এনরিকে উবিয়েতা-গোমেজ
[অনুবাদ – সাগরিকা শূর]
কিউবাবাসী এনরিকে প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক ও ব্লগার। বহু গ্রন্থের প্রণেতা। এই রচনাটি কিউবার ‘গ্রানমা’পত্রিকায় প্রকাশ হয়েছে।
উনিশ শতকের শেষে, এমন একটি অকৃত্রিম সমাজবিপ্লব অকল্পনীয়, যার মুক্তির স্বপ্নের ভিত, একটি অনুকূল অবস্থানে দাঁড়িয়ে জাতি ও দেশের ঊর্ধ্বে উঠে গোটা বিশ্বের মানুষের ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়। গ্রীক গণতন্ত্র ক্রীতদাস ও মহিলাদের বিচ্ছিন্ন রেখেছিল এবং অন্যান্য যুগের উদাহরণ না টেনেই বলা যায়, পুঁজিবাদী বিপ্লবের দার্শনিকরাও উপনিবেশ-শাসিত মানুষদের অগ্রাহ্য করেছিলেন। কিন্তু এরা, বা মূল ভূখণ্ডের শ্রমিক-কৃষকরাও, শোষক ও ঔপনিবেশিক প্রভুদের অন্তর্ভূত একটা সর্বজনীন মানবতাবাদ ছাড়া নিজেদের মুক্ত করতে পারেনি। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট যখন বিদ্রোহীরা মাথাচাড়া দেওয়ার আগে, শুধুমাত্র সেন্ট-ডোমিঙ্গে কলোনিতেই ক্রীতদাস প্রথা রদ করার কথা ভেবেছিলেন, তখনও তুঁসে লভার্তে নামের রাজনৈতিক বিচক্ষণতাসম্পন্ন, এবং ‘বাস্তব‘ পরিস্থিতি ও অবস্থা সম্পর্কে অনবহিত এক নিরক্ষর প্রাক্তন ক্রীতদাস তার প্রতিবাদ করেছিলেন:
“আমরা একমাত্র আমাদের অবস্থাগত স্বাধীনতার দাবি জানাইনি। আমাদের দাবি সেই চূড়ান্ত অন্তর্ভুক্তির কথা বলে, যেখানে লাল, কালো বা সাদা চামড়ার কোনও মানুষ তার সমকক্ষদের সম্পত্তি হতে পারে না। বর্তমানে আমরা মুক্ত, কারণ আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। রাষ্ট্রদূতেরা মার্টিনিক ও বৌরবনে দাসত্ব বহাল রেখে চলেছে; যখন তারা শক্তিশালী হয়ে উঠবে তখন আমরা দাসে পরিণত হব।”
১৮৭১ সালে, মাত্র ১৮ বছর বয়সী হোসে মার্তি, এনলাইটেনমেন্টের উত্তরসূরীদের নিন্দা করেছেন, কারণ, তারা স্পেনে যে অধিকার সমর্থন করেছে, এই কলোনিতে তাদেরই নিন্দা করেছে:
“(…)এমনকি যাঁরা বিশ্বজনীন যুক্তরাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন, মুক্ত অণুর ভেতর মুক্ত পরমাণুর স্বপ্ন দেখেন, অন্যদের স্বাধীনতার সম্মানকে নিজেদের স্বাধীনতা ও শক্তির ভিত্তি হিসেবে দেখেন, তাঁরাও নিজেরা যে অধিকার দাবি করেন অন্যদের কাছ থেকে, তার অনুরোধকে অভিসম্পাত করেছেন, নিজেরাই। নিজেদের প্রচারিত স্বাধীনতার অত্যাচারকে অনুমোদন করেছেন, শান্তি ও নৈতিকতার দূত হিসেবে বিনাশের যুদ্ধ ও হৃদয়ের বিস্মৃতিকে পবিত্র করেছেন। গতকালের মতোই, আজও তাঁরা নিজেদের জন্য বৃহত্তম স্বাধীনতার অনুরোধ জানিয়েছেন, কিন্তু এখনও তাঁরাই অন্যদের মুক্তির আবেদনের কণ্ঠরোধ করার জন্য শর্তহীন যুদ্ধকে সাধুবাদ জানাচ্ছেন।”
১৮৯৫ সালে, মার্তি নিজেই কিউবান বিপ্লবের একটি প্রাথমিক খসড়া নির্মাণ করেছিলেন: “স্বদেশই মানবতা, আমরা মানবতার সেই অংশটাকে আরও কাছ থেকে দেখি, এবং সেই স্থানে যেখানে আমরা জন্ম নিই।” কিউবার স্বাধীনতা, ন্যায় ও সংহতির প্রজাতন্ত্রের জন্য পৃথিবীর সমস্ত গরীবদের সাথে নিয়ে বাহ্যিক ও নৈতিক স্থান সুনিশ্চিত করে, যদিও বলিভারের মতো মার্তিও একটা বৃহত্তর স্বদেশের স্বপ্ন দেখতেন, সেই স্বদেশ যা রিও গ্রান্ডে থেকে পাটাগোনিয়া পর্যন্ত বসবাসকারী সমস্ত মানুষকে সংঘবদ্ধ করবে।
কিউবার ছোট্ট ও প্রগাঢ় ইতিহাসে মার্তি আর ফিদেলই ছিলেন একমাত্র নেতা, যাঁরা বিপ্লবী বাহিনীতে যথাযোগ্য ঐক্য সম্ভব করেছিলেন; এমন এক ঐক্য যা মৈত্রীচুক্তির থেকে অনেক দূরে, যা কিউবানদের অক্ষমতা, কালো মানুষদের হীনমন্যতা ও তাদের নির্ভর করার অনিবার্যতা প্রচারকারী শাসনের কর্তৃত্বকে চূর্ণ করে দিতে পারে। অন্য কোনও লাতিন আমেরিকান মার্ক্সবাদী ফিদেল কাস্ট্রোর মতো এত গভীরে মার্তি-প্রভাবিত ছিলেন না। তারা একদল সৎ মানুষকে নিয়ে স্বাধীনতার ঐক্য তৈরি করেছিলেন, যারা নিজেরাই নিজেদের ছাপিয়ে গিয়েছিল। মার্তির মতোই ফিদেলেরও জয়ে আস্থা ছিল, আস্থা ছিল মানুষে, সংগ্রামের জন্যে আর যা যা অসম্ভব তার পূর্ণ সম্ভাবনায়। তিনি মুক্ত ঐতিহ্যকে সামনে এনেছিলেন, তার সাথে সাথে ঔপনিবেশিক ও নয়া-ঔপনিবেশিক পৃথিবীকেও সামনে এনেছিলেন, যার অন্যতম প্রণেতা আমাদের মার্তি – ধনতন্ত্র দ্বারা শোষিত মানুষদের কাছের জন মার্তি, মার্ক্সীয় চিন্তা ও অক্টোবর বিপ্লবের অধিনায়ক, যার শতবার্ষিকী আমরা সদ্যই পালন করেছি।
১৯৫৯-এর কিউবান বিপ্লব পৃথিবীর শোষিত ও নিপীড়িত মানুষদের বিপ্লব ছাড়া নিজেকে আর কিছুই ভাবতে পারেনি, এই বিপ্লব ছিল সমস্ত মানুষের মুক্তির দীর্ঘ সংগ্রামের একটি সোপান। একথা সত্যি যে, বিপ্লব রপ্তানি করা যায় না, বিপ্লব একটি অদ্বিতীয়, নির্দিষ্ট অবস্থা থেকে জন্ম নেয়, কিন্তু ন্যায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত সংহতির ধারণা সমাজতন্ত্রের ভিত্তি, এবং তাকে কোনও সীমায় রুদ্ধ করা সম্ভব নয়, সেটা নিজের ঘরেই হোক, পারিপার্শ্বিকেই হোক অথবা দেশে।
ফিদেলের কিউবা শর্ত বা ভৌগোলিক-রাজনৈতিক হিসেবনিকেশের উর্ধে উঠে সৌভ্রাতৃত্বের সংহতির কথা বলে, এবং এর আদর্শ লঙ্ঘনকারী স্বার্থের সামনে কখনওই মাথা নোয়ায় না; এটাই এশিয়া, আফ্রিকা বা লাতিন আমেরিকার চিত্র। আমরা কিউবানরা ভিয়েতনামের জন্য যথেষ্ট রক্ত ঝরিয়েছি, অ্যালেন্দাস চিলির জন্য আমাদের চিনির অংশীদারির এক পাউন্ড ছেড়ে দিয়েছি, আমরা তাদের হয়ে যুদ্ধ করেছি যারা পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে নিজেদের মানুষের জন্য যুদ্ধ করেছে, এবং অনেকে হেরেও গেছে; আমরা সান্দিনিস্তাস এবং অপরাজেয় বলিভিয়ানসদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়েছি এক নতুন দেশ তৈরির জন্য। আমরা স্কুল, হাসপাতাল, এয়ারপোর্ট তৈরি করেছি, স্বাক্ষরতা এনেছি, খেলাধুলা ও সংস্কৃতিতে দরিদ্র সম্প্রদায়গুলিকে সাহায্য করেছি, চিকিৎসা পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হাজার হাজার মানুষকে রক্ষা করেছি। আন্তর্জাতিকতা একটি অলঙ্ঘ্য তত্ত্ব যেটা ঐতিহাসিক মুহূর্তের একটি স্বচ্ছ ধারণার কথা বলে।
ফিদেলের কিউবা আদর্শগত বিবেচনা বা তাকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্রকারী নিন্দনীয় শাসনের সামনে মাথা নোয়ায়নি, এবং উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭২-এ যখন ভূমিকম্পে দেশের রাজধানী তছনছ হয়ে গিয়েছিল, তখন চিকিৎসকদের সোমোজাজের নিকারাগুয়াতে পাঠানো হয়েছিল। হ্যারিকেন ক্যাটরিনার আক্রমণের পর যুক্তরাষ্ট্রের মানুষদের সাহায্য করার জন্য এক বাহিনী তৈরি হয়েছিল, যে বাহিনী আমাদের প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধের সময়কার এক নিউইয়র্ক আন্তর্জাতিক-এর নামে গঠিত। যে আদর্শের কথা তারা বলেছিল, তা শব্দে প্রকাশিত নয়: তা কাজে, স্বার্থহীনতায়, উৎসর্গে প্রতিফলিত। দু‘শো ছাপান্ন কিউবান স্বাস্থ্যকর্মী দক্ষিণ আফ্রিকা ও সমগ্র বিশ্বে নথিভুক্ত নিকৃষ্টতম মহামারী প্রাণঘাতী জীবাণুতে আক্রান্ত ইবোলা রোগীদের শুশ্রূষা করেছিল। সেখানেই তারা আক্রান্ত দেশ ও অন্য মহাদেশ থেকে আসা আফ্রিকান চিকিৎসকদের সাথে পরিচিত হয়, যারা কিউবাতে পড়াশুনা করেছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হাজার হাজার আরবি ও লাতিন আমেরিকানদের মতো উচ্চ বিদ্যালয় বা স্নাতকপূর্ব স্তর থেকেও এসেছে। ১৯৯৮ সালে যখন হ্যারিকেন মিচ কেন্দ্রীয় আমেরিকান ক্যারিবিয়ানকে বিপর্যস্ত করেছিল, অপর একটি মতাদর্শগত হ্যারিকেন আন্তর্জাতিক বামপন্থাকে পর্যুদস্ত করেছিল। সেই সমাজতান্ত্রিক শিবিরের বিপর্যয়ের পর ফিদেলই আন্তর্জাতিকতার পুনর্প্রবর্তন করেন, এবং তার সাথে, এটাও নিশ্চিত করেন যে, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে আরও একটি সুন্দর পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব। প্রত্যেকটা বিপর্যয়ে যে যে চিকিৎসা বাহিনী দেশে দেশে ঘুরেছে, অথবা যারা আমাদের সাহায্য চেয়েছে, তাদের প্রত্যেককেই তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিদায় জানিয়েছেন, এবং যে রোগীদের সেবায় তারা নিযুক্ত হবে তাদের ঐতিহ্য, বিশ্বাস ও রাজনৈতিক আদর্শকে সম্মান করার কথা বলেছেন।
ফিদেল আসলে দশকব্যাপী এক অন্ধকার ও আলোকোজ্জ্বল প্রতিরোধের পর যে কোনও অকৃত্রিম বিপ্লবের সংহতির দিকটিকেই পুনর্নবীকরণ করতে চেয়েছিলেন, যেমন ৯০-এর মূলগত সংহতি, যা সংকটনির্বাহ ব্যবস্থা দ্বারা উৎসাহিত, যা সবসময়ই সর্বহারাদের ক্ষতি করা থেকে বিরত থেকেছে, ব্ল্যাক আউট ও ঘাটতির মধ্যেও টিকে থেকেছে, শহরের রাস্তায় তথাকথিত ‘বটেলা’র (সংগঠিত প্রচেষ্টায় যানবাহন অন্যের সাথে ভাগ করে নেওয়া) মতো সহজ ও গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের মধ্যে দিয়ে, শহরের বাইরেও যা প্রসারিত করা গেছে, সামগ্রিক স্বাস্থ্য পরিষেবা ছড়িয়ে দেওয়া গেছে মধ্য আমেরিকা ও হাইতিতে (পরবর্তীকালে ভেনিজুয়েলাও), একইসঙ্গে চিন্তার সংঘাতে আরও পারদর্শী হয়েছে, যা নিম্ন অধিকারভোগী জনগণকে উদ্ধার করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়েছে। দুই সংহতিরই দেশের আভ্যন্তরীণ কার্যকলাপের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ছিল: যে সমস্ত স্বাস্থ্যকর্মী বিপজ্জনক অবস্থায় প্রান্তিক ও দূরতম স্থানেও জীবন রক্ষা করেছিল, এবং প্রত্যেক সমাজকর্মী যারা তাদের সহকর্মী মহিলা ও পুরুষদের মধ্যে বন্ধুর অথচ সুন্দর স্ব-উন্নতির পথে পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছিল, তারা তাদের বৈপ্লবিক সত্তাকে পুনর্নবীকরণ করতে পারত (যদি তাদের সেই সদিচ্ছা থাকত)।
এই প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ফিদেল তাঁর সমকক্ষ একজনকে পেয়েছিলেন: হুগো শ্যাভেজ। একসাথে তারা সমস্ত সমতল, সমস্ত নদী, আমেরিকার সমস্ত শহুরে প্রতিবেশী, সমস্ত লাতিন আমেরিকান হৃদয় ঘুরে বেড়িয়েছেন। একত্রে তারা চিৎকার করে বলেছেন: সংহতি ঐক্যবদ্ধ হোক!
ফিদেলের বিপ্লবের ধারণা (যা তার নৈতিক সংহিতা) তাঁর জীবন ও কাজের প্রেক্ষিতে অর্থপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। যদি স্বদেশ মানবতার আর এক নাম হয়, সমাজতন্ত্র ন্যায়ের নাম হয়, তবে এই হল বিপ্লবী মানবতা। এই আদর্শে ঘোষিত কোনও আঙ্গিক বা ধারণাকেই এর অগ্রণী নীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে বোঝা সম্ভব নয়: যেখানেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে বা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সংঘটিত হবে, সেখানেই এর প্রয়োজন হবে। কে বলেছে ফিদেল বেঁচে নেই? তাঁর বিপ্লবের ধারণা তাঁর নিজস্ব ধারণাকেও ছাপিয়ে গেছে, তাঁর বার্তা যা এই ধারণা গড়ে তুলেছে, এবং ইতিহাসের সাথে কথোপকথন শুরু করেছে, যা ছিল এবং যা হতে যাচ্ছে – সবকিছুর সাথে, কারণ ন্যায় ছাড়া স্বদেশ নেই; দেশ ও বিদেশে সংহতি ছাড়া স্বদেশ তৈরি হতে পারে না; আমাদের অর্জিত জয় ছাড়া ও আমরা যে জয় অর্জন করতে চাই তাছাড়া, আর কোনও স্বদেশ নেই।