রবির আঁধার রবির আলো

রবির আঁধার রবির আলো

নীলার্ণব চক্রবর্তী

 

রবিশঙ্কর বলের আমি একদা নিত্যসঙ্গ করেছি। এটা বহু কাল ধরেই আমার অহংকারের আংটি। এর জন্য রবিদার মৃত্যুর দরকার ছিল না। তবে অনেক সময় মৃত্যু একজন মানুষের সব মালিন্য মুছে দেয়। মৃত্যু এক আশ্চর্য ইরেজার এর ফলে। ক্যানভাসের ছবি থেকে মানুষের নিখুঁত পোর্ট্রেট বার করে আনে সে। কিন্তু আমি ওই ইরেজারকেই ইরেজ করে দিই। দিতে চাই। অন্তত রবিদার ক্ষেত্রে। এই শতাব্দীর সেরা একজন সাহিত্যিককে কলমের ডগায় যখন আনছি, তখন। রবিদার মধ্যে একটা স্যাডিজম ছিল, যেটা সোসাইটির বহু অবহেলা ও তাচ্ছিল্য হতে তার মধ্যে জন্ম নিয়েছিল। যে স্যাডিজম বশে রবি সাহিত্যযশকামীদেরকে লেখা ছাপানোর ক্ষেত্রে এক গভীর দ্বিচারী জগতে নিয়ে যেত। বলত, ‘আপনার লেখাটি আমি ছাপব’, অথচ জানত লেখাটা সে ছাপবে না। সবার ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই এমন হত না কিন্তু অনেকের ক্ষেত্রে বহু সময় হতই। আমি প্রতিদিন কাগজে রবিদার ছাদের ঘরে বসে অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করতাম, কোনও এক প্রৌঢ় লেখককে রবিদা বলছে যে, ‘আপনার ওই লেখাটা এ সপ্তাহের রবিবারের ক্রোড়পত্রে যাচ্ছে।’ কিন্তু আমি জানি সানডে সাপলির গোটা ফাইনাল প্রুফটা ছাড়া হয়ে গেছে, এই ভদ্রলোকের ওই লেখাটি বা কোনও লেখাই সেখানে নেই। ওই ব্যক্তি এরপর রবিবার পেরিয়ে, লেখা-না-ছাপায় হতাশ হয়ে, এসেছেন রবিসাক্ষাতে। বলশালী সম্পাদক তাঁকে ফের একই কথা বলেছে, ‘ওহহ এ হপ্তায় যাবে।’ অথচ ততক্ষণে স্থির কার কার লেখা যাবে রবিবারে। নাহ সেখানে তো এনার নামটিই নেই। এ রকম যে একজনের সঙ্গে তুমুল হয়েছে তা নয়, তালিকাটা দীর্ঘ। এক বা দুহপ্তা ধরে হয়েছে তাও না। মাসের পর মাস বছরের পর বছর চলেছে। আমিও রবিদার পাশে বসে এটা দেখেছি সিনেমার মতো, কিন্তু কিচ্ছু বলার যোগ্যতা আমার তো নেই। হতাশ হয়ে অনেকেই তাঁদের রবিপত্রে লেখার বাসনা ত্যাগ করেছেন। কেউ কেউ রবিদাকে মদ্যটদ্য খাইয়েও বিশেষ লাভ পাননি। কখনও এমনও হয়েছে যে রবি ও কোনও লেখকের মধ্যে লুকোচুরি বা চোরপুলিস খেলা চলেছে। ধরা যাক, সেই লেখক কাগজের অফিসে ঢুকছেন এমন খবর পেল রবিদা, সে তৎক্ষণাৎ পিছনের সিঁড়ি দিয়ে বাইরে এসে চায়ের দোকানে গরম চায়ে চুমুক দিতে শুরু করল। সিটে রবিদাকে না পেয়ে লেখকটি আবার যখন নীচে নামছেন, রবিদা কী করে ঠিক বুঝে সুট করে অন্য সিঁড়ি বেয়ে নিজের ঘরে। এ ছাড়াও টাকা ধার নেওয়ার অদ্ভুত বাতিকও ছিল রবিশঙ্করের। এ জন্য তার নাম একটা কাগজে হেডলাইনও হয়েছে। আমরা জানি, মির্জা গালিব ধারপ্রবণ বলে খ্যাত। জীবনকে যাপন করবার পাগলপারা অভিপ্রায়ে মির্জা নিরন্তর ধার করে গেছেন। তিনি নিজের স্ত্রীর মৃত্যু কামনাও করেছেন খরচ কমিয়ে ফেলে একটু ভালো করে বাঁচার জন্য। রবিদা বাংলার এক অর্থে মির্জা গালিবই। যার মধ্যেকার আঁধারটাই আলোর পথ বাতলে দেয়। আপনার কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সে টাকায় ট্যাক্সি করে শুঁড়িখানায় পৌঁছে দেদার মদ খেয়ে যাওয়া — সব টাকা নাফিনিশ পর্যন্ত, এ একমাত্র রবিদার পক্ষেই সম্ভব। বালে(বাংলা লেখক)র জগতে তাই রবিশঙ্কর মূর্তিমান ব্যতিক্রম। রবিদার পড়াশোনা যে অলৌকিক স্তরের সেটা আজ ইতিকথা। লেখা যে আদতে সেরিব্রাল ম্যানিফেস্টেশন আর প্রতিভাকে পড়াশুনো থেকে নিরন্তর রসদ কীভাবে পেতে হয়, তার নজির সৃষ্টি করেছেন মিস্টার বল। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে রবিদা দৌড় করিয়েছে তার আরবের অশ্বকে, ঊর্ধ্বশ্বাসে ও রুদ্ধশ্বাসে। ক্রমে উর্দুঘেঁষা ভাষাশৈলী রবিকল্পনায় মিশে গিয়েছে। সাহিত্যের দুনিয়ায় সাম্রাজ্য কায়েম করেছে। তবে প্রথমে রবি কাফকার ভক্ত। ম্যাক্স ব্রড না থাকলে কাফকার লেখাগুলি আমরা পেতাম না। কারণ কাফকা বন্ধু ব্রডকে তাঁর মৃত্যুর পর লেখাগুলো পুড়িয়ে ফেলার জন্য অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু ব্রড কথা না রেখে পৃথিবীকে কাফকাময় করেছেন। রবিশঙ্করকে মনে হয়েছে কাফকা সূত্রে ম্যাক্স ব্রডের প্রতি কৃতজ্ঞতায় মশগুল। অনির্বচনীয় কাফকা পাগলামিতে ভুগত, কাফকা ছিল রবির পিতৃতুল্য। শুধু তো কাফকা নয়, বোর্হেস ফুয়েন্তেস মার্কেজের তীব্র ভালবাসার খপ্পরে পড়েছে সে। এ সব জাদু শুষে নিয়ে রবি পড়েছে মান্টোর মহাউদযাপনের রোডে। রবিদার হাত ধরে আমার মতো গণ্ড মূর্খও এলিভেটেড হয়েছে। সে আমার কাছে একটা লিফট হয়ে এসেছে। যে লিফটে মির্জা থেকে মার্কেজ সারা দিন সারা রাত গান করে আর নাচ করে। আমি তাতে উঠেছি যেন কয়েকটা তলা। গাননাচের ওম লাগিয়ে আমি ওমময় হয়েছি এই ক্ষোভময় দুনিয়ায়। এখনও মনে পড়ে রবিদার দেওয়া প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট। তিন জন জাপানি পোস্ট মেটিরিয়ালিস্ট শিল্পীর কাজ প্রদর্শিত হচ্ছে বিড়লা অ্যাকাডেমিতে। সেটা নিয়েই আমায় লিখতে হবে। সবে ২০ পেরুনো আমি তখন, শুনিইনি পোস্ট মেটিরিয়ালিস্ট শব্দ যৌগ। রবিদাও নিশ্চয়ই সেটা বুঝত। তবু আমায় ফেলল এক অগ্নিপরীক্ষায়। হ্যাঁ লিখলাম সেই প্রদর্শনী নিয়ে। ছাপা হল। গ্যালারিতে বৃষ্টি, এই শিরোনামে। এ রকম আরও ছবির এগজিবিশন নিয়ে লিখলাম। লাগাতার। রবিশঙ্কর আমাকে পুরো দস্তুর আর্ট ক্রিটিক বানিয়ে ছাড়ল। আমার জীবনে গুলে দিল ছবির পরশপাথর। লেখালিখির নয়া একটা রাস্তা নজরে পড়তে শুরু করল ক্রমে। একটা রুপোলি রেখা দেখতে শুরু করলাম। কে যেন বলতে লাগল ব্রেনের ভিতরে — তোর হবে।

না হয়নি। হয়ত হবেও না। তবু আমাকে রবিশঙ্কর দেখিয়ে দিয়েছে দরজাটা। যে দরজা ঠেলে সে ঢুকে গেছে। আমি এখনও টোকা দিচ্ছি। আর ভিতর থেকে একটা নারীকণ্ঠ বার বার বলে যাচ্ছে — বাবু বাড়িতে নেই, পরে আসুন।

ছবিটি সুমেরু মুখোপাধ্যায়ের তোলা। তাঁরই ফেসবুক প্রোফাইল থেকে নেওয়া।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4879 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...