শ্রুতি গোস্বামী
বাংলা গানের পৃথিবীতে জটিলেশ্বর অভাবিত পথ তৈরি করেছেন কিনা সেকথা বোঝার জন্যে যে ব্যাপক সঙ্গীতদর্শনের প্রয়োজন হয়, তা আমার নেই। আর গান বিষয়ে পাণ্ডিত্য তো নেই-ই যে একটা উইকিপিডিয়া-উপযোগী তথ্যাগার তৈরি করব। সময়গত দূরত্ব এর পিছনে প্রধানত দায়ী। ওই ফেলে আসা সময়কে সরাসরি শোণিতস্রোতে না ধারণ করলে প্রায় কিছুই বোঝা হয় না এই ধারাপথটির। একজন অগ্রজ সঙ্গীতকারকে আমার সময় থেকে তাকিয়ে দেখে যেটুকু বোঝা যায়, এবং তাঁর গানের সঙ্গে শ্রোতা হিসেবে আমার যেটুকু পরিচয় ঘটেছে, সেটুকু ছাড়া আমার হাতে কোনও অস্ত্র বা অর্ঘ্য নেই।
রবীন্দ্র-দ্বিজেন্দ্র-অতুল-রজনী-নজরুল-দিলীপ রায় যুগের পর সিঙ্গার-সংরাইটার বলতে যা বুঝি আমরা, সেই ধারার এক গানমানুষ হিসেবেই জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়কে দেখতে পেয়েছি আমি। ১৯৩৪ সালে এই গ্রহ পেয়েছিল সেই মানুষকে। গায়ক হিসেবে তাঁর প্রথম রেকর্ড ১৯৬৩ সালে, সম্ভবত সুধীন দাশগুপ্তর সুরে ‘একটি রঙিন ফুল’। তিরিশ-না পেরনো তরুণ কণ্ঠ। আশ্চর্য সানুনাসিক এক কণ্ঠস্বর। কিন্তু তা মোটেই অতিরিক্ত নয়। স্পষ্ট ঋজু নাগরিক উচ্চারণ। কোনওরকম মুদ্রাদোষ নেই। ওই প্রথম রেকর্ড থেকেই। গ্রামীণ টোনও নেই, আবার অতি-পরিশীলিত ভানও নেই। অখিলবন্ধু ঘোষ বা সতীনাথ মুখোপাধ্যায়ের পর এমন মধুর অথচ প্রখর পুরুষকণ্ঠ ষাট-সত্তর দশকের বাংলায় আর এসেছিল কিনা সংশয় আছে। ফলে জনপ্রিয় হয়েছিলেন গায়ক জটিলেশ্বর। ১৯৬৮-র ‘বঁধুয়া আমার চোখে জল এনেছে’ তো এই গায়কসত্তাকে তুমুলভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিল। কিন্তু আমি যতবারই তাঁর গান শুনেছি, সে ‘আমি ফুলকে যেদিন ধরে বেঁধে’ হোক, বা ‘এ কোন্ সকাল’, ‘তোমার সঙ্গে দেখা না হলে’ হোক, বা ‘ও সজন হায়’, ততবারই মনে হয়েছে, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় নামে একজন গায়কের থেকে অনেক বড় ছিল তাঁর সঙ্গীতকার-সত্তা। আরও সঠিকভাবে বলতে গেলে, নিজের থেকে গানটাকে অনেক বড় করে দেখতে পেতেন তিনি। চিন্ময় লাহিড়ী, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্তর ছাত্র ছিলেন। এই শিক্ষার্থীজীবন তাঁকে শুধু কণ্ঠচালনায় শিক্ষিত করেনি, দীক্ষিত করেছিল। সেই দীক্ষা সঙ্গীতধর্মের।
কাকে বলতে চাইছি সঙ্গীতধর্ম? সঙ্গীতকে যাপনের মাধ্যম করে তোলা। অবশ্যই ব্যক্তিগত জীবনযাপনের কথা এখানে আসছে না, শ্রোতা হিসেবে কেবল শিল্পীর কথা বলার অধিকারী আমি। ‘প্রাণের রাধার কোন্ ঠিকানা’ গাইতে গাইতে সঞ্চারীতে সেই শিল্পী বলেন–
হায় কি তারে পাব নাকো দিশেহারা এই জীবনে
মনের চকোর কেঁদে মোলো চাঁদ উঠেছে কোন গগনে।
প্রথম লাইনের পুনরাবৃত্তিতে ‘হায়’-এর সহজ পঞ্চম লাগাবার জন্যে শুদ্ধ ধৈবতকে যেরকম সটান কৌণিকভাবে ক্ষেপণ করেন তিনি, ‘মনের চকোর কেঁদে মোলো’-র পর ‘হায়’ বলতে গিয়ে কোমল গান্ধার ও শুদ্ধ রেখাব থেকে অপূর্ব এক ঢেউয়ে তিনি পৌঁছন কোমল ধৈবতে, তার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত প্রক্রিয়ায়। পাশাপাশি দুই লাইনে ধৈবতের নড়াচড়ায় দুটি ভিন্ন হাহাকারকে স্থাপন করার জন্যে যে শ্রুতি ও বোধের সম্মিলন প্রয়োজন হয়, তা যাপনে গান মিশে না থাকলে হয় না। এ-ই হল ধর্ম, কোনও অসচেতন বহিঃপ্রকাশ নয়, এই উচ্চারণ স্পষ্টতই চিন্তানিঃসৃত।
গানের ধর্ম তো কেবল সুরচালনা নয়। বাংলা কাব্যগীতি তৈরিই হয়েছে তার ভাবসম্পদের ওপর নির্ভর করে। প্রেমের যে পরিচ্ছন্ন স্বচ্ছন্দ গতি পূর্বতন বাংলা কাব্যগীতির ধারায় বহমান ছিল, প্রধানত তাকেই বয়ে নিয়ে গেছেন জটিলেশ্বর। সেই প্রেম রতিসর্বস্ব কিংবা আবেগে মুহ্যমান নয়। গায়ক জটিলেশ্বরের উচ্চারণ বা শব্দক্ষেপণে যেমন নাগরিক মার্জনা ছিল, তাঁর গানের ভাষা-অনুভূতিতেও তা-ই। পরাজিত হওয়া বা স্বেচ্ছাস্বীকৃত পরাজয় অবশ্য তার একটা মৌলিক অভিমুখ। “ভালোবেসে এই বুঝেছি, সুখের সার সে চোখের জলে রে…”, মোটামুটি এই হচ্ছে তাঁর প্রেমের গানের মন্ত্র। কিন্তু এটা আসলে বড় কথা নয়। কারণ গীতিকার জটিলেশ্বরের অনন্যতা এখানে নয়। জটিলেশ্বর কবি ছিলেন। তাঁর গানে খুব নির্দিষ্ট করে কবিতার স্বাক্ষর আছে। শ্রোতা হিসেবে ক্রমশ আমরা অবশ্য যে বধির জীবনে পৌঁছে যাচ্ছি, তাতে আর কতদিন এই কবিতাকে চিনতে পারব জানি না। ভুট্টাক্ষেত, উড়োজাহাজ, ভাঙা বাদাম, উলটো ক্লিপ, ইত্যাদি শিশুমুখসঞ্জাত আধো-আধো বুলি যে যুগে গানের কথা, মেনে নিতে হয় যে সে যুগে মানুষকে আর মানুষের বলার কিছুই নেই। শুধু কিছু পরস্পরবিচ্ছিন্ন ভঙ্গুর ধ্বনি আছে। সে যুগে কল্পনাই করা যায় না কেউ লিখতে পারেন, “ও সজন, তোমায় দেখে যে পথে দাঁড়াল/হায় সে জন, জানে না সে যে পথেই দাঁড়াল…”। সজন-স্বজন, ভবন-ভুবন, কারণ-বারণ এইসব অনুপ্রাসের কবিকৌশল এত অনায়াসে ব্যবহার করার জন্যে ওই শিক্ষা ও দীক্ষা দুটিরই প্রয়োজন হয়। আমরা এগুলো প্রায় এড়িয়ে গেছি। অবশ্য এর ইতিহাস নতুন নয়। আমাদের কৈশোরেও, অর্থাৎ নব্বই দশকে বা তার কিছু পরে প্রচারের পরিসীমায় জটিলেশ্বরকে খুব সহজে শুনতে পাইনি। পেলেও ওই কয়েককলি রিমেড ‘বঁধুয়া’, একটুখানি ‘আমার অঙ্গে জ্বলে রংমশাল’, বা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘এ কোন্ সকাল’। ‘পৃথিবীর যেখানে যত খাঁচার পাখি, উড়িয়ে দেওয়া যেত যদি, কত ভালো হত’-র মতো গান কিন্তু অনেকটা আলোকবৃত্তের বাইরে। যে সমানুপাতের আকাঙ্ক্ষা সহজ সুরে সহজ ভাষায় প্রকাশ করেছেন, তা কি আনা যেত না শ্রোতার আরও কাছাকাছি? “কত ভালো হত, যদি ফাগুনের শৌখিন ফুলটাকে একবার বৈশাখী ঝড়ে দুলতে শেখানো যেত”, মানুষ হিসেবে এই সামাজিক চাহিদা অনেক বেশি পরিচিত হওয়া উচিত ছিল না কি আমাদের? বিভাসে বাঁধা ‘মোহন বাঁশি বাজে’, বা আহির ভৈরোঁ-র আভাসে ‘কে যেন আমায় কানে কানে’-র মতো রাগাশ্রিত হয়েও রাগকে ছাপিয়ে যাওয়া গান আরও শুনতে পারতাম না আমরা?
দুর্ভাগ্যের কথা বলে চোখের জল ফেলানো আমার উদ্দেশ্য নয়। জটিলেশ্বর তো বিনা কারণে জল আনতে চান। কিন্তু এই অহৈতুকীর এক নিজস্ব যুক্তি আছে। যুক্তিটি দ্বন্দ্বের। জটিলেশ্বরের গানের কথক দ্বিধাময়। সে জল ফেলে, কিন্তু নিজেই ক্ষুব্ধ হয় কোমলতা হারিয়ে। সে পেতে চায়, কিন্তু পেতে চাওয়ার প্রতি তার দার্শনিক বিরাগ। সে প্রেমিক, কিন্তু প্রেমের প্রাপ্তিতে সে উদাসীন। সে শ্যামল, আবার সে গৈরিক। এ কোনও ব্রহ্মোপলব্ধির কথা নয়, নিতান্ত জ্যান্ত স্নায়বিক ব্যাপার। সে বলে–
আমার মন-দোতারার একটি তার বাজে বসন্তবাহারে
আর একটি তারে বাজে সেই চেনা সুর–
‘দিন তো গেল সন্ধ্যা হল পার করো আমারে’…
দোটানা, পিছুটান, পাওয়া-ছাড়ার এই দ্বন্দ্বটাই সবথেকে সত্যি জটিলেশ্বরের গানে। প্রেমের চিরন্তন দোলাচলের মতোই। কে না জানে, ওই দোলাচলই প্রেমের সবথেকে স্থায়ী ধর্ম! না পেয়েই পাওয়া! পেয়েও না পাওয়া! পেয়েও না চাওয়া! নইলে কি আর এদেশের প্রেম রাধাকৃষ্ণের মতো একটা সামাজিকভাবে ব্যর্থপ্রতিষ্ঠ প্রেমকেই আদর্শ বানিয়ে ফেলে? এঁর গানে কত অসংখ্যবার যে ফিরে আসে রাধার নাম, কতবার যে বলা হয় বাঁশির কথা! বাংলার ওই কঠিন-পেলব মৌন-মুখর প্রেমের আদর্শ জটিলেশ্বরের কবি বলে যায়। তার সুরে বিনা কারণেই আস্তে আস্তে মিশতে থাকে কবেকার সেই যমুনার জল। কবে কোন কাজে হারিয়ে ফেলেছিল তার সখীকে, ভুল হয়েছিল, সেকথা তাই ভুলতে পারেনি, কেবল মাশুল গুনে চলেছে। ভোলা সহজ নয়। এই উচ্চারণ, এই সৎ আত্মমোচন বোঝার জন্যেও যত্ন প্রয়োজন, বোঝা বড় সহজ নয়। কঠিন, কারণ ‘ঈশ্বর জটিলই হন’…
[শিরোনাম আমার নয়, কথাটা ধার নিলাম সুদীপদা, শ্রদ্ধেয় কবি-গীতিকার-গায়ক সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে।]