আফরাজুল হত্যা : একটি ইস্তাহার

আফরাজুল হত্যা

সোমেন বসু

 

মানবতা বস্তুটা সত্যিই বোধহয় একটা ছদ্ম শব্দ। সমাজে শ্রেণির অস্তিত্ব যদি সত্যিই মেনে নিই, যদি এটাতেও অমান্য করার কিছু না থাকে যে, সেই শ্রেণিগুলি পরস্পর বিরোধী, একের অস্তিত্ব অন্যের অস্তিত্ব বিপন্ন করে, তবে শ্রেণি-ঊর্ধ্ব মানবিকতার বাণী সত্যিই প্রহসনমূলক হয়ে দাঁড়ায়।

কিন্তু সেই প্রহসনেরই দোহাই… নিজেদের মনুষ্য সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার যদি বিন্দুমাত্র প্রেরণা এই অসময়েও আমাদের মধ্যে জীবিত থেকে থাকে… রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এবং তার সমস্ত শাখাপ্রশাখার বিরোধিতা করা… যে কোনও রকম ফর্মেই হোক না কেন… এই মুহূর্তের আশু দাবি।

হ্যাঁ, রাজস্থানের ঘটনা প্রসঙ্গেই বলছি।

ঘটনাটা এখন সবাই জানেন। তবু আরেকবার বলব, তবে তার আগে খানিক প্রাক-কথন—

আজকেই একটি সমীক্ষার রিপোর্টে দেখলাম, ভারতে বেকারত্বের হার এশিয়ার সর্বাধিক। কিছুদিন আগেই ক্ষুধা সূচকে ভারত সেঞ্চুরি র‍্যাঙ্ক করেছে।

এবং, কালই শুরু বহুপ্রতীক্ষিত গুজরাট বিধানসভা নির্বাচন।

ঘটনায় আসি–

• শম্ভুলাল আফরাজুল-কে জীবন্ত জ্বালিয়ে খুন করেছে।

• এবং সেই খুনের ঘটনাটি ভিডিও করে হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিয়েছে।

• নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, শম্ভুলাল হিন্দু এবং আফরাজুল মুসলমান।

• শম্ভুলাল রাজস্থানের স্থানীয় অধিবাসী। আফরাজুল বাংলার মালদা জেলার কালিয়াচকের বাসিন্দা। পরিবারের দাবি অনুযায়ী সে রাজস্থানে শ্রমিকের কাজে গিয়েছিল।

• শম্ভুলালের দাবি, ভিডিওতে দৃশ্যত, আফরাজুল একটি প্রেমের তাগিদে রাজস্থানে গেছিল। এবং প্রেমটি একটি হিন্দু মেয়ের সাথে।

• এই ধরনের ঘটনাকে হিন্দুত্ববাদীরা লাভ জিহাদ বলে থাকে। তাদের বক্তব্য মুসলিমরা পরিকল্পনামাফিক এই ‘জিহাদ’-এর মাধ্যমে নিজ ধর্মে রূপান্তরকরণ চালায়।

• শম্ভুলাল দাবি করেছে, ভবিষ্যতে জিহাদিদের জন্যও এই পরিণতি হবে।

• ঘটনাটি ঘটেছে ৬ই ডিসেম্বর। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ২৫ বছর পূর্তির দিন।

• সেই আক্ষেপও করেছে শম্ভুলাল। তার বক্তব্য, এই দিনই বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল, কিন্তু তারপর এই পঁচিশ বছরে আর একটুও এগোনো যায়নি।

• …

এই পর্যন্ত ঘটনাটি নিঃসন্দেহে বর্বর, পৈশাচিক, নারকীয়। কিন্তু বিরল বলা যায় না। বিশেষত আমাদের দেশে। রাজনৈতিক খুনোখুনি, বিরোধীদের যতটা সম্ভব নৃশংসতার নজির স্থাপন করে হত্যা করা, যাতে কিনা বিরোধিতা শব্দটাই অলীকত্ব প্রাপ্ত হয়, তার বহু নমুনা দেশে তো বটেই, আমরা এ রাজ্যেই প্রত্যক্ষ করে এসেছি। সালটা ঠিক মনে পড়ছে না, গত শতাব্দীর শেষ বা এ শতাব্দীর শুরুর দিকেই হবে, এই বিজেপি মেদিনীপুরের গ্রামাঞ্চলে ‘মাওবাদী’ (তৎকালীন ‘জনযুদ্ধ’) সমর্থক এক পরিবারের চারজনকে খুন করেছিল রীতিমতো যজ্ঞ করে। যাদের খুন করা হয়েছিল তাদের খুলি ফুটো করে মাথার ঘিলু বের করে গায়ে মাখানো হয়েছিল বলে শুনেছি। এই মেদিনীপুরই আবার কেশপুর, গড়বেতা, ছোট আঙারিয়া সহ অনেক কিছুর সাক্ষী। সিপিএম তাদের শাসনকালে এ রাজ্যে পার্টি-পার্টি বিভাজন এবং দ্বন্দ্বকে এক চরম মাত্রায় নিয়ে গেছিল। বিরোধী রাজনীতি করার অপরাধে ঘরবাড়ি পোড়ানো, গ্রামছাড়া করা, একঘরে করা, এসব তো হয়েইছে লাগামছাড়া হারে, তার সাথে বর্বর পদ্ধতি ব্যবহার করে হত্যাও। আবার গুজরাট দাঙ্গায় গর্ভস্থ ভ্রূণকে বের করে এনে ত্রিশূলে গাঁথার ঘটনাও তো স্মৃতিতে জ্বলজ্বল।

ভিডিও করার ঘটনাটা মাত্রা বাড়িয়ে দেয় নিঃসন্দেহে। কিন্তু সেটাও, বিশেষত আজকের এই ইন্টারনেট যুগে, এমন কিছু দুর্লভ নয়। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ প্রকৃত প্রস্তাবে সর্বার্থেই আইসিস বা তালিবানদের বাংলায় যাকে বলে ফ্র্যাটারনাল অর্গানাইজেশন। মুসলিমদের প্রতি এদের প্রকাশ্যে এত জেহাদ সত্ত্বেও এদের শিকার তালিকায় সাধারণ দরিদ্র মুসলিম এবং গৌরী লঙ্কেশ, কালবুর্গিদেরই নাম দেখা যায়, কোনও মৌলবাদী মুসলিম নেতার নয়। তা, ওই মুসলিম সংগঠনগুলির দৌলতে এহেন ভিডিও প্রত্যক্ষ করারও অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে বৈকি। ফলে, সব মিলিয়ে, ঘটনাটি এই অব্ধি হলে আর এস এস বা বিজেপির বিরুদ্ধে তোপ দাগা যেত অবশ্যই, কিন্তু নিজেদের মনুষ্যত্বকে বাজি রাখার দরকার বোধহয়, বিশেষত আমাদের, ভারতবাসীদের হত না।

তা হলে এর বিশেষত্ব কোথায়? কেন আমাদের চমকে উঠতেই হবে? কেন সেই চমকানি যথেষ্ট না হলে প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে আমাদের মনুষ্য সত্তা? দুটি কারণে। প্রথমত, এই ঘটনার সঙ্গে তুল্যমূল্য যে ঘটনাগুলি উল্লেখ করলাম সবই হয় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড, নয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পরিস্থিতি। এই ঘটনাটি এর কোনওটিই নয়। রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড নয়, এবং, আরও শিউরে ওঠার মতো তথ্য, শম্ভুলাল যে আর এস এস বা বিজেপি কর্মী, তারও কোনও প্রমাণ এখনও অব্ধি পাওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষ কর্মী হলে মানুষ অনেক কিছু করে ফেলে বাধ্যতায় বা আনুগত্য প্রদর্শনের খাতিরে। শম্ভুলালের সেসব কোনও দায় ছিল বলে জানা যাচ্ছে না। ফলে এটা অনুমেয়, যে আর এস এসের বিষাক্ত মতাদর্শ কত দূর অব্ধি বিস্তৃত হয়েছে যা একজন সাধারণ মানুষকে দিয়েও এমন একটি আদিম কাণ্ড করিয়ে নিচ্ছে!

দ্বিতীয়ত, ঘটনার বিবরণ দিতে গিয়ে শেষে যে ডটগুলি দিয়েছি, সেগুলি…

শম্ভুলালের এই নারকীয় ঘটনাটির যে ভিডিওটি করা হয়েছে, সেটি করেছে একটি চোদ্দ বছরের বালক, তার ভাইপো! ঘটনাটি প্রত্যক্ষ করেছে বা করানো হয়েছে একটি এগারো বছরের বালিকাকে, তার মেয়ে!!

এবার?

আমরা সুবিধবাদী। অনেক কঠিন কাজের দায়িত্ব আমরা আগামী প্রজন্মের ঘাড়ে চাপিয়ে দিই। তাদের জন্য বাসযোগ্য পৃথিবী দিয়ে যাওয়ার চেষ্টাকে প্রায়শই ছাপিয়ে ওঠে এই বোধ… ওরা নিশ্চয়ই পারবে। ওরা মানে? ওই ছেলেমেয়েদুটিও তো সেই ওরা-ভুক্তই! আমাদের পিঠ ঠেকানোর দেওয়াল, আমাদের ফিরে আসার ঠিকানা। ধূর্ত, ফ্যাসিস্ট আর এস এস থাবা বসিয়েছে বা বসাচ্ছে ঠিক এই জায়গাটাতেই।

তাই… যাকে বলে আই রিপিট…

নিজেদের মনুষ্য সত্তাকে বাঁচিয়ে রাখার যদি বিন্দুমাত্র প্রেরণা এই অসময়েও আমাদের মধ্যে জীবিত থেকে থাকে… রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ এবং তার সমস্ত শাখাপ্রশাখার বিরোধিতা করা… যে কোনও রকম ফর্মেই হোক না কেন… এই মুহূর্তের আশু দাবি…

অতএব….! হ্যাঁ, প্রাক-কথনগুলিকে মনে রেখে…

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...