মশা-মাছির শহরে

গৌরব বিশ্বাস

 

কবি ঈশ্বর গুপ্ত সেবার কাঁচড়াপাড়ার বাড়ি থেকে কোলকাতায় এলেন মামার বাড়ি বেড়াতে। তখনও তিনি ‘কবি’ হননি। নিতান্তই নাবালক। মামাবাড়ি এসেই কাঁপুনি দিয়ে ধুম জ্বর। খুব সম্ভবত ম্যালেরিয়া। তখনও এ শহরে ডেঙ্গি, চিকুনগুনিয়ার আমদানি হয়নি। পীড়াগ্রস্ত নাবালক ঈশ্বর, বিড়বিড়িয়ে ছড়া কাটেন -– “রেতে মশা দিনে মাছি/এই তাড়য়ে কলকাতায় আছি”। সেই তাঁর কাব্যপ্রতিভার প্রথম স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। সেই সাথে কবিসুলভ দূরদৃষ্টিরও আত্মপ্রকাশ বটে। নাবালক ঈশ্বর গুপ্ত কী অবলীলায় অনুমান করেছিলেন আগামী দুশো-অধিক বছরের নগরবাসীদের পরাণকথা।

***

মহেন্দ্রনাথ দত্ত যখন এ শহরে জন্ম নিলেন, ঈশ্বর গুপ্ত ততদিনে গত হয়েছেন প্রায় এক দশক হবে। স্বামী বিবেকানন্দের মধ্যম ভ্রাতাটি তাঁর বাল্য স্মৃতিচারণায় লিখছেন — “কলিকাতার চারিদিকে নালা, পগার ও নর্দমা ছিল এবং চারিদিকে বাঁশঝাড়, কেলে হাঁড়ি ও আবর্জনা পড়িয়া থাকিত; এইজন্য গর্মিকালে অতিশয় মাছির প্রাদুর্ভাব হইত। গর্মিকালে বিশেষতঃ আমের সময় মাছি খাইয়া প্রায় বমি হইত এবং রাত্রিতে মশার উৎপাতও খুব ছিল…।”

এ সব বহুকাল আগের কথা। ব্রিটিশরা অনেককাল হল এদেশ থেকে ভেগেছে। শহরে রাজনৈতিক পালাবদলও হয়েছে। গঙ্গার জল কমেছে। দূষণ বেড়েছে। দিনকয়েক পর তার পেটের ভিতর দিয়ে টিউবরেলও ছুটবে। কিন্তু মশা-মাছির যাত্রাপালা কিস্যুটি বদলায়নি। এ শহরের অতীতের দিকে ফিরে তাকালে এই ধারণাই প্রকট হয়।

***

আজও যেমন এ শহর মৃত্যুপুরী, সেদিনও ছিল তাই। যে শক্তসমর্থ ইংরেজ যুবক দু পায়ে হেঁটে শহরে পদার্পণ করল, বছর ঘুরতে না ঘুরতেই চার কাঁধে চেপে কফিনবন্দি হয়ে চলল মাটির তলায়। বছরের কোনও এক নির্দিষ্ট দিনে, সাহেবরা জড়ো হতেন, কতজন থাকল আর কতজন গেছে তার হিসেব রাখতে। তারপর নাচা-গানা, খানা-পিনায় বেঁচে থাকাকে সেলিব্রেট। কে জানে আগামী দিনে কার জন্যে জারি হবে মরণের পরোয়ানা! সেদিন মৃত্যুপুরীর মৃত্যুমিছিলে ম্যালেরিয়া আর কলেরাই ‘লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট’। কলেরা যেন ম্যালেরিয়ার বড় দাদাটি। জীবনের উপর তারই অগ্রাধিকার। সাহেবরা বলে কলেরা। নেটিভদের ভাষায় ‘ওলাউঠা’। সাহেবরা যা মরে, নেটিভরা মরে তার কয়েক গুণ। সেদিনের দৈনিকিগুলো ঘাঁটলে, “ …এই সপ্তাহে গড়ে প্রতিদিন চারি শত করিয়া লোক মরিতেছে…” এমন সংবাদ একেবারেই অপ্রতুল নয়। নেটিভদের ওলাউঠার সাথে হল সতীদাহের বাড়বাড়ন্ত। সেদিন অনেক অসহায়া সহমৃতা হয়েছিলেন তার ওলাউঠায় মৃত স্বামীর চিতায়। সেই সময়কার এক বাংলা দৈনিক লিখছে — “সিমল্যানিবাসি ফকিরচন্দ্র বসু ১ ভাদ্র সোমবার ওলাওঠা রোগে পঞ্চত্বপ্রাপ্ত হইয়াছেন। ইহার বয়ঃক্রম প্রায় ৩৬ বৎসর হইয়াছিল। তাঁহার সাধ্বী স্ত্রী শ্যামবাজারনিবাসি শ্রীমদনমোহন সেনের কন্যা। তাঁহার বয়ঃক্রম ন্যূনাতিরেক ২২ বৎসর হইবেক এবং সন্তান হয় নাই। ঐ পতিব্রতা স্ত্রী রাজাজ্ঞানুরোধে দুই দিবস অপেক্ষা করিয়া বুধবার প্রাতে সুরের বাজারের নিকট সুরধুনী তীরে স্বামিশবসহ জ্বলচ্চিতারোহণপূর্ব্বক ইহলোক পরিত্যাগ পুরঃসর পরলোক গমন করিয়াছে।”

সেবার এক সাহেব কোলকাতায় এসে হোটেল খুলে বসলেন বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে। হোটেল ঠিক বলা চলে না, ওই সরাইখানা গোছের আর কি। কোনওরকমে এক রাত্রি কাটানোর জন্য চলনসই। সেই সরাইখানাতেই রাত্রিবাস করতে এসে এক ইংরেজ কর্মচারী লিখলেন — “… while the butter’s melting, the flies eat up the cake.” মাছির উৎপাত বোঝাতে একেবারে মোক্ষম উপমা। এমন মশা-মাছি তৎসহ কলেরার মতো জলবাহিত রোগের তাণ্ডবের অন্যতম কারণ যে শহরের অপরিচ্ছন্নতা, অনুন্নত নিকাশি ব্যবস্থা সে কথা সহজেই অনুমেয়। সাহেবরা যখন এ শহরে প্রথম এলেন, তখন তাঁরা একটা  নিকাশি ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন বৈকি। ক্রমে এ শহরে ভিড় বাড়তে লাগল সাহেবদের। এ শহরে যেমন সহজেই দুপয়সা কামানো যায়, এ দেশের অন্য কোনও শহরে তেমন সুযোগ নেই। নিজের দেশে কাঠ বেকার ইংরেজ যুবক পাড়ি জমাল এ শহরে। আর কিছু না হোক, কোম্পানির অধীনে একটা কেরানির চাকরি তো পাকা। সাথে ভদ্রস্থ মাইনে। অর্থান্বেষীদের ভিড়ে নিকাশি ব্যবস্থার বেহাল দশার সেই শুরু। এক ইংরেজ তরুণী এসেছিলেন এ শহরে। মনে হয় দিন কয়েকের জন্য বেড়াতে। তিনি তার ইংল্যান্ডস্থিত প্রেমিককে চিঠিতে লিখছেন — “Vile lane whose odour makes me sick”। তবে তিলোত্তমার পূতিগন্ধময় সে অতীতের চরমতম একটি নিদর্শন লিখে রেখেছেন জনৈক ইংরেজ সাংবাদিক। এ শহরে তখনও কলের জল আসেনি। তবে সাহেবপাড়ায় পানীয় জলের ব্যবস্থা ছিল। সে জল আসত লালদীঘির ট্যাঙ্ক থেকে। সেদিন ভোরে এই সাহেব পালকি চেপে বেরিয়েছিলেন প্রাতঃভ্রমণে। তখন এপ্রিল মাস। বেজায় গরম। লালদীঘির ধারে পালকিতে বসে সাহেব দিব্যি উপভোগ করছিলেন ভোরের স্নিগ্ধ মলয় বাতাস। কিন্তু তারপর যা দেখলেন, তাতে তার গা ঘিনঘিন করে উঠল। কি দেখেছিলেন সাহেব? সাহেব লিখছেন — “As I was jogging along in my palanqueen yesterday, I could not avoid observing without a kind of secret concern for the health of several of my tender and delicate friends, — a  string of parris dogs, without an ounce of hair on some of them, and in the last stage of manage, plunge in and refresh themselves very comfortably in the great Tank…”।

দুর্দশাগ্রস্ত নিকাশি নিয়ে, এদিনের মতো সেদিনও সরব হয়েছিল ইংরেজি-বাংলা দৈনিকগুলো। কোনওবার লাট-বড়লাটের টনক নড়েছিল। কিন্তু বেশি ক্ষেত্রেই তাঁরা ‘স্পিকটি নট’।

এভাবেই কলেরা মাসকয়েক হত্যালীলা চালিয়ে, নেটিভ, সাহেবদের কাঁদিয়ে বিদায় নিত। তার আগে নরনিধনের গুরুদায়িত্বটি অর্পণ করত তার অনুজ ম্যালেরিয়ার হাতে। কলেরা-ম্যালেরিয়ার এমনতর ভ্রাতৃত্বের সাক্ষী সেকালের ‘সমাচার দর্পন’ -– “শহর কলিকাতায় জ্বররাজ রাজ্য করিবার বাসনায় সমাগমন করিয়াছেন কিন্তু তাহার সমভিব্যহারে অধিক সৈন্য নাই কেবল প্রবল এক সৈন্য আছে সে শরীর মধ্যে প্রবেশ করিয়া স্বীয় ক্ষমতাতে অস্থিচূর্ণ করে, তাহাতেই জ্বররাজ অতিসন্তুষ্ট আছেন অন্যান্য সৈন্যেরদিগকে আহ্বান করেন না… পূর্ব্বে ওলাউঠা রোগরাজ এই রাজধানীতে স্বীয় সৈন্য সান্নিপাতাদি সঙ্গে লইয়া আসিয়াছিলেন এবং রাজ্যও বিলক্ষণ রূপে করিয়াছিলেন… এক্ষণে কালবলে তিনি কালপ্রাপ্ত হইয়াছেন অতএব জ্বররাজ বিরাজমান হইয়া স্বীয় শীলতা প্রচারে রাজ্য করিতে আসিয়াছেন…।”

সেদিনের মশককুলের যেন নেটিভদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব ছিল। নেটিভদের চেয়ে সাদা চামড়ার মানুষরাই তাদের প্রথম পছন্দ। ম্যালেরিয়ায় মরত কম নেটিভরা। কিন্তু সাহেব জ্বরাক্রান্ত হয়ে শয্যা নিয়েছেন মানে, সে তার অন্তিম শয্যা। শহরের নামকরা মৃত্যুকারবারী ওল্ডহ্যাম সাহেবের কাছে ততক্ষণে অর্ডার পৌছে গিয়েছে কফিন বানানোর। এখানেই বলে রাখি, স্বয়ং জোব চার্নক মারা গিয়েছিলেন ম্যালেরিয়ায়। সেবার পার্কস সাহেব (Charles Crawford Parkes) ব্রিটিশ সরকারের উচ্চপদের দায়িত্ব নিয়ে পা রাখলেন এ শহরে। সাথে স্ত্রী ফ্যানি। মাসকয়েক কাটতে না কাটতেই সাহেবের ধুম জ্বর। প্রায় যায়-যায় অবস্থা। অনেক ডাক্তার-বদ্যির পর তিনি সে যাত্রায় বেঁচে গেলেন। স্ত্রী ফ্যানির ডায়রিতে ধরা পড়েছে রোগজীর্ণ স্বামীর স্বাস্থ্যের প্রতি তাঁর উৎকন্ঠা — “In July, my husband was seized with one of those terrific Indian fevers, which confined him to his bed about fourteen days; he got up looking very transparent and ghostlike, and in a state of great debility, from which he was some time in recovering. Happily, he was saved from a premature epitaph.”

প্রাণঘাতী ম্যালেরিয়ার থেকেও সাহেবরা তখন তিতিবিরক্ত মশার ভনভনানি আর জ্বালাময়ী দংশনে। এক ইংরেজ সৈন্য নাকি মশা মারতে সত্যিই সেদিন কামান দেগেছিলেন! প্রায় সব সাহেব-মেমের ডায়েরিতে বা চিঠিপত্রে কোলকাতার কথা লিখতে গিয়ে অবশ্যম্ভাবীভাবে উঠে এসেছে এ শহরের মশার কথা। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য সাহেবরা এদেশে এসে বেশ কয়েকবছর ঠাহর করেতই পারেননি, মশা আর মাছি দুই আলাদা পতঙ্গ। ওঁরা বলত ‘flies’। উড়ে বেড়ায়, তাই অমন নাম। অনেকে তো আবার মশা মাছিকে বিচিত্র প্রজাতির জন্তু ঠাওরেছিলেন। এই যেমন এমিলি ইডেন (এনার নামেই ইডেন গার্ডেনস) কোলকাতা থেকে চিঠিতে বান্ধবীকে লিখছেন — “Nobody can guess what these animals are till they have lived among them”। মশার কামড় থেকে বাঁচতে লাট-বড়লাটের বাড়িতে টানা পাখার বন্দোবস্ত হল। পয়সাওয়ালা সাহেবরা মশা তাড়াতে মাসমাইনে দিয়ে চাকর রাখলেন। মশার আক্রমণে ক্রুদ্ধ ডয়লি সাহেব (Charles D’oyly) তাঁর মশককুলের প্রতি আক্রোশ মেটালেন নেটিভদের উপর। মশার এহেন আক্রমণের জন্য নেটিভদেরই দুষলেন তিনি — “The mosquitoes may be heard towards sunset ‘swarming into the homes of Europeans in full chorus, humming as loud as a stocking weaver’s loom. The natives rarely cook their victuals before that time, when the smoke drives away the mosquitoes: then, getting on the wing, they throng towards the quarter occupied by Europeans principally.”

কর্নেল ইয়ং মশাকে নিয়ে ছড়া বাঁধলেন -– “Oh, the pleasure of the plains’/In Bengal, and the Rains,/When the climate, damp and warm,/Makes our tiny tribes to swarm,/From each puddle, from each tank,/Fringed with vegetation rank…”

কোলকাতার স্পেন্সেস হোটেল (এখন যেখানে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল) থেকে নাকি প্রতি সকালে এক গরুর গাড়ি বোঝাই মশা মাছির শবদেহ বার করা হত। একথা আমাদের শুনিয়েছেন হবস সাহেব (Major H. Hobbs)।

মশার আক্রমণে লাট-বেলাট থেকে সাধারণ সাহেব কেরানি সবাই নাস্তানাবুদ। অথচ ইতিহাস বড় বেইমান। সে মঙ্গল পান্ডের কথা লেখে। নানাসাহেব, তাতিয়া টোপির বীরগাথা গায়। কিন্তু এঁদের ঢের আগে লালমুখো সাহেবদের বিরুদ্ধে মশককুলের নিঃশব্দ বিপ্লবের কথা বেমালুম চেপে যায়!

ক্রমে এ শহরের অনেক বদল হল। কলের জল আসার পর কলেরা পাকাপাকিভাবে বিদায় নিল এ শহর থেকে। সাহেবদের শরীরও ম্যালেরিয়ার সাথে যুঝতে শিখে গেল। জ্বর নিরাময়ের জন্য শহরে হাসপাতাল তৈরি হল। রোনাল্ড রস এ শহরেই ম্যালেরিয়ার প্যারাসাইট আবিষ্কার করলেন। ম্যলেরিয়ায় মৃত্যু অনেকাংশে কমল। কিন্তু পিলের জ্বর (ম্যালেরিয়ার জ্বরবাবা পালা করে আসত বলে, অনেকে একে পালার জ্বরও বলতেন) আর মশককুল ডিসপেপসিয়ার মতোই ‘বঙ্গ জীবনের অঙ্গ’ হয়ে রইল। সুকুমার রায় ‘সৎপাত্র’ গঙ্গারামের গুণকীর্তন বর্ণনে লিখলেন — “গঙ্গারাম তো কেবল ভোগে/পিলের জ্বর আর পাণ্ডু রোগে”। পটলডাঙ্গার বিখ্যাত প্যালারাম বাঁড়ুজ্যেও পালার জ্বরে ভোগে আর পটল দিয়ে শিঙিমাছের ঝোল খায়। অবশ্য ততদিনে এ শহরে আমদানি হয়েছে ডেঙ্গির। ১৯২৯-৩০ সাল নাগাদ সাহিত্যিক পরশুরাম লিখলেন ‘রাতারাতি’। জাঁদরেল বাপ চরণ ঘোষ তার ছেলে কার্তিকের বিয়ে দিতে চায় রাখাল সিংগির মেয়ে নেড়ীর সাথে। কিন্তু কার্তিক এ বিয়েতে নারাজ। চরণ ঘোষও নাছোড়বান্দা। অবশেষে কার্তিক গৃহত্যাগী হল। পৈতৃক জুলুমের বিরুদ্ধে একটা ভয়ংকর কিছু করতে চায় সে। চুরি, খুন, ডাকাতি ভয়ংকর কিছু একটা। শেষকালে কার্তিক চৌর্যবৃত্তিকেই বাছল। মুরগিহাটা থেকে ছ-আনা দামের পিস্তল কিনে এক সন্ধ্যায় ঢুকে পড়ল বৃ্দ্ধ গোবিন্দবাবুর বাড়িতে। অন্ধকারে টেবিলে ধাক্কা খেয়ে যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল কার্তিক। বৃ্দ্ধ গোবিন্দবাবু রসিকতার সুরে প্রশ্ন করেন — “তোমারও বাত নাকি?” কার্তিক বলে — “উঁহু, মাস-দুই আগে ডেঙ্গু হয়েছিল, তারপর থেকে মাঝে মাঝে একটুতেই খিল ধরে…।” গোবিন্দবাবু উপদেশ দিলেন -– “…দিন কতক তুলসীপাতার রস দিয়ে কুইনিন খেয়ে দেখো দিকি, ভারী উপকারী। যদি এ সময় পুরী কি দেওঘর গিয়ে থাকতে পারো তো আরও ভালো।”

অতঃপর ডেঙ্গু–ম্যালেরিয়া-আমাশায় ভোগা রোগক্লিষ্ট মধ্যবিত্ত ইংরেজী শিক্ষিত স্বাস্থ্যান্বেষী বাঙালি মোটঘাট বেঁধে রাতের ট্রেনে সপরিবারে রওনা দিলেন এ শহরের পশ্চিমে হাওয়া বদলাতে। লক্ষণীয়, ‘চিত্রচোর’ উপন্যাসে অসুস্থ ব্যোমকেশও স্বাস্থ্যোদ্ধারের আশায় সত্যবতী, অজিত সমভিব্যহারে পাড়ি জমিয়েছে পশ্চিমে। সেখানকার জল-হাওয়া উত্তম। কয়েকমাস কাটালে রুগ্ন শরীরে নেয়াপাতি ভুঁড়ি গজায়। দুধ, ডিম, মুরগি বেজায় সস্তা সেখানে। মধ্যবিত্ত বাঙালি তো বেজায় খুশি। দেহাতিদের হাট বাজার দেখে সে কেবলই বলে -– “ড্যাম চিপ! ড্যাম চিপ!” স্থানীয় লোকেরা অত ইংরেজী বোঝে না। বাঙালি বাবুর মুখনিঃসৃত ‘ড্যাম চিপ’, তাদের কথায় ‘ড্যাঞ্চি’’। বাঙালিবাবুও বনে যান ‘ড্যাঞ্চিবাবু’। তারপর কোনও একদিন হাওয়া বদলাতে আসা দুই বাঙালি পরিবারের দেখা। তারপর আলাপ পরিচয়। মধ্যাহ্নভোজে বা চায়ের আসরে তাদের নিত্য যাতায়াত। সবার অলক্ষ্যে ‘ওই’ পরিবারের কন্যেটিকে ‘এই’ পরিবারের যুবকটির একটু একটু ভালো লাগা। তারপর কোনও হেমন্ত বিকেলে চারি চক্ষুর আশ্লেষে আবদ্ধ হওয়া। এমন প্রেমকাহিনী বাঙালি কবি-সাহিত্যিকদের কলমে বয়ে এনেছে ফল্গুধারা। মশককুল এসময়-সেসময় সব সরকারকেই কাঁদিয়ে ছেড়েছে ঠিকই কিন্তু তেনারা সাহেবদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছেন, লাট-বেলাটদের নাস্তানাবুদ করেছেন, সাহিত্যকে সমৃদ্ধও করেছেন। তাই তেনাদের একেবারে অবজ্ঞা করা উচিত নয়। মশারা একেবারেই অকাজের, মানুষ নিধনই ওদের একমাত্র কাজ, এমনতর একপেশে বিচার কি ঠিক? আপনারাই বলুন!

ঋণ স্বীকার:

Echoes from old Calcutta, H.E. Busteed, 2nd edition, 1888 (দ্রষ্টব্য — ‘home and social life’ অধ্যায়টি)

John Barleycorn Bahadur : Old time taverns in India, Major H. Hobbs। এই বইটা প্রসঙ্গে বলি, কোলকাতার পুরনো দিনগুলিকে যারা ছোট ছোট ঘটনা, চিঠিপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে জানতে চান এ বই তাদের অবশ্যপাঠ্য। আমার নিবন্ধটির বেশ কিছু ঘটনা, বিশেষ করে, ম্পেন্সেস হোটেল থেকে মশার শবদেহ বার করা, মশার প্রতি ডয়লি সাহেবের আক্রোশ এসব এ বই থেকেই পাওয়া।

Wanderings of a pilgrim, in search of the picturesque, during four-and-twenty years in the East; with revelations of life in the Zenana, vol-I, Fanny Parkes। এই বইটির একটি দ্বিতীয় খণ্ডও আছে। দুটি খণ্ডই দুর্দান্ত। সেকালের লোকজন থেকে, পোকামাকড় সবকিছুকেই ফ্যানি ডায়েরিবন্দি করেছিলেন।

The Bengal Annual a literary keepsake, edited by David Lester Richardson, 1830 edition। মশাকে নিয়ে ইয়ং সাহেবের লেখা ছড়ার অংশটি এই বই থেকে পাওয়া। কবিতাটির নাম — ‘The mosquito’s song’।

‘সমাচার দর্পণে’র প্রতিবেদনগুলোর জন্য — বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত শ্রীব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলিত ও সম্পাদিত ‘সংবাদপত্রে সেকালের কথা’ বইটির তিনটি খণ্ড দ্রষ্টব্য।

মহেন্দ্রনাথ দত্তের ‘কলিকাতার পুরাতন কাহিনী ও প্রথা’ এই বইটি সেকালের নগরবাসীদের জীবনযাত্রার এক অমূল্য সম্পদ। মাত্র ১০৪ পাতার বই, কিন্তু চমকে দেওয়ার মতো সব তথ্য। বইটির প্রকাশক — ‘দি মহেন্দ্র পাবলিশিং কমিটি’। খুবই সহজলভ্য বই।

নিবন্ধের শুরুতেই উল্লিখিত “রেতে মশা দিনে মাছি/এই তাড়য়ে কলকাতায় আছি” এই লাইন দুটি নিয়ে অনেক মতভেদ আছে। অনেকে বলেন — “রাতে মশা দিনে মাছি/এই লয়ে কলকাতায় আছি”। তবে আমি এই লাইন দুটি পেয়েছি ‘ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত গ্রন্থাবলী’র (১ম ও ২য় ভাগ একত্রে) বসুমতী সংস্করণের ভূমিকায়। এই ভূমিকা লিখেছিলেন বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

কলকাতা, শ্রীপান্থ, আনন্দ পাবলিশার্স, নবম মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০১৪।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...