শতাব্দী দাশ
অভিশপ্ত ১৬ই ডিসেম্বরের পাঁচবছর পূর্ণ হল। অর্থাৎ তথাকথিত ‘নির্ভয়া’-র ধর্ষণ-এর পর পাঁচ পাঁচটি বছর অতিবাহিত হয়ে গেল। এটি ছিল এমন একটি ধর্ষণ-এর ঘটনা — যা সামাজিক, রাজনৈতিক ও আইনি গুরুত্বের কারণে ভারতের নারীনির্যাতন তথা যৌন নির্যাতনের ইতিহাস সংক্রান্ত যেকোনও আলোচনায়, অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে, অবশ্যই বারবার ফিরে আসবে।
বলা বাহুল্য, ২০১২ সালে নির্ভয়ার ধর্ষণ ছাড়া ভারতবর্ষে আরও অনেক যৌন নির্যাতন তথা ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল। তার মধ্যে একটি ঘটেছিল ফেব্রুয়ারিতে, সুজেট জর্ডনের। সুজেট ধর্ষিত হন কলকাতার পার্কস্ট্রিটে, বার-ফেরতা, মদ্যপ অবস্থায়। শুরুটা প্রচলিত ছক মেনেই হয়েছিল। ধর্ষিত হওয়ার পর ধর্ষিতার জামার ঝুল, ডিভোর্সি স্ট্যাটাস, অ্যালকোহল ইনটেক ইত্যাদি নিয়ে নিয়মমাফিক কাটাছেঁড়া চলছিল। আমরা আবারও বুঝে নিচ্ছিলাম, নারীর জন্য এ পৃথিবী দুর্লঙ্ঘ্য। নানা ধরণের হিংসা প্রতিরোধ করতে করতে, তা সত্ত্বেও আহত হতে হতে, তারপর সেই আঘাত অতিক্রম করতে করতে, সর্বোপরি নিজের উপর নেমে আসা আঘাতের দায় নিজেই মাথা পেতে নিতে নিতেই জীবন কেটে যায়। কিন্তু সেই বছর জুন মাস নাগাদ নিউজ চ্যানেলের আলোআঁধারির আদিখ্যেতা সরিয়ে সুজেট জর্ডন স্টুডিওতে ঘুরে বসেন। সুজেটের এই নিজস্ব মুখ ও পরিচিতি সহ দেশের মুখোমুখি হওয়া ছিল এক ঐতিহাসিক অধ্যায়। সুজেট বললেন, ‘ধর্ষিতা’ হওয়াটাই তাঁর একমাত্র পরিচয় নয়। অর্থাৎ অন্তর্গতভাবে প্যাসিভ একটি শব্দে তাঁকে মেপে ফেলার চেষ্টার বিরুদ্ধে সুজেট সরব হয়েছিলেন। তাই আমরা আজও নতমস্তকে তাঁকে আলোকবর্তিকা মানি। কিন্তু বলা বাহুল্য, পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিটি অগ্রগতিই আসলে জগদ্দল পাথরকে কয়েক ইঞ্চি নড়ানো মাত্র। তা আবার গড়িয়ে আসতেই পারে পিছনে, যে কোনও মুহূর্তে।
সুতরাং আরও অনেক ধর্ষণ পেরিয়ে ১৬ই ডিসেম্বরের রাতের দিল্লিতে জ্যোতি সিং-এর ধর্ষণ ঘটল। নির্ভয়া, দামিনী, জাগ্রুতি-যেকোনও নাম ‘ধর্ষিতা’ নামটির চেয়ে ভালো, তা তো সুজেট শিখিয়েছিলেন। কিন্তু আসলে সে ছিল জ্যোতি সিং, ২৩ বছরের ফিজিও ইন্টার্ন, যে পুরুষবন্ধুর সাথে সিনেমা দেখে বাড়ি ফেরার পথে ধর্ষিত হয় চলন্ত বাসে, যার ধর্ষকদের মধ্যে একজন ছিল নাবালক, যার ইন্টেস্টাইন ভ্যাজাইনার পথে রড পেঁচিয়ে ঢুকিয়ে শরীরের বাইরে বের করে আনা হয়েছিল।
ইন্ডিয়া গেট, রাইসিনা হিল, কলকাতা, বেঙ্গালুরু এমনকি নেপাল, বাংলাদেশ পর্যন্ত রাগে ফেটে পড়েছিল। ভারতীয় পর্যটন শিল্প রাতারাতি ধ্বসে গেছিল। নিউ ইয়র্ক টাইমস দিল্লিকে ‘ভারতের রেপ ক্যাপিটাল’ চিহ্নিত করেছিল। কাঁদানে গ্যাস আর জল মিসাইল ছুঁড়েছিল বটে পুলিশ। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেছিলেন, সঙ্গত কারণেই এই বিক্ষোভ। ধর্ষণের কেসের ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের মাধ্যমে চটজলদি নিষ্পত্তির আশ্বাস এসেছিল। ভার্মা কমিটি গঠিত হয়েছিল যৌন হেনস্থা ও ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনে উপযুক্ত পরিবর্তন ও সংযোজনের জন্য। সেই কমিটি যখন সিভিল সোসাইটি, উইমেন্স অর্গানাইজেশন ইত্যাদির থেকে অভিমত চেয়েছিল, তখন সাজেশন জমা পড়েছিল প্রায় ৮০০০ মতো।
কেন এই জনরোষ? কেন ৮০০০ রকমের প্রস্তাব নারীনির্যাতন রুখতে? কারণ সরকার আর মধ্যবিত্ত জনসাধারণের মধ্যে লিখিত বা অলিখিত সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট বিশ্রীভাবে ভেঙে পড়েছিল। আসলে ভেঙে পড়াটা নতুন নয়। নির্ভয়ার মৃত্যু সেই ভেঙে পড়াটাকে দৃশ্যমান করেছিল। সরকারের দায়িত্ব জনসাধারণের নিরাপত্তা। কনস্টিট্যুশন নারী-পুরুষ সবাইকেই পথে ঘাটে সমান নিরাপত্তা দিচ্ছে, কিন্তু শুধু মৌখিকভাবে। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নয় কেন? এই প্রশ্ন সেদিন পুলিশি ব্যারিকেড ভেঙেছিল।
২০০০ সালে প্রকাশিত ‘Women, Gender and the State’ বইতে সন্ধ্যা আর্য বলেন, আশির দশকের আইনি পরিবর্তনসমূহ ভারতীয় নারীর সামাজিক অবস্থান বদলাতে আদৌ সাহায্য করেনি। বরং আইন স্বয়ং নারীকে সহনাগরিক, সমনাগরিকের মর্যাদা না দিয়ে তাকে ‘পারিবারিক মর্যাদা’, ‘মেয়ে-মা-বোন’, ‘পরনির্ভরশীল’ ইত্যাদি পিতৃতান্ত্রিক রেটরিকে বন্দী করেছে। প্রকারান্তরে, আইন-ই ব্যবহারিক ক্ষেত্রে ‘খারাপ মেয়ে/ভালো মেয়ে’ বাইনারি তৈরি করেছে, ধরে নিয়েছে — ’সুরক্ষা’ দরকার শুধু পিতৃতান্ত্রিক পরিভাষা অনুযায়ী ‘ভালো মেয়েদের’। তদুপরি ছিল এবং আছে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা, দুর্নীতি, নির্যাতিতর অজ্ঞতা — যা এমনকি প্রচলিত অসম্পূর্ণ আইনকেও বহুলাংশে ভোঁতা করে রেখেছিল। ১৯৯৮ সালে National Crime Records Bureau একটা আশ্চর্য ভবিষ্যৎবাণী করেছিল। বলেছিল, ২০১০ সালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির যা হার দেখা যাবে, নারীর প্রতি অপরাধ বৃদ্ধির হার তার চেয়ে হবে বেশি।
হয়েছিলও তাই। সেই নিয়ে ক্ষোভ জমতে জমতে ভিসুভিয়াস হয়েছিল নির্ভয়ার ধর্ষণের পর। জ্যোতি ‘ইন্ডিয়া’স ডটার’ হয়ে উঠেছিল। তা কি খোদ রাজধানী নৃশংসতার অকুস্থল ছিল বলে? জ্যোতি মরে গেছিল আর প্রকৃতিগতভাবে মৃত্যুটি মর্মান্তিক ছিল বলে? হ্যাঁ, সবকটি কারণই প্রণিধানযোগ্য। আসলে জ্যোতি ছিল মধ্যবিত্ত, স্বাধীনতাকামী, উচ্চাকাঙ্খী অথচ ‘ভালো’ মেয়েদের প্রতিনিধি — যাদের দিল্লি শহর পথেঘাটে, বাসে-ট্রেনে-মেট্রোতে, অফিস-কাছারিতে, কলেজ-ইউনিভার্সিটি-ক্যাম্পাসে রোজ দেখতে পায়; কিন্তু সামন্ততান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক মনোভাব নিয়ে গিলতে পারে না ঠিকমতো, মেনে নিতে পারে না। বর্ণগত ও লিঙ্গগত নির্যাতনের শিকার কোনও দলিত নারী উচ্চবর্ণের দ্বারা ধর্ষিত হলে সিভিল সোসাইটির দৃষ্টিভঙ্গিটি খানিক করুণার, খানিক সহমর্মিতার হত। কিন্তু নির্ভয়ার জন্য প্রতিটি স্লোগান ছিল নাগরিক মধ্যবিত্ত নারীর নিজস্ব ভয় ও অসহায়তা প্রসূত। জ্যোতি এক শ্রেণির ভারতীয় মেয়েদের মুখ হয়ে উঠেছিল, যেখানে সুজেট বরং ছিল বহিরাগত। এমনকি ব্রিটিশ প্রযোজনার তথ্যচিত্রও এটাই সাব্যস্ত করতে চেয়েছিল যে, ‘আহা, জ্যোতি বড় ভালো মেয়ে ছিল। লেখাপড়ায়, কর্তব্যকর্মে, অমনটি দু’টি হয় না। এমন মেয়ে এক-আধদিন পুরুষবন্ধুর সাথে সিনেমা দেখতে গেলে মহাভারত অশুদ্ধ হয় না।’ সুজেট জর্ডন তথাকথিত ‘ভালো মেয়ে’ ছিলেন না বলেই মনে হয় এত সহমর্মিতায় বঞ্চিতই রইলেন।
কিন্তু নির্ভয়া কাণ্ডের পর পাঁচ পাঁচটি বছর কেটে গেছে। আমরা কী পেলাম? ২০১৩ সালের ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট একটা বড় প্রাপ্তি, যা ভার্মা কমিটির সুপারিশকে বহুলাংশে মেনেছিল। ফেব্রুয়ারিতে অর্ডিন্যান্স পাশ, অতঃপর রাষ্ট্রপতি, লোকসভা ও রাজ্যসভার সম্মতিক্রমে নতুন আইন। এই আইন নিখুঁত নয়, তবে উন্নততর। এখানে বলা আছে, শুধু ‘vagina, anus, mouth’-এ penis এর insertion-ই ধর্ষণ নয়, তা হতে পারে আরও নানাভাবে। এখানে sexual harassment-এর সীমা বাড়ানো হয়েছে বাচিক যৌন হয়রানি, অশালীন ছবি তোলা বা জোর করে পর্ন দেখানো পর্যন্তও। এখানে স্পষ্টতই বলা হয়েছে, passion নয়, power অর্থাৎ ক্ষমতা প্রদর্শনই ধর্ষণের কারণ। এখানে চূড়ান্ত গুরুত্ব পেয়েছে consent বা সম্মতির ধারণা। Consent-কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে: ‘unequivocal agreement to engage in a particular sexual act’. তারপরেও যে ২০১৭ সালে মহম্মদ ফারুকি সংক্রান্ত একটি পশ্চাৎপদ রায় বেরোতে পারে ভারতীয় আদালত থেকে, তা দুর্ভাগ্যের।
অবশ্য কার্যক্ষেত্রে, আজও, ২০১৩ সালের নতুন আইন অনুসারে পুলিশের বিরুদ্ধে ধর্ষণের কেস নথিভুক্ত করার ব্যাপারে গড়িমসি দেখালে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে — এই ঘোষণা সত্ত্বেও, অনেক কেস নথিভুক্ত হয় না। একশো কোটিকে সচেতন করে তোলার কাজ বাকি আছে। পুলিশ নিজেও সচেতন কি?
ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট হয়েছে বটে। সেই ‘ফাস্ট ট্র্যাক’ কোর্টেই অগাস্ট, ২০১৬ পর্যন্ত পেন্ডিং কেস ছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার। এবং হ্যাঁ, নারীনির্যাতনের নথিভুক্ত কেস কমেনি, বেড়েছে। ঘটনা বেড়েছে, না পুলিশে রিপোর্টিং-এর হার — তা অবশ্য গবেষণাযোগ্য।
এক হাজার কোটির নির্ভয়া ফান্ড গঠিত হয়েছিল, যা থেকে প্রতি ভিক্টিম তিন লক্ষ টাকা পাবেন। আজও সেই প্রাপ্য আদায় করতে বহু বছর কেটে যায় বা তা অনাদায়ী থাকে।
নাগরিক পরিমণ্ডলের বাইরে, প্রত্যাশা মতোই কিছু উলটো ফলও মিলেছিল নির্ভয়া মুভমেন্টের। হরিয়ানার বিভিন্ন খাপ মেয়েদের স্কুলে না পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ‘বাইরে বেরোলে তবেই না ধর্ষণ ঘটবে!’ — এই ছিল যুক্তি, যা আসলে কুযুক্তি, কারণ মেয়েদের জন্য ‘ঘর’-ও আদৌ নিরাপদ নয়। প্রবল সমালোচনায় এই উদ্যোগ স্তিমিত হয়। নতুন জিগির ওঠে, সেই হরিয়ানাতেই — সরকার যেন মেয়ের বিয়ের বয়স ১৮ থেকে কমিয়ে ১৬ করেন — যেন বিয়ে দিলেই ধর্ষণের সম্ভাবনা থাকবে না! মধ্যপ্রদেশে নির্ভয়া ফোর্স (ধর্ষণ প্রতিরোধী মোবাইল পুলিশ বাহিনী) হাস্যকরভাবে ‘আধুনিক পোষাক পরিহিত প্রেমিকযুগল’ দেখলেই গ্রেপ্তার শুরু করেছিল এককালে।
ভার্মা কমিটি ম্যারাইটাল রেপকে ধর্ষণের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। কিন্তু বৈবাহিক ধর্ষণের অস্তিত্ব আজও মানা হয়নি। কমিটি বলেছিল, নির্বাচনে যেকোনও প্রার্থীর বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ থাকলে সে প্রার্থী হিসেবে অযোগ্য বিবেচিত হোক। তাও হল কই? ভার্মা কমিটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য পরামর্শটি ছিল এডুকেশনাল রিফর্ম-এর। অর্থাৎ শৈশব থেকেই যৌনশিক্ষা, লিঙ্গসাম্যশিক্ষার। সেই লক্ষ্যও অধরা থেকেছে।
আশারাম বাপু বলেছিলেন, মেয়েটিও দায়ী। সে ‘ভাইয়া’ বলে জীবন ভিক্ষা না করে প্রতিরোধ দেখিয়েছিল, তাই ধর্ষকরা খেপে উঠেছিল। কংগ্রেসের মহিলা নেত্রী আশা মির্জে বলেছিলেন, ‘এত রাতে বয়ফ্রেন্ডের সাথে বেরোনো খুব জরুরি ছিল?’ এক নিশ্বাসে তিনি এক সুরে সমালোচনা করেছিলেন মুম্বাই-এর সেই ফোটোজার্নালিস্ট মহিলার, যিনি ফাঁকা ফ্যাক্টরিতে ছবি তুলতে গিয়ে ধর্ষিত হন। সমাজবাদী পার্টির মুলায়ম সিং যাদব বলেছিলেন, ‘ছেলেরা ভুল করে থাকে। তা বলে কি ফাঁসি দেবে? আমরা ক্ষমতায় এলে নতুন রেপ ল প্রত্যাহার করতাম।’ অর্থাৎ ভোট পাওয়ার ফিকির হিসেবে ধর্ষকের রক্ষক হওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন এ দেশের নেতারা! একে গোবলয়ের পিতৃতন্ত্র বলে দাগিয়ে দেওয়ার আগে মনে রাখা দরকার, ‘বামপন্থী’ আনিসুর রহমানও বলেছিলেন — ধর্ষিতা হলেই এখন টাকা, প্রত্যেক ধর্ষিতাকে তার ‘ফিজ’ জিগ্যেস করতে হবে।
আজও কিরণ খের একই সুরে ভিক্টিম ব্লেম করেন। ডান-অতিডান-বাম সকলেরই এই বিষয়ে এক রা। আজও। ‘Was she not asking for it?’
‘Asking for it’ লজিক আমরা সিভিল সোসাইটি ও কট্টর নারীবাদী ঘেরাটোপের বাইরে বেরোলেই ভুরি ভুরি পাব। তাই তা যে বাস্তবেই সর্বব্যাপী, তা মেনে না নেওয়া মানে মূর্খের স্বর্গে বাস করা। পাঁচ বছর এই মস্তিষ্কপ্রক্ষালনকে সম্পূর্ণ উৎখাত করার জন্য বড় কম সময়। বস্তুত, আমরা ‘ধর্ষণ সংস্কৃতি’-র মধ্যেই বাস করি। যতদিন না পুরুষ ছাড়া অন্য সব লিঙ্গের নিম্নতর সামাজিক অবস্থানের আমূল পরিবর্তন করা যাচ্ছে, ততদিন যৌন নির্যাতন বা যেকোনও লিঙ্গগত নির্যাতন সম্পূর্ণ ঠেকানো সম্ভব নয়। প্রতিটি ছোটখাটো রেপ জোক, নারীবিদ্বেষী বিজ্ঞাপন, বলিউডি ইভটিজিং-এর দৃশ্যায়ন এক্ষেত্রে আতসকাচের তলায় আসবেই — তা আপাতভাবে যতই বালখিল্য বাড়াবাড়ি মনে হোক। এই প্রতিটি উদাহরণ গুরুত্বপূর্ণ, তাদের নির্মূল করাও গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, নারীর জন্য এ পৃথিবী নির্মম বটে, কিন্তু পুরুষের জন্যও এ পৃথিবী বড় কঠিন। তার নিজের সাধের সামাজিক উচ্চতাই তাকে যেকোনও মুহূর্তে টেনে অপরাধের অতলে নামাতে পারে। কারণ পিতৃতন্ত্র ‘অপরাধ’-কে অপরাধহীনতা, এমনকি কখনও ধর্ম-কর্তব্য-প্রেম-ভালোবাসার মোড়কেও তার সামনে হাজির করতে পারে। নারীবিদ্বেষ ও লিঙ্গবৈষম্য একটি লালিত অভ্যাস, একটি সংস্কৃতি। ধর্ষণ তার চরম প্রকাশ মাত্র।
গভীরতর আত্মিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনে কাঠখড় পুড়বে বেশি, সময় লাগবে অনেক, কিন্তু আমাদের চেষ্টায় যেন গাফিলতি, ফাঁকিবাজি না থাকে। নির্ভয়ার ঘটনার পর পুলিশের জন্য নিয়মিত ওয়ার্কশপের কথা উঠেছিল। ওয়ার্কশপ হয়েছিল। ‘নিয়মিত’ হয়নি। জনসাধারণের সাথেও ‘নিয়মিত’ কনভার্সেশন দরকার। অত্যন্ত সিস্টেমেটিক। যেখানেই রেপ অ্যাপোলজি দেখা যাবে, শোনা যাবে ‘আস্কিং ফর ইট’ লজিক, সেখানেই প্রতিবাদ করা হোক। আক্রমণাত্মক ঝাঁপিয়ে পড়া সব ক্ষেত্রে কাজের নাও হতে পারে। যাদের আলোকিত করতে চাওয়া হচ্ছে, অন্ধকার তাঁরা পুরুষানুক্রমে পেয়েছেন। দু-দশ মিনিটের ঝগড়ায় তা বদলে ফেলা যায় না। বরং ঠাণ্ডা মাথায় কিন্তু দৃঢ়ভাবে তাঁদের অন্যভাবে ভাবতে সাহায্য করা যায়। শিশুদের, বিশেষ করে পুং শিশুদের শুরু থেকেই লিঙ্গনিরপেক্ষ ভাবনাচিন্তায় অভ্যস্ত করা যায়। বালিকাদের শেখানো যায়, তথাকথিত ‘ভালো মেয়ে’ হওয়ার কর্তব্য থেকে তার আজীবনের ছুটি। কমিউনিটি এডুকেশন, সেক্স এডুকেশনই এক্ষেত্রে একমাত্র পথ।
চারবছর পরে নির্ভয়ার ধর্ষকদের ফাঁসি হয়েছিল বটে, জনসাধারণ ভেবেছিল বটে, ন্যায় নেমে এল কলিকালের পৃথিবীতে। কিন্তু তা যৌন নির্যাতন বিরোধী লড়াই-এ তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য ধাপ নয় বলেই মনে হয়। মৃত্যুদণ্ডের ঠিক/বেঠিক দিকসমূহ নিয়ে আলোচনার পরিসর এটা নয়। তবে বিচ্ছিন্ন ফাঁসির ঘটনায় যৌন নির্যাতন কমেনি, কমবে না, কমার নয়। এ হল বড়জোর ‘symptomatic treatment’। অসুখের উৎস সন্ধানে আমাদের বড় অনীহা। কারণ উৎস সন্ধান করতে গেলে তো সেই মর্মমূলেই পৌঁছব, যা সংখ্যাগরিষ্ঠের সাধের অসাম্যভূমি, যাকে নারীবাদীরা পিতৃতন্ত্র বলে ডাকি।
শুধু ফাঁসি ও ক্রিনিমাল ল-ই আমাদের মাথাব্যথার কারণ না হোক। ভাবতে হবে সিভিল ল নিয়েও — ভাবতে হবে সিভিল ল কীভাবে নারীর ক্ষমতায়নে সাহায্য করতে পারে। প্রখ্যাত আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং বলেছেন, ‘Violence, the Language of Rights’ নিবন্ধে — “Civil justice is far more accessible and democratic. It enables the woman to choose her remedies, depending on her need, and have more control over her case’’. অর্থাৎ, আইনের কথাও যদি বলা হয়, শুধু ক্রিমিনাল ল নয়, সিভিল ল-কেও ঢেলে সাজানো প্রয়োজন — যাতে নারীর শিক্ষার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, কাজের অধিকার ইত্যাদি নিশ্চিত হয়। তবেই না সে পূর্ণ শক্তিতে ক্রিমিনাল ল-কে কাজে লাগিয়ে নিজের বিরুদ্ধে ঘটতে থাকা হিংসাকে প্রতিহত করতে পারবে!
সুজেট আমাদের শিখিয়েছেন, ধর্ষিতা হয়েও আত্মমর্যাদার সাথে বুক ফুলিয়ে গলার শিরা চিরে বাঁচা যায়। নির্ভয়ার পরে আমরা শিখেছিলাম কথা বলতে। ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা, কনভার্সেশন বেড়েছিল ১৬ই ডিসেম্বর, ২০১২র পর। শুধু ধর্ষণ নয়, যৌন হয়রানি, অ্যাসিড অ্যাটাক ইত্যাদি নিয়েও সার্বিক আলোচনা বেড়েছিল। এসব নিয়ে ‘আলোচনা’ অন্তত আর ট্যাবু নয়। বেড়েছিল থানায় অভিযোগের হার, যদিও তা যথেষ্ট নয়। মিডিয়ায় রিপোর্টিং শুধু বাড়েনি, ভিক্টিম-ব্লেমিং-এর দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছিল। মিডিয়ার উপর নির্ভয়া-কাণ্ডের প্রভাব নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক একটি লেখা লিখেছিলেন Connecticut-এর টিনা লাপসিয়া। তিনি দেখেছিলেন, ২০১২ সালের আগে ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ আর ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ মেলালেও ছ’মাসে পঞ্চাশটা রেপ কেসের বিশদ বিবরণ পাওয়া যায় না। ২০১২ সালের পর চিত্র বদলেছে। বদল নিছক সংখ্যাতাত্ত্বিক নয়, বদলেছে রিপোর্টিং-এর ভাষাও, কিছুটা হলেও বেড়েছে ভিক্টিমের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়ায় প্রচেষ্টা।
অর্থাৎ অনেক কিছুই যেমন হয়নি, সামান্য কিছু হয়েছেও বটে। অনেক বড় পাথর, আগেই বলেছিলাম। কিন্তু সিসিফাসের পাথর নয়। দীর্ঘমেয়াদী, সুদীর্ঘমেয়াদী কাজ বাকি। কিন্তু সব বিফলে যাওয়ার নয়।