যুদ্ধ, ক্ষমতা এবং আধিপত্য: ইউক্রেনে মার্কিন কৌশল

দিভেশ রঞ্জন, অমিত কুমার পুনিয়া, সন্দীপ পান্ড্যে

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতটাই আধিপত্যবাদী যে এতদিন ধরে ইউক্রেনের পক্ষে থাকা ইউরোপীয় দেশগুলোকে পাশ কাটিয়ে তারা সৌদি আরবে ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি-আলোচনা করেছে। সেখানে আবার রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলেই রাখা হয়নি! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এত কৌশলীভাবে তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে যে একদিন আগেও তারা ইউক্রেনকে সমর্থন করছিল, অথচ আজ তারাই রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনা করছে এবং জাতিসঙ্ঘে রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষেই, মার্কিন সুবিধাবাদ খুবই অনিশ্চিত

 

ওয়াশিংটন পোস্ট জানাচ্ছে, রাশিয়া-ইউক্রেন সঙ্ঘাতের ফলে প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার খরচা হয়েছে, ১,৫০,০০০-এরও বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং ১ কোটিরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। যদিও যুদ্ধর প্রকাশ্য কারণ হিসেবে যা বলা হয়েছে তা হলে— ইউক্রেন ন্যাটো-সদস্য থাকবে, না থাকবে না। কিন্তু গভীর বিশ্লেষণ থেকে বেশ বোঝা যায় যে এই যুদ্ধ বৈশ্বিক আধিপত্য রক্ষা এবং কোথাও কোথাও খনিজ সম্পদের ওপর দখলদারি কায়েম রাখার একটি কৌশলগত লড়াই, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়ার মধ্যে। এবং তার সঙ্গে এই যুদ্ধ মার্কিন একক আধিপত্যের বিরুদ্ধে চিনের নীরব উত্থান প্রতিহত করারও একটি প্রচেষ্টা, যা এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলোর একত্রিত হওয়া প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যেও পরিচালিত হচ্ছে।

 

যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অতীতের বিভিন্ন যুদ্ধে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন যুদ্ধে, আফ্রিকার বিভিন্ন যুদ্ধে, এমনকি উভয় বিশ্বযুদ্ধেও সে তার সময়োচিত হস্তক্ষেপের মাধ্যমে কৌশলগত স্বার্থ রক্ষা করেছে। হেনরি কিসিঞ্জারের সেই বক্তব্যটি স্মরণীয়— “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনও স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু নেই, কেবল স্থায়ী স্বার্থ রয়েছে।” যুদ্ধের ঘটনাগুলি এই বক্তন্যের সঙ্গে অত্যন্ত সামঞ্জস্যপূর্ণ। একটি অভিবাসন ও ব্যবসাকেন্দ্রিক রাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকা সমস্ত বৈশ্বিক সঙ্ঘাতকে অর্থনৈতিক এবং ভূরাজনৈতিক সুযোগ হিসেবে দেখে।

 

দ্বি-পর্যায়ের মার্কিন কৌশল

ইউক্রেনে মার্কিন কৌশল দুটি সুস্পষ্ট পর্যায়ে বোঝা যায়:

পর্যায় ১: মার্কিন আধিপত্য সংহত করা এবং রাশিয়াকে দুর্বল করা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উত্থান প্রতিহত করতে কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে, কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করেছে এবং ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিয়েছে। এই যুদ্ধ রাশিয়ার সম্পদ নিঃশেষ করছে এবং তাদের বৈশ্বিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার গতি কমিয়ে দিয়েছে।

পর্যায় ২: রাশিয়ার সঙ্গে যৌথ-সম্পৃক্ততা নীতির মাধ্যমে রাশিয়া-চিন জোট প্রতিরোধ করা এবং ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের ওপর দখল কায়েম করা। ইউক্রেন বিপুল পরিমাণ গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের আধার, যা ভবিষ্যতের প্রযুক্তি ও প্রতিরক্ষাশিল্পের জন্য অপরিহার্য। এই সম্পদ দখলের মাধ্যমে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিনের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে চায়। মনে রাখতে হবে, চিন বর্তমানে বিশ্বের ৬০ শতাংশ গুরুত্বপূর্ণ খনিজ উৎপাদন এবং ৮৫ শতাংশ প্রক্রিয়াকরণ নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিদানস্বরূপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে ন্যূনতম নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেবে, যাতে তাদের নিজেদের বিনিয়োগের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়, কিন্তু পূর্ণাঙ্গ সামরিক প্রতিশ্রুতি এড়িয়ে যাবে, যাতে রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি সঙ্ঘাত থেকে দূরে থাকা যায়।

 

শান্তি প্রতিষ্ঠার সুযোগ নষ্ট এবং মার্কিন হস্তক্ষেপ

আমেরিকান অর্থনীতিবিদ জেফ্রি স্যাকস ইউরোপীয় সংসদে এক বক্তৃতায় দাবি করেছিলেন যে তিনি তৎকালীন মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জেক সুলিভানের সঙ্গে ইউক্রেনের সম্ভাব্য ন্যাটো সদস্যপদ নিয়ে আলোচনা করেন এবং যুদ্ধ এড়ানোর একটি কৌশল খুঁজতে চান। সুলিভান ন্যাটো সম্প্রসারণের সম্ভাবনা নাকচ করলেও তা প্রকাশ্যে স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানান। আরও জানা যায় যে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যেই ইউক্রেন নিরপেক্ষ থাকার বিষয়ে আলোচনায় আগ্রহী ছিল। জেফ্রি স্যাকস আঙ্কারায় শান্তি আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন, যেখানে তিনি ইউক্রেনীয় কর্মকর্তাদের জীবন, অঞ্চল ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য একটি শান্তি চুক্তি মেনে নিতে বলেন। প্রতিবেদন অনুসারে, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছিলেন, তবে মার্কিন চাপে পিছিয়ে আসেন।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি

এই যুদ্ধের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একাধিক কৌশলগত লক্ষ্য অর্জন করেছে। প্রথমত, ইউক্রেনের সম্ভাব্য ন্যাটো সদস্যপদ নিয়ে উদ্ভূত সঙ্কট দূর করেছে। দ্বিতীয়ত, রাশিয়ার অর্থনীতিকে দুর্বল করেছে এবং তার জ্বালানি-অর্থনীতিকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় এনেছে। তৃতীয়ত, ভবিষ্যতের শান্তি আলোচনায় নিজেদের গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। চতুর্থত, রাশিয়াকে যুদ্ধের মধ্যে ব্যস্ত রেখে এবং অর্থনৈতিক চাপে রেখে রাশিয়া-চিন সম্পর্ক গভীর হওয়া প্রতিরোধ করেছে। পঞ্চমত, ইউক্রেনের খনিজ সম্পদ দখল করে রাশিয়ার প্রান্তসীমায় নিজেদের উপস্থিতি আরও বাড়িয়েছে।

সম্প্রতি, ‘ওভাল বিতর্ক’-এর পর, প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি ট্রাম্পকে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন, যা ইঙ্গিত দেয় যে তিনি ট্রাম্পের নেতৃত্বে শান্তি আলোচনা করতে ইচ্ছুক। জেফ্রি স্যাকসের তত্ত্বই এতে অনেকাংশে প্রমাণিত হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প এক্স (পূর্বে টুইটার)-এ পোস্ট করেন যে তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে বড় পরিসরে ব্যাঙ্ক নিষেধাজ্ঞা, শুল্ক এবং অন্যান্য চাপ প্রয়োগের পরিকল্পনা করছেন যতক্ষণ না একটি চূড়ান্ত শান্তি চুক্তি সম্পন্ন হয়। এটি ট্রাম্পের “আমেরিকা ফার্স্ট” এবং এম-এ-জি-এ নীতির প্রতিফলন, যা দীর্ঘমেয়াদি বিদেশি সঙ্ঘাতের চেয়ে মার্কিন অর্থনৈতিক স্বার্থকেই অগ্রাধিকার দেয়।

 

মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এতটাই আধিপত্যবাদী যে এতদিন ধরে ইউক্রেনের পক্ষে থাকা ইউরোপীয় দেশগুলোকে পাশ কাটিয়ে তারা সৌদি আরবে ইউক্রেনের সঙ্গে শান্তি-আলোচনা করেছে। সেখানে আবার রাশিয়াকে আলোচনার টেবিলেই রাখা হয়নি! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এত কৌশলীভাবে তার অবস্থান পরিবর্তন করেছে যে একদিন আগেও তারা ইউক্রেনকে সমর্থন করছিল, অথচ আজ তারাই রাশিয়ার হয়ে ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনা করছে এবং জাতিসঙ্ঘে রাশিয়ার পক্ষে অবস্থান নিচ্ছে। প্রকৃতপক্ষেই, মার্কিন সুবিধাবাদ খুবই অনিশ্চিত।

মার্কিন কৌশল কিসিঞ্জারের “জাতীয় স্বার্থ” তত্ত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে প্রতিটি রাষ্ট্র কেবলমাত্র নিজেদের স্বার্থে কাজ করে। কিসিঞ্জার আরও বলেছিলেন, “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু হওয়া বিপজ্জনক, তবে তাদের বন্ধু হওয়া আরও ভয়ানক।” জন মিয়ারশ্যাইমারের The Tragedy of Great Power Politics (২০০১) বইতে তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে রাষ্ট্রগুলো ক্ষমতা বৃদ্ধি করে আধিপত্য বজায় রাখার চেষ্টা করে। ফারিদ জাকারিয়ার মতো পণ্ডিতরা পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে দেশীয় রাজনীতি এবং নেতৃত্বের ব্যক্তিত্বের ভূমিকার ওপর (যেমন, ট্রাম্প বনাম বাইডেন) জোর দিলেও, ইউক্রেনে মার্কিন কৌশল স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে বৃহত্তর ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য ব্যক্তিগত নেতৃত্বের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এটি জেফ্রি স্যাকসের অভিযোগকেও সমর্থন করে যে ইউক্রেন যুদ্ধ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রকল্পের অংশ।

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 5002 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...