স্বপ্নময় চক্রবর্তী
সহযাত্রী লেখকের সম্পর্কে কিছু লিখতে খারাপ লাগে না। কিন্তু খুব খারাপ লাগে তাঁর শোকগাথা লিখতে। বিষাদ রোমন্থন আরও বেশি বিষাদিত। গত কয়েক বছর পর পর হারিয়েছি সহযাত্রী ভাষাচিত্রীদের। নবারুণ ভট্টাচার্য, কুনাল কিশোর ঘোষ, অনিল ঘড়াই, জয়দেব বসু, সমীরণ মজুমদার, তুষার চৌধুরী, শচীন দাশকে। রবিও চলে গেল। অনিল এবং রবি আমার অনুজ। রবি আমার চেয়ে অন্তত দশ বছর ছোট ছিল। ছোটদের নিয়ে শোকগাথা লেখা বড় কষ্টের। সিরাজদা, মতিদা, সুনীলদা কিংবা শ্যামলদার মৃত্যুর পরেও কিছু লিখতে বা বলতে হয়েছিল। সেগুলোকে অনেকটা পুষ্পাঞ্জলির মতো ভেবে নেওয়া যায়, কিন্তু অনুজদের বেলায় এসব করতে গেলে ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে’ এই প্রবাদবাক্যটি মনে পড়ে। নিজের ক্ষত পুনর্নিপীড়ন মনে হয়।
রবির গল্প প্রথম কোথায় পড়েছিলাম আজ আর মনে নেই। তবে খবর কাগজে ওর কয়েকটি ফিচার মনে পড়ে। আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবারের পাতায় একটা কভার স্টোরি লিখেছিল ‘হাসি’ নিয়ে। ওখানে চার্লি চ্যাপলিন, রাসেল এবং চমস্কির হাস্যসম্পর্কিত মতবাদ ছিল মনে আছে। এবং শেষ অব্দি বলতে চেয়েছিল দুঃখও একরকমের আনন্দ। এই লেখাটাই মনে পড়ল কেন? ওর দর্শনটার কথা ভাবতে গিয়ে?
ও এক বিষণ্ণতায় আক্রান্ত ছিল যেন। চটুল আড্ডাকালীন অবস্থাতেও রবিকে হা-হা করে জোরে হাসতে দেখিনি, হাততালি দিতে দেখিনি, রবি ফুল্লকুসুমিত হতে পারেনি এক জীবনানন্দীয় বিষাদবোধে। কী একটা বোধ কাজ করে গেছে জীবনে, যাকে সে এড়াতে পারত না।
“সহজ লোকের মতো কে চলিতে পারে আর? কে থাকিতে পারে এই আলোয় আঁধারে সহজ লোকের মতো…” সত্যিই গতানুগতিক সহজতাকে অপছন্দ করত রবি। আবার জীবনানন্দের উদ্ধৃতিতেই বলি —
‘তাহাদের মন
আমার মনের মতো না কি?
তবু কেন এমন একাকী?
তবু আমি এমন একাকী!’
জলের মতোই ঘুরে ঘুরে একা একা কথা কইত রবি। তাই ওর বেশিরভাগ গল্পই যেন সলিলকি। স্বগত ভাষণ। জলের মতোই ঘুরে ঘুরে একা একা কথা। রবি যেন জীবনানন্দের বিষাদপুত্র। ওর ছোটগল্পের মণিময় ও অনুপম যেন পরোক্ষে জীবনানন্দই। যে খ্যাতি পায়নি, প্রেম পায়নি, জীবনের বিচিত্র সাধ, যা আকাঙ্ক্ষাপূরণে সিক্ত হয়, সেই স্বাদ ও পায়নি, অথচ সে নিয়ে ক্ষোভও নেই তেমন, সব অবহেলা উপেক্ষা করে গেছে। এমন চরিত্র সৃষ্টি করেছে রবিশংকর তার অনেক আখ্যানে।
রবিশংকর বেশিরভাগ লেখাই লিটল ম্যাগাজিনে লিখেছে। এরকম কোনও একটি পত্রিকায় ‘হাত’ নামে একটি গল্প পড়ে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। যেখানে মানুষের হাতের সঙ্গে মানুষের সত্তার সম্পর্কের কথা বলা আছে। সম্পর্কের জটিলতাও। রবি গোলগাল গল্প লিখতে অপছন্দ করে গেছে।
রবি কবিতাও লিখত। কবিতা দিয়েই শুরু করেছিল ওর সারস্বত জীবন। গদ্যে হাত দিলেও কবিতা ছাড়েনি। কবিতাই ওকে ছাড়েনি আসলে। অনেক কবির সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল। সংবাদ প্রতিদিনে কর্মরত অবস্থায় অমিতেশ মাইতির সঙ্গে ওর খুব সদ্ভাব ছিল। অমিতেশ মাইতি, আমি, রবি এবং কুনাল কিশোর ঘোষ বিকেল এবং সন্ধ্যার গোধূলিবেলায় চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশনের কাছে অন্য কোনও অফিসের সিঁড়িতে আড্ডা দিতাম। ওখানে জড়ো হত তুষার চৌধুরী, বুবুন, চৈতালি চট্টোপাধ্যায়, গৌতম ঘোষদস্তিদার এবং আরও অনেকে। কখনও পানও চলত। নানা কথা হত। পরনিন্দাও কখনও বা। রবিকে পরনিন্দায় অংশ নিতে দেখিনি। ও মজার কথা বলত নিশ্চয়ই, কিন্তু নিম্ননাদে। ওর উইট ও স্যাটায়ার কম ছিল না, কিন্তু একটু সূক্ষ্ম। অনেক সময় অনেকের মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যেত। রবিকে খুব ভালো বুঝত কুনাল কিশোর। ও সর্বদা রবিপ্রশংসায় পঞ্চমুখ থাকত।
আমার লেখার ধরনের সঙ্গে রবির লেখার অনেকটাই তফাৎ। আমি ব্যক্তিমানুষের ভেতরে খুব একটা ঢুকতাম না, রবি ব্যক্তিমানুষকে প্রাধান্য দিত। ব্যক্তির নিজস্ব বিশ্বাসের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিল। আমি একটা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা এবং এক্সিসটেনশিয়ালিজমের পরিবর্তে সামাজিক মনে এবং তার প্রভাবে বিশ্বাসী ছিলাম। ফলে আমার গল্প বিষয় এবং আঙ্গিকে আলাদা হলেও আমার সঙ্গে খুবই সুসম্পর্ক ছিল কারণ মতবাদের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিল রবি, ফলে আমার বিশ্বাসকেও মর্যাদা দিত। শুধু আমি কেন, আমাদের ঘরানার প্রায় সব লেখকের লেখাই ও ছাপত যখন ও সম্পাদকের ক্ষমতা পেয়েছিল।
প্রচুর তরুণ লেখকের লেখা ছাপিয়েছে রবি। বরং বলা ভালো বেশ কিছু লেখক তৈরি করেছে। সাদিকের লেখা ও গুরুত্ব দিয়ে ছেপেছে। অর্ণব সাহার লেখাও। আরও অনেকের লেখাই। মনে পড়ে, সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকায় নতুন ঢুকেছে, বেলেঘাটার কাছে তখন ওদের অফিস। একটা ‘গোল টেবিল’ করল। যেখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন। ওখানেই শক্তি বলেছিলেন — এত কবি কেন? এত কবি দরকার নেই আমাদের। সুনীল আনন্দবাজার পত্রিকা সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছিলেন। শক্তি-সুনীলের ওইসব কথাবার্তা নিয়ে প্রচণ্ড হইচই হয়েছিল কিছুদিন ধরে। নানা বিষয়ে গোল টেবিল হত। আমিও একবার ডাক পেয়েছিলাম ছোট গল্পের গ্রাম ও গ্রাম্যতা নিয়ে।
প্রচুর পড়াশুনো করেছে রবি। বিশেষত বিদেশী সাহিত্য। আমাদের মধ্যে এত পড়াশুনো সম্ভবত আর কেউ করেনি (দেবর্ষি সারোগি ধরনের সাহিত্যের অধ্যাপকদের কথা ধরছি না)। কালি ও কলমে একটা ধারাবাহিক উপন্যাস লিখছিল। “কিসসা বলেন শেহ্রজাদে”। কয়েকটি কিস্তি পড়েছি। এ এক আশ্চর্য উপন্যাস তৈরি হচ্ছিল। নাবিক সিন্দবাদ, কালীঘাটে এসে পড়া রিফিউজি সন্তান, এবং লাতিন আমেরিকান গল্প উপন্যাসের কিছু বিখ্যাত চরিত্রদের এক ম্যাজিক সম্মিলন। এটা শেষ হল না। শেষ হলে নিশ্চয়ই আর একটা ‘অন্য কিছু’ হত। যেমন হয়েছিল ‘দোজখনামা’। এর আশ্চর্য বয়ন কৌশল। কবরে শুয়ে আছেব বিভক্ত দেশের দুই প্রবাদপ্রতিম। মির্জা গালিব আর মান্টো। ওদের কথোপকথনে দু-আড়াইশো বছরের ইতিহাস বিবৃত হয়েছে শুধু নয়, দার্শনিক তত্ত্বালোচনাও আশ্চর্য কৌশলে আখ্যানের মধ্যেই ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ও মধ্য এশিয়া নিয়ে রবির গাঢ় পড়াশুনো ছিল। রুমি জীবন ও জীবন দর্শন নিয়ে রবিশংকর একটা উপন্যাস লিখেছিল ‘আয়না জীবন’ নামে। ‘ছায়াপুতুলের খেলা’ উপন্যাসটির কথা অনেকেই জানেন। কিন্তু ‘জন্মযান’ এবং ‘বিকেলের বারান্দা’ অনেকটাই কম আলোচিত। অত্যন্ত ‘আরবান’ রচনা। আরবান রচনা আমি লিখতে পারিনি। আরবানাইজেশনের একটা শর্ত হল — চেপে রাখা। অভিব্যক্তির অপ্রকাশ। প্রিয়জনের মৃত্যুতে গ্রামের মেয়েরা চিৎকার করে কাঁদেন, ওরা ঝগড়ার সময়ে কোমরে হাত দিয়ে চিৎকার করতে পারেন, আবার হাততালি দিয়ে আনন্দপ্রকাশ করেন। শহরের মানুষদের এইসব অভিব্যক্তি চেপে রাখতে হয়। আরবান সাহিত্য উচ্চকিত হয় না, অথচ উন্মোচন থাকে।
জন্মযান উপন্যাসটির কথা বলি, পায়খানা বনাম পটি দিয়ে শুরু এই উপন্যাস। এবং যথারীতি ক্রমশ দার্শনিকতার দিকে যাত্রা। উৎপল কুমার বসুর কবিতা, জীবনানন্দের আর্তি, এবং মৃত্যুসম্পর্কিত উপলব্ধির মধ্যে ঢুকে যাওয়া শেষ কালে। ‘বিকেলের বারান্দা’ আর একটি এ পর্যায়ের ছোট উপন্যাস। যেখানে ‘বিজয়ের দুঃখ’ সম্পর্কিত তত্ত্ব। ‘জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না’ রবীন্দ্রনাথের গানের লাইনটি মনে পড়ে। ট্রমা অ্যান্ড দি ট্রায়াম্ফ। রবির দর্শনে ‘কর্তৃত্ব’র মধ্যে একটা পরাজয় থাকে। ‘কর্তৃত্ব’ সবসময় আনুগত্য দাবী করে। বুঝিয়ে, পটিয়ে পাটিয়ে আনুগত্য না পাওয়া গেলে বলপ্রয়োগ দরকার হয়। এটাই পরাজয়। রবির সঙ্গে বছর খানেক আগে দেখা হয়েছিল আমার। ওটাই শেষ দেখা। একটা গাড়িতে আমরা একসঙ্গে কিছুক্ষণ ছিলাম। সেখানে ক্ষমতা এবং কর্তৃত্ব নিয়ে কথা হচ্ছিল। বিশ্বাস, ভক্তি এবং ধর্ম নিয়েও কিছু। রবি বলছিল বিশ্বাস (বিলিফ) এবং ভক্তি (ফেইথ) আলাদা। বলেছিল — লিবারেলিজম এবং রক্ষণশীলতা এই দুটি শব্দ ইতিহাসে বারবার পেন্ডুলামের মতো দুলেছে। এই ধরনের গূঢ় কথাবার্তা আত্তীকরণ করার মতো মানুষ বেশি নেই। ফলে রবির কমিউনিকেশনের সমস্যা হত মনে হয়। যে যে কথা বোঝে তার সঙ্গে সেরকম কথাই বলতে হবে — এটা রবির কাছে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব ছিল না। ফলে ও প্রায়শই চুপচাপ থাকত। এটাকেই ওর ডিপ্রেশন বলে ভাবতাম কেউ কেউ। বলতাম ও বড় অন্তর্মুখী, কেউ বলত অসামাজিক।
কিন্তু ব্যক্তিমানুষ নয়, লেখাটাই শেষ অব্ধি থাকে। ওর লেখার মধ্যে মশলার রকমারি স্বাদ নেই বলে পাঠক কম, কিন্তু যাঁরা পাঠক, তাঁরা তন্নিষ্ঠ পাঠক। এই ধরনের পাঠকদের সঙ্গেই লেখকদের আবহমানের কমিউনিকেশন। ওর প্রচুর মুগ্ধ পাঠক আছেন বাংলাদেশে। আমি দেখেছি, ওঁদের সঙ্গে কথাও বলেছি।
অসুখ ওকে ছিনিয়েছে নাকি ওর দর্শন ওকে আমাদের থেকে আলাদা করেছে কে জানে! ওর লেখায় কেবল কেন মৃত্যু এসেছে ঘুরে ঘুরে? দুটি গল্পের কথা মনে পড়ল। একটিতে প্রশ্ন : জীবিতরা কি বহিরাগত? (আয়নায় দেখা মুখোশ)। অন্য একটি গল্পের চরিত্র সুধাময় — হাসপাতালের অ্যানাটমি ডিপার্টমেন্টে ঘুরে ঘুরে নরকঙ্কাল দেখে বেড়ায়। আসলে ওর পিতাকে দেখতে চায়। ওর পিতা দেহদান করেছিলেন। দান করা দেহটি ডাক্তারি ছাত্রদের কাজে লাগে। শরীরের ভিতরের যন্ত্রপাতি নিয়ে ঘাটাঘাটি ও পরীক্ষার পর পচনশীল দেহ আবর্জনা হয়ে গেলে কঙ্কালটি রয়ে যায়। কঙ্কালও কাজে লাগে অস্থিসজ্জা বোঝানোর জন্য। ছেলেটি বাবার কঙ্কাল চেনার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
গল্প ধরে ধরে একদিন নিশ্চয়ই অ্যাকাডেমিক আলোচনা হবে। আগামীদিনের গবেষণার বিষয় হয়ে উঠবে ওর লেখা। রবির অনেক লেখাই সময়োপযোগী, কিন্তু এই সময় এখনও রবির উপযুক্ত হতে পারেনি।