যুধাজিৎ দাশগুপ্ত
গত ৫ নভেম্বর তাঁর জন্মের ১২৫ বছর পেরোল। হলফ করে বলতে পারি, গত পাঁচ বছরে কলকাতাবাসী, মোট কত লক্ষ জনসংখ্যা জানি না, পাঁচবারও হলডেনের নাম উচ্চারণ করেননি। দরকার পড়েনি। নেহাত যদি তাঁর জীবন নিয়ে কোনও বায়ো-পিক না বেরোয়, ভবিষ্যতেও হয়তো তেমন দরকার পড়বে না। বায়ো-পিক তৈরি হতেই পারে। কারণ এ লোকটার সম্পর্কে একবার জানতে শুরু করলে দু’মিনিট বাদে বাদে মনে হয় – ‘ফ্যাসিনেটিং’ – ঠিক এই শব্দটাই ব্যবহার করেছেন পিটার মেডাওয়্যার, আর-এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী।
জন বার্ডন স্যান্ডারসন হলডেন। ব্রিটিশ। ধমনীতে রীতিমতো নীলরক্ত। পরিচিতি বিজ্ঞানী হিসেবে। জীবনের শেষ সাত বছর ভারতে – কলকাতায় আর ভুবনেশ্বরে – কাটিয়েছিলেন। পায়জামা আর খদ্দরের পাঞ্জাবি পরতেন, এক বঙ্গসন্তানের কাছে বাংলা শিখতেন নিয়ম করে। শেষ জীবনে খেতেন নিরামিষ। তারপর?
তারপর যে কী, সেটা গুছিয়ে বলা বেশ মুশকিল। কী নয়? তালিকা লম্বা হবে, এবং সেই তালিকায় মানুষটাকে অবশ্যই মিলবে না। নিজেই লিখেছিলেন, ‘যদি বিজ্ঞানের আঙিনা থেকে ছুটি চাই তবে আমি গিয়ে সমর সাংবাদিকতায় নাম লেখাতে পারি, বাচ্চাদের জন্য গল্প লিখতে পারি, অথবা রাজনৈতিক বক্তৃতা দিয়ে বেড়াতেও পারি।’ হলডেন কম করে আধডজন কাজে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতেন। গণিতবিদ হলেও চলত। স্ট্যাটিসটিকস তাঁর গবেষণার অন্যতম উপকরণ ছিল। ভারতে আসেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটে গবেষণা করতে। এদেশে থাকবেন বলেই এসেছিলেন, কাজেই ভারতের নাগরিকত্ব নেন। অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার নিরিখে তিনি ছাপ্পা-মারা লাতিন-গ্রিক ইত্যাদি প্রাচীন সাহিত্যবিশারদ। এও এক বলার মতো কথা, প্রথম সারির বিজ্ঞান গবেষণা করেছেন আজীবন, কিন্তু বিজ্ঞানে তাঁর কোনও ডিগ্রি ছিল না। ছিল লাতিন-গ্রিক সাহিত্যে। ভারতে এসে তিনি সংস্কৃত সাহিত্য গুলে খেয়েছিলেন। ভারতীয় পুরাণের নজির তাঁর লেখায় এমনভাবে টানতেন যে, জন্মসূত্রে ভারতবাসী এমন বহু মানুষ লজ্জায় পড়তে পারেন। তিনি দীর্ঘদিন লন্ডনের সংবাদপত্রে সাংবাদিক-নিবন্ধ লিখেছেন। ফ্যান্টাসি গল্প লিখেছেন ছোটদের জন্য। ‘মাই ফ্রেন্ড মিস্টার লিকি’ তাঁর সেই গল্পসংকলনের নাম। তবে, শেষ বিচারে অবশ্যই তিনি একজন বিজ্ঞানী। লিখছেন, বিজ্ঞান জগতে প্রবেশ তাঁর দুই বছর বয়সে, বাবার ল্যাবরেটরিতে মেঝেতে বসে তিনি খেলতেন আর তাঁর বাবাকেও খেলতে দেখতেন – এক্সপেরিমেন্ট-এক্সপেরিমেন্ট খেলা।
হলডেনের পিতা, জন স্কট হলডেন ছিলেন শারীরবৃত্তীয় বিজ্ঞানের গবেষক। নিজেকে নানারকম বিপজ্জনক পরীক্ষার সাবজেক্ট করতে তাঁর জুড়ি ছিল না। নিজের পুত্র, জেবিএস-কেও টেনে আনতেন তার মধ্যে। আর সেই চরিত্র বর্তেছিল জেবিএস-এর মধ্যেও। বেশ কিছু পরীক্ষায় প্রাণসংশয় ঘটতে পারত। সাবমেরিনে দুর্ঘটনার পর তিনি নিজে একটা সাবমেরিনে ওই আপৎকালীন অবস্থা তৈরি করে নাবিক সৈন্যদের মধ্যে কী-কী প্রতিক্রিয়া তখন ঘটেছিল তা দেখতে যান। কিছু কিছু পরীক্ষায় বিপর্যয় ঘটত, এবং তার ফল তাঁকে সারা জীবন বইতে হয়েছে।
বিজ্ঞানী হিসেবেও হলডেনকে কোনও একটা বিশেষ ক্ষেত্রে একটা বিশেষ ধারার গবেষক বলে দাগানো খুব মুশকিল। অজস্র বিষয়ে কাজ করেছেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত লেগে থাকেননি, এগিয়ে গিয়েছেন অন্য বিষয়ের দিকে। ডারউইনের বিবর্তনবাদকে গণিতের কাঠামোয় প্রথম যাঁরা গেঁথেছিলেন তাঁদের অন্যতম এই হলডেন। বিজ্ঞানক্ষেত্রে কোনও একটা কারণে তাঁকে মনে রাখতে হলে এই একটা বিষয়ের কথাই তুলতে হবে। পৃথিবীতে প্রাণের উৎপত্তি হল কীভাবে? এই প্রশ্নে আলেকজান্ডার ওপারিন-এর সঙ্গে একযোগে প্রস্তাবিত তাঁর তত্ত্ব খুব সাড়া ফেলেছিল। তাঁরা বলেছিলেন বিশেষ রাসায়নিক সমৃদ্ধ কোনও জলাধারে সম্ভবত জীবনের প্রয়োজনীয় অণুগুলো জন্ম নিয়েছিল। কিন্তু সেই ধারার গবেষণায় তিনি আর মন দেননি। ওপারিন যদিও ধারাবাহিকভাবে এ নিয়ে কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। জেনেটিকসের আরও অনেকগুলি প্রশ্ন নিয়ে কিছু কাজ করেছেন হলডেন। কিন্তু একইভাবে বিষয়গুলো ধরেছেন, ভেবেছেন, তারপর ছেড়ে গিয়েছেন।
১৯৫৭ সালে ভারতে এসে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের কিছু কাজে লিপ্ত হয়েছিলেন। এখানে তাঁর গবেষণার ছত্রবাহী শিষ্যধারা তৈরি হওয়ার মতো যথেষ্ট সময় পায়নি। মহলানবিশের সঙ্গে কিছু মনোমালিন্যের জেরে চার বছর বাদে স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউট ছেড়ে তিনি চলে যান ভুবনেশ্বরে। তিনি চাইতেন ভারতীয়রা গবেষণায় ব্যয়সাধ্য যন্ত্রের অপেক্ষায় না থেকে একেবারে মামুলি উপকরণে বা কোনও উপকরণ ছাড়াই যেসব গবেষণা সম্ভব তা নিয়ে কাজ করুক। বহু ভারতীয় অবশ্য এই মনোভঙ্গিকে পিছন-ফেরা ভাব বলে মনে করতেন। আজও করেন। কিন্তু হলডেন বিচিত্র নানা বিষয়ে তাঁর প্রশ্ন তুলতেন। ফুলের পাপড়ির রং। কেঁচোর মাটি। শিউলি ফুলের পাপড়ির সংখ্যা আর বিন্যাস। তাঁর তত্ত্বাবধানে দেড় লক্ষ শিউলি ফুলের পাপড়ির সংখ্যা গোনা হয়েছিল। মাপা হয়েছিল ছয় টন কেঁচোর মাটি। যদি তেমন কোনও যুগান্তকারী ফল বেরোত, এসব উদ্যোগ নেহাত বাজে পরিশ্রম বলে মনে করতেন না কেউই।
আমরা যারা তাঁর বিজ্ঞান গবেষণার রস নিতে পারব না (সত্যি কথা বলতে কী, তাঁর গবেষণা ছাড়িয়ে নানা ক্ষেত্রে বিজ্ঞান আজ অনেকদূর চলে এসেছে) তাদের জন্য আছে তাঁর লেখাগুলো। পপুলার সায়েন্স? হ্যাঁ। বায়োলজি থেকে অ্যাস্ট্রোনমি সব বিষয়ে তিনি লিখতেন। জ্যোতির্বিদ্যার নিবন্ধগুলোতে ইংরেজি নামের পাশাপাশি তারাগুলোর ভারতীয় নাম বসাতেন। স্মৃতিচারণ? হ্যাঁ, তাও বটে। রাজনৈতিক মন্তব্য? নিশ্চিত। (হলডেন ছিলেন মার্কসবাদী। কমিউনিজম নিয়ে বহু নিবন্ধ লিখেছেন, তারপর একদিন বীতশ্রদ্ধ হয়ে পার্টির সদস্যপদ থেকে ইস্তফা দেন।) যে কোনও আটপৌরে জিনিসকে ঘুরিয়ে দেখিয়ে তা থেকে সম্পূর্ণ অন্য অর্থ বার করা? অবশ্যই। তাঁর নিবন্ধগুলো সেই কারণেই এখনও আমাদের চমকে দেয়। এমন ঋজু, ক্ষুরধার, ঝকঝকে চিন্তা দুর্লভ। অনেক কথাই হয়তো মানতে দ্বিধা হবে পাঠকের, তর্কে নামার জেদ চাপবে, কিন্তু কিছুতেই অগ্রাহ্য করা যাবে না।
ভারতে অহিংসার ঐতিহ্য তাঁকে খুব টানত। বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উপদেশাবলী তো ছিলই, সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছিল মহাত্মা গাঁধীর বাণী। একাধিকবার লিখেছেন, এদেশে তাঁকে টানত ভারতীয়দের অহিংস নীতি। শুনে মনে হবে হলডেন নিশ্চয় ছিলেন মাটির মানুষ। একেবারে উলটো। বিশেষ একটা সৌজন্যের ধার ধারতেন না। রগচটা স্বভাবের কারণে এখানকার অনেকেই তাঁর সঙ্গে মিশতে ইতস্তত করতেন, ভয়জনিত দূরত্ব থাকত। নিজে বলেছেন, ভারতীয়দের সমস্যা হল, তারা বড্ড বেশি পোলাইট। এটা কাটাতে না পারলে তাদের দ্বারা কিছু হবে না। কেন যে তাঁর এরকম মনে হয়েছিল কে জানে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রণক্ষেত্রে যেতে হয়েছিল। গুলি চালিয়ে শত্রুনিধন করেছেন। পরে সে ঘটনা উল্লেখ করার সময় স্মরণ করেছেন গীতার বাণী। নিজেকে সহিংস প্রকৃতির মানুষ বলে জানিয়ে দিতেন। সেই মানুষটাই ভারতে এসে প্রচার করতে লেগেছেন, জীববিজ্ঞানের গবেষণায় কোনও প্রাণী মারা চলবে না। সাধু প্রস্তাব। তাতে অনেকেরই নিশ্চয় মনে হয়েছিল যে এতে গবেষণার প্রকৃতিও হয়ে পড়বে ধরাবাঁধা। আজকের পৃথিবী অবশ্য তাঁর কথাই যেন ফিরে বিবেচনা করছে। তাঁর ধারণা হয়েছিল, ভারতীয়রা এতই অহিংস যে সাপও মারতে নারাজ। তিনি বলতে থাকলেন, কেউটে-গোখরোও মারা চলবে না। তার বদলে সাপের বিষের প্রতিষেধক টিকা বানাও, আর সমস্ত ভারতবাসীকে সেই টিকা দিয়ে দাও, যাতে তাদের সাপের কামড়ে আর কোনও ক্ষতি না হয়। পায়ের ধুলো থেকে বাঁচতে চামড়া দিয়ে পুরো পৃথিবী ঢেকে ফেলার মতো ব্যাপার!
লন্ডন-এর ‘ডেইলি ওয়ার্কার’ পত্রিকায় ১৯৪০ সালে একটা লেখা লিখেছিলেন, ‘What I Require from Life’, ‘কী আমি চাই এ জীবনের কাছে’। সেখানে তিনি লিখেছিলেন কেমন মৃত্যু তিনি চান। লেখাটার কিছু অংশ এরকম: ‘‘জীবনের চাহিদার পরিপূরক হিসেবে আমার মৃত্যুরও কিছু চাহিদা আছে। যত মানুষের মৃত্যু নথিবদ্ধ অবস্থায় আছে, তার ভেতর ঈর্ষা করার মতো হল সক্রেটিসের মৃত্যু। তিনি মারা গিয়েছিলেন তাঁর দায়বদ্ধতার জন্য, সে দায়টুকু অস্বীকার করে তিনি চাইলে বেঁচেও যেতে পারতেন। তিনি মারা যান প্রায় সত্তর বছর বয়সে, তখনও তাঁর চিত্তবৃত্তি পূর্ণ সক্ষম, কিন্তু ততদিনে যে সব কাজ সেরে যাওয়ার আশা করা সঙ্গত ছিল, সেসবই তিনি সেরে ফেলেছিলেন। আর তিনি মারা যান হাসতে হাসতে। তাঁর শেষ কথা ক’টা ছিল একটা রসিকতা।
সক্রেটিসের মতো এতটা সৌভাগ্যবান হতে চাই এমন দাবি আমি মৃত্যুর কাছে করি না। তাঁর মতো তিন-তিনটে লক্ষণ পূরণ করা মৃত্যু খুবই বিরল। তবে আমি যদি এর অন্তত দুটো লক্ষণ পূরণ করতে পারি তো বলব সেই অনেক। আমার বন্ধুরা যদিও শোক করবে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি, আমাকে নিয়ে তাদের করুণার কিছু থাকবে না।’’
হলডেনের মৃত্যু হয় ক্যানসারে। রোগটা ভয়াবহ জেনেও তিনি, সক্রেটিসের কথা ভেবেই হয়তো, তাকে নিয়ে ঠাট্টা করতে ছাড়েননি।
I wish I had the voice of Homer
To sing of rectal carcinoma,
Which kills a lot more chaps, in fact,
Than were bumped off when Troy was sacked.
এইভাবে শুরু হয়ে দীর্ঘ কবিতাটা শেষ হল,
I know that cancer often kills,
But so do cars and sleeping pills;
And it can hurt one till one sweats,
So can bad teeth and unpaid debts.
A spot of laughter, I am sure,
Often accelerates one’s cure;
So let us patients do our bit
To help the surgeons make us fit.
এক পরিচিত ব্যক্তিকে তিনি লিখেছিলেন, মরতে হবে তা নিয়ে ভাবিত নই, কথা দিয়ে কথা না রেখে মরাটা নিয়েই আপত্তি।
…lot & lots of thank for the pretty presentation !