সংশয়ীদের কেরামতি

প্রদীপ দত্ত

 

সদ্য-সমাপ্ত কলকাতা বইমেলায় দিশা প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত লেখকের ‘জলবায়ু বদলে যাচ্ছে, পৃথিবী বিপন্ন’ বইয়ের একটি অধ্যায় থাকল চার নম্বর প্ল্যাটফর্মের পাঠকদের জন্য

 

১৯৮০-র দশকের মধ্যেই জলবায়ু বিজ্ঞান বেশ উন্নত হয়ে উঠেছিল। প্রায় পৌনে দু-শো বছর ধরে বিজ্ঞানীর একের পর এক গবেষণায় স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল মানুষের কাজকর্মে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ বেড়ে চলার জন্য পৃথিবী উষ্ণ হচ্ছে।[1] তাই, কয়লা তেল ও গ্যাসশিল্পের শিরোমণিরা তাদের ব্যবসায় বিপদ ঘনিয়ে আসছে বুঝে সংশয় ছড়াতে নানা পদক্ষেপ নেয়। আজও সেই চেষ্টা চলছে, বিশেষ করে বার্ষিক শীর্ষ সম্মেলনগুলোতে তাদের প্রতিনিধিরা বিপুল সংখ্যায় যোগ দিয়ে কার্বন-নিঃসরণ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত যেন না-নেওয়া হয় সেই ব্যপারে নজর রাখে।

জলবায়ু বদল রোখার জন্য যেদিন থেকে কার্বন-নিঃসরণ কমানোর কথা উঠেছে, জীবাশ্ম-জ্বালানির কারবারিদের মদতে পালটা প্রচারও শুরু হয়েছে। তাঁরা বলেন— জলবায়ুবিজ্ঞান অপরিণত, কার্বন-নিঃসরণ বৃদ্ধি হলে মোটেই তাপমাত্রা বাড়ে না, কার্বন ডাইঅক্সাইডের বৃদ্ধি পৃথিবীর পক্ষে উপকারী, তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণ প্রাকৃতিক।

সংশয়ীরা (sceptics, deniers) বলেন, জলবায়ুর কম্পিউটার মডেল তৈরিতে ত্রুটি রয়েছে। প্রকৃতির নিয়মের জটিলতার জন্য কোনও মডেলই কিন্তু ত্রুটিহীন হওয়া সম্ভব নয়। তবে বেশিরভাগ জলবায়ুবিজ্ঞানীর মতে, ১৯৮০-র দশক থেকে শুরু করে বর্তমানে যে উন্নত মডেল তৈরি হয়েছে, তা জলবায়ুর গতি-প্রকৃতির উৎকৃষ্ট প্রতিরূপ।

তাছাড়া, জলবায়ুর ঠিক কেমন পরিবর্তন ঘটছে/ঘটবে তা বুঝতে শুধু মডেলকেই ভরসা করা হয় না। প্রাকৃতিক কারণে জলবায়ুর যে বদল ঘটছে— যেমন, পৃথিবীর কক্ষপথের পরিবর্তন, পৃথিবীর হেলে থাকার তফাতের জন্য পরিবেশে প্রভাব ইত্যাদি বিষয়ে বিজ্ঞানীদের তাত্ত্বিক বোধ বেড়েছে। তা থেকেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে যে, উষ্ণায়নের জন্য গ্রিনহাউস গ্যাস বেড়ে চলাই দায়ী। বৃক্ষ-বলয়, বরফের অন্তস্তল, শিলাস্তরের নমুনা, পরাগরেণুর জীবাশ্ম ইত্যাদির বিশ্লেষণ অতীতের আবহাওয়া ও তার পরিবর্তন বুঝতে সাহায্য করে। সেসব বিশ্লেষণ করে প্রাকৃতিক পরিবর্তনের যে তথ্য পাওয়া যায়, তার সঙ্গে মানুষের ক্রিয়াকলাপে জলবায়ুর কেমন বদল ঘটবে, তা নিয়ে কম্পিউটার মডেলের মিল রয়েছে।

জলবায়ু বদলের জন্য গ্রিনহাউস গ্যাসকে দায়ী করার বদলে সংশয়ীরা পৃথিবীতে সূর্যরশ্মি আপতনের তফাতের কথা বলেন। প্রায় তিরিশ বছর ধরে বায়ুমণ্ডলে কতটা সৌরশক্তি পৌঁছোচ্ছে তা উপগ্রহের সাহায্যে মাপা হচ্ছে। পরিমাণের তফাত যৎসামান্য। বেশিরভাগ জলবায়ুবিজ্ঞানীর মতে, সেই তফাতে জলবায়ুর এতটা পরিবর্তন হওয়ার কথা নয়। তা ছাড়া সূর্য যদি দায়ী হত, তা হলে পরিবর্তনের ধরন হত ভিন্ন। যেমন, সূর্যরশ্মি আপতনের পরিমাণ যদি বেশি হয়, তা হলে ট্রোপোস্ফিয়ার (ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার পর্যন্ত বায়ুস্তর) এবং স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার (প্রায় ১৩ কিলোমিটার থেকে ৫০ কিলোমিটার পর্যন্ত) দুই-ই উষ্ণ হওয়ার কথা। তা কিন্তু হচ্ছে না।

বিজ্ঞানীরা হিসাব করেছেন যে, বায়ুমণ্ডলে গড় বিচ্ছুরক সৌরশক্তির প্রভাবে কতটা পরিবর্তন হলে পৃথিবীর উপরতলের তাপমাত্রায় কতটা প্রভাব পড়ে। তাঁরা হিসাব করেছেন যে, মানুষের কার্যকলাপে উৎপন্ন কার্বন ডাইঅক্সাইড, মিথেন, কালো ধোঁয়া ইত্যাদি সৌররশ্মির প্রভাবে কতটা পরিবর্তন এনেছে। এছাড়া, যেসব কণা সৌররশ্মির প্রতিফলন ও মেঘ তৈরি করে, তার বিপরীত প্রভাব এবং সমুদ্র কী হারে তাপ ধরে রাখে ইত্যাদি হিসাব থেকে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার পাওয়া যায়। এই বৃদ্ধি প্রায় ০.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, মানুষের কার্যকলাপে বিপুল পরিবর্তন না ঘটাতে পারলে এই শতকের শেষে ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প সময়ের তাপমাত্রার চেয়ে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে। এই মুহূর্তে উদ্যোগ শুরু হলেও ২ ডিগ্রি বেড়ে যাওয়া প্রায় অনিবার্য।

তবে ১৯৯৯ সাল থেকে পনেরো বছর ধরে পৃথিবীর তাপমাত্রা খুবই কম বেড়েছিল। তাপমাত্রা বৃদ্ধির এই থমকে থাকাকে কেন্দ্র করে সংশয়ীরা বলছিলেন, জলবায়ুবিজ্ঞান যে ভুল এ তারই প্রমাণ। কম্পিউটার মডেল কিন্তু বলে, জলবায়ুচক্রে প্রাকৃতিকভাবেই ধীরগতিতে উষ্ণতা বৃদ্ধির সময় আসে। তাছাড়া মহাসমুদ্র হল তাপশোষণের বড় ক্ষেত্র। শোষণ চলে ধীরগতিতে। সমুদ্রের উপরতলের তাপ ধীরে ধীরে নিচের দিকে ছড়াতে থাকে। সমুদ্রের নিচের দিকে তাপ কীভাবে ছড়ায় সে-বিষয়ে বিজ্ঞানীদের জ্ঞান অপেক্ষাকৃত কম। তাছাড়া, সময়ের বিচারে তাপমাত্রা বাড়ার প্রকৃতি নির্ণয় করার ক্ষেত্রে দশ-পনেরো বছর সময় কিছুই নয়।

 

হয়রানি, বিষোদ্গার আর আক্রমণ

কয়েক দশক ধরে নানা মতলবে আমেরিকায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। কোনওটার উদ্দেশ্য ছিল সিগারেট কোম্পানির পক্ষে প্রচার করা, কোনওটা নানা বিষয়ে সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করে, কোনওটার কাজ নিছক জলবায়ু-বিজ্ঞানের বিরোধিতা করা। ধীরে ধীরে এই সব সংগঠনই জলবায়ু পরিবর্তনে সংশয়ীদের আখড়ায় পরিণত হয়। এবং জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়াতে থাকে। বড় বড় মার্কিন কোম্পানি, বিশেষত তেল ও গ্যাস কোম্পানি এদের আর্থিক সাহায্য করে।

কয়েকজন মার্কিন সেনেটর ও কংগ্রেস সদস্যের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণার বিরুদ্ধে আক্রমণ চলতে থাকে। এই আক্রমণ ও প্রচারে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিলেন মার্কিন রিপাবলিকান সেনেটর জেমস ইনহোফ। ২০০০ থেকে ২০০৮ সালের মধ্যে তিনি এই কাজে তেল কোম্পানির কাছ থেকে ৬৬২,০০০ ডলার অনুদান পেয়েছেন। ২৭ বছরে ধরে কংগ্রেস সদস্য জো বার্টন পেয়েছেন ১০ লক্ষ ডলার। অন্যদিকে, যে-মার্কিন প্রেসিডেন্ট জীবাশ্ম-জ্বালানির স্বার্থরক্ষা করবেন, তাঁর নির্বাচনী খরচের বড় অংশ বহন করে এই সব কোম্পানি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামার দ্বিতীয় দফা নির্বাচনী প্রচারে তা খুবই স্পষ্ট ছিল। এইভাবে তারা অনেক বছর আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়া সরকারকে জলবায়ু নীতি গ্রহণ করতে দেয়নি, জীবাশ্ম-জ্বালানির ব্যবহার কমাতে দেয়নি, বিকল্প শক্তির অগ্রগতিতেও বাধা তৈরি করেছে। নব্বইয়ের দশক থেকে নানা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যত বেশি ভূ-উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের সমর্থন মিলেছে, ততই জলবায়ুবিজ্ঞানীদের নানাভাবে হয়রান করা, ভীতিপ্রদর্শন ও বেপরোয়া আক্রমণ চলেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এভাবে বিজ্ঞানীদের মুখ বন্ধ করতে তারা সফলও হয়েছে।

১৯৯৫ সালে প্রকাশিত আইপিসিসি-র দ্বিতীয় রিপোর্টে গুরুত্ব পেল জলবায়ু নিয়ে বহু স্বাধীন গবেষণার ফলাফল। তাদের কথায়: ‘দ্য ব্যালান্স অফ এভিডেন্স সাজেস্টস আ ডিসারনিবল হিউম্যান ইনফ্লুয়েন্স অন গ্লোবাল ক্লাইমেট’। সেই থেকে ক্রমেই মানুষের কার্যকলাপে জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণা শক্তিশালী হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যেসব বিজ্ঞানী গবেষণা করেন, তাদের শতকরা ৯৮ ভাগ গবেষণাপত্রেই তার সমর্থন পাওয়া গেছে। তবে এখনও বেশ কিছু বিষয়ের মীমাংসা হয়নি। যেমন, পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে সূর্যরশ্মির প্রতিফলন বাড়া-কমার বিষয়টি এখনও সম্পূর্ণ পরিষ্কার নয়, হিমায়িত মাটি এবং গভীর সমুদ্রের তল থেকে কীভাবে কতটা মিথেন গ্যাস মুক্ত হয় ইত্যাদিও পরিষ্কার নয়। এই ধরনের অজানা বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলোই সংশয়ীদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়।

আমেরিকান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউট ১৯৮৯ সালে এক টাস্কফোর্স তৈরি করে। উদ্দেশ্য ছিল, জলবায়ুবিজ্ঞান অস্বীকার করা এবং ওই বিষয়ে গড়ে ওঠা জনমতে সংশয় তৈরি করা। ওই ইনস্টিটিউট এই কাজে ৫৯ লক্ষ ডলার ব্যয় করে। পরবর্তীকালে ‘গ্লোবাল ক্লাইমেট সায়েন্স কমিউনিকেশনস অ্যাকশন প্ল্যান’ শিরোনামে তাদের একটি মেমোরান্ডাম প্রকাশিত হয়। সেখানে বলা হয়েছিল, ‘বিল্ড আ কেস আগেনস্ট প্রেসিপিটাস অ্যাকশন অন ক্লাইমেট চেঞ্জ বেসড অন সায়েন্টিফিক আনসার্টেনটি।’ যাঁরা সংবাদমাধ্যমে ও জনমানসে সন্দেহের বীজ ছড়াবেন সেইরকম বিজ্ঞানীদের দলে নেওয়া, প্রশিক্ষণ ও পারিশ্রমিক দেওয়ার কথা মেমোতে বিস্তারিতভাবে বলা হয়।

পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির আর্থ সিস্টেম সেন্টারের অধিকর্তা হলেন প্রত্নজলবায়ুবিজ্ঞানী মাইকেল ম্যান। ২০১২ সালে, একদিন বেশ কিছু চিঠিপত্র বগলদাবা করে নিজের অফিসে ঢুকলেন। ঘরে বসে খাম ছিঁড়ে চিঠি বার করতে করতে হঠাৎ একটা খামের ভিতর থেকে সাদা পাউডার আঙুলে লাগল। সতর্ক ম্যান তৎক্ষণাৎ চেয়ার ঠেলে পেছনে আসায় চিঠিটা মেঝেতে পড়ল। অল্প ধোঁয়াও উঠল। তবে ম্যানের জীবনে এই ধরনের ঘটনা মোটেই আকস্মিক নয়। শুধু ম্যানই নন, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার বহু জলবায়ুবিজ্ঞানীর জীবনে ভীতি প্রদর্শন, বদনাম ছড়ানো ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।

নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে ম্যান, ব্র্যাডলি ও হিউজেস এক লেখচিত্রের (গ্রাফ) সাহায্যে দেখিয়েছিলেন যে, ভূপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা নাটকীয়ভাবে বাড়ছে। হকিস্টিকের মতো দেখতে ওই লেখচিত্র জলবায়ু-বিতর্কে অতিপরিচিত। সংখ্যাগরিষ্ঠ জলবায়ুবিজ্ঞানীর কাছে তা হল তাপমাত্রা বৃদ্ধির অকাট্য প্রমাণ। হকিস্টিক লেখচিত্রে এক হাজার বছরে পৃথিবীর উষ্ণতার পরিবর্তন দেখানো হয়েছে। ১৯৯৮ সালে ম্যান ও তাঁর সহকর্মীদের এই গবেষণাপত্রটি নেচার পত্রিকার ৩৯২ ভলিউমে প্রকাশিত হয়। লেখচিত্রটি হাজার বছরের বেশিরভাগ সময় ধরেই ভূ-উষ্ণায়নের ছোট ছোট ওঠানামা-সহ যেন সামান্য নিম্নগামী এক হকিস্টিকের অনুভূমিক লম্বা হাতল। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে গড় তাপমাত্রার রেখাচিত্র ক্রমে হকিস্টিকের আকৃতি পায়। আইপিসিসি ২০০১ সালে প্রকাশিত তৃতীয় পর্যালোচনায় তা অন্তর্ভুক্ত করে।

তাপমাত্রার এই গ্রাফটি হকিস্টিক গ্রাফ নামে জনপ্রিয়। Michael Mann, Raymond Bradley ও Malcolm Hughes এর প্রথম সংস্করণটি নির্মাণ করেন ১৯৯৯ সালে। ২০০০ সালের পরের দিকের কয়েক বছর অবধি তাপমাত্রার রেখাটিকে টেনে উপরের সংস্করণটি তৈরি করেছেন Klaus Bitterman. দেখুন, Stefan Rahmstorf,  “Most Comprehensive Paleoclimate Reconstruction Confirms Hockey Stick,” Thinkprogress, 8 July 2013। গ্রাফটি পাব্লিক ডোমেনে আছে এবং উপরের ছবিটির সূত্র: https://commons.wikimedia.org/wiki/File:T_comp_61-90.pdf.

২০০৬ সালে জলবায়ু বদল নিয়ে তৈরি আল গোরের তথ্যচিত্র ‘অ্যান ইনকনভিনিয়েন্ট ট্রুথ’-এ তা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ম্যানের বক্তব্য, সেই থেকে তাঁর জীবনে ক্রমাগত হয়রানি ও আক্রমণ চলছেই। তাঁর ই-মেল চুরি হচ্ছে, সংবাদপত্র ও বিলবোর্ডে তাঁর নিন্দা হচ্ছে, পরিবারকে ভয় দেখানো হচ্ছে। তাঁর গবেষণা নিয়ে মার্কিন ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন, ব্রিটিশ হাউস অব কমন্স ইত্যাদির তরফে আট-আটটি তদন্ত করা হয়েছে। কোনও ক্ষেত্রেই তথ্যের জালিয়াতি বা অপব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তদন্তকারীরা সিদ্ধান্তে এসেছেন— তাঁর গবেষণাপদ্ধতি যথার্থ, তথ্য থেকে তাঁর প্রতিপাদ্যের অবিকল অনুকৃতি তৈরি করা যায়। প্রতিবারই অভিযোগ থেকে মুক্তি পেয়েছেন, কিন্তু তারপরই ফের শুরু হয়েছে একটি তদন্ত।

২০১০ সালে ভার্জিনিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল কেন কুচিনেল্লি ইউনিভার্সিটি অব ভার্জিনিয়ার কাছে দাবি করেন যে, তাদের প্রাক্তন অধ্যাপক মাইকেল ম্যানের গবেষণা-সংক্রান্ত যাবতীয় নথিপত্র তারা যেন আদালতে জমা দেয়। কারণ, ম্যান ভার্জিনিয়ার করদাতাদের সঙ্গে উষ্ণায়নের গবেষণা নিয়ে জালিয়াতি করেছেন কিনা তা জানা দরকার। ম্যান যতদিন সেখানে ছিলেন সেই এগারো বছরের সব তথ্য নথি জমা দিতে হবে। ইউনিভার্সিটি ওই দাবি প্রত্যাখ্যান করে বিষয়টি নিয়ে মামলা চালিয়ে যায়। ২০১২ সালে মামলাটিতে কুচিনেল্লি হেরে যান।

আলাস্কা নিয়ে গবেষণারত দুই সরকারি বিজ্ঞানী জেফ্রে গ্লিসন ও চার্লস মনেট এক রিপোর্টে লেখেন যে, সুমেরু সমুদ্রে একটি মৃত মেরুভল্লুক ভাসতে দেখা গেছে। তাঁদের মনে হয়েছিল, ভল্লুকটি জলে ডুবে মরেছে। সুমেরু সমুদ্রের বরফ গলে যাওয়ার ফল কী হতে পারে তা নিয়ে আলোচনা প্রসঙ্গে ঘটনাটি ‘অ্যান ইনকনভিনিয়েন্ট ট্রুথ’ তথ্যচিত্রে স্থান পায়। কাজেই ২০১০ সালে ইউএস অফিস অব দি ইন্সপেক্টর জেনারেল বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে। তা নাকি ‘ইন্টেগ্রিটি ইসু’। দু-বছর ধরে তদন্তের পরও কোনও চার্জ আনা হল না, অথচ তদন্ত শেষ হওয়ারও লক্ষণ ছিল না। কেন এতদিন ধরে চলল, তা জানা না গেলেও, ওই দুই বিজ্ঞানীর জীবন নষ্ট করে দেওয়ার জন্য ওই তদন্তই যথেষ্ট ছিল। পরে মনেট জানালেন, তিনি আর কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্র প্রকাশ করবেন না। গ্লিসন আলাস্কার চাকরি ছেড়ে চলে যান। অবশ্য খুব কম বিজ্ঞানীই হয়রানির ভয়ে চাকরি ছেড়েছেন, মনেট ও গ্লিসনের ঘটনা সেই অর্থে ব্যতিক্রম। তবে অনেকে তাঁদের গবেষণা নিয়ে বাইরে কথা বলা বন্ধ করেছেন। তাতে হয়রানি ও অপমানের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা কমে।

সংশয়ী গোষ্ঠীর আক্রমণের হাজারো পদ্ধতি রয়েছে। এক মার্কিন মহিলা বিজ্ঞানীকে ই-মেলে তাঁর মেয়ের কথা বলে গিলোটিনের কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। এ-ক্ষেত্রে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্য সাধিত হল। লরেন্স লিভারমোর ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির এক জলবায়ু মডেলারের ঘরে গভীর রাতে টোকা পড়ল। দরজা খুলে দেখলেন, দরজার গোড়ায় পড়ে রয়েছে এক মরা ধাড়ি ইঁদুর। দরজা খোলার পরই এক হলুদ রঙের গাড়ি গতি নিল। এমআইটি বা ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির এক হারিকেন-গবেষক ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে দেখলেন, তাঁর কম্পিউটারের ইনবক্সে অসংখ্য ই-মেল, যাতে তাঁকে ও তাঁর স্ত্রীকে জঘন্য ভাষায় ভয় দেখানো হয়েছে। ২০১১ সালে অস্ট্রেলিয়ার কয়েকজন জলবায়ুবিজ্ঞানীর সঙ্গে গুন্ডামি এবং তাঁদের সন্তানদের ওপর যৌন আক্রমণের ভয় দেখানোর পর সরকারের সক্রিয়তায় বিজ্ঞানীদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।

হয়রানির ঘটনার সঙ্গে থাকে আইনি ও রাজনৈতিক আক্রমণ। বিজ্ঞানীদের গবেষণায় ব্যাঘাত ঘটাতে নানা সংগঠন নিয়মিত মামলা দায়ের করে এবং ফ্রিডম অব ইনফরমেশন অ্যাক্টের সুবাদে গবেষণার নানা তথ্য পাওয়ার অনুরোধ পাঠাতে থাকে। ২০০৫ সালে মাইকেল ম্যান ও অন্য জলবায়ুবিজ্ঞানীদের কংগ্রেসে সাক্ষ্য দিতে ডেকে আনার আগে টেক্সাসের কংগ্রেস সদস্য জো বার্টন বিজ্ঞানীদের নির্দেশ দেন— গবেষণাপদ্ধতির বিশদ বিবরণ, কম্পিউটার প্রোগ্রামিং এবং অতীতে কারা তাঁদের গবেষণার অর্থ জুগিয়েছে তা জানাতে হবে। এমনিতেই এগুলো গবেষণাপত্রে উল্লিখিত থাকে। তারপরও এগুলো চাওয়া মানে স্রেফ হয়রানি করা। ওকলাহোমার সেনেটর জেমস ইনহোফ ২০১০ সালে ১৭জন বিশিষ্ট জলবায়ু-বিজ্ঞানীর তালিকা-সহ এক রিপোর্ট প্রকাশ করেন। তাঁর বক্তব্য, এই সব বিজ্ঞানী ‘পোটেনশিয়ালি ক্রিমিনাল বিহেভিয়র’-এ জড়িত। তিনি জানান, ওই বিজ্ঞানীরা তিনটি ‘ল’ এবং চারটি ‘রেগুলেশন’ ভেঙেছেন, এর মধ্যে রয়েছে ফেডারেল ফলস স্টেটমেন্ট অ্যাক্ট, যার জন্য পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। আমেরিকান ট্র্যাডিশন ইনস্টিটিউট (এটিআই) বেশ কয়েকজন জলবায়ুবিজ্ঞানী যেসব সংস্থা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কাজ করতেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা ঠোকে। এর মধ্যে যেমন মাইকেল ম্যান ছিলেন, ছিলেন নাসার বিজ্ঞানী জেমস হ্যানসেন। এটিআই গবেষকদের চিঠিপত্র আদানপ্রদানের কপি এবং গবেষণার নথিপত্র চেয়ে পাঠিয়েছিল।

 

পেড প্রোমোটার

টিমোথি বল ইউনিপেগ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক। ২১ শতকের প্রথম দশকে তিনি বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ে ছশোটি সভায় বক্তৃতা দিয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি ছ-দিনে একটি বক্তৃতা। ২০০২ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে কানাডার ২৪টি দৈনিক পত্রিকায় ৩৯টি প্রবন্ধ এবং সম্পাদকীয় দপ্তরে ৩২টি চিঠি লিখেছেন। অর্থাৎ প্রতি মাসে একটি করে। এরপরও তিনি সংশয়ীদের ওয়েবসাইট ‘টেক সেন্ট্রাল স্টেশন’-এ নিয়মিত লিখেছেন। সংশয়ীদের দুটি তথ্যচিত্র ‘দি গ্রেট গ্লোবাল ওয়ার্মিং সুইন্ডল’ এবং ‘ফক্স নিউজ’-এর ‘এক্সপোজড: দ্য ক্লাইমেট অব ফিয়ার’-এ আবির্ভূত হয়েছেন। বল ‘ফ্রেন্ডস অব সায়েন্স’-এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সংগঠনটি তেল ও গ্যাস কোম্পানির অর্থে লালিত ছিল। পরে তিনি ওই সংগঠন ছেড়ে ‘ন্যাচারাল রিসোর্সেস স্টিউয়ার্ডশিপ প্রোজেক্ট’ গঠন করেন।

২০০৬ সালে ‘ক্যালগারি হেরাল্ড’ দৈনিক পত্রিকায় এক প্রবন্ধে বল দাবি করেন যে, তিনি জলবায়ুবিজ্ঞানে কানাডার প্রথম পিএইচডি এবং আঠাশ বছর ধরে ওই বিষয়ে ইউনিপেগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তিনি কানাডার ইউনিভার্সিটি অব লেথব্রিজ-এর পরিবেশ বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডন জনসন-কে তাঁর এক প্রবন্ধে আক্রমণ করে বসেন। এরপর হেরাল্ড পত্রিকায় চিঠি দিয়ে জনসন জানান যে, বল নানা মিথ্যা দাবি করেছেন, জলবায়ু ও বায়ুমণ্ডল নিয়ে গবেষণার কোনও সাক্ষ্য-প্রমাণ দেননি। বল এরপর মামলা করেন। পরবর্তীকালে আদালতে তিনি স্বীকার করেন যে, সত্যিই তিনি বাড়িয়ে বলেছেন, আঠাশ নয়, আট বছর ধরে অধ্যাপনা করছেন এবং তাঁর ডক্টরেট ডিগ্রির বিষয় জলবায়ুবিজ্ঞান ছিল না, ছিল ভূগোল। ক্যালগারি হেরাল্ড জনসনের প্রতি আস্থা রেখে জানায়: দি প্লেনটিফ (বল) ইজ ভিউড অ্যাজ এ পেড প্রোমোটার অব দি অ্যাজেন্ডা অব দি অয়েল অ্যান্ড গ্যাস ইন্ডাস্ট্রি র‍্যাদার দ্যান অ্যাজ আ প্র্যাকটিজিং সায়েন্টিস্ট।’ সম্মান খুইয়ে ২০০৭ সালের জুন মাসে টিমোথি বল মামলা প্রত্যাহার করে নেন।

২০০৭ সালে ওই লজ্জাকর পরিণতির চার বছর পর ২০১১ সালে ফের তিনি কনজারভেটিভ ওয়েবসাইট ‘কানাডা ফ্রি প্রেস’-এ প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ভিক্টোরিয়ার জলবায়ুবিজ্ঞানী অধ্যাপক অ্যান্ড্রু উইভারকে আক্রমণ করে বসেন। উইভার মামলা করেন। কানাডা ফ্রি প্রেস ক্ষমা চেয়ে নেয় এবং তাদের ওয়েবসাইট থেকে বলের লেখাটি অপসারণ করে। ওই ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তাঁর প্রায় ২০০টি প্রবন্ধের সব কটি সরিয়ে দেয়।

কিছু কিছু সংশয়ী ক্রমাগত জলবায়ুবিজ্ঞানীদের সমালোচনা করে নাম করেছেন। এমনই একজন হলেন স্টিভেন মিলয়। তিনি ফক্স নিউজ-এর ভাষ্যকার বা কমেন্টেটর। আগে ছিলেন তামাকশিল্পের অর্থাৎ সিগারেট কোম্পানির প্রচারক। এখন junkscience.com ব্লগটি চালান। তা উষ্ণায়ন ও জলবায়ু বদলের ধারণার বিরুদ্ধে আক্রমণ শানানোর মঞ্চ। নব্বইয়ের দশকে তামাক লবি থেকে আসা টাকা কমে এলে মিলয় উষ্ণায়ন-সংশয়ীদের শিবিরে যোগ দেন। ততদিনে কনজারভেটিভদের অনেকেই জলবায়ুবিজ্ঞান অস্বীকারের পথে নেমেছেন। মিলয় অর্থ পেতেন তেলসম্রাট চার্লস ও ডেভিড কচের সংগঠন থেকে। বিনিময়ে তাদের হয়ে প্রচার করেন। মিলয় ও তাঁর মতো আক্রমণাত্মক সংশয়ীরা এমন এক যুদ্ধ করছেন যা বহুমুখী, এবং যা যুক্তিবাদী উত্তরের তোয়াক্কা করে না। নানাদিক থেকে তাঁরা ক্রমাগত নানা ধরনের তত্ত্ব ও মিথ্যের ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করেন।

প্রায় দেড় দশক আগে কচ ফাউন্ডেশন ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়ার পদার্থবিদ রিচার্ড মুলারের গবেষণার জন্য ১৫০,০০০ ডলার অনুমোদন করে। মুলার সংশয়ীদের অতি প্রিয় বিজ্ঞানী ছিলেন। সংশয়ীদের অভিযোগ— ভুল বিশ্লেষণ, অনির্ভরযোগ্য আবহাওয়াকেন্দ্র এবং আরবান হিট আইল্যান্ড এফেক্টের জন্যই পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে বলে মনে হয়, কিন্তু আসলে তা ঘটেনি। মুলার ও তাঁর সহকর্মীরা দু-বছর ধরে ৩৯ হাজার কেন্দ্র থেকে ১৬০ কোটি পরিমাপ নেন। অন্যান্য তথ্যও পরীক্ষা করেন। এরপর ২০১১ সালের অক্টোবর মাসে মুলারের গবেষক দল ঘোষণা করে— ১৯৫০ সাল থেকে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৮৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তা অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পরিমাপের সঙ্গে মিলে যায়। মুলার পরে আরও জানান: ভূ-উষ্ণায়ন বাস্তব ঘটনা, যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলা যায়, এতদিন পর্যন্ত তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে যা রিপোর্ট করা হয়েছে তাতে কোনও একপেশেমি ছিল না। তারপর থেকে কিছু কিছু কনজারভেটিভ অবস্থান বদলেছেন। যারা এতদিন সংশয়ীদের অর্থ জুগিয়েছেন তারাও অবস্থান বদলাচ্ছে। এক্সন মোবিল-সহ নানা কোম্পানি আর্থিক সাহায্য কমিয়েছে।

 

নুন-খাওয়া সংগঠন

১৯৮৯ সালে তেল কোম্পানি-সহ নানা বড় বড় কোম্পানির মদতে গ্লোবাল ক্লাইমেট কোয়ালিশন (জিসিসি)-এর জন্ম হয়েছিল। তার সঙ্গে ছিল এক্সন মোবিল, অ্যামোকো, শেভ্রন, আমেরিকান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউট, শেল, টেক্সাকো, ইউএস চেম্বার অব কমার্স, ক্রিসলার কর্পোরেশন, জেনারেল মোটর্স এবং আমেরিকান ফরেস্ট অ্যান্ড পেপার অ্যাসোসিয়েশন। জন্মের কয়েক বছর পর জিসিসি ভূ-উষ্ণায়ন নিয়ে তাদের বক্তব্য প্রচারের জন্য এক জনসংযোগ কোম্পানিকে ভাড়া করে। ওই কোম্পানি ১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রোটোকলের বিরোধিতা করে একটি ভিডিও তৈরি করে তার ব্যাপক প্রচার করে। এরপর কয়েকটি কোম্পানি জিসিসি-র সঙ্গ ছেড়ে চলে যায়। কারণ তারা জানতে পারে, ধূমপানের ক্ষতি অস্বীকার করে বিগ টোব্যাকোকে যেমন আদালতের মামলায় হেরে শেষ পর্যন্ত ২৫,১০০ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হয়েছিল, এ-ক্ষেত্রে তাদেরও সেই দশা হতে পারে। সদস্য কোম্পানি একে একে সরে পড়তে থাকায় শেষ পর্যন্ত ২০০১ সালে জিসিসি ভেঙে যায়।

সর্ষের মধ্যেই ভূত দেখা দিতে শুরু করল। জিসিসি এক গবেষণা শাখা তৈরি করেছিল— সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলাজি অ্যাসেসমেন্ট কমিটি। সেখানে শিল্পসংস্থার বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদরা কাজ করতেন। মোবিল অয়েলের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার এলসি বার্নস্টেইনের নেতৃত্বে ওই কমিটি ১৯৯৫ সালে এক রিপোর্ট তৈরি করেছিল। রিপোর্টটি জিসিসি সদস্যদের মধ্যে বিলি করা হয়। তাতে বলা হয়: জলবায়ুর উপর কার্বন ডাইঅক্সাইডের মতো গ্রিনহাউস গ্যাসের সম্ভাব্য প্রভাবের বৈজ্ঞানিক ভিত্তি এমনই সুপ্রতিষ্ঠিত যে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। সূর্যের উজ্জ্বলতার হেরফের প্রসঙ্গে রিপোর্টে বলা হয়: উজ্জ্বলতার যে সামান্য তফাত হয় তা এতই কম যে, তাতে পৃথিবীতে তাপমাত্রার হেরফের হয় না। রিপোর্টে আরও বলা হয়: জলবায়ু প্রক্রিয়ায় আমাদের সামগ্রিক বোধ নিয়ে বিরোধী তত্ত্বগুলো প্রশ্ন তুললেও, গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ থেকে জলবায়ু বদলের প্রচলিত মডেলের বিরুদ্ধে সেসব তত্ত্বে গ্রহণযোগ্য যুক্তি পাওয়া যায় না।

কাজেই তেলকোম্পানি ও তাদের ভাড়াটে লোকজন যখন প্রকাশ্যে দাবি করছিলেন যে, জীবাশ্ম-জ্বালানির দহনে ভূ-উষ্ণায়ন ঘটছে না, তাদের কোম্পানির বিজ্ঞানীরাই উলটো কথা বলতে শুরু করছিলেন। ওই রিপোর্ট তৈরির বারো বছর পরে ২০০৭ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার আদালতে এক মামলার সুবাদে বার্নস্টেইন রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছিল।

শিকাগো-ভিত্তিক হার্টল্যান্ড ইনস্টিটিউটের জন্ম হয়েছিল তামাক লবির স্বার্থে প্রচারের জন্য। ১৯৯৬ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে এক্সন মোবিল হার্টল্যান্ড ইনস্টিটিউটকে ৬৭৬,৫০০ ডলার অর্থসাহায্য দেয়। ২০০৬ সালের পর থেকে হার্টল্যান্ড তাদের অনুদান-দাতাদের নাম গোপন রাখা শুরু করে। বছর পনেরো আগে ওই ইনস্টিটিউট ‘দ্য স্কেপটিকস হ্যান্ডবুক’ প্রকাশ করে। বইটি প্রকাশের খরচ দিয়েছে কোনও বেনামী দাতা। লেখিকা হিসাবে যে নাম রয়েছে (জিয়ান্না নোভা) তা আসল নাম নয়। ১৫টি ভাষায় দেড় লক্ষ কপি ছাপা হয়েছিল। ৮৫০ জন সাংবাদিক, ২৬,০০০টি স্কুল, ১৯,০০০ জন নেতা ও রাজনীতিবিদকে, ব্ল্যাক চার্চকে ২৫,০০০ কপি, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টিকে ২০,০০০ কপি বিলি করা হয়। তা বাদে বিনামূল্যে ৬০,০০০ কপি ডাউনলোড করা হয়েছিল।

২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জানা যায়, হার্টল্যান্ডকে অর্থসাহায্যকারী কর্পোরেট সংস্থার মধ্যে ছিল মাইক্রোসফ্‌ট, জেনারেল মোটর ফাউন্ডেশন ইত্যাদি। উষ্ণায়ন-বিরোধী বক্তব্য প্রচারের বিনিময়ে হার্টল্যান্ড কয়েকজন বিজ্ঞানীকে নিয়মিত অর্থ দিত। যেমন অ্যারিজোনার জলবায়ু পরিবর্তন-অস্বীকারকারীদের এক সংগঠনের মাথা ক্রেগ ইদসো বার্ষিক ১,৩৯,০০০ ডলার পেতেন। হার্টল্যান্ডের নানা পরিকল্পনার কথাও জানা যায়। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, এমনভাবে স্কুল-কলেজে মতামত তৈরি করা যাতে মনে হয়, জলবায়ু পরিবর্তন বিতর্কিত ও অনিশ্চিত বিষয়।

১৯৮৪ সালে, প্রেসিডেন্ট রেগনের স্টার ওয়ারস (স্ট্র্যাটেজিক ডিফেন্স ইনিশিয়েটিভ বা এসডিআই) কর্মসূচির সময় ওয়াশিংটন ডিসি-তে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল দ্য জর্জ সি মার্শাল ইনস্টিটিউট। মার্শাল ইনস্টিটিউট স্টার ওয়ারস গবেষণা ছাড়া গ্লোবাল ওয়ার্মিং-এর বিরুদ্ধে প্রচারের কর্মসূচিও নিয়েছিল। তাদের বিজ্ঞানীরা নানা সময়ে বলেছেন— বিংশ শতক মোটেই অস্বাভাবিক উষ্ণ ছিল না; ২০০৫ সালে ভূ-উষ্ণায়ন বন্ধ হয়েছে; বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড বাড়লে গাছপালার বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে, তাতে পৃথিবী বেশি উৎপাদনশীল হবে। মার্শাল ইনস্টিটিউটের কিছু বিজ্ঞানীর যোগ্যতা ছিল বিচারের ঊর্ধ্বে। তবে সেই যোগ্যতা ভূ-উষ্ণায়ন সংক্রান্ত গবেষণার সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না। সূর্যের বর্ধিত উজ্জ্বলতা যদি ভূ-উষ্ণায়ন না ঘটায় ওই বিজ্ঞানীদের আর বলার কিছু থাকে না। তাই বলে তাঁরা ভূ-উষ্ণায়ন নিয়ে কথা বলা থামাননি।

সূর্যের বর্ধিত উজ্জ্বলতা যে উষ্ণায়ন ঘটাচ্ছে না, সে-নিষ্পত্তি দু-দশক আগেই হয়ে গিয়েছিল। তা যদি না হত তা হলে পৃথিবীপৃষ্ঠ এবং স্ট্র্যাটোস্ফিয়ার— দুই-ই উষ্ণ হত। ১৯৭৯ সাল থেকে উপগ্রহের সাহায্যে সরাসরি সৌররশ্মির আপতনের পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করে উচ্চমানের তথ্যভাণ্ডার তৈরি করা হয়েছে। সেখানে পৃথিবী পরিক্রমণকালে সামান্য ওঠা-নামা দেখা যায়, কারণ ১১ বছরের সৌরকলঙ্কচক্র। তার গড় করে দেখা গেছে এক সাইকেল থেকে অন্য সাইকেলে সূর্যের তীব্রতার কোনও হেরফের ঘটেনি। অন্যদিকে, গ্রিনহাউস গ্যাসের জন্য বায়ুমণ্ডলের উষ্ণায়নের পক্ষে একটি নাটকীয় প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। গ্রিনহাউস গ্যাসের জন্য উষ্ণায়ন ঘটলে পৃথিবীপৃষ্ঠ ও তার সংলগ্ন বায়ুস্তর (ট্রোপোস্ফিয়ার) উষ্ণ হওয়ার কথা কিন্তু স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের নিচের অংশের ঠান্ডা হওয়ার কথা। ঠিক এই দুটো প্রক্রিয়াই যে ঘটছে, তা গবেষণায় জানা গেছে। অবশ্য স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ঠান্ডা হওয়ার পেছনে মানুষের কার্যকলাপ ও আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত— দুইয়েরই ভূমিকা রয়েছে।

মার্শাল ইনস্টিটিউটের দুই বিজ্ঞানী স্যালি ব্যালিউনাস এবং উইলি সুন ২০০৩ সালে ‘ক্লাইমেট রিসার্চ’ পত্রিকায় একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেখানে দাবি করা হয়, বিশ শতকে পৃথিবীর তাপমাত্রায় বিশেষ পরিবর্তন ঘটেনি। গোলমেলে গবেষণাপত্রটি ছাপানোর প্রতিবাদে ওই জার্নালের তিন সম্পাদক পদত্যাগ করেন। পরে জানা যায়, ব্যালিউনাস ও সুনের গবেষণার অর্থ জুগিয়েছিল আমেরিকার পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউট। মার্শাল ইনস্টিটিউট ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে এক্সন মোবিলের কাছ থেকে ৬৩০,০০০ ডলার আর্থিক সাহায্য পেয়েছিল। আরও অন্তত দুটি জীবাশ্ম-জ্বালানি সংস্থার অর্থসাহায্যও তারা পেয়েছে। নিজের কর্মস্থল নিয়ে তাদের এগজিকিউটিভ ডিরেক্টর ম্যাথু ক্রফোর্ডের এমনই মোহভঙ্গ হয় যে, তিনি চাকরির মাত্র পাঁচ মাস পরেই ইস্তফা দেন। ক্রফোর্ডের মতে: নানা পদে বিজ্ঞানের মোড়ক লাগাতেই স্কলারশিপ দেওয়া হত। ওই সব পদ নানা স্বার্থ বজায় রাখত। যোগ্যতা নয়, ওই সব পদে নিয়োগ হত অন্যভাবে। ক্রফোর্ডে কাজের মধ্যে ছিল ভূ-উষ্ণায়নের বিরুদ্ধে যুক্তি তৈরি করা।

মার্শালের বর্তমান বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ উইল হ্যাপার। তিনি হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভসের এক কমিটির কাছে সাক্ষ্য দিতে এসে ২০১০ সালে বলেন, বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়া, উদ্ভিদের বেড়ে ওঠার পক্ষে উপকারী। তিনি আরও বলেন, উদ্ভিদের বেড়ে ওঠার জন্য গ্রিনহাউসে কার্বন ডাইঅক্সাইড বাস্তবিক বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

১৮৩০-এর দশকে জার্মান বিজ্ঞানী ইউস্টুস লিবিগ ‘লিবিগস ল অব দি মিনিমাম’ আবিষ্কার করেন। বক্তব্য হল, উদ্ভিদের বৃদ্ধি মোট রসদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় না, হয় যে-রসদ সবচেয়ে কম পাওয়া যায় তার দ্বারা। যেমন, মরুভূমিতে সাধারণত জলের অভাব থাকে। তাই সেখানে কার্বন ডাইঅক্সাইড নয়, জলের অভাবই উদ্ভিদের বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করে। ২০০০ সালে ইউনিভার্সিটি অব নেভাদার স্ট্যান স্মিথের এক গবেষণাপত্র ‘নেচার’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেখানে বল হয়, পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, কার্বন ডাইঅক্সাইড বাড়ালে বৃদ্ধি হয় অতি সামান্য। ২০০২ সালে ‘সায়েন্স’ ম্যাগাজিনে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির আর একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়— শুধুমাত্র কার্বন ডাইঅক্সাইড বাড়লে গাছ দ্রুত বাড়ে। কিন্তু বাস্তবে উষ্ণতা, নাইট্রোজেনের পরিমাণ, বৃষ্টিপাতের পরিমাণে পরিবর্তন ইত্যাদি হিসাবে আনলে দেখা যায়, বৃদ্ধির হার কমেছে।

১৯৮৪ সালে আমেরিকায় দ্য কম্পিটিটিভ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট (সিইআই) তৈরি হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল, নানা ক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করা। বাতাসের মান, ডায়োক্সিন নিঃসরণের সম্ভাবনা, ওষুধের নিরাপত্তা, জ্বালানির কর্মক্ষমতার মান, মদ, এসব ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক লেবেলিং-এর বিরোধিতা ছাড়াও উচ্চ প্রযুক্তি, ই-বাণিজ্য, মেধা-সম্পত্তি (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি) এবং টেলিযোগাযোগের সরকারি নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদির বিরোধিতা করা। সিইআই-এর বক্তব্য— যে কোনও বিষয়েই সরকারি নিয়ন্ত্রণ খারাপ।

সিইআই ভূ-উষ্ণায়নের মোকাবিলায় যে-কোনও পদক্ষেপেরই বিরোধী। তারা ‘আর্থ সামিট প্রোগ্রাম’ নামে এক কর্মসূচিতে প্রচুর অর্থ ঢেলেছিল। ওই কর্মসূচির মাধ্যমে তারা ১৯৯২ সালের রিও জলবায়ু শীর্ষ সম্মেলনে আলোচিত সম্ভাব্য পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রচুর প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকার প্রকাশ করে। ১৯৯৭ সালে সিইআই জানায় ভূ-উষ্ণায়ন ‘বাস্তব নয় তত্ত্ব’— এই বিষয়ে কথা বলার জন্য তারা বিশেষজ্ঞ জোগান দেবে। ২০০৬ সালে সিইআই আল গোরের ডকুমেন্টারি ‘অ্যান ইনকনভিনিয়েন্ট ট্রুথ’-এর মোকাবিলা করার জন্য আমেরিকার চোদ্দোটি শহরের টেলিভিশনে বিজ্ঞাপন দিয়েছিল। সিইআই-কে অর্থ দিয়েছিল অ্যামোকো, ফিলিপ মরিস এবং এক্সন মোবিল। ১৯৯৮ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে এক্সন মোবিল তাদের ২০ লক্ষ ডলার অর্থসাহায্য করেছিল।

 

প্রেসিডেন্ট নির্বাচন

২০০৮ সালের নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট হিসাবে ক্ষমতায় আসার পরে বলেছিলেন, আগামী দিনে নবায়নযোগ্য শক্তির দৌড়ে যে-দেশ এগিয়ে থাকবে, বিশ্ব-অর্থনীতিতে তাদেরই নেতৃত্ব থাকবে। তিনি নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার, গ্রিডের সংস্কার ও বিস্তার এবং নিঃসরণ কমাতে নানা ব্যবস্থা নিয়ে জীবাশ্ম-জ্বালানিশিল্প ও সংশয়ীদের চক্ষুশূল হয়েছিলেন।

সাধারণভাবে রিপাবলিকান রাজনীতিকরা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সন্দিহান। তেল, গ্যাস ও কয়লাশিল্পের সঙ্গে তাঁদের আঁতাত বেশি। তাই ২০১২ সালের মার্কিন নির্বাচনে রিপাবলিকান মিট রোমানির হয়ে প্রচারে সে-দেশের শক্তিশিল্প তেড়েফুঁড়ে নেমে পড়েছিল। পরে, ২০১৬, ২০২০ এবং ২০২৪ সালেও, বায়ু ও সৌরবিদ্যুতের প্রোডাকশন ট্যাক্স ক্রেডিট বা পিটিসি রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে উঠেছিল। রিপাবলিকানরা ক্লিন এনার্জি বা বিকল্প শক্তি উৎপাদনে পিটিসি সুবিধে দেওয়ার বিরোধী। তাঁদের কথা, ২০১২ সালে পিটিসি-র মেয়াদ শেষ হলে তা আর নতুন করে চালু করা চলবে না। রোমানির বক্তব্যও তাই ছিল।

তেল, গ্যাস ও কয়লাশিল্পের কর্তারা নির্বাচনে বারাক ওবামাকে হারাতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। তাঁরা চেয়েছিলেন, জীবাশ্ম-জ্বালানির ব্যবহার বাড়ুক। ওবামার ক্লিন এনার্জি কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাঁরা টিভিতে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ গ্রহণ, কানাডা থেকে তেলের জন্য কিস্টোন পাইপলাইন বসানোর কাজে দেরি করা ইত্যাদির কড়া সমালোচনা করেছেন। তেলকোম্পানির অর্থে তৈরি ‘আমেরিকান এনার্জি অ্যালায়েন্স’ বিজ্ঞাপনে বলে, ওবামা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর থেকে গ্যাসের দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে, ওবামাকে বলুন, অকেজো শক্তিনীতি আর চলবে না। কয়লা এবং তেলের ব্যবহার ও গ্যাস ড্রিলিং আরও বাড়ানোর জন্য প্রচারে এবং বিকল্প শক্তিকে আক্রমণ করে টিভিতে বিজ্ঞাপন দিতে ভোটের দু-মাস আগে পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১৫.৩ কোটি ডলার। অন্যদিকে, ক্লিন এনার্জির প্রসার এবং উষ্ণায়ন ও বায়ুদূষণের বিরুদ্ধে, অর্থাৎ ওবামার নীতির পক্ষে প্রচারে একই সময়ে খরচ হয়েছে মাত্র ৪.১ কোটি ডলার। কর্মসংস্থান ও অর্থনীতির পরই সবচেয়ে বেশি কথা হয়েছে শক্তি নিয়ে। তবে আগেরবার, ২০০৮ সালের ভোটে, জীবাশ্ম-জ্বালানির তুলনায় সবুজ বিজ্ঞাপন ছিল বেশি। দ্বিতীয়টিতে ১৫.২ কোটি, অন্যটিতে ১০.১ কোটি ডলার ব্যয় করা হয়েছিল। সেবার আল গোরে সমর্থিত ‘অ্যালায়েন্স ফর ক্লাইমেট প্রোটেকশন’ ৩.২ কোটি ডলার ব্যয় করেছিল। তাদের মূল বক্তব্য ছিল, উষ্ণায়ন কমাতে আইন প্রণয়ন করা দরকার। ওই সংগঠন নাম পরিবর্তন করে এখন হয়েছে ক্লাইমেট রিয়েলিটি প্রোজেক্ট। ২০১২-র নির্বাচনে তারা বিজ্ঞাপনের জন্য একেবারেই খরচ করেনি। খরচ না করার কারণ, জীবাশ্ম-জ্বালানি মহলের অর্থের তোড়ে তাদের ঢালা অর্থ ধুয়েমুছে যেত।

রোমানি কথা দিয়েছিলেন, উপকূল এলাকায় বিপুল পরিমাণ সরকারি জমিতে ড্রিলিং-এর অনুমতি দেবেন, বায়ু ও সৌরবিদ্যুতের পিটিসি বন্ধ করে দেবেন, কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে নিরুৎসাহিত করতে যেসব বাধা তৈরি করা হয়েছে, তাতে রাশ টানবেন। তাই জীবাশ্ম-জ্বালানি শিল্প রোমানির পক্ষে উদার হস্তে অর্থ ঢেলেছে। গ্যাস কোম্পানির মদতে তৈরি আমেরিকান পেট্রোলিয়াম ইনস্টিটিউট ব্যয় করেছে সবচেয়ে বেশি। তাদের প্রচারের মূল ক্যাপশন ছিল, “আই অ্যাম অ্যান এনার্জি ভোটার।” তারা রোমানি ও রিপাবলিকানদের নীতিগত অবস্থানের সমর্থক। ড্রিলিং কমাতে আইন এবং তেলশিল্পে ভর্তুতুকি বন্ধ করার জন্য ওবামার ঘোষণা, দুইয়েরই নিন্দা করেছে। ভোটের আড়াই মাস আগে পর্যন্ত টিভি-বিজ্ঞাপন বাবদ প্রায় ৩.৭ কোটি ডলার খরচ করেছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে প্রায় একই কাণ্ড ঘটেছে।

একইভাবে আমেরিকান এনার্জি অ্যালায়েন্সের মতে, প্রেসিডেন্ট ওবামা কার্যত আমেরিকার ভূমি ও উপকূলে শক্তি উৎপাদন বন্ধ করতে চলেছেন। তাই ওবামাকে হারাতে টিভি ও অন্যান্য বিজ্ঞাপনে তারা ৭০ লক্ষ ডলার ব্যয় করেছে। কয়েক ডজন সংস্থা ও কোম্পানি বেশি বেশি জীবাশ্ম-জ্বালানি উৎপাদন করার স্বপক্ষে প্রচার করেছে, ওবামা প্রশাসনের নিন্দা করেছে। নির্বাচনী প্রচারের জন্য এদের কাছ থেকে রোমানি অন্তত ১৩০ কোটি ডলার অর্থ সাহায্য পেয়েছিলেন। ওবামা পেয়েছিলেন মাত্র ৯ লক্ষ ৫০ হাজার ডলার আর সবুজ শিল্প থেকে পেয়েছিলেন মাত্র ৭৮ হাজার ডলার। ফলে, প্রচারের কাজে টাকার অঙ্কে বিরাট তফাত ছিল।

রোমানি ২০১২-র অগস্ট মাসে নির্বাচনে প্রচারের অর্থ তুলতে প্লেট প্রতি ৫০ হাজার ডলার মূল্যে ভোজের আয়োজন করেছিলেন। সে-সময় তেল ও গ্যাস কোম্পানির কর্তারা তাঁকে বলেন, জীবাশ্ম-জ্বালানি শিল্পে আইনের বাঁধন কম করা চাই, সরকারি জমিতে আরও বেশি তেল ও গ্যাসের জন্য ড্রিলিং করার অনুমতি চাই।

এত সবের পরও শেষরক্ষা হয়নি, রোমানি হেরেছেন। বিশ্লেষকেরা তার নানা কারণের কথা বলেছেন। একটি প্রধান কারণ হল, ৭০ ভাগ মার্কিন নাগরিক মনে করেন, বিকল্প শক্তিশিল্পকে সরকারের সাহায্য করা দরকার। বায়ু ও সৌরশক্তি এরই মধ্যে সে দেশে মূলস্রোতের অঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ওবামার আমলেই স্মার্ট গ্রিড, শক্তির দক্ষতা বৃদ্ধি এবং শক্তির চাহিদা ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ শুরু হয়। সে-দেশে জলবিদ্যুৎ-সহ বিকল্প বা নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে এখন শতকরা ২১.৪ ভাগ বিদ্যুৎ পাওয়া যায়। ২০১১ সালেই তা শতাধিক পরমাণু চুল্লিতে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ ছাপিয়ে গিয়েছিল। তবে রিপাবলিকানদের বিরোধিতার ফলে বিকল্প শক্তিনীতি বা কার্বন-নীতি গড়ে ওঠেনি। ওবামার প্রথম দফায় ওয়াক্সম্যান-মার্কি বিলের মাধ্যমে আমেরিকায় নিঃসরণ কমানোর প্রচেষ্টা শুরু হয়েছিল। বিলটি কংগ্রেসের অনুমোদন পেলেও, রিপাবলিকানদের বিরোধিতায় সেনেটের পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়।

দ্বিতীয় দফায় ওবামা যখন জিতেছিলেন, জলবায়ু বদলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তাঁর জেতা খুব জরুরি ছিল। পৃথিবীর কাছে আমেরিকার গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে হলে সদর্থক পদক্ষেপ নিতেই হত। ২০১৩ সালের জুন মাসে তিনি সে-কথা ঘোষণা করেছিলেন। তিনি এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সিকে (ইপিএ) নির্দেশ দিয়েছিলেন, তারা যেন ২০১৩ সাল থেকেই নতুন তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের এবং ২০১৪ সালের মধ্যে সব তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্বন-নিঃসরণের মাত্রা স্থির করে দেয়। সবরকম জীবাশ্ম-জ্বালানিতে ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং সরকার বিকল্প শক্তি উৎপাদনে অর্থ সাহায্য বাড়াবে, যাতে ২০২০ সালের মধ্যে সৌর ও বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদন দ্বিগুণ হয়। ওবামা জানিয়েছেন, ২০১৫ সালে প্যারিসে রাষ্ট্রসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে শীর্ষ সম্মেলনে আমেরিকা-সহ, নানা দেশের নিঃসরণ কমাবার জন্য উদ্যোগী হবেন।

 

সংশয়ীদের সম্মেলন

সকাল ৮:৫০। ঠিক সেই সময় ভূ-উষ্ণায়ন নিয়ে তাঁদের সর্বশেষ গবেষণার কথা জানাতে বিজ্ঞানীরা কোপানহেগেনে জড়ো হচ্ছেন। নিউ ইয়র্কের টাইমস স্কোয়ারের কাছে এক হোটেলের জানলাহীন সভাঘরে আলোচনাসভা চলছে।[2] আলোচনার বিষয়— ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এক্সট্রিম ইভেন্টস: লাইস, ড্যাম লাইস অ্যান্ড স্ট্যাটিসটিকস। উপস্থিত প্রায় ১০০ জন। এক বক্তা তাঁর কথা শেষ করতে চলেছেন। তিনি শ্রোতাদের প্রশ্ন করলেন তাঁর পরিসংখ্যানভিত্তিক আলোচনা ক-জন বুঝলেন? গোটা ছয়েক হাত উঠল। মাথা পিছনের দিকে হেলিয়ে, মস্ত বড় হাঁ করে শেষ সারিতে ঘুমোচ্ছেন এমআইটি-র এক অধ্যাপক।

যারা কার্বন নিঃসরণ কমানোর জন্য সরকারি উদ্যোগের বিরোধী এ হল তাদের জলবায়ু বদল বিরোধী সম্মেলন। পৃথিবীর নেতৃস্থানীয় শোধনবাদী বিজ্ঞানী ও কর্মীদের জমায়েত। তাদের বক্তব্য, জলবায়ু বদল হল অতীতের স্মারক। তাদের প্রশ্ন, ভূ-উষ্ণায়ন কি আদৌ কখনও সত্যিকারের সমস্যা ছিল? সবুজ অর্থনীতি বিষয়ে ওবামার উদ্যোগের বিরুদ্ধে এবং আমেরিকা যেন জলবায়ু বদল নিয়ে কোনও চুক্তিতে স্বাক্ষর না করে সেই লক্ষ্যে এ ছিল নতুন প্রচারের শুরু। ভূ-উষ্ণায়নকে যিনি এককথায় ধাপ্পাবাজি বলেন সেই রিপাবলিকান সেনেটর জেমস ইনহোফ-এর শাগরেদ মার্ক মোরানোর ভাষায়— মেইনস্ট্রিম সংবাদমাধ্যম, কংগ্রেসের নেতৃত্বে এবং হোয়াইট হাউসে যা ঘটছে এ হল তার বিরুদ্ধে আক্রমণ।

আমেরিকা, ইউরোপ ও অন্যান্য জায়গা থেকে যাঁরা এই সভায় এসেছিলেন তাঁরা একবাক্যে স্বীকার করতেন যে, নেতৃস্থানীয় বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান এবং সরকার তাঁদের বক্তব্যে আমল দেয় না। কিন্তু তাঁরা হাল ছাড়েননি। তাঁরা মনে করতেন, বিশ্বজুড়ে আর্থিক মন্দায় তাঁদের কাছে ভূ-উষ্ণায়ন নিয়ে সম্ভাব্য যুদ্ধজয়ের সুযোগ এসেছে। শিকাগোর হার্টল্যান্ড ইনস্টিটিউট এই আলোচনাসভার উদ্যোক্তা। এই সংস্থার প্রেসিডেন্ট জোসেফ বাস্ট-এর মতে, মার্কিন অর্থনৈতিক সঙ্কট কার্বন নিঃসরণ কমাতে ক্যাপ অ্যান্ড ট্রেড বা এনার্জি ট্যাক্সের (কার্বন কর) পাল থেকে হাওয়া কেড়ে নিয়েছে। তাঁর মতে, ওবামা যদি দু-মাসের মধ্যে ক্যাপ অ্যান্ড ট্রেড চালু করতে না পারেন অথবা যদি এনার্জি বিল পাশ না হয় তা হলে সে-সবের আর কোনও ভবিষ্যৎ থাকবে না।

আলোচনাসভার সঙ্গে যুক্ত প্রায় ৫০ জন ব্যক্তি ও সংগঠন এক্সন মোবিল এবং কচ পরিবারের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার অনুদান পেয়েছিল।

 

সারস্বত স্বাধীনতা বিপন্ন

২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ফ্রন্টিয়ারস ইন সাইকোলজি’ নামে মনস্তত্ত্ব-বিষয়ের বিশিষ্ট জার্নালে বিজ্ঞানী স্টোগন লিওয়ানভোস্কি ও তাঁর সহকর্মীদের এক গবেষণাপত্র ছাপা হয়। তার শিরোনাম ছিল, “Recursive fury: Conspiracist ideation in the blogosphere in response to research on conspiracist ideation.” তাতে বলা হয়, যাঁরা জলবায়ুবিজ্ঞান প্রত্যাখ্যান করেন, তাঁদের মধ্যে চক্রান্তের তত্ত্বে বিশ্বাসের প্রবণতা বেশি। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সংশয়ীদের ব্লগে যা বলা হয়, তা নিয়ে বিস্তারিত সমীক্ষা ও বিশ্লেষণ করেই তাঁরা ওই সিদ্ধান্তে এসেছিলেন। ‘রিকারসিভ ফিউরি’ প্রকাশিত হওয়ার পর ফ্রন্টিয়ারসের বিরুদ্ধে কয়েকটি মামলা করার হুমকি আসে। এরপর তারা তাদের ওয়েবসাইট থেকে গবেষণাপত্রটি তুলে নেয়।[3] এরপর গবেষণাপত্রটিকে ফের খতিয়ে দেখা হয়। দেখা যায়, সেখানে বিজ্ঞান ও নৈতিকতার দিক থেকে বক্তব্য একেবারে সঠিক ছিল, কোনও ভুল হয়নি। কিন্তু তারপরও আইনি জটিলতার ভয়ে ২০১৪-র ৩১ মার্চ ফ্রন্টিয়ারস তা ওয়েবসাইট থেকে তুলে নেয়। মামলার ভয়ে বৈজ্ঞানিক গবেষণা কতটা আক্রান্ত হতে পারে এই ঘটনা তার চরম উদাহরণ। ফ্রন্টিয়ারস তাদের বিবৃতিতে জানায়: মৌলিক গবেষণাপত্রটি প্রকাশের পর অল্প কয়েকটি অভিযোগ পেয়ে ফ্রন্টিয়ারস তার অ্যাকাডেমিক, নৈতিক এবং আইনগত দিক বিস্তারিতভাবে খতিয়ে দেখে। ওই সব দিক থেকে কোনও খুঁত পাওয়া যায়নি। তারপরও তারা আইনগত দিকটি যথেষ্ট পরিষ্কার নয় বলে প্রকাশিত প্রবন্ধটি তুলে নিতে চায়। সংশ্লিষ্ট গবেষকরা এই সিদ্ধান্তের কথা জেনে সারস্বত স্বাধীনতা প্রয়োগের ক্ষেত্রে আইনি প্রতিকূলতা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন।

‘রিকারসিভ ফিউরি’ নিয়ে ফ্রন্টিয়ারস-এর এই সিদ্ধান্ত বৈজ্ঞানিক মহলে তীব্র সমালোচনার শিকার হয়েছে। যেসব বিজ্ঞানী ফ্রন্টিয়ারস-এ গবেষণাপত্র জমা দিতেন, তাঁদের অনেকে ই-মেলে তীব্র সমালোচনা করে ফ্রন্টিয়ারস-এর কাছে আশ্বাস চান যে, একইরকম পরিস্থিতিতে তাঁদের গবেষণাপত্র যেন তুলে নেওয়া না হয়। কেউ কেউ সারস্বত স্বাধীনতার ক্ষেত্রে ফ্রন্টিয়ারস-এর দায়বদ্ধতা এবং বিচারবোধ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিজ্ঞানীমহলে এ নিয়ে রীতিমতো তোলপাড় চলেছিল।

 

২০১৫ সাল থেকে এখন অবধি

মধ্যপ্রাচ্যের এক তেল ও গ্যাস কোম্পানি এবং এক ইন্দোনেশীয় কয়লা কোম্পানির প্রতিনিধির ছদ্ম পরিচয়ে গ্রিনপিস (Greenpeace) ২০১৫ সালে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির নেতিবাচক দিকগুলি তুলে ধরতে, ই-মেলের মাধ্যমে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক উইলিয়াম হ্যাপার (William Happer)-কে ক্রমবর্ধমান কার্বন নিঃসরণের উপকার সম্বন্ধে একটি রিপোর্ট লেখার অনুরোধ করে।

হ্যাপার হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশিষ্ট জলবায়ু সংশয়ীদের একজন। তিনি প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচডব্লিউ বুশের শক্তি উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন আমেরিকার জর্জ মার্শাল ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান এবং ব্রিটেনের গ্লোবাল ওয়ার্মিং পলিসি ফাউন্ডেশনের উপদেষ্টা। জলবায়ু-‘গোঁড়ামি’ সম্পর্কে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট প্রার্থী এবং সেনেট বিজ্ঞান কমিটির চেয়ারম্যান টেড ক্রুজ (Ted Cruz)-এর ডাকা কংগ্রেসের শুনানিতে তাঁকে সাক্ষ্য দিতে ডাকা হয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে তিনি যুক্তি দিয়েছেন যে, ক্রমবর্ধমান কার্বন নিঃসরণ মানবতার জন্য আখেরে এক সুবিধা।

হ্যাপার পারিশ্রমিকের বিনিময়ে রিপোর্ট লিখতে সম্মত হন। কিন্তু, তিনি গ্রিনপিসকে অনুরোধ করেন, তাঁর ওই রিপোর্ট লেখার মজুরি যেন তাঁর পরিবর্তে সিওটু কোয়ালিশন-কে দান করা হয়।[4] কার্বন ডাইঅক্সাইডের প্রভাব নিয়ে মিনেসোটা প্রদেশের শুনানিতে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য পিবিডি এনার্জি কোম্পানি থেকে পাওয়া ৮ হাজার ডলার মজুরি তিনি সিওটু কোয়ালিশনকে দান করেছিলেন। হ্যাপার একটি ইমেলে লিখেছেন যে তাঁর ফি ঘন্টা প্রতি ২৫০ ডলার এবং চারদিনের পারিশ্রমিক ৮ হাজার ডলার।

তিনি বলেছিলেন যে, তাঁর রিপোর্ট সম্ভবত সমগোত্রীয় বৈজ্ঞানিক পত্রিকার পর্যালোচনায় পাশ করবে না। তিনি লেখেন: আমি পিয়ার-রিভিউড জার্নালে প্রবন্ধটি জমা দিতে পারি, তবে তা প্রকাশে অনেক দেরি হতে পারে এবং সুপারিশকারী ও পত্রিকা সম্পাদকের প্রতিক্রিয়ায় হয়তো প্রবন্ধটি মূল বক্তব্য থেকে সরে এসে লেখা হবে কার্বন ডাইঅক্সাইড দূষণকারী, মানবতার জন্য উপকারী নয়। অথচ তা আমি বলতে চাই না, আপনার মক্কেলেরও সেই ইচ্ছা নেই। বিকল্প হিসাবে তিনি বলেন, নিবন্ধটি নিজেদের বাছাই করা পর্যালোচকদের দিয়ে পাশ করানো যেতে পারে। তবে বিশুদ্ধবাদীরা সেক্ষেত্রে আপত্তি করতে পারে যে, প্রক্রিয়াটি সমগোত্রীয় পর্যালোচনা হিসাবে যোগ্য নয়।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞান ইতিহাসবিদ এবং জলবায়ু বদল নিয়ে সংশয়ীদের আন্দোলন সম্পর্কে ‘মার্চেন্টস অফ ডাউট’ বইয়ের লেখক নাওমি ওরেসকেস দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছিলেন: হ্যাপার প্রায় ২০ বছর ধরে এই যুক্তি দিয়ে আসছেন যে, কার্বন ডাইঅক্সাইড কৃষির জন্য ভাল। অথচ এই দাবি যে মিথ্যা তা প্রমাণিত হয়েছে। আমরা ‘মার্চেন্টস অফ ডাউট’-এ যাদের কথা লিখেছি হ্যাপারের প্রোফাইল সেই লোকেদের মতো।

হ্যাপার ছাড়াও গ্রিনপিস পেনসিলভানিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির অবসরপ্রাপ্ত সমাজবিজ্ঞানী ফ্রাঙ্ক ক্লেমেন্টে (Frank Clemente)-কে ইন্দোনেশিয়ায় কয়লার দূষণে উচ্চহারে নাগরিকের অকালমৃত্যু নিয়ে ক্ষতিকারক সমীক্ষার উত্তর হিসাবে কয়লার সুবিধার পক্ষে রিপোর্ট তৈরি করার জন্য বলেছিল। তিনি ৮ থেকে ১০ পৃষ্ঠার একটি গবেষণাপত্রের জন্য ১৫ হাজার ডলার পারিশ্রমিকের কথা বলেন। এও জানান যে, সংবাদপত্রে মতামত লেখার জন্য তিনি ৬ হাজার ডলার পারিশ্রমিক নেন।

দুই ক্ষেত্রেই, অধ্যাপকরা রিপোর্টের জন্য অর্থগ্রহণ অস্পষ্ট করার উপায় নিয়েও আলোচনা করেছেন। ক্লেমেন্টে দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকাকে বলেছিলেন: তিনি অনেক শিল্পের পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করেছেন, যা মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে। নিজের গবেষণার জন্য তিনি গর্ববোধ করেন এবং বিশ্বাস করেন যে, পরিচ্ছন্ন কয়লা প্রযুক্তি নির্ভরযোগ্য এবং সাশ্রয়ী বিদ্যুতের পথ। তা বিশ্বব্যাপী শক্তির দারিদ্র্য হ্রাস এবং পরিচ্ছন্ন পরিবেশের পথ। পিবিডি এনার্জি কোম্পানি নিয়মিতভাবে ক্লেমেন্টের গবেষণার উদ্ধৃতি দেয় যে, উন্নয়নশীল দেশে কয়লার ব্যবহার সম্প্রসারিত করা বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য মোচনে সাহায্য করবে। ওদিকে, এমনকী বিশ্বব্যাঙ্কও কয়লার দারিদ্র্য মোচনের ধারণা প্রত্যাখ্যান করেছে।

গ্রিনপিসের ওই স্টিং অপারেশন থেকে বোঝা যায় যে, জীবাশ্ম-জ্বালানি সংস্থার স্পনসরশিপের কথা গোপন রেখে মর্যাদাপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের দিয়ে এমন রিপোর্ট লেখানো সম্ভব যা জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে সন্দেহের বীজ বপন করে। জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মানুষের মনে সন্দেহ জাগাতে এইসব রিপোর্টের জন্য তেল, কয়লা এবং গ্যাসকোম্পানি অর্থ দেয়। অর্থাৎ জীবাশ্ম-জ্বালানি শিল্পের অর্থে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কে মতামতকে প্রভাবিত করা যায়, এবং এইভাবে উষ্ণায়ন এড়াতে জোরালো পদক্ষেপের সম্ভাবনা ঠেকিয়ে রাখা যায়।

ওদিকে জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকারের শিরোমণিরা বারবার নিজেদের বক্তব্য বদলেছে। নানা সময়ে তারা বলেছে, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে না,’ ‘জলবায়ু পরিবর্তন ঘটছে কিন্তু মানুষের কার্যকলাপে তা হচ্ছে না,’ ‘জলবায়ু পরিবর্তন ঘটলেও তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।’ এ নিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রাজনৈতিক কৌশল হল— বিশেষজ্ঞ ও বিরোধীদের উপর ব্যক্তিগত আক্রমণ এবং ই-মেল স্ক্যান্ডাল করা। বিজ্ঞানীদের দুর্নীতিগ্রস্ত, অ্যাক্টিভিস্টদেরকে প্রগতিবিরোধী, সাংবাদিকদের মিথ্যাবাদী হিসাবে দাগিয়ে দেওয়ার কৌশল জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকার আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকার করতে যেসব সংগঠন তৈরি হয়েছে তাদের দিকে তাকালে বোঝা যায় যে, জনসাধারণের কাছ থেকে তথ্য লুকিয়ে কর্পোরেটদের ব্যক্তিগত লাভ দেখার এবং জনস্বাস্থ্যের ক্ষতিতে জীবাশ্ম-জ্বালানি শিল্পের ভূমিকা অস্বীকার করার উদ্দেশ্যে তাদের নিজস্ব বিশেষজ্ঞদের আর্থিক সাহায্য করাই তাদের কাজ। তামাকশিল্প নিজেদের ব্যবসা অক্ষত রাখতে তামাকজাত পণ্যের সঙ্গে ক্যান্সারের সম্পর্ক অস্বীকার করতে যা করেছে, সংশয়ীরা জীবাশ্ম-জ্বালানি শিল্পকে রক্ষা করার জন্য সেই কাজ করে চলেছে।

২০০৯ সালে, কোপেনহেগেন জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের আগে, হ্যাকাররা ইস্ট অ্যাংলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জলবায়ু গবেষণা ক্ষেত্র থেকে অসংখ্য ই-মেল হ্যাক করেছিল৷ হাজার হাজার ই-মেলের মধ্যে, জলবায়ু বিষয়ের বাইরের কয়েকটি ই-মেলকে সংশয়ীরা বেছে নিয়েছিল। উদ্দেশ্য, ইঙ্গিতে এ-কথা বোঝানো যে, জলবায়ু গবেষকরা তথ্য বিকৃত করে জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতা সম্পর্কে জনসাধারণকে বিভ্রান্ত করেছেন। বিষয়টি ‘ক্লাইমেটগেট’ কেলেঙ্কারি নামে পরিচিত। ক্লাইমেটগেট কয়েক মাস ধরে মার্কিন সংবাদমাধ্যমে প্রচার পেয়েছিল, বিশেষ করে রক্ষণশীল সংবাদপত্রতে। পরবর্তীকালে একাধিক স্বাধীন তদন্তে জানা যায় যে, বিজ্ঞানীদের গবেষণায় কোনও ভুল নেই। তবে সেই সব তদন্ত রিপোর্টের কথা সংবাদমাধ্যমে প্রচার পায়নি। তাই জলবায়ুবিজ্ঞানের উপর জনসাধারণের আস্থা কমেছিল।

কয়েকবছর আগে, এক জলবায়ুবিজ্ঞানী বেশ কয়েকটি অভ্যন্তরীণ নথি ফাঁস করেছিলেন যেখানে জলবায়ু বিজ্ঞানের উপর আক্রমণকারী হার্টল্যান্ড ইনস্টিটিউটের আর্থিক মদতদাতাদের নাম প্রকাশ করা হয়েছিল। এ নিয়ে জলবায়ু অ্যাক্টিভিস্টদের চাপ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে, স্টেট ফার্ম ইন্স্যুরেন্স এবং জেনারেল মোটরসের মতো কর্পোরেশনগুলি ওই প্রভাবশালী থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বা চিন্তাকেন্দ্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। অন্য অনেক কর্পোরেশন সিদ্ধান্ত নেয় যে, তারা আর প্রকাশ্যে জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকারের পথে থাকবে না।

তারপরও আমেরিকায় জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকারের ধারা বা বা শক্তিশালী সংশয়বাদ রয়ে গেছে। ২০২৪  সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নেচার পত্রিকায় দুই বিজ্ঞানীর যৌথভাবে প্রকাশিত গবেষণায় টুইটার (এখন এক্স) এবং ভূ-অবস্থানের তথ্য ব্যবহার করে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং নেটওয়ার্ক বিশ্লেষণের সাহায্যে জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকারকারীদের চিহ্নিত করতে আমেরিকা জুড়ে ম্যাপ ও প্রোফাইল তৈরি করা হয়েছিল। ওই গবেষণা থেকে জানা গেছে, ১৪.৮ শতাংশ আমেরিকাবাসী জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বাস করে না। এই সংশয় বা অস্বীকারবাদ আমেরিকার কেন্দ্রীয় ও দক্ষিণ অঞ্চলে সর্বোচ্চ। এর কারণ ওই সব অঞ্চলের বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের জনপ্রিয়তা। সংশয়বাদের পিছনে শিক্ষাগত যোগ্যতা, কোভিড-১৯ টিকা নেওয়ার হার, আঞ্চলিক অর্থনীতিতে কার্বন-নিঃসরণের তীব্রতা এবং রোজগারেরও প্রভাব রয়েছে। বিশ্লেষণ থেকে জানা গেছে যে, ঠান্ডা আবহাওয়া এবং শীর্ষ সম্মেলনগুলোকে ব্যবহার করে কীভাবে এক সামাজিক সংবাদ আদান-প্রদানের নেটওয়ার্ক জলবায়ু পরিবর্তন এবং বিজ্ঞান সম্পর্কে অবিশ্বাসের বীজ বপন করে। এই নেটওয়ার্কে সবচেয়ে প্রভাবশালী হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তার পরে রয়েছে রক্ষণশীল মিডিয়া আউটলেট এবং ডানপন্থী কর্মীরা।

যেসব স্থানীয় অর্থনীতি জীবাশ্ম-জ্বালানির উপর বেশি নির্ভরশীল এবং যেখানে গ্রামীণ সম্প্রদায় ও জনসাধারণের মধ্যে বৈজ্ঞানিক মানসিকতা কম, সেখানেই সংশয়বাদ বেশি৷ লক্ষ লক্ষ ব্যবহারকারীর কাছে ভুল তথ্য ছড়ানোর মূল অস্ত্র হল সোশাল মিডিয়া। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন না নেওয়ার প্রতিক্রিয়াতেও তা স্পষ্ট ছিল।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে তুষারঝড়ের পর বিশ্ব-উষ্ণায়ন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে ট্রাম্পের একটি টুইট ওই সম্প্রদায়কে জলবায়ু পরিবর্তনের কথা যে অর্থহীন সে-বিষয়ে টুইট করতে উদ্‌বুদ্ধ করেছিল। এদের বক্তব্য, জলবায়ু পরিবর্তনের কথা বলা এক প্রতারণা বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। তা মানুষকে কার্বন নিঃসরণহীনতার খরচ বহন করার জন্য প্রভাবিত করার প্রতারণা। এভাবে ধনীদের জন্য প্রচুর সম্পদ তৈরি করা হয়। রক্ষণশীল মিডিয়া, ডানপন্থী কর্মী এবং ভুল ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর সাইটগুলো এই নিয়ে টুইটের মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার করে। টেক্সাস এবং মিড-আটলান্টিক অঞ্চল ও নিউ ইংল্যান্ডের তুষারঝড় নিয়েও সংশয়ীদের মধ্যে টুইটের ঝড় উঠেছিল। সংশয়ীরা দুই ঘটনা নিয়েই বলতে শুরু করে যে, জলবায়ু পরিবর্তন বাস্তব নয়।

টুইটারের তথ্য ব্যবহার করে, রাজ্য ও কাউন্টি স্তরে আমেরিকায় জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকারের ব্যাপক সামাজিক চেহারা দেখাতে, গবেষকরা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এবং নেটওয়ার্ক বিশ্লেষণ ব্যবহার করেছেন। রিপাবলিকান কাউন্টিতে, বিশেষ করে গ্রামীণ অঞ্চলের কলেজে না-যাওয়া বাসিন্দাদের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন অস্বীকারের ভৌগোলিক পূঞ্জগুলোকে চিহ্নিত করেছেন। গবেষণায় দেখা গেছে, যারা রিপাবলিকান প্রার্থীকে ভোট দেয় তাদের জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত অন্যান্য খবরের তুলনায় ট্রাম্পের টুইটকে বিশ্বাস করার সম্ভাবনা বেশি।

গবেষকরা ৭৩ লক্ষ টুইট-নমুনায় জাল বিশেষজ্ঞদেরও রেখেছিলেন, যাদের জলবায়ুবিজ্ঞান সম্পর্কে কোনও ধারণা বা দক্ষতাই নেই, অথচ সংশয়ের বার্তা পৌঁছে দেয়। একই নৈতিক মূল্যবোধের সামিল হিসাবে তারা বিশ্বাসযোগ্য বার্তাবাহকের কাজ করে। এর মোক্ষম উদাহরণ হল আইপিসিসির ২০১৮ সালের জলবায়ু  প্রতিবেদন সম্পর্কে সন্দিগ্ধ ট্রাম্পের টুইট, যা তাঁর সমর্থকরা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিয়েছিল। তারা জলবায়ু পরিবর্তনকে মানুষের কাজকর্মের ফল হিসাবে না দেখে আজও প্রাকৃতিক ঘটনা বলে প্রচার করে।

 

নির্বাচিত সূত্রনির্দেশ

বই

  • Ross Gelbspan, Boiling point: How politicians, big oil and coal, journalists, and activists have fueled a climate crisis—and what we can do to avert disaster, New York: Basic Books, 2004.
  • Thomas Gale Moore, Climate of fear: Why we should not worry about global warming, Washington DC: Cato Institute, 1998.

 

ইন্টারনেট সূত্র: পত্রিকা, ব্লগ ও অন্যান্য

(এখানে সূত্রগুলির ইউআরএল অনুযায়ী শেষ মিলিয়ে দেখা হয়েছিল ১২.১২.২০২৪ তারিখে)

 


[1] বইয়ের ‘উষ্ণায়ন-ভাবনার প্রাক্‌-ইতিহাস: নেপথ্যের বিজ্ঞানীরা’ অধ্যায়ে এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
[2] সভার বিস্তারিত বিবরণ ২০১০ সালে ব্রিটেনের ‘দি গার্ডিয়ান’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল।
[3] অবশ্য তা পরেও ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার ওয়েবসাইটে ছিল।
[4] জীবাশ্ম-জ্বালানির সমালোচনা থেকে বিতর্ক সরানোর জন্য ওই ২০১৫ সালেই ওই সিওটু কোয়ালিশন তৈরি হয়েছিল।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4993 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...