
চন্দ্রা মুখোপাধ্যায়
জীবনকে ঘিরেই যেহেতু মেয়েদের গান, তাই জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজকর্ম বা শ্রমকে ঘিরেও মেয়েরা গান বেঁধেছেন নানা ধরনের। কালিদাসের রঘুবংশে আমরা দেখেছি মেয়েরা আখের ক্ষেত পাহারা দিতে দিতে রঘুর বন্দনাগীত গাইছেন; অর্থাৎ বাংলার মেয়েরা ঘরের বাইরে কাজ করছেন বহু বহু যুগ ধরেই। এই উল্লেখের কয়েকশো বছর পরে, লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি গোবর্ধন আচার্য তাঁর 'আর্যা সপ্তশতী' গ্রন্থে বলছেন কলমগোপীদের কথা, যে গোপী বা গোয়ালিনীরা নিজেদের পেশাগত কাজ সারার পরেও ক্ষেত পাহারা দেওয়ার কাজ করতেন, তাঁদের কথা। চর্যাপদে আমরা দেখেছি মেয়েরা নদী পার করার বা শুঁড়িখানা চালানোর কাজ করছেন। অন্তঃপুরে বন্দি না থেকে বাংলার নানা পেশাজীবী মেয়েরা ঘরে এবং বাইরে কাজ করে আসছেন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে
এ-লেখার মূল ভিত্তি বাংলার মেয়েদের নিজস্ব গান। বাংলা ভাষা সৃষ্টিরও আগে থেকে বাংলার মেয়েরা গান গাইছেন জীবনের প্রত্যেকটি অভিজ্ঞতাকে কেন্দ্র করে। জীবনকে ঘিরেই যেহেতু মেয়েদের গান, তাই জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় কাজকর্ম বা শ্রমকে ঘিরেও মেয়েরা গান বেঁধেছেন নানা ধরনের। কালিদাসের রঘুবংশে আমরা দেখেছি মেয়েরা আখের ক্ষেত পাহারা দিতে দিতে রঘুর বন্দনাগীত গাইছেন; অর্থাৎ বাংলার মেয়েরা ঘরের বাইরে কাজ করছেন বহু বহু যুগ ধরেই। এই উল্লেখের কয়েকশো বছর পরে, লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি গোবর্ধন আচার্য তাঁর ‘আর্যা সপ্তশতী’ গ্রন্থে বলছেন কলমগোপীদের কথা, যে গোপী বা গোয়ালিনীরা নিজেদের পেশাগত কাজ সারার পরেও ক্ষেত পাহারা দেওয়ার কাজ করতেন, তাঁদের কথা। চর্যাপদে আমরা দেখেছি মেয়েরা নদী পার করার বা শুঁড়িখানা চালানোর কাজ করছেন। অন্তঃপুরে বন্দি না থেকে বাংলার নানা পেশাজীবী মেয়েরা ঘরে এবং বাইরে কাজ করে আসছেন হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে।
চণ্ডীমঙ্গলে ভাঁড়ু দত্ত যখন বাজার করতে গিয়েছিলেন তখন সবাইকে ঠকিয়ে জিনিসপত্র আদায় করতে পারলেও মেছুনিদিদির কাছে তিনি কিন্তু কুপোকাত; পেশাজীবী বাঙালিনীরা দাপটের সঙ্গে সমাজে তাঁদের জায়গা করে নিয়েছিলেন— গোয়ালিনী, রজকিনী, সুতা-কাটুনি, হালিক রমণী, ভানুনি, ভাজানি, ধাত্রীমাতা বা পসারিনী— হাট মাঠ ঘাট বা বাট বা পথই ছিল যাঁদের কর্মক্ষেত্র। সাহিত্যে তাঁদের উল্লেখ এসেছে বারেবারে।
মেয়েদের কর্মক্ষেত্র তো শুধু বাইরে নয়, ঘরেও তাঁদের নানান কাজ। সে-কাজের মূল্য কেউ হয়তো দেয় না কিন্তু সম্প্রতি রাষ্ট্রসঙ্ঘের হিসাব অনুযায়ী মেয়েরা ঘরে যে সেবামূলক ও উৎপাদনমূলক কাজ করেন, তা যদি জাতীয় আয়ের সঙ্গে যুক্ত হত সেটা দাঁড়াত (১০% + ৩৯%); উৎপাদন, পরিবহন এবং বাণিজ্যের চেয়েও যা হয়তো বেশি। তাই কর্মক্ষেত্র বলতে ঘর ও বাহির, যা-ই বোঝানো হোক না কেন, গ্রামীণ মেয়েরা প্রত্যেকটি কাজ করেন যত্নসহকারে আর তাই নিয়ে বেঁধে রাখেন নানান গান। তাই মেয়েদের কর্মক্ষেত্র হিসেবে ঘর-দোর, হাট-বাট, মাঠ-ঘাট, পাহাড়-জঙ্গল, নদী-পুকুর সবই তাঁদের গানে আসে নানাভাবে, নানা সময়।
সকালের ঘরদোর
ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে শ্রম শুরু হয় তার পরিধি ঘর-উঠোন-রান্নাঘরে পরিব্যাপ্ত থাকে—
আঁধার ঘরের ছঁচ তুলেছি… (ঝাড়গ্রাম)
ছঁচ তোলা অর্থাৎ মাটি লেপা শুরু হয় ভোরের আলো ফোটার আগে অন্ধকার থাকতেই। একটু বেলা বাড়লে উঠোন ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজা, মশলা বেটে রাখা… নানা কাজ চলতে থাকে।
আঙিনা সাংটোং মুঁই খুরুৎ খারাৎ বাঁশের ঝাঁটা দিয়া
মশলা পিষিতে, ভারা না মাঞ্জিতে, হাতে মোর পড়িচে কালা… (গোয়ালপাড়া)
.
আঙিনা সাংটিয়া ঘরো না নেপিনু ঘরো না মুচিনুরে
ছ্যাঁকা না পারিয়া কাপড় ধুইনু, কাপড় শুকানো রে—
ভাত না চড়েয়া ভাত না রান্দিনু ভাত না বাড়িনু রে… (কোচবিহার)
ভারা মাঞ্জা মানে বাসন মাজা; ছ্যাঁকা পাড়ার অর্থ, কলাগাছের বাসনা পুড়িয়ে ক্ষার তৈরি করা। যখন সাবান ছিল না তখন এভাবেই কাপড় কাচা হত।
এইসব কাজ করতে করতে ঘুমন্ত শিশু যখন উঠে পড়ে মা ছুটে যান বাচ্চাকে কোলে তুলে নিতে— সন্তানপালন মেয়েদের একটা বড় কাজ।
গোপাল আমার কাঁচা সোনা, ধূলায় পড়ে রবে না… (ফরিদপুর)
তখন তাকে স্নান করানো, খাওয়ানো সেগুলোও তো মায়েরাই করেন।
নাওইয়া পাখলাইয়া মায়ে তুইলা লইল কোলে,
ঢালিয়া না ধলা দুধ দিল চন্দ্রমুখে… (কুমিল্লা)
ক্ষেতখামার
ঘরদোর পরিষ্কার করে, রান্নার প্রাথমিক পর্ব সামলে, বাচ্চাদের নাইয়ে খাইয়ে এবারে মেয়েরা বেরোবেন বাইরের কাজে। যাওয়ার সময় ঘরের পুরুষ মানুষটির জন্য জলখাবারটা বেঁধে নিয়ে যেতেও ভোলেন না—
হাতে নিল জলের ঝারি, মাথায় জলপান…
এবার মাঠে গিয়ে চাষবাসের কাজে হাত লাগাবেন মেয়েরা। প্রায় ১২০০০ বছর আগে কৃষি মেয়েদের হাত ধরেই এসেছিল আর লাঙল আসার আগে পর্যন্ত পুরোটাই ছিল মেয়েদের দায়িত্বে। এখনও কৃষিকাজের বিভিন্ন ধাপেই মেয়েরা জড়িত থাকেন। ধান রোয়া এখনও মেয়েদেরই কাজ।
আরে গাওখান হইল মোর ন্যাতের প্যাতের
নাওছা বেছন গাড়িয়া… (রংপুর)
ধানগাছ একটু বড় হলে যে নিড়ানি দিতে হয় সেটাও মেয়েরাই করেন।
চলো গো মাসি চলো গো পিসি চলো যাব ধান লিড়াইতে… (বাঁকুড়া)
শুধু ধানচাষই নয়, নানা সবজিচাষেও মেয়েরা অংশগ্রহণ করেন—
কলা রুইলাম সারি সারি, বেগুন রুইলাম দুই বাড়ি…
অথবা
বাহারে ঠিকরে আলু, আলু তোর বলেহারি যাই
এই আলুর চাষ করিতে কী কী নাগে ভাই?…
এই আলুর তুলিতে কী কী নাগে ভাই?… (নদিয়া)
ফসল পাহারা দেওয়ার কাজও করতে হয় দরকার হলে—
ও দিদি তাড়া লো…
হনুতে ফুলকপি খেল… ফুলকপি খেল রে দিদি,
ওলকপি খেল রে দিদি… (ঝাড়গ্রাম)
.
আবার প্রাঙ্গণ
ধান কেটে যখন ঘরে আসে তখন উঠোনই আবার কর্মক্ষেত্র। ধান বা গোটা কলাই তো আর আমরা খাই না; তাই শুরু হয় ধান শুকানো, সেদ্ধ করা, ধান ভানা, চিঁড়ে কোটা, মুড়ি ভাজা, খই ভাজা, বা জাঁতা ঘুরিয়ে ডাল, ছাতু তৈরির মতো খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের নানান কাজ। আর তার সঙ্গে থাকে নানা গান—
ধান ঘাটোং, বারা ভুকাংও রে… আই মুঁই বসিয়া সিয়ান আরও ক্যাঁথা (মেখলিগঞ্জ)
ধান শুকানো, ভানার মাঝে যখন একটু বিশ্রাম নিচ্ছেন, শীতের প্রস্তুতি হিসাবে আগাম সেলাই করে রাখছেন কাঁথাটা। সারা দুপুর ধরে চলে নানা কাজ।
আম কাঁটোলের ছোঁয়ার তলে—
ভর দুপুরা বারা বানি রে… (গোয়ালপাড়া)
.
চিঁড়া কুটে মুকুন্দমুরালি…
বৃন্দাবনে কোটে চিঁড়া, রসের কামিনী… (কুমিল্লা)
.
আমদের টুসু মুড়ি ভাজে চুড়ি ঠনঠন করে লো… (বাঁকুড়া)
.
জাঁতা টান রে টান… সাঁঝের বেলা শুনতে যাব আলাপেরই গান (মুর্শিদাবাদ)
.
ডাল ডলনু, ছাত্তু পিষনু আরও পিষনু আটা… (মালদহ)
এইভাবেই চলতে থাকে নানা কাজ আর তার গান।
হাটে বাজারে
পরিবারের ধান বা কলাইটুকুই শুধু নয়, পাড়ার অন্য বাড়িতে বা হাটে গিয়েও মেয়েরা ধান ভানছেন বহু যুগ ধরে; সঙ্গে বেচাকেনা করছেন নানা জিনিস। তাই হাট বা বাজার— দুটোই মেয়েদের কর্মক্ষেত্র হাজার বছর ধরেই। লক্ষ্মণ সেনের সভাকবি শরণ সেই যুগেই লিখেছিলেন, মেয়েরা কড়ি গুনতে গুনতে তাড়াতাড়ি ফিরছেন হাট থেকে— হাওয়ায় তার বুকের বসন উড়ে যাচ্ছে। আর একালে আমরা নানা জেলায় পাই নানা গান—
হামরা বারা বানতে যাব সানঝা একসাথে
চলটে রাইহোর হাটে… (মালদহ)
হাটে তাঁরা শুধু ধান ভানতেই আসতেন না, জেলেনি আসতেন মাছ বিক্রি করতে, যিনি আনাজ বা শাকচাষ করেছেন তিনি আসেন শাকসবজি বিক্রি করতে।
এক ঝুড়ি শিম লিব, মানকরের হাটে যাব
ও শিম বিকে নারে বিকে না, মানকরের হাটে… (বাঁকুড়া)
.
ছন্তি পালংয়ের শাক তুললাম গোছা গোছা রে—
সবারই শাক আশেপাশে, আমার শাকে বাজার বসে,
সবারই শাক আনা আনা, আমার শাকে চোদ্দ আনা… (মুর্শিদাবাদ)
.
হাতে নিল কুলা ডেলি মাথায় নিল মাছ
যায় যায় ডুমুনি আমার গৌরীপুরের হাট… (গোয়ালপাড়া)
পথে পথে
আবার কখনও কখনও পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে ঘুরে নানান জিনিস বিক্রি করেন মেয়েরা—
এ পাড়ার বউঝি তোরা মাছ নিবি না কি লো,
মাছ তো ধারে দিব না,
ঘরে আছে ছেল্যার বাবা দেবে গঞ্জনা (দক্ষিণ ২৪ পরগনা)
একইরকমভাবে নানান ধরনের ঘরে তৈরি জিনিসও তারা বিক্রি করতেন; যেমন হাতপাখা—
এ পাড়ার বউঝি তোরা পাংখা নিবি না কি লো?
আমার পাংখার এমন গুণ
আইতে ঘুম, যাইতে ঘুম… (ঐ)
.
দে তুলে দে বিলাতির ঝুড়ি—
আমি বিকবো লো কুলহি কুলহি..
.
কন্যার মা হীরা জালনি—
মাছের হাঁড়ি মাথে লয়ে ঘুরে বাড়ি বাড়ি…
তোরা মাছ লবি লো… (কুমিল্লা)
এইভাবে পথ হাট ক্ষেত খামার— সবই মেয়েদের কর্মক্ষেত্র।
ঘরই যখন কর্মক্ষেত্র
বাংলার বস্ত্রশিল্পের একসময় জগৎজোড়া খ্যাতি ছিল। তাঁতে বসার আগে সুতোকাটা, রং করা, গোটানো— এমন নানা পর্যায়ে মেয়েরা কিন্তু জড়িত থাকতেন নানাভাবে। দক্ষ কাটুনিরা শুধু সুতোই কাটতেন না, সূক্ষ্মতা বুঝতে পারতেন হাতের স্পর্শেই আর সেই অনুযায়ী শ্রেণিবিভাগও করতে পারতেন। ছোটখাটো খারাপ হলে চরকা সারিয়ে নিতে পারতেন নিজেরাই—
দড়ি কিনা আন, নড়ি কিনা আন—
মারনু একটা ডাং—
বা কু কু করে চরখা রে, চরখার গান শুনিতে ভাল (জলপাইগুড়ি)
ঘরে বসেই বৃত্তি অনুযায়ী তৈরি করতেন পৈতা, নরুন বা প্রদীপ—
সানঝা আয় লো বামুনপাড়া দিয়া
যতসব বামুনের মেয়ে পৈতা বেইচ্যা খায় লো…
সানঝা আয় লো কামারপাড়া দিয়া
যতসব কামারের মেয়ে নরিন বেইচ্যা খায় লো… (মালদহ)
গোয়ালিনীরা গোয়ালঘর সংলগ্ন এলাকাতেই মাখন, ননী তৈরি করতেন। দধিমন্থনের শব্দ শোনা যেত—
এ কী শব্দ শুনা যায়
ব্রজপুরে দধি মথে নন্দরানি মায়… (শ্রীহট্ট)
তালপাতার পাখাও তৈরি করতেন মেয়েরা—
তালের পাতা কেটে চতুক দিকে বসে
পাঙ্খা বোনাব আমরা চারজনায় চারখানা… (মুর্শিদাবাদ)
খাল বিল পাহাড় জঙ্গল
অনেক সময় ঘরের প্রয়োজনেই বাইরে বের হতে হয়। ভাতটা চাষ থেকে এলেও ভাতের সঙ্গে কিছু একটু দেওয়ার জন্য মেয়েরা ঘুরে বেড়ান খালে, বিলে, পুকুরে, পাহাড়ে, জঙ্গলে। কোথাও বিল ছেঁচা হচ্ছে খবর পেলে তাঁরা ছুটে যান কিছু মাছের আশায়—
ছ্যাঁচা বিলে মাছ মারিলাম রে, হেলেঞ্চার শাগে মইজ্যা যায়… (মালদহ)
রান্নার সময় যদি একটু হ্যালেঞ্চাশাক পাওয়া যায়, তাহলে তরকারিটা সুস্বাদু হয়; আশেপাশের জলায় তাই নেমে পড়া—
হেলেঞ্চা তুলিতে নাইম্যাছিলাম জলে
বেলের কাঁটা ফুইট্যা গেল পায়ে… (মুর্শিদাবাদ)
আবার শাক তোলার জন্য হয়তো নেমেছেন বেতোশাকের বনে—
এপার বাইতো ওপার বাইতো, বাইতো দুমদুম করে—
বাইতোর শাক তুলতি গেলি সাপের পট করে… (ফরিদপুর)
কাঁটা বা সাপই শুধু নয়, কখনও আবার বাঘেরও দেখা মেলে—
শাগ তুলিবার গেনু মাও মুঁই মানস নদীর বাতায় রে—
শাগের ভুঁইয়ত বাঘের পাড়া ধুমকি উঠিল গাও রে… (রংপুর)
মাছ না পেলে যদি একটু গুগলি পাওয়া যায় তাই বিলের ধারে খোঁজখবর চলে—
গগলি কুড়াতে গেলি, বড় বাঁধের বিল—
মাথায় গগলির ঠেকা উপরে উড়ে চিল।
দাদার দেনো বাঁটুল হে বিঁধে মারি সোনার শাঁখচিল… (ঝাড়গ্রাম)
শাক, মাছ, গুগলি জোগাড়ের পর এবারের কাজ জ্বালানি সংগ্রহ। সেই জন্য তাঁরা কখনও জঙ্গলে, কখনও পাহাড়ে উঠেও শুকনো ডালপালা সংগ্রহ করে আনেন। শুশুনিয়া অঞ্চলের দিদিরা কাঠের বোঝা মাথায় নিয়ে পাহাড়ে ওঠানামার কথা বলেন—
শুশুন্যারি কুলহি বড় চড়ি—
ও আমার আসা-যাওয়া লাগে গেল বুক ধড়ি (বাঁকুড়া)
.
জলের কাছে, নদীর কাছে
খাদ্যসংগ্রহ, জ্বালানি সংগ্রহের পর জল আনাটাও মেয়েদেরই দায়িত্ব। রাজস্থানের মেয়েদের মতো কঠিন পরিশ্রম করতে না হলেও জলটা তাঁদেরই আনতে হয়—
আমার হাতে কলসি কাঁখে কলসি সই গো—
আমি পারিনে জল ভরাতে কদমতলাতে… (নদিয়া)
শুধু জল আনার জন্যই যে মেয়েরা নদীতে যান তা-ও নয়, নদীতে তাদের যেতে হয় বিভিন্ন কাজে। নিজেদের স্নান ছাড়াও থাকে কাপড় কাচা—
উড়ুক ঢুলা লাগুক কাপড়ে
ও কাপড় কাচব নদীর পাথরে… (বাঁকুড়া)
.
কন্যার জেঠি কাপড় কাচে চালতাতলার ঘাটে… (কুমিল্লা)
কাপড় কাচা ছাড়াও নানান জিনিস ধুতে যেতে হয় নদীর ঘাটে বারে বারে, যেমন নোয়াখালির গানে শুনছি—
ইলিশমাছ গা ধুইত নিল মেঘনা নদীর ঘাটে,
মেঘনা নদী ভাসি গেল ইলিশার তেলে
মাছ ইলিশা রে… (নোয়াখালি)
আর জলের ঘাটে বন্ধুর সঙ্গে দেখা করাটাও কি একটা কাজ নয়? তাই অনেক সময় কলসির জল মাটিতে ঢেলেও মেয়েরা বাইরে বেরোন জলের ছলে—
কলসির জল মাঝিয়ায় ঢালিয়া কলসি হইল মোর খালি রে
কলসিত্ নাই জল রে (গোয়ালপাড়া)
নদীর ধারে আরেক কাজ। গরু-ছাগল চরানো—
ছাগল চরাইতে গেলাম অজয় নদীর ধার
কী আজ মঙ্গলবার… (বর্ধমান)
সাশ্রয়ী মেয়েরা নদীতীরের উর্বর মাটিতে আবার ছড়িয়ে দেন নানা বীজ…
নদীধারে লঙ্কা দেখলাম, লঙ্কা হল তিন ঝাঁজা… (বীরভূম)
.
আবারও ঘর
দিনের শেষে রান্নাবান্না করে সবাইকে খাওয়ানো পরিবেশন করে নিজেদের খাওয়া বাসন ধুয়ে পরিষ্কার করা— সেসবের পর্বও চলতে থাকে। তাই গানও থাকে সব কাজের—
মাগুর মাছের ঠুমা রে তুমি আদা আদা বা চাকা চাকি
কমোর হালেয়া পারস করো নয়ন ভরিয়া দেখি—
নাচ করো হে সুরূপা সুন্দরী, হাতে বা দিয়া তালি… (গোয়ালপাড়া)
কাজ করতে করতে আনন্দের প্রকাশ নাচে গানে; শ্রম আর সৃজন হাত ধরেই চলে বাংলার মাটিতে।
তবে শুধু নাচে গানে আনন্দেই যে দিন কাটে তাও তো নয়। বাড়ির বৃদ্ধ মানুষটিকে যখন খেতে দেওয়া হয় তখন তিনি খাবেন না। আবার মাঝরাত্রে উঠে বলেন এখন আমায় খেতে দাও। অর্থাৎ মেয়েদের জ্বালা একরকমের নয়—
ভাত রাঁধেছি হুড়া হুড়া, বুড়া বলে খাব না
অর্ধেক রাতে উঠে বলে আমি কি ভাত পাব না!! (বাঁকুড়া)
আর সব মিটিয়ে শুতে গেলেও কি ঘুমানো যায়!
থালি ধুলাম, বাসন ধুলাম শুলুম বুড়োর পাশে,
সারা রাতে ঘুম আসে না খুকুর খুকুর কাশে… (বীরভূম)
এইসব নিয়েই মেয়েদের চলা। তাই ঘর-বার, ক্ষেতখামার, নদী জঙ্গল খালবিল, পাকশালা গোশালা, হাটবাজার— সবটাই মেয়েদের কর্মক্ষেত্র। তাই প্রাঙ্গণ বা প্রান্তর, সর্বত্রই আছে নারীর শ্রমচিহ্ন।
*আগ্রহী পাঠক বিশদ জানতে পড়তে পারেন লেখকের এই বিষয়ের বই নারীর গান শ্রমের গান (তবুও প্রয়াস)। আরও গান শুনতে পারেন Geedali ইউটিউব চ্যানেলে