
পেগি মোহন
ভাষাতাত্ত্বিক পেগি মোহনের এই সাক্ষাৎকারটি হিন্দুস্তান টাইমস পোর্টালে প্রকাশিত হয় গত ২৫ মার্চ। পেগি মোহনের সঙ্গে কথা বলেছেন সাংবাদিক মুরলি কে মেনন। বর্তমানে কেন্দ্র সরকারের আগ্রাসী ভাষানীতির ফলে নতুন করে হিন্দি ও তামিল ভাষার মধ্যে দ্বন্দ্বের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে সাক্ষাৎকারটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক বলে মনে হওয়ায় ‘চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম’ এটি পুনঃপ্রকাশের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পত্রিকার জন্য লেখাটি অনুবাদ করেছেন সোমরাজ ব্যানার্জি
চার বছর আগে প্রকাশিত ওয়ান্ডারার্স, কিংস, মার্চেন্টস বইয়ে পেগি মোহন প্রাঞ্জল ভাষায় ভারতের ইতিহাস বলেছিলেন দেশের মানুষের কথ্য ভাষাগুলির মাধ্যমে। তাঁর নতুন বই ফাদার টাং, মাদারল্যান্ড-এ এই ভাষাতাত্ত্বিক আরও গভীরে গিয়ে অনুসন্ধান করেছেন— কীভাবে দক্ষিণ এশিয়ার ভাষাগুলি গড়ে উঠেছে পুরনো স্থানীয় ব্যাকরণ ও নতুন শব্দভাণ্ডারের সংমিশ্রণে।
‘ক্রিওল মডেল অব ল্যাঙ্গুয়েজ ইভোলিউশন’-এর ভিত্তিতে তিনি দেখিয়েছেন, ভাষার এই পারস্পরিক আদানপ্রদান কীভাবে অঞ্চলটির আধুনিক ভাষাগুলিকে আকার দিয়েছে। মোহন বড় হয়েছেন ত্রিনিদাদে, একটি বহুভাষিক পরিবারে। তাঁর বাবা ভারতীয় বংশোদ্ভূত, মা কানাডিয়ান— ফলে ছোট থেকেই তিনি শুনে বড় হয়েছেন ইংরেজি, ভোজপুরি ও ক্রিওল ভাষা।
মোহন মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞানে পিএইচডি করেছেন এবং হার্ভার্ড ও অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। এই সাক্ষাৎকারে তিনি ভাষার পরিবর্তনে মিশ্রণ, ক্ষমতার স্থানান্তর ও শহুরে জীবনের প্রভাব নিয়ে কথা বলেন। এছাড়াও, কেন হিন্দি ও তামিল ভবিষ্যতের সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না, এবং কীভাবে তিনি দীর্ঘদিন ধরে একটি হরপ্পান গান পুনর্গঠনের কথা ভাবছেন— সেসব বিষয়ও উঠে এসেছে আলোচনায়।
মুরলি: দক্ষিণ এশিয়ায় নতুন ভাষার উদ্ভবের প্রেক্ষিতে আপনি যে মিশ্রভাষার ‘ক্রিওল মডেল’-এর কথা বলেছেন, তা কীভাবে প্রযোজ্য?
পেগি মোহন: ক্রিওল কেবল ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে দাসপ্রথার সাথে সম্পর্কিত নয়। এটি ভাষার দ্বিস্তরীয় মিশ্রণকে দেখার একটি পদ্ধতি। আমাদের মা-বাবার মতোই, ভাষার মিশ্রণ ঘটে তখনই, যখন অভিবাসীরা স্থানীয়দের সঙ্গে মিলেমিশে যায়— সাধারণত বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে। এই ব্যবস্থায় যারা অনুপ্রবেশ করে, তারা বেশিরভাগই পুরুষ। অচিরেই তাদের স্ত্রীর প্রয়োজন হয়, নচেৎ তারা বিলুপ্ত হয়ে পড়ে।
পশ্চিম আফ্রিকায়, সিন্ধু উপত্যকায় বৈদিক যুগে, কিংবা পরে দাক্ষিণাত্যে— এই অভিবাসীরা ছিল ভ্রমণকারী প্রকৃতির। তারা স্থানীয় মহিলাদের বিয়ে করে, এবং সেখান থেকেই জন্ম নেয় প্রথম প্রজন্ম, যারা দুটি ভাষাতেই দক্ষ।
তবে প্রকৃত মিশ্রণটা ঘটে পরে— যখন ওই অভিবাসীদের সরাসরি উত্তরসূরি নয় এমন মানুষজনও তাদের জীবনধারা বদলাতে শুরু করে, শহরে আসে, চাষাবাদে যুক্ত হয়। তখনই পুরুষ ও নারী একত্রে বসবাস করে পরিবার গড়ে তোলে, আর ভাষাও তাদের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যেতে থাকে।
এটি ঐতিহাসিকভাবে দক্ষিণাত্যেও দেখা যায়। পুরুষেরা উত্তর থেকে এসেছিল, স্থানীয় মহিলাদের বিয়ে করেছিল— আর ধীরে ধীরে স্থানীয়রা দেখতে পেল, তাদের পরিচিত পৃথিবীটা পুরোপুরি বদলে গেছে। ক্ষমতার ভাষাটাও ছিল নতুন। কিন্তু তারা সেই ভাষাকে পুরোপুরি গ্রহণ করেনি— বরং এই বদলগুলোকে তারা তাদের পুরনো, চেনা ভাষার ভেতরেই মিশিয়ে নিয়েছিল।
এইভাবেই দক্ষিণী ভাষাগুলোর জন্ম: তেলেগুর ‘অপারেটিং সিস্টেম’-এর উপর বসেছে উর্দু শব্দের আস্ত স্তর। একইভাবে, বৈদিক সংস্কৃত প্রবাহিত হয়েছে প্রাকৃতের ভেতর দিয়ে। আধুনিক ভাষাগুলোর শিকড়ও গেঁথে আছে প্রাচীন কোনও কাঠামোর মধ্যে— যা সম্ভবত সিন্ধু সভ্যতা থেকেই এসেছে।
অবশেষে, যখন স্থানীয় ভাষাগুলি তাদের শব্দভাণ্ডারে পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রাকৃত শব্দ অন্তর্ভুক্ত করে ফেলে, তখন প্রাকৃত নিজেই ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। সিন্ধু উপত্যকার ভাষাগুলিও তেমনি বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। তাদের জায়গা নিয়ে ফেলে একেবারে নতুন কোনও ভাষা।
প্রথমদিকের মুসলিম সুলতানাতগুলি আধুনিক ভারতীয় ভাষাগুলির বিকাশে কী ভূমিকা পালন করেছিল?
মুসলিম সুলতানাতগুলি ভারতে প্রবেশ করেছিল এমন এক সময়ে, যখন সুবিশাল, ভগ্নপ্রায় প্রাকৃত-ভিত্তিক যুগ শেষের পথে, কিন্তু সেটিকে একেবারে শেষ করে দেওয়ার মতো কোনও চূড়ান্ত আঘাত তখনও আসেনি। ফলে সেই ভাষাগত কাঠামো কোনওভাবে টিকে ছিল। তখন ভারতের বিভিন্ন অভিজাত শ্রেণির মানুষ প্রাকৃত ভাষায় কথা বলত, অথচ দরিদ্র মানুষরা ছিল একেবারে ভাষার এই পরিসরের বাইরে। এই বিষয়টি নিয়ে ভাবলে আমাদের বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে মিল পাওয়া যায়— আপনি ও আমি ইংরেজিতে কথা বলছি, আর দরিদ্র মানুষ ভাবছে: এরা কী বলছে? আমরা এই আলোচনায় কীভাবে অংশ নিতে পারি?
প্রাকৃত ভাষাগুলিকে চূড়ান্তভাবে সরিয়ে দেওয়ার কাজটি ঘটেছিল তখনই, যখন সুলতানাতগুলি ভারতে আসে। তারা নিজে থেকে নতুন কোনও ভাষার সৃষ্টি করেনি। বরং ক্ষমতায় আসার পর তারা বাংলা, মারাঠি প্রভৃতি নতুন ভাষাভাষীদের, এবং এই ভাষাগুলির নানা বৈচিত্র্যকে, রাজকীয় দরবারে আমন্ত্রণ জানাতে শুরু করে। তারা এই ভাষাগুলির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল।
তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্টালিন সম্প্রতি হিন্দির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন যে এটি মৈথিলি থেকে মুণ্ডারি পর্যন্ত একাধিক ভাষাকে গ্রাস করেছে। তাহলে তামিলও কি অন্য অনেক ভাষাকে প্রতিস্থাপন করেছে?
আসলে, তামিলও গ্রাস করেছে। দক্ষিণ ভারতের কোনও উপজাতির মধ্যে আপনি এমন কোনও ভাষা খুঁজে পাবেন না, যা দ্রাবিড়ীয় নয়। অন্য ভাষাগুলোর উপরে দ্রাবিড়ীয় ভাষার আধিপত্য পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। শুধু তামিল নয়, দক্ষিণের সমস্ত উপজাতীয় ভাষা এখন দ্রাবিড়ীয় ঘরানার। তামিল ভারতের অন্যতম বৈচিত্র্যময় ভাষা— একে একক বৈচিত্র্য হিসেবে বিচার করাই মুশকিল। একটিমাত্র নামেই এতরকম বৈচিত্র্যকে বোঝানো হয়, ফলে এটিকে আলাদা করে দেখা সহজ নয়।
অন্যদিকে, হিন্দি একটি দ্বাদশ শতাব্দীর ভাষা, যা ব্রজ, আওধি, মারোয়াড়ি প্রভৃতি ভাষার সঙ্গে সমসময়ে বিকশিত হয়েছিল। এই ভাষাগুলিও ছিল হিন্দির সমতুল্য। ফলে বোঝা অপেক্ষাকৃত সহজ যে হিন্দি কীভাবে তাদের গ্রাস করল। স্টালিন আজ যেটা বলছেন, সেটা আমি চল্লিশ বছর আগেই বলেছিলাম। আমি নিজে একজন ভোজপুরিভাষী, এবং আমার নিজের ভাষাও ঠিক এই একই পরিণতির শিকার।
আগে ভাষার বিলুপ্তি নিয়ে আমি দুঃখ পেতাম, কিন্তু পরে বুঝেছি ভাষার মধ্যে একধরনের ‘Triage’ (অর্থাৎ প্রয়োজন বা গুরুত্ব অনুযায়ী বাছাই) ঘটে। যেখানে অনেক ভাষা পাশাপাশি টিকে আছে, আর টিকে থাকার ভিত্তি যদি হয় দারিদ্র্য— অর্থাৎ ভাষাগুলির ব্যবহারকারী যদি হয় প্রান্তিক, আধুনিক প্রেক্ষিতের বাইরে থাকা, বনবাসী কিংবা শ্রমজীবী মানুষ— তাহলে সেই ভাষাগুলি টিকে থাকতে পারে না। যদি না আপনি মেনে নেন যে এই ধরনের অসাম্য কাম্য। এই ধরনের ভাষাগুলি তখন আর আধুনিক প্রেক্ষাপটে ব্যবহার হয় না, আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়। এর জন্য ভাষাভাষী মানুষদের মৃত্যু দায়ী নয়— বরং তারাই তাদের সন্তানদের এমন স্কুলে পাঠাচ্ছেন, যেখানে ক্ষমতার ভাষাগুলি শেখানো হয়।
নতুন শিক্ষানীতির ‘তিন ভাষার ফর্মুলা’ সম্পর্কে আপনার কী মত?
আমরা দেখছি কেন্দ্রের পক্ষ থেকে হিন্দি ভাষা প্রচারের উপর জোর দেওয়া হয়েছে, যদিও এর উদ্দেশ্য মানুষের ক্ষমতায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। কিন্তু আমি মনে করি, এই বিষয়ে রাজনীতিকদের বিশেষ কোনও ভূমিকা নেই। তাঁরা অবশ্যই এটি নিয়ে কথা বলতে পারেন, কিন্তু এই ইস্যুটি শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত হয় বাজার এবং প্রযুক্তির মাধ্যমে। আর সেখানেই আসল লড়াই। হিন্দির সমর্থকেরা হয়তো দাবি করতে পারেন যে এটি জনপ্রিয় সংস্কৃতি বা সাহিত্যের ভাষা। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট নয়। আসল প্রয়োজন ভবিষ্যতের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া। কিন্তু তামিল বা হিন্দি— কেউই যথেষ্টভাবে এই কাজটি করছে না। সম্পূর্ণরূপে সক্রিয় থাকতে হলে তামিল ও হিন্দিতে সফটওয়্যার লেখা বা বৈজ্ঞানিক গবেষণা পরিচালনার প্রয়োজন। ভারতের ভাষার বহুত্ব নিয়ে আমার কোনও সমস্যা নেই, কারণ সাধারণত যদি কখনও ভাষার সমস্যা সৃষ্টি হয়, তবে মানুষ নিজেরাই এর মীমাংসা করে নেয়। এটি আগ্রহজনক যে মহারাষ্ট্রের দক্ষিণ ও গোটা দক্ষিণাত্যে একটি গোধূলিকাল দেখা যায়, যা অনেক ক্ষেত্রেই উত্তরের বা দক্ষিণের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। ভাষা বৌদ্ধিক নয়, এটি পরিবেশগত। যদি এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি না করা যায়, যেখানে মানুষ একটি নির্দিষ্ট ভাষা শেখার প্রয়োজন অনুভব করবে, তবে তারা তা শিখবে না।
তামিলনাড়ু সরকার সম্প্রতি সিন্ধু উপত্যকার লিপির পাঠোদ্ধারের জন্য ১ মিলিয়ন ডলারের পুরস্কার ঘোষণা করেছে। এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রগতির যুগেও, এটিকে ডিকোড করার সম্ভাবনা কতটা?
আমি সম্প্রতি চেন্নাইয়ে তিন দিন কাটিয়েছি, যেখানে কিছু মানুষ গাণিতিক পদ্ধতি ব্যবহার করে প্রমাণ করার চেষ্টা করছেন যে সিন্ধু সভ্যতার সিলগুলি (seals) কোনও প্রাকৃতিক ভাষার প্রতিনিধিত্ব করে। ব্যক্তিগতভাবে, আমি সিলের উপর খুব বেশি মনোযোগ দিই না, কারণ আমার কাছে আরেকটি তথ্যের উৎস রয়েছে— তা হল আধুনিক উত্তর ভারতীয় ভাষাগুলির ব্যাকরণগত কাঠামো, যা সুনির্দিষ্টভাবে সংস্কৃত থেকে উদ্ভূত নয়। তাহলে, সেগুলি কোথা থেকে এসেছে? সেখান থেকেই একটি মৌলিক কাঠামোর পুনর্গঠন শুরু করা যায়, যদিও এখনও অনেক প্রশ্ন অমীমাংসিত রয়ে গেছে।
একটি বিষয় যা আমাকে প্রমাণ করতে হবে তা হল, এই আধুনিক ভাষাগুলির কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেগুলি সংস্কৃতে অনুপস্থিত। অর্থাৎ এই ভাষাগুলি এতটাই প্রাচীন যে সম্ভবত সেগুলি সিন্ধু সভ্যতার সময়েও বিদ্যমান ছিল।
আমার স্বপ্ন হল, আমার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বসে একটি হরপ্পান গান পুনর্নির্মাণ করা। সম্ভবত সেই গানে এমন অনেক শব্দ থাকবে, যা বর্তমান পাঞ্জাবি ভাষায় প্রচলিত। আবার হয়তো সেই এলাকায় বসে যখন আমি গানটি শুনব, তখন মনে হবে তার কিছু শব্দ যেন মলয়ালম ভাষা থেকে এসেছে।