গাজা কোনও ‘জিনিস’ নয়, মিঃ প্রেসিডেন্ট

মালাক হিজাজি

 



মালাক হিজাজি গাজার লেখক। তাঁর এই নিবন্ধটি দ্য ইলেকট্রনিক ইন্তিফাদা-য় গত ৩ ফেব্রুয়ারি ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। বাংলা অনুবাদ আমাদের

 

 

মনে হচ্ছে ইজরায়েল এবং আমেরিকা কারওই আমাদের, গাজার মানুষদের, শান্তিতে বাঁচতে দেওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। ইজরায়েলি ঔপনিবেশিক দখলদারি যে গণহত্যা চালাচ্ছে তাতে যদিও মার্কিন সমর্থনে এবং মিশর ও কাতারের মধ্যস্থতায় একটা লোকদেখানো অস্ত্রবিরতি ঘোষিত হয়েছে, কিন্তু তার মধ্যেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প একটি অত্যন্ত বিতর্কিত ঘোষণা করেছেন। তিনি প্রস্তাব দিয়েছেন “সম্পূর্ণ জিনিসটা পরিষ্কার করার,”[1] যার মধ্যে প্রস্তাব রয়েছে “দেড় মিলিয়ন” প্যালেস্তিনীয়কে তথাকথিত মানবিক সমাধানের নাম করে জর্ডন এবং মিশরের মতো প্রতিবেশী দেশগুলিতে স্থানান্তরিত করার।

আমি তাঁর কথাগুলো দুবার পড়েছি, “জিনিস” বলতে তিনি ঠিক কী বোঝাতে চাইলেন বুঝতে চেষ্টা করেছি। ভুল হওয়ার কোনও জায়গা নেই— তিনি গাজা ভূখণ্ডের কথাই বোঝাতে চেয়েছেন। যে-ভূখণ্ড দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষের বাসভূমি, যে মানুষগুলি কয়েক দশক ধরে অবরোধ, বোমাবর্ষণ এবং জবরদস্তি উচ্ছেদ মোকাবিলা করে চলেছেন। ট্রাম্পের কাছে গাজা জীবন, ইতিহাস এবং প্রতিরোধের একটা নাম নয়— গাজা একটা বাধা যেটাকে মুছে ফেলতে হবে, গাজার মানুষ আমেরিকার পেয়ারের বখে যাওয়া বাচ্চাটার একটা সমস্যা যেটার “সমাধান” করতে হবে।

জর্ডনের রাজা দ্বিতীয় আবদুল্লার সঙ্গে একটি ফোন-কলের কথা উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেছেন গাজার “একটা পুরো জগাখিচুড়ি” অবস্থা হয়ে গেছে। তিনি রাজা আবদুল্লাকে অনুরোধ করেছেন যেন তিনি তাঁর দেশে আরও বেশি সংখ্যক প্যালেস্তিনীয়কে আশ্রয় দেন। তাঁর দাবি, এই নতুন ব্যবস্থা স্বল্পমেয়াদি বা দীর্ঘমেয়াদি যা-ই হোক, তা নাকি তাঁদের “জীবনে শান্তি ফিরিয়ে আনতে” সাহায্য করবে।

“আমি চাই মিশর আশ্রয় দিক, আমি চাই জর্ডন আশ্রয় দিক,” বলেছেন তিনি[2]। মিশর এবং জর্ডন উভয়েই অবশ্য গাজা থেকে প্যালেস্তিনীয়দের উৎখাত করার এই প্রস্তাব[3] প্রত্যাখ্যান[4] করেছে।

এ নতুন কিছু নয়। ট্রাম্পের কাছে গাজা কোনও মানুষের বাসভূমি নয়— বরং, একটি রিয়েল এস্টেট প্রবলেম যেটার সমাধান করতে হবে। সম্প্রতি তিনি গাজাকে একটি “বিস্ময়কর জায়গা” বলে অভিহিত করেছেন[5], আবার সেই একই সময়ে তাকে তুলনা করেছেন একটি “ব্যাপক ধ্বংসাত্মক এলাকা”র সঙ্গে। তাঁর কথাগুলি তাঁর জামাই জারেড কাশনারের কথার প্রতিধ্বনি— যিনি আগের বছর গাজার মূল্যবান জলসম্পদের কথা এমনভাবে উল্লেখ করেছিলেন[6] যেন একবার এখানকার মানুষদের সুন্দর করে মুছে দেওয়া গেলেই গাজা পুঁজির একটা মুখ্য গন্তব্য হয়ে উঠতে পারে।

 

অবজ্ঞা এবং হতাশা

ট্রাম্পের এই প্রস্তাবে গাজায় দু-ধরনের প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কেউ এটা উড়িয়ে দিয়েছেন, কেউ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন হয়েছেন। যাঁরা উড়িয়ে দিয়েছেন, তাঁরা তাঁর এই কথাগুলিতে কোনও গুরুত্ব দিতেই রাজি নন। বিশেষত যখন ইজরায়েলি ফৌজ উপকূলবর্তী অঞ্চলের বেশিরভাগ জায়গা থেকে সরে গেছে, উত্তর গাজার মানুষরাও ফিরে আসছেন তাঁদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাড়িঘরে। গাজার সাধারণ জনমতই হল, যখন বোমাবর্ষণ চলছিল, বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার চাপ ছিল চূড়ান্ত পর্যায়ে, তখনই যখন তাঁরা তা করেননি, এই এখন, যখন হত্যালীলাটা থেমেছে, তখন তা কেন তাঁদের করতে হবে?

অন্যরা যদিও তাঁর এই বিবৃতিকে একটা সতর্কবাণী হিসেবেই দেখছেন। তাঁদের মতে, গাজার পুনর্গঠন ইচ্ছাকৃতভাবেই থমকে দেওয়া হয়েছে, উদ্দেশ্য— শহরটাকে অ-বাসযোগ্য বানিয়ে তোলা, যাতে এখানকার অধিবাসীরা শহর ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। সরাসরি ফৌজি হস্তক্ষেপ না-হলেও গাজায় যুদ্ধ কিন্তু চলছেই— বঞ্চনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ। খাবার, ওষুধ, জল এবং জ্বালানির ওপর হাজারো নিষেধাজ্ঞা দৈনন্দিন জীবনকে বেঁচে থাকার জন্য একটা যুদ্ধে পরিণত করেছে। হসপিটালগুলি ঠিকঠাক কাজ করার জন্য যুদ্ধ করে যাচ্ছে, প্রতিটি পরিবার পরিষ্কার পানীয় জলের জন্য সারাদিন ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকছে, অন্তহীন পাওয়ার-কাট গোটা এলাকাকে সবসময়েই ডুবিয়ে রেখেছে নিঃসীম অন্ধকারে।

যদি এই পরিস্থিতি চলতে থাকে, তাহলে গাজায় থাকা একসময় একটা অসহনীয় সিদ্ধান্তে পরিণত হবে। অভিভাবকদের সামনে একটি ভয়াবহ দ্বিধা হাজির হবে— তাঁরা কি তাঁদের সন্তানদের ক্ষুধা ও রোগ-যন্ত্রণায় কষ্ট পেতে দেখবেন, নাকি নিজেদের মাতৃভূমি ছেড়ে যাবেন? মানবিক সহায়তা— যা ইতিমধ্যেই বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে— এমনভাবে ব্যবহার করা হতে পারে, যাড় ফোলে বাধ্যতামূলক স্থানান্তর জরুরি প্রয়োজনের ছদ্মবেশে উপস্থিত হবে। বোমা যে লক্ষ্য অর্জন করতে ব্যর্থ হল, ক্রমশ বাড়তে থাকা হতাশা তা পূরণ করে দিতে পারে।

যদিও মিশর এবং জর্ডন এখন পর্যন্ত প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক শান্তি সমঝোতার ধুয়ো তুলে তাদের ওপর প্যালেস্তিনীয় শরণার্থীদের গ্রহণের জন্য কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টি করা হবে যে সে নিয়ে সংশয় নেই।

 

বলপূর্বক উচ্ছেদের সুদীর্ঘ ইতিহাস

২০২৩ সালের ১১ অক্টোবর, মার্কিন কর্মকর্তা জন কিরবি গাজার বাসিন্দাদের পালানোর জন্য “সেফ প্যাসেজ” নিয়ে কথা বলছিলেন।[7] আমার বাবা আমাদের বসার ঘরে বসে রেডিওটি বিরক্তিতে বন্ধ করে দিলেন। তাঁর মুখ গম্ভীর হয়ে উঠল, এবং তিনি বিরক্তিভরে হাত নেড়ে বললেন— “আমরা যাব না।” যেন তিনি নিজেই কিরবিকে— বা সেই শক্তিগুলিকে— উত্তর দিচ্ছিলেন, যারা আমাদের জনগণকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে নির্বাসনের এই অবিরাম চক্রের মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।

আমার বাবা প্রায়ই তাঁর দাদার ১৯৪৮ সালের নির্বাসনের কথা বলতেন[8]— নিজের ভূমি হারিয়ে গেল, ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে নিজের বাবার কাছ থেকে যন্ত্রণাদায়ক বিচ্ছেদ ঘটল। যখন আমার দাদা কাজের জন্য মিশরে গিয়েছিলেন, তাঁকে আর কখনও ফিরে আসার অনুমতি দেওয়া হয়নি। এগুলো কিন্তু বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং এক দীর্ঘ ইতিহাসের অংশ— বাস্তুচ্যুতির, ছিন্নভিন্ন পরিবারগুলোর, ভঙ্গ করা প্রতিশ্রুতির ইতিহাস।

তিনি আমাকে ১৯৭০-এর দশকের কথা বলেছিলেন: যখন জাবালিয়া শরণার্থী শিবির থেকে পরিবারগুলোকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। ইজরায়েলি সেনাবাহিনি মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িগুলোর সামনে ক্রশ চিহ্ন এঁকে দিয়েছিল, এবং তাঁদের মাত্র ৪৮ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছিল বাড়ি ছাড়ার, নতুবা সেগুলো ধ্বংস করে দেওয়া হবে। কিছু বাড়ি রাস্তা প্রশস্ত করার অজুহাতে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল— উচ্ছেদের আরেকটি মোক্ষম কৌশল। তাঁদের মধ্যে একটি পরিবার ছিল দাউদের পরিবার, আমার বাবার প্রতিবেশী। তাঁদের জোর করে মিশরের আল-আরিশে পাঠানোর আগে বিদায় জানাতে তাঁরা আমাদের বাড়িতে এসেছিল, এই অনিশ্চয়তা নিয়েই যে তাঁরা আর কখনও ফিরে আসতে পারবে না।

গাজা থেকে প্যালেস্তিনীয়দের উচ্ছেদ করার এই কৌশল নতুন নয়। ১৯৫৩ সালে, মিশর এবং জাতিসঙ্ঘের প্যালেস্তিনীয় শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (UNRWA)-র মধ্যে আলোচিত একটি পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল গাজা থেকে ৬০,০০০ শরণার্থীকে সিনাইয়ে স্থানান্তর করা, যার জন্য UNRWA-র পক্ষ থেকে ৩০ মিলিয়ন ডলারের তহবিল বরাদ্দ করা হয়েছিল। ১৯৫৫ সালে, যখন ইজরায়েলি সামরিক হামলা বৃদ্ধি পায়, তখন এই পরিকল্পনায় আরও গতি সঞ্চারিত হয়— কিন্তু গণবিক্ষোভের[9] মুখে শেষ পর্যন্ত এটি বাতিল করা হয়।

১৯৫৬-৫৭ সালে, ইজরায়েলের অর্থমন্ত্রী লেভি এশকোল গাজা থেকে ২০০ প্যালেস্তিনীয় শরণার্থী পরিবারকে সরানোর ৫০০,০০০ ডলার বরাদ্দ করেছিলেন।[10] ১৯৬৯ সালের মধ্যে, ইজরায়েলি কর্মকর্তারা এমন নীতির কথা বিবেচনা করছিলেন, যার মাধ্যমে গাজা তথা ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের মানুষের জীবনযাত্রার মান আরও নিচে নামিয়ে আনা হবে, যাতে মানুষ স্থানান্তরে বাধ্য হয়।[11] ১৯৭১ সালে অ্যারিয়েল শ্যারনের সামরিক নেতৃত্বে ইজরায়েল হাজার হাজার ঘরবাড়ি ধ্বংস করে এবং ১২,০০০ বেসামরিক নাগরিককে সিনাইয়ে নির্বাসিত করে, যাঁদের মধ্যে অনেককে মিশরীয় সীমান্তের কাছে “কানাডা ক্যাম্পে” রাখা হয়, যেখানে তাঁরা বছরের পর বছর অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটান।[12] এসব নীতি ছিল প্যালেস্তিনীয় সমাজকে বিভক্ত করা, শরণার্থী জনগোষ্ঠীকে হ্রাস করা এবং তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয় মুছে ফেলার একটি বৃহত্তর কৌশলের অংশ— যা গাজায় বাস্তুচ্যুতির দীর্ঘ ইতিহাসেরই ধারাবাহিকতা।

এই ধরনের নীতিগুলোই দীর্ঘদিন ধরে প্যালেস্তিনীয়দের চেতনা-গঠনে ভূমিকা রেখেছে— একটি যৌথ উপলব্ধিকে শক্তিশালী করেছে যে বাস্তুচ্যুতি কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং এটি একটি উদ্দেশ্যমূলক পরিকল্পনা। এ-কারণেই সাম্প্রতিক গণহত্যার সময়ে গাজার উত্তরের অনেক মানুষ দক্ষিণে স্থানান্তরিত হতে অস্বীকার করেছিলেন, কারণ তাঁরা এই তথাকথিত সরিয়ে নেওয়ার আদেশগুলোকে জোরপূর্বক স্থানান্তরের একটি পরিচিত কৌশল হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। তাঁরা জানতেন যে এটি শুধু বোমাবর্ষণ থেকে বাঁচার ব্যাপার নয়— এটি অস্তিত্ব মুছে ফেলার বিরুদ্ধে প্রতিরোধের লড়াই।

অনুরূপভাবে, দক্ষিণেও অবিরাম চাপ ও হিংস্রতার মুখেও অনেকেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, কারণ তাঁরা আরেকটি জোরপূর্বক নির্বাসনের ঢেউয়ের অংশ হওয়ার ঝুঁকি নিতে চাননি। তাঁরা কখনওই মিশরের সীমান্ত পেরিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেননি। গাজায় প্রতিরোধ কখনওই শুধুমাত্র ব্যক্তিগত বিষয় নয়; এটি এমন একটি ইতিহাসের বিরুদ্ধে সম্মিলিত অবস্থান, যার বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটে।

 

গাজা কোনও “জিনিস” নয়

পশ্চিমি ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো দীর্ঘদিন ধরে গাজাকে, এবং বৃহত্তর অর্থে সমস্ত প্যালেস্তিনীয়দের, ইতিহাস, সংস্কৃতি ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকারী একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে নয়, বরং একটি জনসংখ্যা হিসেবে দেখেছে যাদের নিয়ন্ত্রণ করা, উপেক্ষা করা বা পরিচালিত করা যায়। তাদের দৃষ্টিতে, আমরা শুধুই “মানবপশু”— প্রান্তিক ও মূল্যহীন, যাদের নির্বাসিত, অনাহারে রাখা এবং মুছে ফেলা যেতে পারে কোনও পরিণতি ছাড়াই। ট্রাম্পের বক্তব্য— গাজা একটি “বস্তু” এবং তা “পরিষ্কার” করতে হবে— কোনও বিচ্ছিন্ন মন্তব্য নয়, বরং এই মানবতাবিরোধী দৃষ্টিভঙ্গিরই স্পষ্ট প্রতিফলন।

তবে ইতিহাস তাদের ভুল প্রমাণ করেছে। গাজা নীতির ছড়ি ঘোরানোর কোনও বস্তু নয় বা নিছকই একটি সঙ্কটপূর্ণ এলাকা নয়। এটি রক্ত-মাংসে গঠিত একটি জীবন্ত ভূখণ্ড, একটি প্রতিরোধের ভূমি, যা তাকে মুছে ফেলার প্রতিটি হীন প্রচেষ্টাকে অস্বীকার করেছে। যাঁরা শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত, তাঁরা সবচেয়ে সূক্ষ্ম ঔপনিবেশিক কৌশলগুলোকেও ভেঙে চুরমার করে দিয়েছেন। যাঁদের ক্ষমতাহীন বলে মনে করা হয়, তাঁরা বারবার দখলদারের সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রগুলো ব্যর্থ করে দিয়েছে।

আমরা যা সহ্য করেছি, তা কেবল আরেকটি যুদ্ধ বা মানবিক বিপর্যয় নয়; এটি আমাদের ভেঙে ফেলা ও মুছে দেওয়ার একটি পরিকল্পিত প্রচেষ্টা। তবে সবকিছুর পরও, তারা ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের ক্ষতি অপরিমেয়— আমরা হারিয়েছি মহান মানুষদের, সম্পূর্ণ পরিবার, ঘরবাড়ি, রাস্তা, আর আমাদের শহরের দেওয়ালে খোদাই করা ইতিহাস। স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু যখন ২৭ জানুয়ারি ২০২৫-এ আমরা দেখলাম মানুষ তাদের ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরে ফিরে যাচ্ছে, ধ্বংসস্তূপের ওপর পা রেখে, ধ্বংসাবশেষ হাতড়ে স্মৃতিচিহ্ন খুঁজছে, তখন প্রমাণ হল যে আমাদের এই ভূমির সঙ্গে সম্পর্ক অটুট, অবিচ্ছেদ্য।

গাজা যেমন আগেও জোরপূর্বক স্থানান্তরের পরিকল্পনাগুলো ব্যর্থ করেছে, তেমনি বর্তমান প্রচেষ্টাকেও ব্যর্থ করবে। ১৯৪৮ সালে বিতাড়িত প্যালেস্তিনীয় শরণার্থীদের জন্য যে স্থান আশ্রয় হয়ে উঠেছিল, তা চিরকাল ইজরায়েলের জন্য এক অভিশাপ হয়ে থাকবে। আর যেমন গাজার প্যালেস্তিনীয়রা তাঁদের উত্তরের ধ্বংসাবশেষে ফিরে গেছেন, একদিন তাঁরা তাঁদের প্রকৃত জন্মভূমিতেও ফিরে যাবেন।

এই মহান প্রত্যাবর্তন মিছিল এক গভীর সত্যকে প্রকাশ করে, যা এখন সবচেয়ে শক্তিশালী সেনাবাহিনিকেও স্বীকার করতে হবে। অত্যাধুনিক অস্ত্র, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নিয়ন্ত্রিত যুদ্ধ[13], ক্ষেপণাস্ত্র এবং দমন করার জন্য তৈরি অস্ত্রাগারের বিপরীতে তথাকথিত দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষগুলো তাদের অবস্থান অটুট রেখেছে।

গাজা আর কখনও আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না— এটি একটি বাস্তবতা যা আমরা অস্বীকার করতে পারি না। হয়তো সামনে আরও কঠিন সময় অপেক্ষা করছে, হয়তো আরেকটি যুদ্ধ ইতিমধ্যেই গঠিত হচ্ছে। কিন্তু একটি সত্য অনড়-অটল: আমাদের এই ভূমির সঙ্গে সম্পর্ক যে শক্তিগুলি ছিন্ন করতে চায়, তাদের চেয়ে এই সম্পর্ক ঢের বেশি শক্তিশালী। ইজরায়েল আমাদের বুঝতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রও পারে না। কারণ একটি ভূমির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার আর তা দখল করে রাখার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। তারা মনে করে নিয়ন্ত্রণ আসে দমন থেকে। কিন্তু আমরা জানি, প্রকৃত সম্পৃক্ততা কখনও ভাঙা যায় না।


[1] Klein, Betsy and Harvey, Lex. Trump suggests his plan for Gaza Strip is to ‘clean out the whole thing’. CNN. Jan 26, 2025.
[2] Miller, Zeke and Weissert, Will. Trump wants Jordan and Egypt to accept more Palestinian refugees and floats plan to ‘clean out’ Gaza. AP. Jan 26, 2025.
[3] Krauss, Joseph. Trump wants Jordan and Egypt to take in Palestinians from Gaza. Here’s why the idea is rejected. Feb 12, 2025.
[4] Arab nations reject Trump’s suggestion to relocate Palestinians to Egypt, Jordan. CBS News. Feb 1, 2025.
[5] Brown, Michael F. Trump mixes Gaza ceasefire with West Bank mayhem. The Electronic Intifada. Jan 25, 2025.
[6] Wintour, Patrick. Jared Kushner says Gaza’s ‘waterfront property could be very valuable’. The Guardian. Mar 19, 2024.
[7] White house in active discussions with Israel over safe passage of civilians from Gaza. Reuters screenocean. Record ID: 1745598. Oct 11, 2023.
[8] Hijazi, Malak. Palestinian intergenerational trauma and Israeli bombs strike Jabaliya. The Electronic Intifada. Nov 24, 2024.
[9] Adler, Jonathan. How plans to move Palestinians to Egypt backfired. New Lines Magazine. May 12, 2023.
[10] Israel’s policy toward refugees in the Gaza Strip. Palquest.org.
[11] Aderet, Ofer. ‘We give them 48 hours to leave’: Israel’s plans to transfer Gazans go back 60 years. Haaretz. Dec 5, 2024.
[12] Tyler, Patrick E. Peace put 7,000 Palestinians of border camp in no-man’s land. Washington Post. Jan 1, 1987.
[13] Abraham, Yuval. ‘A mass assassination factory’: Inside Israel’s calculated bombing of Gaza. +972. Nov 30, 2023.

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4994 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...