা পড়ে, কে জানে…।’ চোখের সামনে আমার গোবেচারা বন্ধু ভানু হাঁটুর বয়সী মেয়েটার সঙ্গে প্রেম করে ফেলল, আমি শালা টেরই পেলাম না! কাকু-কাকিমা এখনও জানে না তাই। জানলে আবার আমাকে এর জন্যে দায়ী না করে বসে। মামণির দোকান চালানোর পক্ষে আমি সমানে সওয়াল করে গেছি। এখন আবার ভেবে না বসে যে এর আসল কারণ আমার বুড়োটে বন্ধুকে মামণির সঙ্গে জুতে দেওয়া। অতটা না ভেবে যদি শুধু জেনেশুনে প্রশ্রয় দিয়েছি ভাবে, তাতেও আমাদের ক্ষতি। ওরা অনাত্মীয় হয়েও আমাদের খুবই ভালবাসে। এদিকে মামণিকে আমরাও স্নেহ করি, চাই না ওর ক্ষতি হোক। সারারাত পর্যন্ত এসব আলোচনা করতে করতে আমাদের ঘুম এল না। শেষ রাতে, যখন আলো ফুটতে শুরু করেছে, দু-একটা কাক ডাকছে, রিনি বলল, আচ্ছা, ভানুদা মানুষটা ভাল তো?
—খারাপ কিছু তো দেখিনি বা শুনিনি। নেশাভাং করেনি কোনওদিন। সিগারেট পর্যন্ত খায় না। ওই একটা ছোটবেলার প্রেম ছিল, তা বাদে মহিলার দোষ-টোষও নেই। থাকলে ঠিকই খবর পেতাম। আমাদের সবুজগ্রাম এখনও কলকাতা শহর হয়ে যায়নি। আর ওসব করার সময়ই বা পেল কখন? গোটা জীবনটাই তো দৌড়াদৌড়ি করে কোনওমতে বাঁচার জোগাড় করতেই কেটে গেল ছেলেটার। ভালবাসার তেষ্টাটা বোধহয় রয়ে গিয়েছিল, বুঝলে? তাই এই ভুলটা করে ফেলেছে। মামণির মতো মেয়েও তো খুব বেশি হয় না আজকাল…
চোখে ঘুম নেমে আসার সময়ে আগে সমাজ ঘুমিয়ে পড়ে, মনটা নরম হয়ে যায়। তখন সব সামাজিক আদবকায়দা, হিসাবনিকাশের ঊর্ধ্বে উঠে ওসব অনুভব করতে পারে মানুষ। ঘুম ভেঙে ওঠামাত্রই মাথার ভিতরের সমাজটা জেগে ওঠে। তখন খেয়াল হয়, স্বপ্নে গা ভাসিয়ে জীবন চলে না। শুধু প্রেম দিয়ে বিয়ে টেকে না। আজ যার বয়স ২৫, সে প্রেমের প্রাবল্যে ৪৫-কে বিয়ে করতেই পারে। কিন্তু সে যখন ৪৫ হবে, তখন আজকের ৪৫ পৌঁছে যাবে ৬৫-তে। তখন সে আজকের পাগল করে দেওয়া প্রেমিক থাকবে না। হয়তো হেঁপো রুগী হয়ে যাবে, বা প্রস্টেটের সমস্যায় যখনতখন কাপড়ে-চোপড়ে করবে। তার ৪৫ বছরের বউয়ের তখন সেই বুড়োর উপর রাগ হবে, আরও বেশি রাগ হবে নিজের উপর। আজকের অন্ধ প্রেম তখন সহস্রাক্ষি হয়ে তার গোটা জীবনের যত ভুল সব দেখাবে বৃদ্ধ স্বামীর মধ্যে, ফুলশয্যার স্মৃতিটুকুও মুছে গিয়ে অয়েল ক্লথ পাতা বিছানা কাঁটা ফোটাবে দুজনের গায়েই। চা খেতে খেতেই রিনির সঙ্গে এসব আলোচনা হল। ঠিক করলাম, দেরি না করে আজই এই কথাগুলো বুঝিয়ে বলব ভানুকে। মামণিকে বোঝাবে রিনি।
কিন্তু বিকেলের আগে তো সময় হবে না আমার, স্কুল আছে। ভানুকে ফোন করলাম— একটু কথা ছিল রে। বিকেলে তোর বাড়ি যাব ভাবছিলাম, কিন্তু তোর তো ফিরতে ফিরতে রাত হয়, নাকি? তাহলে ফোনেই…
—না রে, আজ বেরোব না ভাবছি। কাল রাতে জ্বর এসেছিল, শরীরটা ভাল্লাগছে না। আসিস…
আঃ! এমনি কি আর লোকে টাক পড়ছে বললে আমি বলি আমার কপাল চওড়া?
সাত.
ভানুর বাড়ির পাড়ায় অনেকবার গিয়েছি। হাইস্কুল থেকে ইউনিভার্সিটি পর্যন্ত আমার যে সবচেয়ে প্রাণের বন্ধু ছিল, এখন আমেরিকায় থাকে, তার বাড়ি ওই পাড়াতেই। ওর মা বারান্দায় বসেছিলেন, ভানুর বাড়িটা দেখিয়ে দিলেন। ভানু দরজা খুলে দিতেই ওর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হল— ফিরে যাই। এটা তো ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমি ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধুও নই। গত কয়েক মাসে একটু নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ হচ্ছে, তাও সেটা মামণির জন্যে। আর সেই মামণির সঙ্গেই যেন সম্পর্ক না রাখে— এই অনুরোধ নিয়ে আমি এসেছি। মামণিকেও এসব বোঝানোর কোনও অধিকার কি আমাদের আছে? একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের তো ব্যবসা করার মতো জীবনসঙ্গী বেছে নেওয়ার অধিকারও আছে। আমাদের সঙ্গে কোনও রক্তের সম্পর্ক থাকলেও না হয় কথা ছিল। আমরা তো ওর পাড়াতুতো দাদা-বৌদি। তাও সে পাড়ায় থাকি না এক যুগ হতে চলল। শুধু ভাল চাই বলে এভাবে কারও জীবনে নাক গলানো চলে কি?
ঠায় দাঁড়িয়ে আছি দেখে ভানু বলল— কী রে! কী হল? ভেতরে আয়?
ঢুকে দেখি ফ্যানটা ঘুরছে পুরো গতিতে আর হেমন্ত-সন্ধ্যার গলা ভেসে আসছে— আজ কৃষ্ণচূড়ার আবির নিয়ে/আকাশ খেলে হোলি/কেউ জানে না/সে কোন কথা মনকে আমি বলি। ভানু বোতল থেকে ঢকঢক করে অনেকটা জল গলায় ঢেলে বলল, দুপুরে আবার জ্বর এসছিল, একটু আগে ঘাম দিয়ে ছাড়ল। এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে। বোস, এই পাশের দোকানটা থেকে একটু তেলেভাজা নিয়ে আসি, দুজনে খাই। আমি বারণ করার আগেই ঝড়ের বেগে টেবিল থেকে ওয়ালেটটা তুলে নিয়ে ও বেরিয়ে গেল। গান চলা সত্ত্বেও পরিষ্কার শুনতে পেলাম আমার বুক ধুকপুক করছে। হাসি পেয়ে গেল। আমার পিতৃদত্ত নাম সুদীপ্ত ঘোষাল। কিন্তু লেখক হিসাবে ওটা ম্যাড়মেড়ে শোনায় মনে করে দৃপ্ত ঘোষাল নামে লিখি। আমার অনেক ভক্ত ফেসবুকে আমার লেখা পড়ে মন্তব্য করে— আপনার দৃপ্ত কলম আমাদের ভরসা দেয়। এদিকে শালা ছোট থেকে চিনি এমন একজনের কাছে কয়েকটা অপ্রিয় কথা বলতে এসে আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে।
ভানু গরম বেগুনি আর আলুর চপ নিয়ে ফিরে এল। গানের ভলিউমটা কমিয়ে, দুটো বাটিতে মুড়ি ঢেলে, চপের ঠোঙা মাঝে রেখে আমার মুখোমুখি বসল। আমি ততক্ষণে সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছি। আমার সংলাপ পড়ার জন্যে উদগ্রীব হয়ে আছেন নাকি? লাভ নেই। নতুন কিছু বলিনি। যে কথাগুলো বেড টি খেতে খেতে রিনির সঙ্গে হয়েছিল, সেগুলোই বললাম। ভানুর চোখে চোখ রেখেও বলতে পারলাম না। বাটির দিকে তাকিয়ে এক নিশ্বাসে বলে যাওয়ার পর বুঝলাম, ধুকপুকুনি কমছে। তখন খেতে শুরু করলাম। ভানু ওর চিরপরিচিত মৃদু হাসিটা ঠোঁটে ঝুলিয়ে খেয়ে চলল খানিকক্ষণ। এত নির্বিকার হতে পারে মানুষ! তাহলে কি মামণি, রিনি— দুজনেই ভুল বুঝেছে? ভানু আদৌ প্রেমে পড়েনি?
নিজের ভাগের মুড়ি চপ শেষ করে একটা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলল। তারপর উঠে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে এল, গানটা বন্ধ করল। আমি ভাবছি এই দীর্ঘ প্রস্তুতি আমাকে নিজের চরকায় তেল দিতে বলার, অথচ ও চেয়ারে ফিরে এসে বলল— ওই যন্তরটা বেশ ভাল হয়েছে, বুঝলি? মাকে কিনে দিয়েছিলাম। সারাদিন একা একা থাকত তো, চোখে ভাল দেখতে পেত না, তাই টিভি দেখারও উপায় নেই। হাজার তিনেক গান আছে, শুয়ে শুয়ে তাই শুনত। আমার সময় হত না বললেই হয়। আজকে এক দিনে বুঝে গেলাম কীরকম কাজের জিনিস। একলা লোকের জন্যে পারফেক্ট। তারপর হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ওর কথার কোনও অন্য মানে আছে কিনা বোঝার চেষ্টা করছি, জিজ্ঞেস করল— তোর ক্লাস ফোরের কথা মনে আছে?
—সব কিছু তো মনে নেই। তুই কোনটা বলছিস?
—ওই যে ক্লাসে গার্ডার আটকে কাগজের বল বানিয়ে আর খাতাকে ব্যাট বানিয়ে আমরা ক্রিকেট খেলতাম?
—হ্যাঁ হ্যাঁ। সে যা ক্রিকেট… বল ড্রপ ফেলা যাবে না। আন্ডার আর্ম ফুলটস, তাও আবার হাঁটুর নিচে হলে নো বল।
—হুম। একবার শুক্লাদি ক্লাসে ঢুকে বলটা মাটিতে পড়ে থাকতে দেখে শতভিষাকে বলল জানলা দিয়ে বাইরে ফেলে দিতে। মনে আছে তোর?
—পরিষ্কার। বলটা গিয়ে পড়েছিল ঠিক বাথরুমের দরজার সামনে। বলটা আমাদের দরকার। তাই আমরা ঠিক করলাম কেউ একজন হিসি করার নাম করে বাইরে বেরোবে, বেরিয়ে তুলে আনবে।
—আমরা নয়, প্ল্যানটা আমার ছিল। আর সবাই ভয় পেল। আমিই যেতে চাইছিলাম, তুই আমায় বললি, দিদিভাই তোকে ছাড়বে না। জানে তুই দুষ্টু ছেলে, বুঝতে পারবে কী মতলবে যাচ্ছিস। বলে তুই বললি, দিদিভাই, ছোটবাইরে যাব? শুক্লাদি ছেড়েও দিল। আর শতভিষাটা এমন বদ, জানলা দিয়ে দেখে সঙ্গে সঙ্গে নালিশ করে দিল— দিদিভাই, সুদীপ্ত বাথরুমে যায়নি। বল নিয়ে চলে আসছে। তুই আসার পরে দিদিভাই বলটা নিয়ে নিল। তারপর তোকে বলল, বলো কে এই বুদ্ধি দিয়েছে? তুমি তো এরকম ছেলে নও। তুই বললি, কেউ বুদ্ধি দেয়নি। আমিই আনতে গেছি। তখন বলল, মিথ্যে কথা কেন বলছ? বলো কে বুদ্ধি দিয়েছে? তুই সমানে এক কথা বলে গেলি। দিদিভাইও বুঝেছিল ওটা আমার বুদ্ধি, কিন্তু তোকে দিয়ে বলাতে পারল না। শুক্লাদি খুব মারকুটে। আর আমাকে মারতে একটু বেশি ভালবাসত মনে হয়। সেদিন বাগে পেলে মেরে রক্ত বার করে দিত। সেই কাঁটা কাঁটা লাঠিটা এনেছিল…
—হঠাৎ এসব কথা বলছিস!
—তুই আবার আমায় বাঁচিয়ে দিলি ভাই।
—মানে!
—বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম। ঠিকই বলেছিস। পারমিতা বাচ্চা মেয়ে, ভাল মেয়ে। ওর তো গোটা জীবন পড়ে আছে, আমার শেষ। আমাকে বিয়ে করলে ওর হয়ে গেল। এদিকে কাজকারবারও ভাল যাচ্ছে না… বলছিল দোকান খুলেছে বলে বাবা রাগ করেছিল, সেটা নাকি তুই মিটিয়ে দিয়েছিস। আবার নতুন করে এসব নিয়ে ঝামেলা করা… একবার স্ট্রোক হয়ে গেছে ওনার… কী যে হয়েছিল আমার… কেন যে এটা করতে গেলাম…
—তেমন কিছু… করেছিস নাকি? আমি উৎকণ্ঠিত হয়ে ভাসিয়ে দিলাম।
ভানু ধরতে পারল। হেসে বলল, না না, ওসব নিয়ে চিন্তা নেই। তুই, আমি সেকেলে বাপ-মায়ের ছেলে রে ভাই। বিয়ের আগে ওসব কি আমরা ভাবি, বল?
আমি বাধ্য ছেলের মতো ঘাড় নেড়ে জানিয়ে দিলাম, না, ভাবি না।
—এখন কী করি বল তো? এই প্রথম হাসি মুছে গেল ভানুর ঠোঁট থেকে। মেয়েটাকে কী করে বলি, এসব ভুলে যাও? কষ্ট পাবে খুব। এই ক-মাসেই যা দেখলাম, বাইরে খুব শক্ত। ভেতরটা খুব নরম রে। কলেজের যে হারামিটা ওকে ছেড়ে দিয়েছে, তার কথা বলতে গিয়ে একদিন কী কান্না কাঁদল ফোনে! এখন যদি…
কী আশ্চর্য! এই দিকটা তো আমরা দুজনে ভেবেই দেখিনি। ভানুকে বিয়ে করলে ২০ বছর পরে হয়তো সত্যিই মামণি নিজেকে অভিসম্পাত দিত, কিন্তু আজ? আজকের কষ্ট সামলাবে কী করে? বিশেষ করে আগেও যখন একটা প্রেম ভেঙে গেছে? ভাল করতে গিয়ে মন্দ করছি না তো মেয়েটার? দ্বিধাগুলো ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠছে, সেগুলো অগ্রাহ্য করার জন্যেই আমি বড্ড বেশি জোর দিয়ে বলে উঠলাম— ও তুই ভাবিস না। আমার গিন্নি ওকে বোঝানোর দায়িত্ব নিয়েছে।
—সেই ভাল। আমি বরং আর ওদিকে ঘেঁষবই না। কিছু যে বলব, বলার তো মুখ নেই। আমি ওর থেকে এত বড়, আমারই তো দায়িত্বশীল হওয়া উচিত ছিল। ওর কাঁচা বয়স, আবেগ বেশি। আমারই ভেসে যাওয়া উচিত হয়নি। এখন গিয়ে বলবটা কী? যে বুঝিনি কত বড় দায়িত্ব হয়ে যাচ্ছে, ক্ষমা করো? হাস্যকর।
আমি ক্রমশ অপরাধবোধে কুঁকড়ে যাচ্ছিলাম, ভানুর মুখের দিকে তাকানো অসম্ভব হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। উঠি, বলে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে এলাম। বাইরে ততক্ষণে ঘুরঘুট্টি অন্ধকার। ভানুর বারান্দায় কোনও আলো নেই। সাইকেলের চাবি ঢোকানোর গর্তটা খুঁজে পেতে বেশ সময় লাগল। ফোনের টর্চটার কথা মাথাতেই আসেনি। কানে এল, ভানু আবার গান চালিয়ে দিয়েছে। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ধরলেন— তুমি না হয় রহিতে কাছে…
রিনি মামণিকে আমাদের ফ্ল্যাটে ডেকেছিল। আমি যখন ঢুকছি, ও তখন বেরিয়ে যাচ্ছে। বললাম, চললি? আমার দিকে না তাকিয়ে জবাব দিল— হ্যাঁ, দোকান খুলতে দেরি হয়ে গেল আজকে। আমার মনমেজাজ ভাল ছিল না, রিনিরও না। দুজনের কেউই অন্যের চেষ্টা কতটা সফল হল তা সারা সন্ধে জিজ্ঞেস করিনি। কথা হল একেবারে বিছানায়। রিনি বলল মামণি সবটা পাথরের মূর্তির মতো বসে শুনেছে, একটাও কথা বলেনি। চলে যাওয়ার সময়ে দরজার সামনে গিয়ে হাউহাউ করে কেঁদে ফেলেছে, বলেছে— কোনওদিন ক্ষমা করব না। কাকে? রিনিকে? আমাকে? ভানুকে? সে-কথা আর জিজ্ঞেস করা যায়নি।
আট.
এ-বছর টেস্ট করিয়ে দেখা গেছে আমার কোলেস্টেরলের মাত্রা এখন প্রায় স্বাভাবিক। তবে হাঁটার অভ্যাসটা ভাল, ডাক্তার ওটা বজায় রাখতে বলেছেন। আমি তাই রোজ হাঁটি, মামণির দোকানে লাল চা খাই। কফি, কেক, পেস্ট্রি, মোমো— এসব খেতে আর ইচ্ছে করে না। ভানুকে সেদিনের পরে আর দেখিনি। মাঝে একবার ভেবেছিলাম ফোন করব, পকেট থেকে বার করেও আবার রেখে দিয়েছি। মামণির আমার সঙ্গে ব্যবহারে কোনও পরিবর্তন আসেনি। তবে লক্ষ করে দেখেছি, দোকানে আর টোস্ট বিস্কুট রাখে না।