দেবব্রত শ্যামরায়
প্রিয় পাঠক, মূল লেখাটির মধ্যে প্রবেশ করার আগে ‘অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি’ এমন কয়েকটি তথ্য জেনে নেওয়া যাক।
১। একজন এইডস রোগী আপনার তিন ফুট দূরত্বের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঘণ্টাদুয়েক ক্রমাগত হেঁচে গেলে, আপনার এইডস হবার সম্ভাবনা ৬৭% বেড়ে যায়।
২। জীবজগতে সবচেয়ে বেশি বায়ুত্যাগ করে গরু। গরুর দ্বারা নির্গত মিথেন গ্যাসের পরিমাণ প্রতিদিন প্রায় ৫১৩ লিটার।
৩। শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোর জাতীয় সংগ্রহশালায় একটি বিশাল অণ্ডকোষ সংরক্ষিত আছে। সন্দেহ করা হয় এটি সম্ভবত বীর কুম্ভকর্ণ-এর।
এই পর্যন্ত পড়ে যারা এই অধমের ফাজলামিতে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হচ্ছেন, যারা মুচকি হাসছেন, তাদের সবাইকে জানাই গম্ভীর মুখে বিশ্বাসযোগ্যভাবে অনর্গল মিথ্যে লিখে যাওয়ার অভ্যেস এখনও রপ্ত করতে পারিনি। তাও উপরের প্রথম দু’টি বক্তব্যে বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভান রেখেছিলাম, সংখ্যা গুঁজে দিয়ে খানিক বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠার চেষ্টা ছিল, দু’টো পয়েন্ট পাব্লিকের ‘খাওয়া’র একটু হলেও সুযোগ ছিল, তিন নম্বরে এসে সে সুযোগ নিজে হাতে নষ্ট করেছি। কোত্থেকে কুম্ভকর্ণ এসে সব মাটি করে দিল। পোষ্ট-ট্রুথ আর লিখে ওঠা হল না আমার।
অথচ বিশ্বাস করুন, পোষ্ট-ট্রুথ লিখতে চাই। এই বস্তুটি একবার রপ্ত করে ফেলতে পারলে এই মাগগির বাজারে বাড়তি টু পাইস রোজগার করে ফেলাও কঠিন নয়। পোষ্ট-ট্রুথ-এর একটা সাম্প্রতিক নমুনা দেখে নেওয়া যাক। পোস্টটি সোশাল মিডিয়ায় সাঁতরে বেড়াচ্ছে। বানান অবিকৃত রাখলাম।
—————————–
দেখুন তো, নিচের এই নাতিদীর্ঘ পরিচ্ছদটি পড়তে পড়তে একবার হলেও বুকের ভিতর’টা কেঁপে ওঠে কিনা…!!
যা চলছে তাতে …. ২০১৮’এর মধ্যেই বিনারক্তপাতে ইসলাম যে গোটা ব্রিটেন’টাকেই গ্রাস করে ফেলতে চলেছে…!!
–কার দোষ…?
–নিঃশব্দে এই পরোক্ষ মুসলিম আগ্রাসনের জন্য কাকে দায়ী করবেন….??
লন্ডনের মেয়র – মুসলমান।
বার্মিংহামের মেয়র – মুসলমান।
লীডসের মেয়র – মুসলমান।
ব্ল্যাকবার্ণের মেয়র – মুসলমান।
শেফিল্ডের মেয়র – মুসলমান।
অক্সফোর্ডের মেয়র – মুসলমান।
লুটনের মেয়র – মুসলমান।
ওল্ডহ্যামের মেয়র – মুসলমান।
রকডেলের মেয়র – মুসলমান।
সে দেশে মসজিদের সংখ্যা – ৩০০০
মুসলমান’দের জন্য ১৩০টি’রও বেশি শরিয়তি আদালত আছে সেখানে।
আছে অন্তত ৫০টি’রও বেশি মুসলিম পরিষদ।
এখানেই শেষ নয়, সে দেশের মাটিতে বহু জায়গাতেই “মুসলিম–অনলি–নো–গো” অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। অর্থাৎ এই জায়গাগুলিতে মুসলিম ছাড়া অমুসলিমমাত্রেরই প্রবেশ নিষিদ্ধ হয়েছে।
সে দেশের ৭৮% মুসলিম মহিলা স্রেফ ঘরে বসেই বেকার ভাতা পেয়ে থাকেন।
৬৩% মুসলিম পুরুষ পান বেকার ভাতা’র অর্থ!
প্রতিটি মুসলিম পরিবারই গড়ে ৬-৮টি সন্তানের জন্য নিখরচায় ভাতা পেয়ে থাকে।
ব্রিটেনের প্রতিটি স্কুলে কেবল হালাল মাংসই সরবরাহিত হয়।
….. আর ব্রিটেনের ৬কোটি ৬০লক্ষ মানুষের মধ্যে থেকে এর সবকিছুই তারা ছিনিয়ে নিতে পেরেছেন তাদের ৪০লক্ষ জনসংখ্যার সুবাদে …!!! জনসংখ্যার অনুপাতে যা কেবলমাত্র ৬%-এর সামান্য বেশি।
ব্রিটেন তো গেল ….
এবারে কি তবে ভারত….?
তবে আর কি, ধ্বংসের জন্য প্রস্তুত হন ….!!
জানতে চান, – কি ভাবে …??
ইন্সটিটিউট অফ ওয়ার্ল্ড ডেমোগ্রাফি’র একদল গবেষক সম্প্রতি ভারতের ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যার যে ভয়ঙ্কর পরিসংখ্যানটি (১৯৪৮-২০১৭) আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, এমন ভাবে চলতে থাকলে ২০৪১সাল নাগাদ কি ঘটতে পারে; নিচের সংক্ষিপ্ত চিত্রতেই তা পরিষ্কার….।।
সালঃ ১৯৪৮
হিন্দুঃ ৮৮.২%
মুসলিমঃ ৬%
সালঃ ১৯৫১
হিন্দুঃ ৮৪.১%
মুসলিমঃ ৯.৮%
এবারে ২০১১ সালে এসে মজা দেখুনঃ
সালঃ ২০১১ (প্রস্তাবিত, অর্থাৎ এই হারে যা হবার কথা ছিল)
হিন্দুঃ ৭৯.৮%
মুসলিমঃ ১৫.০%
সালঃ ২০১১ (বাস্তবে সরকারী নথী অনুযায়ী যা পাওয়া গেল)
হিন্দুঃ ৭৩.২% (হিসেবের চেয়েও হ্রাস পেল ৬.৬%)
মুসলিমঃ ২২.৬% ( হিসেবের চেয়েও বৃদ্ধি পেল ৭.৬%)
অর্থাৎ বাস্তবে ২০১১’তে স্বাভাবিকের চেয়েও মুসলিম বৃদ্ধি পেল (৬.৬% + ৭.৬% = ১৪.২%)
সালঃ ২০১৭ (বাস্তবে সরকারী নথী অনুযায়ী যা পাওয়া গেল)
হিন্দুঃ ৬৮.৬%
মুসলিমঃ ২৭.২%
সালঃ ২০২১ (প্রস্তাবিত, অর্থাৎ এই হারে যা হবার কথা)
হিন্দুঃ ৬৫.৭%
মুসলিমঃ ৩২.৮%
সালঃ ২০৩১ (প্রস্তাবিত, অর্থাৎ এই হারে যা হবার কথা)
হিন্দুঃ ৬০.৪%
মুসলিমঃ ৩৮.১%
সম্ভবত ২০৩০’এর সাধারণ নির্বাচনেই ভারতবর্ষ তার প্রথম মুসলিম প্রধানমন্ত্রী পেতে চলেছে।
সালঃ ২০৩৭ (প্রস্তাবিত, অর্থাৎ এই হারে যা হবার কথা)
হিন্দুঃ ৫৫.০%
মুসলিমঃ ৪৩.৬%
সালঃ ২০৪০ (প্রস্তাবিত, অর্থাৎ এই হারে যা হবার কথা)
হিন্দুঃ ৩০.৫%
মুসলিমঃ ৬৬.৯%
ব্যাস! – মুসলমানদের বহু প্রতীক্ষিত ঘাজওয়া-ই-হিন্দ সম্পন্ন ….!!
সালঃ ২০৪১ (প্রস্তাবিত, অর্থাৎ এই হারে যা হবার কথা)
হিন্দুঃ ১১.২%
মুসলিমঃ ৮৪.৫%
……………………….
ওহে বন্ধু, …
এখনও সময় আছে। ….
জাঠ, ব্রাহ্মণ, দলিত, শিখ, জৈন, বেনিয়া …. এই সব কিছু’র রাজনীতির ঊর্ধে উঠুন।
হিন্দু হন, …. অথবা পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে যাবার জন্য প্রস্তুত হন।
…. আর যদি এখনও একত্রিত হতে কুন্ঠা বোধ করেন তো … শেষের এই ক’টা দিন মজায় কাটিয়ে নিন।
উদ্বেগের এহেন বিষয়টি নিজেদের সেইসব আত্মীয় – পরিজন’দের মাঝে ছড়িয়ে দিন, যারা এখনও সাংস্কৃতিক তমসায় আচ্ছন্ন ….।।
–হে আমার অমুসলমান বন্ধুরা, … আপনাদের সকলের চৈতন্য হোক …. ।।
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া
—————————————-
পড়লেন পোস্টটা? হয়তো আগেও পড়েছেন, বীরভোগ্যা রাজস্থানে শম্ভুলাল যখন বাংলার পরিযায়ী শ্রমিক আফরাজুলকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারছে ও তার কিশোর সহযোগী সেই দৃশ্য ক্যামেরাবন্দী করে ছড়িয়ে দিচ্ছে মিডিয়ায়, তারই কাছাকাছি সময়ে এই পোস্টটাও ঘুরে বেড়াচ্ছে আমার আপনার মোবাইলে। সেই ভিডিও আর এই পোস্ট, এদের মধ্যে কি কোনও যোগাযোগ আছে? এরা দু’জনেই কি কোনও এক ‘গ্র্যান্ড ডিজাইন’-এর অংশ?
সে কথায় না হয় পরে আসা যাবে! আগে দেখে নিই এই পোস্ট পড়ে ঠিক কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে আপনার? আপনার বুক সত্যিই কেঁপে উঠলো কি? রাজাবাজার এলাকার গলির ভেতর দিয়ে যাবার সময় যখন আপনি দেখছেন সারি সারি গরুর ছাল-ছাড়ানো শরীর কেটে ঝোলানো আছে, আপনি কি খানিক সন্ত্রস্ত হলেন, এই পোস্টটার কথা মনে পড়ে গেল কি আপনার? যদিও তাই হয়ে থাকে, এই পোস্টের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। আপনি ও আপনার মতো লাখ লাখ অমুসলিম, যারা মুসলিম নামে একটা স্টিরিওটাইপ ধারণা আগে থেকেই মাথার মধ্যে লালন করে রেখেছেন, তারাই এই পোস্টের ‘টার্গেট অডিয়েন্স’। এই পোস্টটা দেখার পর আরেকবার আফরাজুল হত্যার ভিডিওটা দেখুন, হত্যার বিভৎসতা ও অমানবিকতা যদি আপনার কাছে সামান্য হলেও সহনীয় মনে হয়, পোস্ট-ট্রুথ তার প্রার্থিত কাজটি সেরে ফেলেছে! গোয়েবেলস বেঁচে থাকলে বড় খুশি হতেন।
এছাড়াও আরেকদল মানুষ আছেন, যারা এই পোস্টটা পড়ে ঐসব তথ্যের সত্যতা নিয়ে সন্দিহান হয়ে পডবেন, অস্বস্তি বোধ করবেন, পেছনের রাজনীতিটাকে আন্দাজ করতে পারবেন। বস্তত তাদের শুভবুদ্ধির ওপর ভরসা রেখেই এই লেখাটির অবতারণা।
একটা মিথ্যে উদগার করতে সময় লাগে না, কিন্তু সেটাকে অপ্রমাণ করতে রীতিমতো খাটতে হয়। যেহেতু আক্রমণ করা হয়েছে তথ্য দিয়ে, তথ্য দিয়েই এর মোকাবিলা করা যাক। ডেটা ঘেঁটে যা পাওয়া গেল তা মোটামুটি এইরকম।
প্রথমত, লেখাটির তথ্যসূত্র হিসেবে উইকিপিডিয়ার নাম করা হয়েছে। নেট দুনিয়ার সবচেয়ে অসমর্থিত সূত্রের মধ্যে উইকিপিডিয়া একটি। এখানে পাওয়া সব তথ্যই যে ভুল তা নিশ্চয়ই নয়, কিন্তু উন্মুক্ত এই তথ্যকোষের ওপর নির্ভর করে স্পর্শকাতর ও সিরিয়াস বিষয়ে প্রচার করা কাজের কথা নয়। তবে যেটা বলার, উইকিপিডিয়া ঢুঁড়েও পোস্টটির এহেন তথ্যগুলির বেশিরভাগের সমর্থন খুঁজে পাওয়া গেল না। এছাড়াও ইনস্টিটিউট অফ ওয়ার্ল্ড ডেমোগ্রাফি নামে কোনও সংস্থার অস্তিত্ব নেট খুঁজে পাওয়া গেল না। বিশ্বের ডেমোগ্রাফি নিয়ে কাজ করে এমন সংস্থা বহু রয়েছে, পোস্ট তাদের ছেড়ে কেন একটি বায়বীয় সংস্থার দেওয়া ডেটা উল্লেখ করল, তা বোঝা আশা করি কঠিন নয়।
দ্বিতীয়ত, পোস্টের দাবি- ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরের সমস্ত মেয়রই মুসলিম। ভুল। ২০১৭-১৮ সাম্প্রতিক তথ্য খেটেখুটে বের করে নীচে দেওয়া হল।
লন্ডনের মেয়র – সাদিক খান।
বার্মিংহামের মেয়র – অ্যানে আন্ডারউড।
লীডসের মেয়র – জেন ডসন।
ব্ল্যাকবার্ণের মেয়র – কলিন রিগবি।
শেফিল্ডের মেয়র – অ্যানে মারফি।
অক্সফোর্ডের মেয়র – জিন ফুকস।
লুটনের মেয়র – মোহাম্মদ আয়ুব।
ওল্ডহ্যামের মেয়র – ইয়ান ডাকওয়ার্থ।
রকডেলের মেয়র – বিল সারানভভস্কি।
এই পর্যন্ত লিখে একটু থমকে দাঁড়াতে হয়। পোস্টে মুসলিম ও অমুসলিমের তুলনামূলক সংখ্যা বিচার করতে গিয়ে আমি নিজেই একই খেলার ফাঁদে পড়ে যাচ্ছি না তো? পোস্টদাতা মুসলিম নামধারী মানুষের সংখ্যা বেশি দেখিয়ে নিজের মত প্রতিষ্ঠা করতে চাইছেন, আমি সত্যিটা তুলে ধরছি, কিন্তু মেয়র পদে মুসলিম নাম অপেক্ষাকৃত কম দেখে সন্তুষ্ট হচ্ছি। এটাও কি আরেক ধরণের সরলীকরণ নয়? পোস্টদাতার কথামতো মেয়র পদে মুসলিম নামের আধিক্য থাকলে কি প্রমাণ হয়ে যেত মুসলিমরা ব্রিটেন অধিকার করে নিচ্ছেন? যেমন সাদিক খানের পরিবার ১৯৫৯ সাল থেকে ব্রিটেনে রয়েছেন এবং তিনি ব্রিটিশ রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। সাদিকের এই অংশগ্রহণ এক ব্রিটিশ নাগরিক হিসেবেই, সেটা থেকে বিযুক্ত করে শুধুমাত্র তাঁর ধর্মপরিচয়কেই বড় করে তোলা হচ্ছে এই পোস্টে, একজন মানুষের সমস্ত সত্ত্বাকে বাদ দিয়ে সামনে নিয়ে আসা হচ্ছে শুধু তার সম্প্রদায়গত আইডেন্টিটি, আমরা সেই ফাঁদে পা দেব কেন?
তৃতীয়ত, বিট্রেন সম্বন্ধে পরবর্তী তথ্যগুলি মুসলিম জনসংখ্যা সংক্রান্ত। পোস্ট বলছে ব্রিটেন মুসলিম জনসংখ্যা ৪ মিলিয়ন। ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী ব্রিটেনে মুসলিমদের সংখ্যা ২.৭ মিলিয়ন। পোস্ট নির্দিষ্ট সংখ্যক মসজিদ ও শরিয়া আদালতের সংখ্যা জানাচ্ছে। অথচ এখনও পর্যন্ত কোনও সরকারি নথি নেই যা নির্দিষ্ট করে মুসলিম প্রার্থনাঘরের সংখ্যা বলতে পারে, কারণ প্রার্থনার জন্য ইঁটের তৈরি সাময়িক কাঠামোও মসজিদ, আবার সর্বধর্মের জন্য তৈরি উপাসনালয়েও মুসলিমরা প্রার্থনা করতে পারেন, কোনগুলিকে কী ভিত্তিতে গণনা করা হচ্ছে তা পরিষ্কার নয়। মুসলিম অধ্যুষিত ও অমুসলিমদের জন্য ঘোষিত কোনও নো-গো অঞ্চল ব্রিটেনে নেই। শরিয়া কাউন্সিল ব্রিটেনে আছে, যার সংখ্যা অনির্ণেয়, কিন্তু দেশের আইনকে অতিক্রম করে যাবার অধিকার শরিয়া কাউন্সিলের নেই।
বেকার ও অর্থনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় মুসলিম পুরুষের সংখ্যায়ও গরমিল রয়েছে। ব্রিটেনে মুসলিম পুরুষদের ১১% বেকার ও ২৪% অর্থনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয়। দুইয়ের যোগফল ৩৫%, কিন্তু উপরের পোস্ট অনুযায়ী মুসলিম বেকার পুরুষের সংখ্যা ৬৩%। পোস্ট বলছে মুসলিম বেকার নারী ৭৮%, প্রকৃত সংখ্যা এক্ষেত্রে কাছাকাছি (১৬% বেকার ও ৫৮% অর্থনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয়) কিন্তু মনে রাখতে হবে গোটা ব্রিটেনেই কাজ না করা মহিলাদের জাতীয় গড় ৪৭%, তাই শিক্ষাগতভাবে আরও পিছিয়ে পড়া মুসলিমদের শতাংশে বেশি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। তবে মুসলিম নারী পুরুষদের বেকারভাতা সংক্রান্ত কোনও তথ্য নথিবদ্ধ নেই।
এখানে অবশ্য স্বীকার করে নেওয়া দরকার, ব্রিটেনসহ গোটা ইউরোপেও মুসলিম জনসংখ্যা ক্রমবর্ধমান, তার মূল কারণ মধ্যপ্রাচ্যে থেকে আগত উদ্বাস্তু মিছিল ও ইউরোপের উদার অভিবাসননীতি। আগত মুসলিমদের মধ্যে কিছু ‘র্যাডিক্যাল এলিমেন্ট’ থাকবে এই নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই, বেশ কিছু সন্ত্রাসী ঘটনারও সাক্ষী ইউরোপ, এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে গোটা ইউরোপে মুসলিম বিরোধী দক্ষিণপন্থার উত্থান হচ্ছে, ঠিক যেমনটি হয়েছে ভারতে বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এই নিয়ে গোটা ইউরোপের রাজনীতি বর্তমানে দ্বিধাবিভক্ত। একে কীভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে ইউরোপ মোকাবিলা করে সেটাই দেখার। তবে এটুকু স্পষ্ট যে কিছু মুষ্টিমেয় র্যাডিকাল ইসলামী সন্ত্রাসীর জন্য গোটা মুসলিম সমাজকে একরঙে রাঙিয়ে দিতে মুক্তচিন্তার লালনভূমি ইউরোপ রাজি নয়, কারণ এটাও সত্যি যে এই মুহূর্তে যে সম্প্রদায়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় ধর্মত্যাগ করছেন, সেই সম্প্রদায়ের নাম ইসলাম।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার মূলত অর্থনৈতিক কারণে ব্রিটেন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এসেছে, যে ঘটনা ব্রেক্সিট নামে পরিচিত। ব্রেক্সিট ব্রিটেনকে নিজের পররাষ্ট্রনীতি নতুন করে সাজানোর সুযোগ এনে দিয়েছে, এবং ইউনিয়নের অভিবাসননীতি থেকে ব্রিটেনের নীতি এখন আলাদা। এর ফলে ব্রিটেনে আগত মধ্যপ্রাচ্যের মানুষের সংখ্যা কীভাবে প্রভাবিত হচ্ছে, তা জানতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে পোষ্ট-ট্রুথ রচনায় ঐসব জরুরি ফ্যাক্টর মাথায় না রাখলেও চলে, তাই পোস্টে ব্রেক্সিটের বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই, কারণ তাদের কাছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটাই আসল, বাস্তব তথ্য নিয়ে তাই কোনও মাথাব্যথা নেই।
ব্রিটেন ছেড়ে এবার পোস্টটি চোখ ফিরিয়েছে ভারতের দিকে। এক্ষেত্রে মুসলিম বিদ্বেষের হাতিয়ার করা হয়েছে মূলত মুসলিমদের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যাকে। না, ১৯৪৮-এ কোনও আদমসুমারি হয়নি, ঐ সালের জনসংখ্যার তথ্যটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। অবশ্য তাতে খুব একটা ক্ষতি হয়নি, কারণ পোস্টে ২০৫১ -এর সেন্সাস ডেটা সঠিক উল্লেখ করা আছে।
সালঃ ১৯৫১
হিন্দুঃ ৮৪.১%
মুসলিমঃ ৯.৮%
এই সত্যটুকু ছুঁয়েই পোস্ট এবার উড়াল দেয় মিথ্যের দিকে। যেভাবে সিনেমায় স্মাগলারের স্যুটকেস ভরা জাল টাকার ওপরের দিকে সাজানো থাকে অল্প কিছু আসল টাকা, ব্যাপারটা ঠিক সেরকম। পোস্টে এবার বলা হচ্ছে-
‘সালঃ ২০১১ (বাস্তবে সরকারি নথি অনুযায়ী যা পাওয়া গেল)
হিন্দুঃ ৭৩.২% (হিসেবের চেয়েও হ্রাস পেল ৬.৬%)
মুসলিমঃ ২২.৬% ( হিসেবের চেয়েও বৃদ্ধি পেল ৭.৬%)
অর্থাৎ বাস্তবে ২০১১’তে স্বাভাবিকের চেয়েও মুসলিম বৃদ্ধি পেল (৬.৬% + ৭.৬% = ১৪.২%)’
অথচ সত্যিটা অন্যরকম। বাস্তবে সরকারি নথি অনুযায়ী যা পাওয়া গেল- ২০১১ সালে
হিন্দুঃ ৭৯.৮%
মুসলিমঃ ১৪.২%
মুসলিমদের জনসংখ্যা ২২.৬%, এই মিথ্যের ওপর পা রেখে চক্রবৃদ্ধি গণিতের মাধ্যমে পোস্ট ২০৪১ সালে হিন্দু ১১.২% ও মুসলিম ৮৪.৫%-এর ভয় দেখাচ্ছে। পুরো প্রোজেকশনটিই ভুল ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। খুব সযত্নে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে একটা অতি জরুরি তথ্য। ১৯৯১ থেকে ২০০১, মুসলিমদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২৯.৫২%, ২০১১-তে যা কমে গিয়ে হয়েছে ২৪.৬%। এই ট্রেণ্ড অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যা বলছে আমাদের দেশের মুসলিমরা শুধুমাত্র প্রজনন বাড়িয়ে গোটা ভারতবর্ষকে ইসলামের ছায়াতলে নিয়ে যেতে আগ্রহী নন, বরং তাদের বৃদ্ধির হার কমছে অর্থাৎ বোঝা যাচ্ছে, মুসলিমদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়ছে, মুসলিম সমাজ বুঝতে পারছে অনেকগুলি সন্তান আনার অর্থ সেইসব সন্তানদের উপযুক্ত শিক্ষা ও বেড়ে ওঠাকে অনিশ্চিত করে তোলা। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে শিক্ষিত হিন্দু বাঙালির অবস্থাটাও ছিল একইরকম অর্থাৎ আমাদের দাদু-ঠাকুরদাদের স্বাভাবিক সন্তান সংখ্যা ছিল ছয় থেকে আটটি, শিক্ষা ও সচেতনার সাথে সাথে সেই অভ্যেস লুপ্ত। আর্থসামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা মুসলিম সমাজও ধীরে ধীরে সেই সচেতনতায় পৌঁছচ্ছে, দেরিতে হলেও, এই অগ্রগতিতে আমাদের সাধুবাদ জানানো দরকার।
আফরাজুলের নিধনযজ্ঞ আর সোশাল মিডিয়ায় মিথ্যে তথ্য ছড়িয়ে মুসলিম বিদ্বেষ – কোনও পরস্পর বিযুক্ত ও কাকতালীয় ঘটনা নয়। মুসলিম আগ্রাসনের তত্ত্ব ছড়িয়ে শুদ্ধ করে নেওয়া হচ্ছে মুসলিম হত্যার ব্লু প্রিন্ট। গত আট বছরে আমাদের দেশে যতগুলি মুসলিম নিধনের ঘটনা ঘটেছে তার ৯৭% ঘটেছে ২০১৪-এ বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পর। দেশভাগের সমষ্টিগত বিরূপ স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা ধর্মভীরু হিন্দু নাগরিক সিঁদুরে মেঘে খুঁজে নিচ্ছেন অশনিসংকেত। এক মৌলবাদ পুষ্ট করছে অন্যের মৌলবাদকে। সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক দূরত্ব বাড়ছে। মৌলবাদী রাজনীতির উদ্দেশ্য এটাই যা সফল হচ্ছে। নিজ নিজ গোষ্ঠীর ভোটে উপচে পড়ছে ভোটবাক্স। সকলের জন্য কাজ-শিক্ষা-স্বাস্থ্য, সামাজিক প্রগতি, সকলের সমান অধিকার- লাস্ট বয়দের মতো বসে থাকছে সবচেয়ে পেছনের বেঞ্চিগুলোতে।
অতএব আমাদের লড়াইটা এখন আরও কঠিন। এই অশুভ সময়ে আমাদের আরও বেশি করে সচেতন থাকতে হবে। পোস্ট-ট্রুথ প্রোপাগাণ্ডার মোকাবিলা করতে হবে আমাদের সংশয়, কাণ্ডজ্ঞান ও শুভবুদ্ধি দিয়ে। সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বিরুদ্ধে এনে দাঁড় করাতে হবে লালনের গানকে। বাড়াতে হবে শিক্ষা, শ্রেণি সচেতনতা, সম্প্রদায়গত আদানপ্রদান। কারণ এখন শুধু ‘জেগে থাকাও একটা ধর্ম’।