ব্রতীন্দ্র ভট্টাচার্য
প্যাঁচ দিয়ে-দিয়ে ভাঙা দুই হাত
ওপড়ানো নখ, ওপড়ানো দাঁত
উদাসীনভাবে দেখছে লোকে
ক্ষত-বিক্ষত ছেলেটার লাশ
দেখছে জনতা, বলছে – ‘শাবাশ’!!
– কবীর সুমন
ভিডিও ক্লিপটা আমি দেখিনি। দেখা উচিত ছিল। তবু স্থিতাবস্থাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত আমি, নিশ্চিত পরিণতির থেকেও মুখ ঘুরিয়ে থাকি যে-ক’দিন পারি। একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে কাটছে, তার গায়ে আগুন ধরাচ্ছে। আর সেই মুহূর্তগুলোকে অক্ষয় করে তোলার জন্য এগারো আর চোদ্দো বছরের ছেলেমেয়ের সাহায্য নিচ্ছে। না কি দীক্ষিত করছে, যেমন করে দীক্ষাপ্রাপ্ত হয় অনালোকিত পরিবারের শিশুরা -– বলি বা কুরবানির সময়?
আমাদের পৈতৃক বাড়ির কাছেই ছিল কালীঘাট মন্দির। বহুদিন যাইনি সেখানে -– মূলতঃ ধর্মীয় কারণে যাবার প্রশ্ন ওঠে না, তাই। তবু মনে আছে -– একবার পাঁঠাবলি দেখেছিলাম। প্রচণ্ড চিৎকারের মধ্যে হঠাৎ সাময়িক স্তব্ধতা। তারপর থকথকে আজবগন্ধী সভ্যতার রজোরক্তে ভেসে যাওয়া। নখদর্পণে আসন্ন বিপর্যয়ের আভাস।
আনন্দমার্গীদের পোড়া দেহের ছবি দেখেছি খবরের কাগজে।
একটা ভাবনার অবয়বকে ধ্রুবত্ব দান করে তাকে নিয়ে মশগুল হয়ে গেলে, তাতেই গ্রস্ত হলে কি হয়?
ওই দানব, যার নাম মুখে আনতেও আমি অস্বস্তি বোধ করছি -– হ্যাঁ, ঘৃণার থেকে অস্বস্তির বোধটাই বেশি -– সে হিন্দু নারীর সম্মান -– ভালোবাসা নয়, সম্মান বাঁচাতে -– যে সম্মানের ধারণাটা তার মনে-মনে তৈরি হয়ে উঠেছে, সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অন্য ধর্মের ও/বা বিশ্বাসের মানুষের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ -– একটা খেটে-খাওয়া দুর্বল মানুষকে ওইভাবে টুকরো করে ফেলল, জ্বালিয়ে দিল শুধুমাত্র কিছু ধারণার বশে। আর ওই মানুষটা -– সে মরে গেল কেন ওইভাবে? সে কি বিস্ময়ে কাণ্ডজ্ঞান হারিয়েছিল তার? আক্রমণকারীর বীভৎস রূপ কি আসন্ন বিপদের থেকে বেশি বিহ্বল করেছিল আফরাজুলকে?
এই মৃগয়ার পেছনে ধার্মিকতার বোধের ভূমিকা নিয়ে নতুন কিছু তো বলার নেই। সেই বোধ তৈরির ক্ষেত্রে না হলেও, তার পুষ্টিসাধনে কোন রাজনৈতিক শক্তি কীভাবে কাজ করছে, তা-ও আমাদের অগোচর নয় আর। জুনেইদ খুন হয়ে গেলে আমাদের -– মানে আমাদের অনেকেরই -– হিন্দুহৃদয়সম্রাটকে নিয়ে তার বাবা বলেছিলেন -– উনি একদিনের ঘোষণায় নোটবন্দি করে দিতে পারেন, আর এই সব খুনিদের শায়েস্তা করতে পারেন না? এই প্রশ্ন বেগবতী শোক, গা-গুলোনো ক্ষোভ আর আপাত-নিঃসীম সেই হতাশার বহিঃপ্রকাশ যা মানুষকে কালক্রমে খুনিতে পরিণত করে। দেওয়ালে পিঠ ঠেকলে আক্রান্তও আক্রমণের শেষ চেষ্টাটা করে উঠতে ভোলে না।
এই দেশ আমার দেশ নয়, এই দেশ-এর শাসক আমার শুভাকাঙ্ক্ষী নয়, এই দেশ-এর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ আমার ক্ষতি চায় -– আখলাকের সন্ততিরা, জুনেইদের ভাইবেরাদর, আফরাজুলের আত্মীয়েরা কি এইভাবে ভাবতে শুরু করেছেন? আর তাঁদের সেই ভাবনায় মাটি-জল দিচ্ছি না কি আমরা? আমরা -– যারা এই ঘটনাতেও অবিচল, বা মনে-মনে খুশি, একটা বিধর্মী নিকেশ হল -– এই আনন্দে? আমরা, যারা চাপা উল্লাস প্রকাশ করতে সাহস পাইনি -– আহা আমার এই দেশ এখনও সম্পূর্ণ বধ্যভূমি নয় -– তারা জুনেইদের মৃত্যুকে ন্যায্য প্রতিপন্ন করেছি -– ঠারেঠোরে -– পুলিসকর্তা আইয়ুব পণ্ডিতের মৃত্যু দিয়ে। অভিযোগ — কাশ্মীরের মুসলমানেরা নাকি আইয়ুব পণ্ডিতের পদবী দেখে তাঁকে হিন্দু মনে করে পাথর ছুঁড়ে হত্যা করেছে। আক্রান্ত চেনে আক্রমণকারীকে, হিন্দু বা মুসলমান তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়, এই সত্যটা আমরা অস্বীকার করেছি।
অনেকের মতো আমিও আফরাজুলের ঘটনাকে প্রথমে আলাদা গুরুত্ব দিতে অস্বীকার করেছিলাম। কেন? আমার মনে হয়েছিল, এটা ধর্মীয় গোঁড়ামির কারণে অন্যান্য খুনগুলোর মতন আরও একটা খুন। এই খুন দুঃখজনক বটে, আতঙ্কজনকও, তবু ঠিক যেন অস্বাভাবিক নয় আর। এইরকম ভেবেছিলাম।
এক বন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় এই কথাগুলোই বলেছিলাম তাকে। সে আহত হল খুব।
আমায় বলল, একটা মানুষ ওইভাবে আরেকজনকে মারল। আর সেটা মনে বিন্দুমাত্র অপরাধের গ্লানি না রেখে, বরং দেশ ও সমাজের প্রতি কর্তব্যপালনের গরিমায় চোখ-মুখ উদ্ভাসিত হয়েছিল সেই খুনির। মনের কোন স্তরে ঘৃণার পহুঁছ হলে এমনভাবে ভাবা যায়?
১৯০১-এ মিসুরির গণহত্যা দেখে মার্ক টোয়েইন তাঁর দেশের নাম দিয়েছিলেন ‘ইউনাইটেড স্টেটস অফ লিঞ্চারডম’। আর ‘ওয়েলকাম টু লিঞ্চিস্তান’ – এই কথা আমরা প্রথম দেখলাম সম্ভবত সাংবাদিক শেখর গুপ্তার ট্যুইটে। গত বছর। লিঞ্চিস্তান নিয়ে নিন্দামন্দ ও সমর্থন – দেখা গেল দুই-ই। কিন্তু, মুশকিলের কথা হল – এই মন্তব্যকে সমর্থন বা নিন্দা করার মতন তথ্যসূত্র তেমন পাওয়া গেল না।
জুনেইদ খুনের পর দেশের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রসচিব রাজীব মেহরিশি বলেছিলেন – ‘লিঞ্চিং ভারতে কিছু নতুন নয়। এগুলো সামন্ততান্ত্রিক অভ্যাসের মতন।’ হয় তো উনি বলতে চেয়েছিলেন – আমাদের রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর ঢঙে – এমন তো ঘটেই থাকে। এবং এটাও, যে এই ধরণের ঘটনা নিজের নিয়মে ঘটতেও থাকবে। সুতরাং, আলাদা করে এর দিকে দৃষ্টি দেবার খুব কিছু কারণ নেই।
ইন্টারনেট ঘাঁটতে-ঘাঁটতে অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তরফে রূপা সুব্রহ্মণ্যের একটা লেখা চোখে পড়ল। সেখানে লেখিকা দেখাচ্ছেন – জুন ২০১১ সাল থেকে শুরু করে জুন ২০১৭ পর্যন্ত মাসপ্রতি গণ-হিংসার হিসেব। তাঁর বক্তব্য, জুন ২০১১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত সংখ্যাটা ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে সে-কথা ঠিক, কিন্তু এই বৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়েছে জুন ২০১৪-র পর। অর্থাৎ, কেন্দ্রে নতুন সরকার আসার পর। বরং, গত সরকারের শাসনকালের শেষদিকে এই মাসিক বৃদ্ধির হার কমে আসছিল, যা কি না নতুন প্রাণ পেয়েছে নতুন সরকার আসার পর। রূপার এই কাজ নিয়ে পরবর্তীতে লেখা বেরিয়েছে হাফিংটন পোস্টেও। এই লেখার নিচে রূপার মূল রচনার লিঙ্ক দেওয়া গেল।
অর্থনীতিতে কোয়ান্ট-অ্যান্ড্রিউজ পরীক্ষার ব্যবহার হয়। ধরুন আপনার হাতে এক গুচ্ছ তথ্য রয়েছে। সেই তথ্যসমূহ থেকে লেখচিত্র তৈরি করা গেল। এবার, ওই তথ্যবিন্দুগুলোকে জুড়ে জুড়ে যে রেখা পাওয়া গেল, তা এক দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস – নির্দিষ্ট সময়ান্তরে এক বিষয়ের বিভিন্ন মান। যদি দেখতে হয় ওই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ওই নির্দিষ্ট বিষয়ের মান-সংক্রান্ত তথ্যে কোনও ‘স্ট্রাকচারাল চেঞ্জ’ বা প্রণিধানযোগ্য গঠনগত ফারাক আছে কিনা, সেক্ষেত্রে এই পরীক্ষার ব্যবহার হয়। এই পরীক্ষা থেকে জানা যায়, ফারাক থাকলে কোন সময়ের থেকে সেই ফারাকের সূত্রপাত।
রূপা তাঁর গবেষণায় অর্থনীতির এই পরীক্ষার প্রয়োগ ঘটিয়ে দেখাচ্ছেন, জুন ২০১১ থেকে ২০১৭-র মধ্যবর্তী সময়ের যে তথ্যাবলীর লেখ, তাতে গঠনগত ফারাকের সূত্রপাত সূচিত করছে জুন ২০১৪ মাস। এ কি নিছকই সমাপতন? যেহেতু পোস্ট ট্রুথে আমাদের রুচি নেই, তাই এ-কথাও বলে রাখা ভালো, যে এই তথ্য সংবাদপত্রের প্রতিবেদন থেকে সংগৃহীত, কোনও সরকারি সূত্র থেকে নয়।
এ নিয়ে মনে হয় নিন্দুক বা সমর্থক কারও মনে কোনও দ্বিধা নেই, যে এইসব ঘটনার উদ্দেশ্য হল সংখ্যালঘুকে দাবিয়ে রাখা, এবং তাঁদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া -– কোনও বাপ তোকে বাঁচাতে আসবে না! এই দেশের নিয়ম এখন থেকে সংখ্যাগুরুর নিয়ম, এবং সেই নিয়ম মাথায় করেই তোমায় চলতে হবে। তবে এই প্রসঙ্গে সংখ্যালঘু-দলের সঙ্গে ‘ছোটজাত’ দলিতদেরও জুড়ে দেওয়া উচিত। নিয়মের ব্যত্যয় দেখলে আমরা যেখানে পারব সেখানেই তোমায় শাস্তি দেব। তারপর আমাদের নেতা বা মন্ত্রীদের দিয়ে তোমার কাজেরই নিন্দে করাব, আর আমার পুলিশকে দিয়ে তোমাকেই দোষী সাব্যস্ত করাব। এক্সট্রা-জুডিশিয়াল পানিশমেন্ট। আমাদের হিন্দুহৃদয়সম্রাট বড়জোর একটা মিনমিনে ‘সাবধানবাণী’ দিয়ে আমাদের ছেড়ে দেবেন। আর প্রতিটা অত্যাচারের পর তোমাদের কাজ হবে আওড়ানো – আমরা তো হিন্দুস্তানি! আমরা তো ভারতীয়! সেটা মারের থেকে গা বাঁচাতে বলবে, না কী হৃদয়ের গভীর বিশ্বাস থেকে আহত হয়ে বলবে, সে তোমাদের ব্যাপার। তোমাদের তাবড় বিদ্বজ্জন টিভি-রেডিওতে এসে সাহস করে একবারও বলবেন না – হিন্দুরা, আপনারা অন্যধর্মীদের ওপর অত্যাচার বন্ধ করুন। বললেই শিক্ষিতের মুখোশে আমাদের মুখেরা বলে উঠবে – এই দেখো ও সন্ত্রাসী!
ডটপেন দিয়ে খোঁচানো চোখে
সাম্যের হাওয়া গন্ধ শোঁকে
গণপিটুনীর আজব গন্ধ
ক্ষত-বিক্ষত ছেলেটার গালে
পথচারী তার দেশলাই জ্বালে!
জুনেইদকে যখন মারা হচ্ছে, যখন তার রক্তে ভেসে যাচ্ছিল ট্রেনের কামরা, যখন হত্যাকারীরা তাকে মোল্লা, কাটুয়া, গোরুখোর বলে খিস্তি দিচ্ছিল আর মেরে ফেলছিল, তখন ট্রেনে আরও অনেকেই ছিল। মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী… আমার ভাই!
অ্যাবেল মিরোপল নামে এক শিক্ষক লিউইস অ্যালেন ছদ্মনামে একটা গান লিখেছিলেন ১৯৩৭ সালে। সেই গানকে বিখ্যাত করেন বিলি হলিডে। সেই গানের ক’টা কথা এইখানে দিলাম, আমার দেশের ভবিষ্যৎ কল্পনা করে, আমাদের উবদো দেশের উবদো গাছের আজব ফলের গান। আমায় ক্ষমা করবেন, মহর্ষি লালন –
Southern trees bear strange fruit
Blood on the leaves and blood at the root
Black bodies swinging in the southern breeze
Strange fruit hanging from the poplar trees
Pastoral scene of the gallant south
The bulging eyes and the twisted mouth
Scent of magnolias, sweet and fresh
Then the sudden smell of burning flesh
Here is fruit for the crows to pluck
For the rain to gather, for the wind to suck
For the sun to rot, for the trees to drop
Here is a strange and bitter crop
তথ্যসূত্র –
http://www.orfonline.org/expert-speaks/has-india-become-lynchistan/
চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এ আমার পড়া এযাবৎ সেরা লেখাগুলোর একটা। মুখের সামনে আয়না ধরে এই লেখা।
আপনাকে ধন্যবাদ কল্পেশবাবু
ধন্যবাদ কল্পেশবাবু।
বড্ড ভাল লিখেছেন। ঠিক জায়গাটিতে লেগেছে টঙ্কার!
আপনার মত মানুষ এই অন্ধকারেও আশার আলো যোগায়, নতুন পথ দেখায়… একবার একঝলকের জন্য আপনার সাথে আলাপিত হওয়ার সুযোগ এসেছিলো, কিছু সময় আপনার সান্নিধ্যে কাটানোর সৌভাগ্য হয়েছিল, আমি ভাগ্যবান। পত্রিকাকে ধন্যবাদ, সাথে সম্পাদককেও, দিন দিন আপনার মতো লেখকদের কলমের পরশে ছোট্ট প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠুক টার্মিনাল ষ্টেশন, এই কামনা করি।