দেবজিৎ অর্ঘ্য মুখোপাধ্যায়
উৎসর্গ : মেঘ আর মাম্মাম-কে যা বলার ছিল
যদিও ব্যাপারটা অদ্ভুত তাও, আমাদের শোওয়ার ঘরে একদল প্রেত বাদ্যযন্ত্রী দাঁড়িয়ে থাকে। পৃথিবীর ভালোবাসাতম সুর বাজিয়ে বাজিয়ে ক্লান্ত তাদের আঙুল তাদের ফুসফুস, তারা তোমার মতোই ঘামছে। এখনও আমার বীর্য তোমার জরায়ু ছোঁয়নি। এখনও আমাদের আদরের রেশ কাটেনি। এখনও সফলতম শুক্রাণু লড়াই করে জিতে নেয়নি রাণি ডিম্বাণুকে। তখনও তুমি আমাদের প্ল্যানমাফিক গর্ভবতী হওনি। তোমার জন্য হরলিক্স কেনার কথা, ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট, আয়রণ ট্যাবলেট, রোজ একটা করে ফল, শুকনো করে ঘর মোছা এসব কিছু আমার মাথায় চেপে বসতে এখনও ঢের দেরি। আমাদের সঙ্গম মিনিট পনেরো হল শেষ হয়েছে আর ঠিক পাঁচ মিনিট পর আমাদের মধ্যে থাকবে তোমার বাড়ি থেকে নিয়ে আসা তোমার প্রিয় পাশবালিশ। আমি মধ্যরাত্রে সেই বালিশে নাক ডুবিয়ে তোমার কিশোরীবেলার গন্ধ খুঁজি — যে তার নগ্ন দেহ আঁকার প্রত্যাশা করেছিল অলীক চিত্রকরের কাছে। আমি আমার আঙুলের দিকে তাকিয়ে হাসি কেননা আমি তো একটা ভালো করে গোলও আঁকতে পারি না। তবে তোমার এক পিঠ জুড়ে কবিতা লিখেছি আর মাত্র একবারই কষ্টে সৃষ্টে একজোড়া ডানা এঁকেছিলাম। তারপর আঁকড়ে ধরে জিগ্যেস করেছিলাম, “ছেড়ে যাবে না তো”। তারপর থেকে তুমি আর কোনওদিন ডানা আঁকতে দাওনি পাছে তোমায় হারানোর ভয় আবার আমায় পেয়ে বসে।
কুড়ি মিনিট বাদে সকালের আজান দেবে। আর মিনিট পঁচিশের মধ্যে আমাদের ঘর ছেড়ে চলে যাবে সেই বাদ্যযন্ত্রীর দল। তুমি ততক্ষণে তোমার স্বপ্নে ঢুকে পড়লে। তোমার স্বপ্নগুলো এখন কেমন হয়, আমাকে বলো না। অথচ সকালে চুমু খাওয়ার সময় আমি কীভাবে যেন বুঝে যাই গতরাতে তুমি ভালো নাকি খারাপ স্বপ্ন দেখেছ। আমার নিজেকে ঈশ্বর মনে হয় আর তোমাকে ঈশ্বরী। মহা ব্রহ্মাণ্ড বানানোর পর তার অনুভূতিকে ছুঁই। তোমার জরায়ুর মধ্যে ঘুমিয়ে থাকে মহা ব্রহ্মাণ্ডের রাণির ডিম্বাণু, নিষিক্তের পর যাকে আমরা ডাকব মাম্মাম বলে। মাম্মামের কড়া মা হাতে শাঁখা পরে, পলা পরে আমার মঙ্গল কামনায়। শ্যাম্পুর পর চুল শুকোলেই মাম্মামের মা আবার সিঁথি ভরিয়ে ফেলে। মাম্মাম একবার গামছা পেঁচিয়ে শাড়ি পরেছিল আর কপালে লিপস্টিক দিয়ে সিঁদুর। সারা বাড়ি সে পুরো সকাল জুড়ে তোমার অভিনয় করে গেছিল, কিভাবে আমি তুমি ঝগড়া করি, কিভাবে তুমি আমাকে বাবাই ডাকো কিম্বা মাম্মামকে পড়াতে বসলে তোমার হাত পা গুলো কেমন দেখতে হয়। মাম্মাম তোমার নকল করে “ধ্যাত” বলতে শিখেছে।
তোমার নাভির পাশে আজ কামড়ে ফেলেছি আদর করতে গিয়ে। তলপেটে চুমু খেয়েছি অনেক। চুমু খেতে খেতে দেখেছি অজস্র শিরা, চামড়া ফাটা দাগ আর শেকড় বাকড় নাভি থেকে যোনির দিকে চলে গেছে। তোমার তলপেট জুড়ে যেন এক বৃদ্ধ বটগাছ তার অভিজ্ঞতায় ঠাসা ঝুড়িগুলো ঝুলিয়ে রেখেছে। প্রত্যেকটা ঝুড়ির ভেতর আলাদা আলাদা গল্প। আমি সেসব গল্পের ওপর চুমু খাই। আদর করে ঠোঁট ঘসি। তুমি মুচড়ে ওঠো। তোমার মুখ দিয়ে ছিটকে বেরিয়ে আসে স্বরবর্ণ… আমার ডাকনাম।
আমি সেরকম এক একটা দাগের মতো দেখতে নদী এঁকেছিলাম ক্লাস নাইনের ম্যাপ পয়েন্টিং-এ। ভারতের সাদা ম্যাপ আমরা ভরিয়ে দিয়েছিলাম অরণ্য, মরুভূমি, পাহাড়, মালভূমি আর ছোট ছোট নদীতে। আমি তোমার পেটে ওরকম নদী দেখতে পাই। নদী বললে তুমি প্রথমেই খোয়াইয়ের কথা ভাবো আর আমি ভাবি আমাদের কোলকাতার পাশ দিয়ে বয়ে চলা থলথলে গঙ্গার কথা। অবশ্য আমরা হানিমুনে সমুদ্রেই গেছিলাম। জলের কথা ভাবলে আমার মাম্মামের জন্য ভয় হয়। মাম্মাম এখনও সাঁতার ভালো শিখে উঠতে পারেনি। জলের ভাষা এখনও রপ্ত করতে পারেনি। মাম্মার হাবুডুবু খেলে পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা আমিটারও কেমন দম টম আটকে আসে। আর তুমি, মেয়ে নতুন কিছু শিখছে বলে “ওরকম একটু হয়-টয়” বলে আমাকে উড়িয়ে দিচ্ছ। আমি মাম্মামকে তোমার আড়ালে শিখিয়ে দিয়েছি, কেউ যদি জিগ্যেস করে, “তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো? বাবা না মা?” তাহলে মাম্মাম যেন বলে, মা-কে, “মাম্মাম, মা এতে খুশি হবে বুঝলি”। এর উত্তরে মাম্মাম গম্ভীরভাবে “হুম” বলে। ও এই বয়েসেই খুব বুঝদার হয়ে উঠেছে। মায়ের ভালো বকা, বাজে বকা আলাদা করতে পারে। আমার কাছে শুধু মায়ের বাজে বকাগুলোরই নালিশ জানায়। “মায়েরা ওরকম একটু বকে” বলে মাম্মামকে লাই দিই। ওর মাকে আড়ালে ডেকে বলি, “মেয়েকে ওরকম বাজে বকলে কিন্তু মাম্মাম আর মা-ই ফেভারিট বলবে না”। তারপর দুম করে মাথার মধ্যে ফাটল এসব দাগ… তোমার মাম্মাম চিহ্ন… তাহলে মাম্মাম কি…
আমি আঁতকে উঠে প্রেত বাদ্যযন্ত্রীদের দিকে তাকিয়ে দেখি বিউগল বাজাচ্ছিল যে ছেলেটি তার হাঁটুর ফাঁক দিয়ে মাম্মাম আমাদের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। পৃথিবীর ভালোবাসাতম সুর তখন চরমে উঠছে। পিয়ানোবাদক ছেলেটি তার সমস্ত ভালোবাসা উপুড় করে দিচ্ছে আঙুলে, বেহালাবাদক তারের ওপর বুনছে তার ভালোবাসা সম্পর্কিত ধারণা। বিউগল বাজানো ছেলেটি “ভালোবাসা” শব্দটি বলতে যতটা শ্বাস ক্ষয় করতে হয় ঠিক ততটাই শ্বাস ক্ষয় করে বাজিয়ে চলছে বাজনা। আর এই পুরোটায় ছন্দ তাল লয় আমাদের আদরের তাল লয় ছন্দের সাথে মিলে যায়! আমার অস্বস্তি হয়, ঠাণ্ডা লাগে কাঠ হয়ে আসে শরীর। আমাদের দিকে পাঁচখানা বাদ্যযন্ত্রীর দশখানা চোখ তাকিয়ে থাকা অবধি তুমি মেনে নিয়েছিলে, কিন্তু মাম্মাম? তার বিস্ময়ে ঠাসা চোখ? এসব তোমায় বলতে আমার বাঁধে। তবু বুঝতে পারি এসব মিথ্যে। মাম্মামকে আনার জন্যই তো ডাক্তারের কথা মতো আমাদের এই সঙ্গম। বাকি কাজ প্রথাগতভাবে সারি। মাম্মাম তখন বাদ্যযন্ত্রীদের আড়ালে কী করেছিল জানা নেই ঠিক।
তুমি কোনওদিন আমাকে ওভাবে জড়িয়ে শোওনি। নিজের মুখের ওপর হাত বুলিয়ে দেখি আমার চামড়া কতটা আরও পুরু হল, আমার স্নায়ুগুলো কতটা নিচে চাপা পড়ে গেল। যাদের কেউ হয়ত কোনওদিন ফসিলের মতো তুলে আনবে না। সিঁদুর বাঁচিয়ে তোমার কপালে চুমু খাই। আমার মাথায় তখন ঈশ্বর ভর করেন। অজস্র উল্কাপাত হয়। আমি প্রত্যেক মানুষের মুখের সাথে নিজের মুখের সাংঘাতিক মিল পেতে থাকি। সবার চিবুক, চোখ, কপাল, নাক যেন একই রকমের। তাদের হাসি আর ব্যঙ্গ করার পদ্ধতিও। কুকুর পোষার শখ, দুপুরের ঘুম, জুতোর মাপ, প্রিয় মাছ, হাত খরচ, দাঙ্গার সময় ভয়, শীৎকার, ঝগড়াঝাঁটি, আনাজ কোটার পদ্ধতি সব একই রকমের। তারা প্রত্যেকে “তুমি বড় হয়ে কী হতে চাও” রচনায় একই কথা লিখেছে। এবং তারা প্রত্যেকে জানত তারা মিথ্যে কথা লিখছে। অথবা জানতই না জীবনটা এতটা একঘেয়ে আর সাদামাটা একটা বিষয়। তারা প্রত্যেকে এক জোড়া ডানা থাকলে উড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার শখ প্রকাশ করেছিল কখনও না কখনও একই শব্দ চয়ন করে, একই ভঙ্গিতে। তারা সবাই বৃষ্টির গন্ধ খুব ভালো লাগে বলেও একটানা বৃষ্টির পর একইভাবে বিরক্ত হয়েছে, কখনও না কখনও কোনও না কোনও প্রেমের কবিতা পড়ে ভেবেছে এটা যেন তার জন্যই লেখা, কোনও না কোনও উপন্যাসের চরিত্রের সাথে নিজেদের মিল খুঁজতে গিয়ে বেকুব বনেছে। প্রত্যেকেই মেলা থেকে বুড়ির চুল কিনে বাড়ি ফিরেছিল, প্রত্যেকেই একইরকমভাবে কখনও না কখনও যৌন নির্যাতিত। অদ্ভুতভাবে তারা সবাই হঠাৎই চুপ করে যায়। যেন তাদের কিছু বলার নেই। সব কথা যেন ফুরিয়ে ফেলেছে তারা। এমনকি তাদের নতুন করে শোনারও কিছু নেই। পৃথিবী জুড়ে নেমে আসে অখণ্ড নিস্তব্ধতা। আমি নিস্তব্ধতাকে অপেক্ষা করতে করতে ঘেমে যেতে অবধি দেখেছি। নিস্তব্ধতার রুমালের রঙ খয়েরি। তার ঘাম মোছার ভঙ্গিও আদবকায়দাহীন। তার অপেক্ষা করার পদ্ধতিও সাদামাটা। নিস্তব্ধতা একত্রিশে ডিসেম্বরের সন্ধেতে যাদবপুর এইট বি-র মোড়ে মদ খেয়ে চিৎকার করে বলে, মেঘ আমি তোমাকেই ভালবাসি। তারপর আমি নিস্তব্ধতাকে হেঁটে যেতে দেখেছি টলতে টলতে যাদবপুর স্টেশনের দিকে। আজ তার আত্মহত্যা করার কথা ট্রেনের সামনে ঝাঁপিয়ে — এরকম কথাই সে বলেছিল মেঘ-কে। নিস্তব্ধতা বুঝতে পারে না সে মেঘ-কে কথা দিয়ে ফেলেছে কি না, যে সে এভাবেই আত্মহত্যা করবে। নিস্তব্ধতা কাটা পড়লে ট্রেন চলাচল ব্যাহত হবে। অফিসফেরতা মানুষগুলোর বাড়ি ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। তাদের জন্য অপেক্ষা করবে কেউ। তারপর নিস্তব্ধতার লাশ এসে কুড়িয়ে নিয়ে যাবে ডোম। নিস্তব্ধতা এত মানুষকে ভোগান্তি দিতে চায় না। সে ঠিক করে মধ্যরাত্রে মেল ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেবে। নিস্তব্ধতার লাশ কেটে মানুষ ঘুরতে যাবে, সকালের খবর যাবে, মানুষকে লেখা মানুষের গুটিকয় কথা যাবে, মধ্যরাত্রে নিস্তব্ধতার শুকিয়ে যাওয়া রক্ত শুঁকে দেখবে ক্ষুধার্ত কুকুর। একসময় নিস্তব্ধতা ভাবে সে মেঘকে কথা দিয়েছিল মেঘের জন্য বাঁচবে… মেঘের সাথে বাঁচবে। এরপর আমরা এক আত্মহত্যাবিমুখ নিস্তব্ধতাকে বাড়ি ফিরে আসতে দেখি ঘামতে ঘামতে। সেই সন্ধেতে নিস্তব্ধতার বদলে তার খয়েরি রুমাল আত্মহত্যা করে। ট্রেনের সামনে ছুঁড়ে দেয় সে তার খয়েরি রুমাল আর ক্লান্ত ট্রেনচালক ভাবেন কেউ তাকে রুমাল নেড়ে অভিবাদন জানাল। এরকম নিস্তব্ধতা যেন সবাইকে পেয়ে বসেছে যাদের একইরকম দেখতে, যাদের আবহাওয়াও একইরকমের, জলবায়ু ঘ্যানঘ্যানে আর কখনও সখনও আলটপকা। সব মানুষ নিশ্চল, নির্বিকার দাঁড়িয়ে পড়েছে। তারা যেন নিস্তব্ধতার দাস। মাথা যেন মূর্তি তৈরি কারখানার গুদাম, এরকমটা অনেকক্ষণ ধরে চলে। তারপর আসতে আসতে খিলখিলে হাসির শব্দ শুনতে পাই, একটা না দুটো। শব্দ ক্রমে আমার দিকে এগিয়ে আসে। এই যেন ছুঁয়ে ফেলবে আর হুশ করে দেবে। আমি ধাপ্পা দেওয়ার ফুরসতটুকুও পাব না। এক সময় দেখি মাম্মাম তোমার সাথে লুকোচুরি খেলছে। সেই নিশ্চল মূর্তিগুলোর আড়ালে মাম্মাম লুকোচ্ছে আর তুমি তাকে খোঁজবার ভান করছ। এরকমটা অনেকক্ষণ ধরে চলে। আমি দূর থেকে সব দেখি, হাসি একা একাই। স্বপ্নের শেষ দিকে এসে আবিষ্কার করি সমস্ত কটা মূর্তি আমার মতোই দেখতে আর তুমি কিছুতেই আমাকে চিনতে পারছ না, মাম্মামও না। আমি চিৎকার করে বলি, “আমি এই তো, এইখানে”। তোমারা যেন আমায় শুনতে পাও না, দেখতে পাও না, নিজেদের খেলাতেই মত্ত। তোমাদের যেন এখনও অনেক খেলা বাকি থেকে গেছে। তোমার কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলি, “কি গো আমায় দেখতে পাচ্ছ না? সেই কখন থেকে ডাকছি…”। যেন কিছুই হয়নি, কিছুই হচ্ছে না, আমার মধ্যে দিয়ে তুমি চলে যাও মাম্মামকে খোঁজার ভান করতে করতে। আমার দিকে তাকিয়ে আমারই মতো দেখতে লক্ষ লক্ষ মূর্তি ব্যঙ্গের হাসি হেসে ওঠে। আমার দিকে তাকিয়ে আমারই মতো দেখতে তোমাদের প্রভু নিস্তব্ধতা হো হো করে হেসে ওঠেন যিনি একত্রিশে ডিসেম্বর সন্ধেবেলা যাদবপুর এইট বি-র মোড়ে চিৎকার করে বলেছিলেন, মেঘ আমি তোমাকেই ভালবাসি। যার মতো আমাকে দেখতে, সেই আমিই আজও স্খলন মুহূর্তে চিৎকার করে উঠি…