
মধুশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়
এই সমাজ পিতৃতন্ত্রের ধারক। তাই যে নারী চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক বিধান মানে না, উপদেশ শোনে না সে হয় অবিদ্যা, পতিতা। সমাজ থেকে পতিত। পতিত হওয়ার ভয়ে যুগে যুগে, দেশে দেশে অধিকাংশ নারী নিরুপায়ে নিরুচ্চারে অনুশাসন মেনে চলে সতী নারী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। হতে পারে তা মহাভারতের যুগে ভারতবর্ষে। অথবা মধ্যযুগের ইউরোপে, অষ্টাদশ শতকের বাংলায় অথবা আজকের আফগানিস্তানে
স্ত্রী ও পুরুষ— একই প্রজাতির দুই ভিন্ন লিঙ্গ। জীবের মধ্যে লিঙ্গভেদ এসেছে সেই ২০০ কোটি বছর আগে যখন বহুকোষী জীবের মধ্যে লিঙ্গভেদের উদ্ভব হল। বিবর্তনের মাধ্যমে পুরুষ ও স্ত্রী লিঙ্গভেদের ফলে অতি আশ্চর্য এক প্রক্রিয়া, যৌন জনন, এসেছে। আমি মরে যাব, আমি নশ্বর। তবে আমার সন্ততিতে থেকে যাবে আমার ও অংশীদারের পূর্বতন পুরুষের জিনগত উপাদান। যৌন জনন ভালভাবে জিনের অদলবদল করতে পারল। এর ফলে জিনগত পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে গেল। উপকারী পরিব্যক্তি স্বাভাবিক নিয়মেই দ্রুত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে অভিযোজন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। অযৌন জননকারী প্রজাতির থেকে যৌন জননকারী প্রজাতি প্রকৃতির সঙ্গে যুঝতে অনেক বেশি পারঙ্গম।
এই হল প্রাণীকুলে স্ত্রী ও পুরুষ লিঙ্গভেদের বৈজ্ঞানিক কারণ।
সময় প্রবাহমান। বিবর্তনের মাধ্যমে এসেছে স্তন্যপায়ী প্রাণী, এসেছে মানুষ। সঙ্গে এসেছে মানুষের নিজস্ব গোষ্ঠী, নিজের সমাজ। সমাজবদ্ধ মানুষের সঙ্গে প্রতিবেশ এবং সমাজে মানুষের নিজেদের মধ্যেকার মিথস্ক্রিয়া, এ-দুয়ের হাত ধরে মানুষ তথ্য ও জ্ঞান আদানপ্রদান করে; এর থেকে তাদের ভিতরে শিল্পবোধ ও আদিম ধর্মীয় বোধের উন্মেষ ঘটে। এক কথায়— জন্ম নেয় সংস্কৃতি। সংস্কৃতি আমাদের প্রজাতির সম্মিলিত জ্ঞানকে প্রভাবিত করে। একটি মানবশিশু (স্ত্রী বা পুরুষ) ধু ধু মরুভূমিতে জন্ম নিলে এবং কোনওভাবে একা একা টিকে থাকতে পারলে, তার যত বড় মস্তিষ্ক থাকুক বা জিনে যতই নবতম কার্যকর মিউটেশন থাকুক, সে উন্নত চিন্তা করতে পারবে না। তার জন্য প্রয়োজন সমাজের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার।
পুরুষ ও নারীর মধ্যে বিবর্তনের শারীরিক ভিন্নতা আছে তাকে অস্বীকার করা যায় না। অস্বীকার করার প্রয়োজনও নেই। একই বয়সের পুরুষ সমবয়সি নারীদের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ বেশি লম্বা। পুরুষদের পেশি বেশি এবং হাড় তুলনায় ভারি। মাংসপেশির জন্য পুরুষ নারীদের তুলনায় বেশি শক্তিশালী। নারীর শরীরে চর্বি বেশি।
আরও কিছু পার্থক্য আছে— জিনগত তফাৎ। স্কুলের বাচ্চারাও আজ জানে জীবদেহ কোষ দিয়ে গঠিত, আর কোষের মধ্যে থাকে ক্রোমোজোম। আমাদের শরীরে প্রতিটি কোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজোম আছে। এর মধ্যে ২২ জোড়াতে পুরুষ ও নারীর ক্রোমোজোমে কোনও পার্থক্য নেই। ২৩-তম জোড়ার ক্রোমোজোম দুটি পুরুষ ও নারীর ক্ষেত্রে ভিন্ন। নারীর ক্ষেত্রে এই জোড়ে ক্রোমোজোম দুটি একইরকম— ‘এক্স-ক্রোমোজোম’। আর পুরুষের ক্ষেত্রে ক্রোমোজোম দুটি আলাদা— ‘এক্স-ক্রোমোজোম’ ও ‘ওয়াই ক্রোমোজোম’। নিষেকের সময়ে নারী সবসময়ে ‘এক্স-ক্রোমোজোম’ দেয়, পুরুষ দিতে পারে ‘এক্স-ক্রোমোজোম’ বা ‘ওয়াই ক্রোমোজোম’।
পুরুষের শুক্রাণু থেকে কোন ক্রোমোজোম আসবে তার উপরে নির্ধারিত হয় ভ্রূণের লিঙ্গ। তবু সেই মধ্যযুগ থেকে নারীকে অভিযুক্ত করা হল, প্রহার করা হল, এমনকী সন্তান-সহ পুড়িয়ে মারার চল উঠল স্ত্রী-সন্তান প্রসবের অপরাধে। বিনা অপরাধের সেই প্রহার এখনও চলছে।
অথচ এক সময়ে নারীকে সম্ভবত দেবতা (মাদার গডেস) হিসেবে অর্চনা করার চল ছিল। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে নারীর উর্বরতাশক্তি পুরুষদের বিস্ময় উদ্রেক করেছে। প্রাগৈতিহাসিক মানুষ সন্তানের জন্মের অন্তর্নিহিত প্রক্রিয়া বুঝতে পারত না। যৌনমিলনের পরে দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হওয়ার ফলে সন্তানের জন্ম হয়, তাই যৌনমিলনের সঙ্গে সন্তানধারণকে যুক্ত করা প্রাথমিকভাবে সম্ভব হয়নি। পুরুষ সন্তানের জন্ম দিতে পারে না, স্তনদান করতেও পারে না। নারীর সন্তানধারণ ও পালন ছিল সেই সব প্রাগৈতিহাসিক মানুষের কাছে এক বিস্ময়।
আবার প্রাণীজগতে, এমনকী স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যেও, ঋতুস্রাব বিরল। কোনও আঘাত ছাড়া প্রতি মাসে নারীদের নিয়মিত রক্তমোক্ষণ তাদের কাছে ছিল ভীতিপ্রদ। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে রহস্যময় নারী-রক্ত ও নারীর উর্বরতাশক্তি পুরুষদের বিস্ময় উদ্রেক করেছে। এইসব কারণে গর্ভবতী নারী তাদের ভয়ার্ত করত। আসন্নপ্রসবা নারীর মূর্তি তৈরি করে সম্ভবত তারা নারীর এই ক্ষমতাকে পুজো করত।
দুই.
মানুষের উদ্ভব আফ্রিকাতে, অবশ্য আফ্রিকার বাইরে মানুষের সফল পরিযান হয়েছিল ৭০-৭২ হাজার বছর আগে। এই সময় আফ্রিকা থেকে যারা বেরিয়ে এসেছিল, আফ্রিকার বাইরে আজকের সব আধুনিক মানুষ তাদেরই বংশধর।
তখন উৎপাদনব্যবস্থায় নারীর অংশ ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেই সময়ে মানুষের পেশা ছিল শিকার ও সংগ্রহ করা। তারা হাঁটত আর কুড়িয়ে নিত কন্দ, গাছের ফল, পাখির ডিম। দলবদ্ধভাবে শিকার করত পশু। খেত মাছ, মাংস৷ এই সমাজে নারী ছিল মূল সংগ্রাহক, শিকারেও তার ভূমিকা ছিল। চিকিৎসা ছিল অভিজ্ঞতানির্ভর লতাপাতার ব্যবহার অথবা ম্যাজিক-নির্ভর তুকতাক। সেই সমাজে নিরাময়কারী হিসেবে নারীর ভূমিকা ছিল। ৩০ হাজার বছরেরও বেশি আগে পাওয়া প্রাচীনতম প্রত্নবস্তু ইঙ্গিত দেয়, তখন দলের আধ্যাত্মিক প্রধান একজন নারীও হতে পারত।
তিন.
আফ্রিকা থেকে আসা দলবদ্ধ মানুষ ভারতে প্রবেশ করে আজ থেকে প্রায় ৬৫ হাজার বছর আগে। আজকের আন্দামান দ্বীপপুঞ্জের আদি অধিবাসী ওঙ্গে, জারোয়ারা ওই প্রাচীন জনগোষ্ঠীর নিকটতম প্রতিনিধি। সেই দ্বীপপুঞ্জে আজও জারোয়া পুরুষরা ধনুক ও তির দিয়ে শিকার করে আর নারীরা ঝুড়ি দিয়ে মাছ ধরে।
মাত্র ১২-১০ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে কৃষিকাজ শুরু হয়েছে। কৃষি শিখে নেওয়ার পরে সামান্য জমি থেকে মানুষ সারা বছরের খাদ্য জোগাড় করতে শিখল। মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, জীবনধারা আমূল পাল্টে গেল। কৃষিকাজের জন্য বাসস্থানও বদলাল। কৃষিজমির পাশে তৈরি হল স্থায়ী বসতি; এল গ্রাম। কৃষির সঙ্গে সঙ্গে জনসংখ্যা ও জনবিন্যাস পাল্টে গিয়ে ঘন জনবসতি তৈরি হল। কৃষিতে হালচাষের প্রচলনের পরে পুরুষরা পশু-টানা লাঙলে চাষ, জমিতে জলসেচ করার কাজে যুক্ত হল। একই স্থানে ক্রমাগত জনসমাগমে একদিন তৈরি হল ক্ষুদ্র নগর। সঙ্গে এল যুদ্ধ, রাজনীতি, পুরোহিততন্ত্র।
নারীর ভূমিকা রয়ে গেল নিবিড় কাজের জন্য— শস্য রোপণ ও পেষা, ফসলের আগাছা তোলা। অবশ্য সন্তানপালন ও গৃহকাজের দায়িত্ব থাকে নারীর উপরে। সমাজ সেই কাজের মূল্য দিল না। উৎপাদনব্যবস্থায় নারীর ভূমিকা হল গৌণ।
চার.
ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা— হরপ্পীয় সভ্যতা। অন্তত ৯ হাজার বছর আগে থেকে ওই অঞ্চলে কৃষিকাজ ও পশুপালন শুরু হয়ে গেছে। শেষে যখন উদ্বৃত্ত উৎপাদন সম্ভব হয় তখন তৈরি হয় নগর ও সড়ক, শুরু হয় সমুদ্র-বাণিজ্য।
হরপ্পীয় সমাজে নারীর স্থান কেমন ছিল?
যে নারীমূর্তিগুলি হরপ্পীয় সভ্যতায় পাওয়া গেছে, তার অনেকগুলোতেই নারীর লিঙ্গবৈশিষ্ট্যকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অপরিস্ফুট স্তন, স্তনগুলিতে স্তনবৃন্তের অভাব, বিরল যৌনাঙ্গ নারীকে জায়া ও জননীর ঊর্ধ্বে কোনও এক নিজস্ব অবস্থান দিয়েছে। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করি, ব্রোঞ্জের ‘নৃত্যরতা নারী’র মূর্তিটি। মূর্তিটি নগ্ন, কিন্তু তাতে কামোদ্দীপনা জাগে না, আছে এক কিশোরীর সারল্য। কিছু ছিল মাতৃমূর্তি, তাদের ছিল অতিরিক্ত বড় স্তন। তাদের সম্ভবত পুজো করা হত।
সম্ভবত নারী সংসার করে সুতো কেটে বস্ত্র বয়ন করত, বাজারে বিকিকিনিতে অংশ নিত। সে ছিল এক ক্রান্তিকালীন সময়।
পাঁচ.
হরপ্পীয় সভ্যতার অন্তিম লগ্নে স্তেপভূমি থেকে ভারতে প্রবেশ করে ইন্দো-ইউরোপীয় আর্যরা। ইন্দো-ইউরোপীয়রা আসার আগে ভারতের জনগোষ্ঠীর কাঠামো ছিল আজকের থেকে অনেকটা আলাদা। আজ থেকে ৪,০০০ বছর আগে হিন্দুকুশ পর্বত পেরিয়ে বৈদিক সংস্কৃতভাষী ইন্দো-ইউরোপীয়রা ভারতবর্ষে এসেছে। সেই দলগুলো ছিল পুরুষপ্রধান, দলগুলোতে নারীর সংখ্যা ছিল তুলনায় কম। ইন্দো-ইউরোপীয়রা ছিল শ্বেতবর্ণের অধিকারী। শ্বেতকায় আর্যভাষীদের বর্ণের অহঙ্কার ঋগ্বেদেও বহুবার উল্লিখিত হয়েছে। তারা প্রাগার্যদের প্রতি বারে বারে তাচ্ছিল্যসূচক শব্দ ব্যবহার করেছে— যেমন, অনাস, রাক্ষস, দাস, দস্যু ইত্যাদি। আবার নারীর অভাবে মিশ্রিতও হতে হয়েছে প্রাগার্য দেশজ শ্যামবর্ণ মানুষের সঙ্গে। মহাভারতের শ্রেষ্ঠ সুন্দরী কৃষ্ণা দ্রৌপদী ছিলেন চিরযৌবনা উর্বশী। বোঝা যায় একটা সময় পর্যন্ত জন্মভিত্তিক বর্ণব্যবস্থা দৃঢ়ভাবে গড়ে ওঠেনি। তখন নিশ্চিতভাবেই বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহ হত। সম্ভবত বর্ণবিভাগ ছিল পেশার বিভাগ।
ইন্দো-ইউরোপীয়রা ভারতে হাজার বছর ধরে থাকতে থাকতে এখানকার প্রধানতম শক্তিশালী জনগোষ্ঠী হয়ে উঠল। সেইসময়ে আর্য ও প্রাগার্য নরনারীর মিশ্রণের গতিতে এল পরিবর্তন। শুরু হল সামাজিক স্তরভেদ— আজ থেকে প্রায় ২,০০০ বছর আগে আর্য ও প্রাগার্য নরনারীর এই মিশ্রণ বন্ধ হয়ে গেল। বর্ণভেদ প্রথা এই পরিবর্তন আনল। আসলে তখন তাদের নিজেদের সম্প্রদায়ের বাইরে নারীর প্রয়োজন আর ছিল না।
ইন্দো ইউরোপীয় বর্ণব্যবস্থা ও পুরোহিততন্ত্র আসলে পুরুষতন্ত্রের প্রতীক হয়ে গেল।
রাবণরাজের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জিতে রাম বললেন—
যুদ্ধে শত্রুকে জয় করেছি, তোমাকেও মুক্ত করেছি, ভদ্রে। তোমার কুশল হোক, জেনে রাখো, এই যে যুদ্ধের পরিশ্রম, বন্ধুদের বীরত্বের সাহায্যে যা থেকে উত্তীর্ণ হয়েছি, তা তোমার জন্যে নয়। আমার চরিত্রমর্যাদা রক্ষা করার জন্যে এবং প্রখ্যাত আত্মবংশের কলঙ্কমোচন করার জন্যেই তা করেছি। তোমার চরিত্র সন্দেহজনক হয়ে উঠেছে। আমার সামনে তুমি আছ, চক্ষুপীড়াগ্রস্তের সামনে প্রদীপ যেমন পীড়াদায়ক হয় তেমনই। তাই জনকাত্মজা, এই দশদিক পড়ে আছে, যেখানে ইচ্ছে তুমি চলে যাও আমি অনুমতি দিলাম তোমাকে— তোমাকে আর আমার কোনও প্রয়োজন নেই।
পুরুষের দোষে নারীর শাস্তি সামাজিকভাবে গৃহীত হল। নারী উৎপাদনব্যবস্থায় স্থান হারাল। ধর্ম যত কেন্দ্রীভূত হল, ধর্মশক্তি যত রাষ্ট্রশক্তির বখরা পেল, নারীর স্বাধীনতা তত কমে গেল।
২ হাজার বছর আগে মনুস্মৃতির সময় থেকে নিজের বর্ণের মধ্যে বিবাহ বাধ্যতামূলক হয়। মনুস্মৃতি নারীদের ঘরে থেকে গৃহস্থালির কাজ করে জীবন অতিবাহিত করবার পরামর্শ দেয়— আদর্শ স্ত্রী হলেন যিনি তাঁর স্বামীকে সন্তুষ্ট করেন এবং পরিবারের সমস্ত দায়িত্ব পালন করে বাধ্য জীবনযাপন করেন। গুপ্ত যুগে নারীদের অবস্থা আরও খারাপ হয়— সমাজে নারীদের স্থান গৌণ। নারীর কাছ থেকে প্রত্যাশিত, সে বিয়ের আগে তার বাবার অনুগত থাকবে, বিয়ের পর তার স্বামীর আনুগত্য এবং শেষে পুত্রের আনুগত্য করবে।
ছয়.
মধ্যযুগে নারীর অধিকার কতটা ছিল? নারীর মর্যাদা তাদের সামাজিক শ্রেণি এবং ধর্মীয় পটভূমি দ্বারা নির্ধারিত হত— নিম্নবিত্ত নারীর তুলনায় উচ্চবিত্ত নারীর অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা বেশি ছিল।
তখন দেশে ইসলাম প্রবেশ করেছে। মুসলিম নারীদের জন্য ছিল জেনানা মহল, বোরখা, হারেম। পরদাপ্রথা উত্তর ভারতের হিন্দুরাও অনুকরণ করে। হিন্দুদের মধ্যে দৃঢ় হল বাল্যবিবাহ, সতীপ্রথা। রাজপুত এবং অন্যান্য উচ্চবর্ণের মধ্যে কন্যাশিশু হত্যা প্রচলিত ছিল। কয়েকজন নারী প্রশাসন এবং যুদ্ধে যুক্ত হতে পেরেছেন। তবে সাধারণভাবে নারীশিক্ষা ও তার অধিকার ছিল অবহেলিত।
সাত.
তারপরে দিন কেটেছে, যুগের পরিবর্তন হয়েছে। আজ থেকে দেড়শো বছর আগে থেকে নারী তার প্রাপ্য অধিকার দাবি করল।
সে চায়—
- শারীরিক ন্যায়বিচারের অধিকার— সহিংসতা থেকে রক্ষা পাওয়া, নিজের পছন্দ অনুযায়ী চলা। হায়, এ-দেশে, পাশের দেশে, এ-রাজ্যে সহিংসতা থেকে এখনও নারী রক্ষা পায়নি।
- সামাজিক অধিকার— স্কুলে যাওয়া এবং জনজীবনে অংশগ্রহণ; আফগানিস্তানে বিদ্যালয়ে যাওয়ার অধিকারও নারীর নেই।
- অর্থনৈতিক অধিকার— সম্পত্তির মালিক হওয়া, নিজের পছন্দের কাজ করা এবং সমান অর্থ পাওয়া; সেই অধিকার এখনও সব নারীর নেই।
- রাজনৈতিক অধিকার— ভোট দেওয়া এবং নির্বাচিত পদে থাকা।
পথ চলা বাকি আছে।
একটা কথা প্রচলিত— নারী নিজের ইচ্ছেতেই ধর্ম তথা সমাজের কঠিন অনুশাসন মেনে চলে। এই কথা শুধু পুরুষ নয়, অনেক নারীও বিশ্বাস করেন। তবে যদি কোনও নারী সেই ধর্মীয় তথা সামাজিক অনুশাসন মানতে না চায়, তখন নেমে আসে সামাজিক দণ্ড।
এই সমাজ পিতৃতন্ত্রের ধারক। তাই যে নারী চাপিয়ে দেওয়া সামাজিক বিধান মানে না, উপদেশ শোনে না সে হয় অবিদ্যা, পতিতা। সমাজ থেকে পতিত। পতিত হওয়ার ভয়ে যুগে যুগে, দেশে দেশে অধিকাংশ নারী নিরুপায়ে নিরুচ্চারে অনুশাসন মেনে চলে সতী নারী হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। হতে পারে তা মহাভারতের যুগে ভারতবর্ষে। অথবা মধ্যযুগের ইউরোপে, অষ্টাদশ শতকের বাংলায় অথবা আজকের আফগানিস্তানে।
একসময়ে এই দেশে নারীরা সতী হয়েছেন, বিধবা হওয়ার পরে নিজের প্রিয় পূর্বজীবনের অভ্যাস ছেড়ে দিয়েছেন। তবে আজ আর নারী তা করার প্রয়োজন বোধ করেন না। পরাধীনতার ইচ্ছে আর তার আসে না। অধিকাংশ ইচ্ছে কোনও স্বাধীন অভিব্যক্তি নয়। সমাজ নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় মানুষের উপরে, আর নারী তাকে নিজের ইচ্ছে বলে ধরে নেয়। স্বাধীন হওয়ার জন্য, নারীর প্রয়োজন আর্থিক স্থিতিশীলতা অর্জন করা— অর্থাৎ উৎপাদনব্যবস্থায় অংশ নেওয়া।
আমাদের চিন্তা করা দরকার কীভাবে নিজের স্বাধীনতাকে রক্ষা করে সমাজকেও কিছু দিতে পারি। পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে আমাদের পছন্দ ও অপছন্দ বলতে পারি, সিদ্ধান্ত নিতে পারি। গণতান্ত্রিক সমাজের উন্নয়নের জন্য রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ অপরিহার্য। যখন নারী রাজনৈতিক নেতৃত্বে প্রতিনিধিত্ব করে, তখন তারা বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিজ্ঞতাকে টেবিলে নিয়ে আসে, যার ফলে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও সচেতন হয়। নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয় এবং জনসংখ্যার চাহিদা পূরণ করে এমন নীতির দিকে পরিচালিত করে। নারী নিজের ও সমাজের অধিকার বিষয়ে সজাগ হয়।
শেষে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়। শিক্ষিত, স্বাধীনচেতা ও আলোকপ্রাপ্ত নারী কীভাবে প্রতিরোধ করবে পৃথিবীর দেশে দেশে উন্মত্ত ধর্মীয় ও সামাজিক মৌলবাদকে? সামগ্রিকভাবে সামাজিক চিন্তার জগতে শেষ পঞ্চাশ বছরে আমরা কি পিছিয়ে পড়ছি? এই প্রশ্ন আছে। বিশ্লেষণ করতে হবে।
মার্কিন কথাকার, কবি এবং নাগরিক অধিকার কর্মী মায়া অ্যাঞ্জেলো বলেন—
যখনই একজন নারী নিজের পক্ষে দাঁড়ান, তা না জেনে, দাবি না করেই, তিনি সকল নারীর পক্ষে দাঁড়ান।
তাই, মানসিকভাবে সঙ্গে থাকি প্রতিটি প্রান্তের উঠে দাঁড়ানো নারীর পাশে।