উদ্বাস্তু

মৃন্ময় প্রতিহার

 

এতদ্বারা………. বিডিও অফিসের পক্ষ হতে…………. সমস্ত…… আসছে…….. যত শীঘ্র সম্ভব……… নিরাপদ স্থানে………. সাবধান, সাবধান……..

মাইকের কথাটা কানে যেতেই একছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে বাঁধে উঠে এল মঙ্গল। ইস্কুল যায়। সব কথা না বুঝলেও খানিক খানিক বোঝে। কে আসছে? সাবধান কথাটার মানেও বোঝে। খারাপ কিছু হলে সাবধান করে লোকে। কী খারাপ?

বাঁধে উঠে দেখে মাইক গাড়িটা দূরে চলে গেছে। অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসছে তখনও। সাবধান… সাবধান। বাঁধে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। সবার নজর নদীর দিকে। বর্ষার নদী ফুলে উঠেছে। ঘোলা জলের ঘূর্ণি নিয়ে জল ছুটে চলেছে। কত লোক পাড়ে দাঁড়িয়ে কলিজাল পেতে মাছ ধরছে। মাছ উঠছে ভালোই। মাছধরা দেখতে খুব ভালো লাগে মঙ্গলের। খুব। শুধু দেখতেই ভালো তা নয়। নদীতে মাছ উঠলে পাতে ভাতের সঙ্গে মাছও পড়ে। তাদের ঘরে মাছ আসে এসময়টাতেই তো। তার বাপও মাছ ধরে। ঘরে তিন চার রকম জাল, ঘুনি এসব আছে। মঙ্গল নিজেও যায়। ঘুনি ঝাড়তে। সে অন্য সময়। জল কম থাকলে। এখন ভরা নদী। ছোটদের যাওয়া মানা।

তার বাপও মাছ ধরতেই গিয়েছিল। মঙ্গল তার বাপকেই খুঁজছিল। ছোটছোট জটলা। লোকে নদীর দিকেই চেয়ে। একটা কথা মঙ্গলের কানে আসছিল। বান। বান আসছে। দু চারজন নদীতে তখনও জাল ফেলে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে তার বাপ নেই। খোঁজাখুঁজি করে বাঁধের ওপরেই দেখতে পেল বাপকে। জাল হাতে নিয়ে একটু তফাতে একা দাঁড়িয়ে আছে। নজর নদীর দিকে। ছুট্টে গিয়ে বাপের হাত টেনে ধরে বলল, বা, কে এসচে?? বান? বান কী বা? বলো না, কে এসচে? ওই যে ওরা বলে গেল। ও বাবা….

অন্যমনস্ক তার বাপ বুধন আচমকাই খিঁচিয়ে ওঠে। হ্যাঁ, তোর বাপের সুমুন্দি এসচে।

মঙ্গল দমে যায়। অবাক হয়ে তাকায় ক্রুদ্ধ বাপের মুখের দিকে। হঠাৎ এ রাগের কারণ বুঝতে পারে না সে। তার অভিমানাহত মুখটার দিকে চেয়ে বুধন বলল, ঘর চল।

ছেলের হাত ধরে বাড়ি ফিরে আসতে থাকে বুধন। মাছ পাউনি? ছেলের কথা কানে ঢোকে না তার। চার বছর আগের কথা মনে পড়ে তার। মঙ্গলের বয়স তখন আড়াই তিন। বান এসেছিল। তাদের ঘর ডুবেছিল। ছিটেবেড়ার মাটিলেপা ঘর। ডোবা মানে ধুয়ে যাওয়া। চিহ্ন থাকে না। তাই হয়েছিল। রাতারাতি প্রাণটুকু নিয়ে বাঁধের উপর উঠে এসে বেঁচেছিল সপরিবার। আগাম কিছু জানতেও পারেনি সেবার। উত্তরে গঙ্গাপুরে বাঁধ ভেঙেছিল, জল হু হু করে ঢুকে এক রাত্তিরে সব ভাসিয়ে দিয়ে গেল। ঘর, বাড়ি, পুকুর, জমি, ফসল, মানুষের জীবিকা, আরও অনেক কিছু। রাতের অন্ধকারে বাঁধের ওপর। যেটা নিজেও খুব একটা ভরসার নয়। জলের তোড়ে ভেসে যেতে পারে সেও। বুধন জানে। কিন্তু উপায়!! তার মতো বাঁধের উলটো ঢালে যাদের ঘর, সবাই উঠে এসেছিল বাঁধে। গ্রাম থেকে বানভাসি লোকজনও এসেছিল। লোক বাড়লে ভরসা বাড়ে। না, এত লোককে নিয়ে এখানে বাঁধ ভাঙবে না। ভাঙেওনি।

প্রায় তিনদিন অনাহারে কাটানোর পর খাবার জুটল, পঞ্চায়েতের চিঁড়ে গুড়। জল আনতে হয়েছিল পলিথিনে করে পাঁচমাইল দূর থেকে। বন্যায় খাবার তবু মেলে, জল মেলে না সহজে। বাইরে থেকে যারা খাবার দাবার আনে বোধহয় জলে জল ভেবে আর খাবার জলের কথা মাথায় রাখে না। সত্যি, এত জল, খাবার জন্য একফোঁটাও মেলে না। জলই জীবন, জলই মরণ। বাধ্য হয়ে মানুষ নোংরা জলই খায়। বন্যায় না ভাসলেও পেটের অসুখে মরে।

ওদিকে বিসুয়া দাঁড়িয়ে ছিল জটলার মধ্যে। বুধনকে ডেকে বলল, এ বুদুন, কী করবি? বিডিও থেকে সবাইকে তো চলে যেতে বলল, ইস্কুলে দোতলায়।

বুধন বলল, কত ধুরে বলল?

আজ সুন্ধে নাগাত চলে এসবে বলচে। তার আগেই…

ইস্কুলে কত লোকের জাগা হবে?

ওইজন্যেই তো বলচি। তাড়াতাড়ি গেলে জ্যায়গা পাবি।

তাড়াতাড়ি ছেলেকে নিয়ে ফিরে আসে বুধন। বৌকে বলল ঘরের জিনিস কটা বেঁধে নিতে। ইশকুলে যেতে হবে। বান আসছে।

ওই স্কুলেই ক্লাস টুয়ে পড়ে মঙ্গল। মায়ের বাঁধাছাঁদায় হাত লাগায় সেও। একবার বলল, আমরা ইস্কুল ঘরে যাব? ওখেনে থাকব? ভালই হবে। বেশ পাকা ঘর। বলো মা? আচ্ছা, আমাদের ইস্কুল হবেনে আর?

ওর মা বলল, পড়ে দিগগজ হবি একেকটা….

হ্যাঁ, মঙ্গলদের স্কুলটা দোতলা। ওর দোতলাটা ফাঁকা করে ওদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ব্যবস্থা মানে মেঝেতে কালো ত্রিপল পেতে দেওয়া হয়েছে। পঁয়তিরিশটি পরিবারের শতাধিক লোক গাদাগাদি করে অপেক্ষা করছে। বানের। চার বছর আগেই নতুন করে তৈরি করা ঘরের ভেসে যাবার খবরের। সরকারি চিঁড়ে, গুড় ত্রিপলের। আন্ত্রিক, কলেরার। নেতাদের ঘুরে যাবার। আকাশে হেলিকপ্টারের। অপেক্ষা কবে জল নামে তার। অপেক্ষা সরকারি সাহায্যর। অপেক্ষা আবার কবে বাঁধের পাশে মাথা গোঁজার নিজের ঘরটি ঠেকনা মেরে দাঁড় করানো যাবে। মঙ্গল ভাবে, কবে আবার ইস্কুল খুলবে। মিড্ডে মিলের খাবারটাই কারণ। ঘরে যা হয় তার চেয়ে ঢের ভালো।

* * *

অপেক্ষার অবসান। অবশেষে সে এল। বন্যা। বান। মঙ্গলরা বিকেলের আগেই চলে এসেছিল স্কুলঘরে। পুরুষেরা সব বাইরে। বন্যা নিয়ে হাজার খবর আসছে মিনিটে মিনিটে। সম্ভব অসম্ভব নানা খবর। দৌলতপুরে বাঁধ ভেঙেছে। জল ঢুকছে হু হু করে। খানিক বাদে জানা গেল, না, ভাঙেনি এখনও। তবে যেকোনও সময় ভাঙবে। জল উপচাচ্ছে মাঝে মাঝে। পুরুষেরা বাঁধ পাহারা দিচ্ছে। তবে কেউ জানে না পাহারা দিয়েই বা লাভটা কী। জল আরও বাড়ার কথা। আজকাল একটা সুবিধে হয়েছে। আগাম খবরাখবর জানা যায়। সরকারি গাড়ি দু একটা সেই সকালেই ঘুরে গেছে। লোকে বাঁধের দিকে সতর্ক নজর রেখে চলেছে। কোথাও জলের চাপে বাঁধের গায়ে কোনও ধস পড়ে কিনা। আসলে কী হয়, মাটির বাঁধের গায়ে এমনিতে ফাঁকফোকর রয়েই যায়। আর নদীর বালিমাটির বাঁধ এমনিতেই ক্ষয়প্রবণ। তার ওপরে শেয়াল বেজি, ইঁদুর গর্ত করে বাসা বানায়। বন্যার সময় সামান্য ওই গর্তগুলোই ভয়াবহ হয়ে ওঠে। ছুঁচ থেকে ফাল হবার মতো ব্যাপার। সেই গর্তই হানামুখ তৈরি করে জলের তোড়ে বাঁধকে ভেঙে দেয়। অবশ্য তেমন তেমন জলের চাপ থাকলে কিছুই লাগে না। একবার একটু ভাঙতে পারলে আর রক্ষা নেই। কারো সাধ্য নেই তা রক্ষা করে। খড়কুটোর মতো ভেসে যায় গ্রাম।

তাও লোকে পাহারা দেয়। বুধনও সেই দলে ছিল। জল বাড়ছে। সন্ধ্যার দিকে খবর হল দৌলতপুর নয়, খলৎপুরের দিকে বড় হানা হয়ে গেছে। ওখানটায় নদী বাঁক নিয়েছে পুব দিকে। নদীর প্রবল জলস্রোত সোজা পশ্চিম পাড়ে ধাক্কা মারতে মারতে যায়। ওই জায়গাগুলোই ভয়ানক।

খানিক বাদেই খবর পাওয়া গেল, বাঁধ সত্যিই ভেঙে গেছে। হু হু করে পশ্চিমে জল ঢুকছে। সাত কিলোমিটার দূরে খলৎপুর। ইতিমধ্যেই জমির ধান-টানের উপর দিয়ে বইছে। আর দাঁড়াল না বুধন। স্কুলের দিকে রওয়ানা দিল সে। বাঁধের অন্য লোকেরাও ফাঁকা হতে শুরু করেছে।

হাঁটু, কোথাও কোমর জল পেরিয়ে কোনওমতে স্কুলে পৌঁছাল সে। স্রোতের টান অনুভব করা যাচ্ছে। জল বাড়ছে। বিপদের মধ্যে বানভাসি হয়ে সাপখোপেরাও বেরিয়ে পরে এসময়। বানের সময় এমন দুর্ঘটনা প্রচুর ঘটে।

বাপকে দেখেই ছুটে এল মঙ্গল, বা? বান এসে গেছে? আমায় দেখাবেনে? চলো না।

ছেলের বায়নাতে আর রাগ করে না বুধন। হাতটা ধরে জিজ্ঞাসা করল, তোর মা কই?

হুই তো, ওখেনে। ঘরের এককোণে লক্ষ্মী বসেছিল। ঘরের সামান্য মালপত্র বাঁধা বুচকিগুলো দিয়ে যতটা সম্ভব জায়গা আগলে। ছেলে, ছেলের বাপের জন্য। জায়গা কই। তিনটেই তো ঘর সাকুল্যে। শতাধিক লোকের বন্দোবস্ত। তাও পুরুষরা অধিকাংশ এখনও আসেনি। পাশে গিয়ে বসার পর ফিসফিস করে লক্ষ্মী বলল, ঘরে জল উঠে গেছে দেখে এলে?

উঠেনে এখনও, তবে এই শুরু। তোড় ভালই। আজ রাতের মধ্যেই হয়ে যাবে।

একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে লক্ষ্মীর বুক থেকে। আরবারের বানের পর বহু কষ্টে ঘরটা দাঁড় করিয়েছিল দুজনে। গায়ে গতরে খেটে। হাজার টাকার উপরে শুধু বাঁশ। কঞ্চিগুলো আবার সুলের মা চুরি করে নিয়েছিল বলে কী ঝামেলা!! ঝগড়া করে আনতে হয়েছিল। টাকা দিয়ে কেনা জিনিস!! তারপর কাঠামো দাঁড় করানো থেকে কাদা করা, লেপা — সব দুজনে করেছিল। একটু মজবুত করেই হয়েছিল। লক্ষ্মী আবার শৌখিন, দেওয়াল এবড়ো খেবড়ো তার পছন্দ নয়। পাকা বাড়ির প্লাস্টারের মতো সমান করেছিল। আগড়ের দরজার মাথায়, জানলার উপরে চুন দিয়ে নকশা আঁকিয়ে ছিল সুলতাকে দিয়ে। মেয়েটা নকশা ভাল আঁকে। সে ঘরটাও যাবে। আবার।

আটটার মধ্যেই স্কুল চত্বরে জল চলে এল। মঙ্গলের কী উৎসাহ। বান দেখল সে। আস্তে আস্তে স্কুল মাঠটাও ডুবে গেল। টর্চের আলোয় দেখছিল সব। বানের জল ঢোকা শুরু হতেই কারেন্ট অফ ছিল।

উদ্বিগ্ন মানুষ খোঁজ নেয়, লোক আসেনি? এসেছিল। সন্ধ্যার দিকেই প্রধান নিজে এসেছিল। বলে গেছে, বিডিও থেকে কিছু ব্যবস্থা হবে। তা সে নটা বাজতে গেল, কারও টিকি নেই। মঙ্গল বলে, মা, আজ রান্না হবেনে তো?

লক্ষ্মী হাসে, আমার মাথায় করতে হবে। তোর খিদে পেয়েছে? মুড়ি খাবি?

ঘাড় নাড়ে মঙ্গল, অত খিদে তার পায় না। বলল, আচ্ছা মা, এত জল কোথা থিকে এল? আকাশে জল তো নেই এখন!!

বান তো জল থামার পরেই এসে। তুই বরঞ্চ ঘুমিয়ে পড়।

সত্যি করারই বা কী ছিল!! অনেকেই ইতিমধ্যে শুয়ে পড়েছে। ওদিকে জল বাড়তে বাড়তে নীচের ঘরে ঢুকতে শুরু করেছে। ক’টা উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিবার নীচে ফাঁকায় ফাঁকায় ছিল। এখন উঠে এল। জায়গা নিয়ে একটু ঝগড়া ঝামেলা হল। তাদের চালাকির জন্য কটাক্ষও শুনতে হল। ঘরে আলো নেই। মাঝে মাঝে পুরুষেরা বিড়ি ধরায়। লাইটারের আলো, তারপর লাল আগুনের আলো।

না, আজ আর রিলিফ দেবেনে মনে হয়। আচ্ছা, জল আর কত উঠবে জ্যাঠা?

সাতাত্তরের বানে, দাসেদের দোতলায় নৌকো লাগত। আরও আগে একবার, কবে বলতে পারবুনি ঠিক, আমি তখন ওই মংলার মতো, বাঁধ ডুবে গেসল।

ততটা আর হবেনে। অবিশ্বাসী কণ্ঠে শীতলা জেঠার কথার উত্তর দেয় বুধন।

* * * *

অনেকক্ষণ থেকেই আনচান করছিল বুধন। অজান্তেই হাতটা ট্যাকের কাছে চলে যাচ্ছে বারবার। অভ্যাসমতো বিড়ির জন্য হাতড়ে না পেয়ে মনে পড়ছে , ও, বিড়ি তো কখন ফুরিয়েছে। শীতলা জেঠার কাছ থেকে তো আর চাওয়া যায় না। ঘরে জনাপাঁচেক বউ আর গোটাসাতেক ছোট ছেলেমেয়ে হৈচৈ করছে। পুরুষ বলতে সে আর শীতলা জেঠা। ইস্কুলের সেই ঘরেই এখনও ওরা ক’ঘর রয়ে গেছে। অবশ্য বেশিদিন আর থাকা যাবে না। স্কুল চালু হবে। প্রধান কাল এসে বলে গেছে। বুধনের বউ লক্ষ্মী বলেছিল, সেকি কথা গো, তাহালে আমরা যাব কোথায়? বিরক্তিতে দাঁত খিঁচিয়ে উঠেছিল শরৎ, প্রধানের মোটর সাইকেলের ড্রাইভার, তোরা কোথায় যাবি মানে? এটাই কি পার্মানেট ঘর পেয়ে গেলি নাকি? ইস্কুল হবেনে? তোদের জুন্যে উপ্রে জবাব দুবো কী? দাদা, এদের ঢুকানাই ভুল হয়েচে বুইলে? শালা, খেতে পেলে শুতে চায়। প্রধান বলে, না না, কালকের মধ্যে ইস্কুল ফাঁকা চাই। সোমবার থেকে ইস্কুল চালু হবে। এবার বুধন এগিয়ে এসে বলল, বাবুদা, কোথায় যাব আমরা এ অবস্তায়? ঘরের হাল তো সব জানো।

দেক, বুধো, আমায় সবদিক দেখতে হয়। শুধু তোদের পেছুনে পড়ে থাকলে আমাদের চলেনে। সবাই তো যে যার চলে গেল। তোরাই ক ঘর শুদু…. প্রধানের গলায় ঝাঁঝ।

ওদের তো তেমন কিছু হয়নে বাবুদা। আমার ঘরটা তো কিছু নেই জানো। বাঁদের গায়ে আমাদের তিনঘর তো সাপ হয়ে গেছে একদম। সুবল, হারু, দিলুদের ঘরে জল অব্দি উঠেনে।

ওসব কথা ছাড় বুধো। আমাদের উপরে পেসার আছে। ইস্কুল চালু করতে হবে ব্যাস। শুন, সবায়ের সবকিছু গবমেন্ট করে দিবেনে। শালা তোরা বেইমানের দল, গলা থিকে নেবে গেলেই বলিস, কী খেলি? বসে বসে আর কদিন খাবি? কালকের মধ্যে ঘর খালি করে দিবি ব্যাস।

মোটর সাইকেল হাঁকিয়ে চলে যায় প্রধান।

কথাটা ভুল নয়। পনেরো দিন ধরে স্কুলঘরে আছে বুধনরা। সেই বন্যা আসা থেকে। রিলিফ এসেছিল। চিঁড়ে গুড় ছিলই। মাঝে মাঝে শহর থেকে নেতারা এসে মিস্টি কলা পাউরুটি এসবও বিলি করে গেছে। বুধন, মংলা, লক্ষ্মীরা আনন্দ করে খেয়েওছে। একদিন তো মাংসভাতও হল। সেবার কলকাতা থেকে একটা পার্টি এসেছিল নৌকা করে। তা এবারে বানও হল বটে। শীতল জেঠাও বলছিল, আটাত্তরেও এমন হয়নে। বানের জল একটু নামতে বুধন বাঁধের দিকে গিয়ে দেখল, তাদের ঘরটা কোথায় ছিল সেটাই খুঁজে বের করা মুশকিল। চিহ্ন নেই আর। তার, সপ্নার আর হাগরুর ঘরের এক অবস্থা। ওইখান দিয়েও জল ঢুকেছিল এবারে। উঁচু হয়ে বালি কাদা জমে গেছে। এখন নতুন করে কিছু করতে গেলেও অনেক ঝামেলা। সেটা সরকার থেকে না করে দিলে বুধনদের পক্ষে করা মুশকিল। তাছাড়া বাঁধটাও তো বাঁধাই, মেরামত হবে। এ অবস্থায় আবার ওখানে ঘর তোলাও তো যাবে না। সুবল, হারু, দিলুরা ভাগ্যবান। ওদের ঘরে জল ঢুকলেও ভেঙে পড়েনি। জল নামতে মেরামত করে নিয়ে ওরা চলে গেছে স্কুলবাড়ি ছেড়ে। বিসুয়াও ভাগ্যবান। তার  মতো কিছু লোকের আবার ঘর অনেকটা ক্ষতি হলেও ওরা পঞ্চায়েত থেকে পাঁচহাজার টাকা করে রিলিফ পেয়েছে। সেই টাকায় বাঁশটাস কিনে আবার ঘর খাড়া করেছে। ফিরে গেছে তারাও। বুধনও পঞ্চায়েতে গিয়েছিল। খালি হাতে ফিরতে হয়েছে তাকে। সব লোককে টাকা দেওয়া সম্ভব নয় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। পঞ্চাশটাই রিলিফ এসেছে, তারা কী করবে? বুধন জিজ্ঞাসা করেছিল, সেই বা বাদ কেন? ঘাড়ধাক্কা খেতে হয়েছিল তাকে। কটা জনসভায় গেছিস তুই? তখন তো খুব, — হাঁ দাদা, আমি পাটি ফাটিতে নেই — ভালো লাগেনে ওসব — আমাদের ঘরের লোককে না দিয়ে তোদের আগে দুব? কথা শুনে ফিরে এসেছিল সে। সত্যি, পার্টির কোনও কাজে সে থাকে না। কোনও পার্টিই সে করে না। ওসব ভাল লাগে না। খাটে খায়। দয়ার দানের দরকার নেই তার।

এমনটা মনে হত। এখন দেখল, না, দয়ার দানের দরকার পড়ে। প্রকৃতি মাঝে মাঝে মানুষের সিধে শিরদাঁড়া নুইয়ে দেয়। যা ছিল, তা গেছে। কাজ করে কিছু আনবে, তার রাস্তা বন্ধ। কে দেবে কাজ, কী কাজ? জমিতে এখনও হাঁটুজল। রোয়া ধান মাঠেই ডুবে পচে গেছে। এবারের পুরো মাঠেই ধানচাষটা বরবাদ। পচা গন্ধ চারদিকে। চাষীদের মাথায় হাত, মুখে হাহাকার। কে কার কথা শোনে? বুধন আগুরিদের জমিতেই কাজটাজ করে বেশিরভাগ। কিছু টাকা চাইতে গিয়েছিল। মেজকত্তা ঝাঁঝিয়ে উঠে বললে, টাকার কথা বলিস কোন মুখে বুধো? পুজোর মুখে আমরা খাব কী তারই ঠিক নেই। ছ বিঘে ধানীজমি ভেসে গেল। বালি পড়েছে দুহাত। ও জমিতে আর চাষ কবে হবে তাই ঠিক নেই। কোথা থেকে টাকা দিই বল তো?

তাহলে কিছু কাজই দাও।

কাজটাই বা আছে কী যে করবি?

ঘরটা তুলতে হবে, কিছু টাকা না পেলে…. তোমরা না দিলে আর কে দিবে কাকা?

টাকা কি এখানে তোর জমা করা আছে? নিজে কী খাব তার ঠিক নেই… যা না, সরকারের ঘরে যা।

বুধন আর বলল না সে ঘুরে এসেছে। ফিরে এল স্কুলঘরে। সামান্য টাকাকড়ি যা ছিল মঙ্গলের ডাক্তারির পিছনে খরচা হয়ে গেল আবার। গেল সপ্তায় আমাশায় পড়েছিল ছেলেটা। রক্ত বেরোচ্ছিল সাথে। সমীর ডাক্তার এসে ওষুধ দিয়ে গেল, সাড়ে সাতশো টাকার ওষুধ। ধরা করা করতে নিজের ফিজটা মুকুব করেছিল সমীর। শীতলা জেঠার থেকে পঞ্চাশ টাকা নিয়ে ম্যানেজ হল। গরীব মানুষের কাছে আবার কত থাকে?

রাতে শুয়ে খৈনি ডলছিল বুধন। লক্ষ্মী অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল, ও কী হাতে? খৈনি বুধন সহ্য করতে পারত না মোটে। কিন্তু বিড়ি নেই। দুপুরে হারুর থেকে একটু নিয়ে রেখেছিল কাগজে মুড়ে। তামাকের নেশাটা খুব চাগাড় দিয়েছে বলে বাধ্য হয়েই… বুধন লক্ষ্মীকে বলল, কাল সোকালে জিনিসকটা কাপড়ে বেঁদে নিস। ভাবছি, দেশেই ফিরে যাই চ। লক্ষ্মী বুধনের দেশে যায়নি কখনও। ঝাড়গ্রামের দিকে শুনেছে। চোখে অবিশ্বাসীর দৃষ্টি নিয়ে বলল, পাবে কিছু আর? তিরিশ বছর চলে এসেছ? সিলিঙের দিকে চোখ করে বুধন বলে, দেকতে হবে। নিজের বাপের জুমি। চেষ্টা করতে হবে। এখেনেই আর কী আছে? পরে আবার এসব এখন।

মঙ্গলের কানে গেল ওদের কথা। বলল, কোথায় যাব বাবা?

বুধন বলল, দেশে রে, আমাদের দেশে।

আর ইস্কুল? বলল যে, সোমবার থিকে ইস্কুল খুলে দিবে?

বুধন দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলে, ইস্কুল ওখেনেও আছে নিশ্চই।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4881 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...