বিচারপতি-অশোক গাঙ্গুলী
মাননীয় বিচারপতি অশোক গাঙ্গুলী মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি, এবং পশ্চিমবঙ্গ মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন প্রধান।
মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের চার বরিষ্ঠ বিচারপতির জানুয়ারির বারো তারিখের সাংবাদিক সম্মেলন নিঃসন্দেহে একটি অভূতপূর্ব ঘটনা। এমন ঘটনা ভারতীয় বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে আগে কখনও ঘটেনি। কর্মরত বিচারপতিরাই কেন উচ্চ ন্যায়ালয়ের কার্যকলাপ নিয়ে সরাসরি প্রশ্ন তুললেন এবং তাতে নানাবিধ অস্বচ্ছতার অভিযোগ আনলেন, এই প্রশ্ন দেশের সাধারণ মানুষকেও যথেষ্ট বিচলিত করেছে। চার বিচারপতির আনা অভিযোগ মূলতঃ দু’টি — এক, মেমোরান্ডাম অফ প্রসিডিওর বা কার্যপ্রণালীর নিয়মনীতি চূড়ান্ত না করা; এবং দুই, মামলা বণ্টনের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার অভাব।
আমাদের দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিত্বেরা এই চার বরিষ্ঠ বিচারপতির নেওয়া পদক্ষেপের সপক্ষে ও বিপক্ষে দুইদিকেই সওয়াল করেছেন। কেউ বলেছেন, এ-কাজ একেবারেই অনুচিত হয়েছে। আবার অনেকেই বলেছেন — মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে মামলা বণ্টনের ব্যাপারে স্বচ্ছতার অনুরোধ ব্যর্থ হওয়ায় এই চার বিচারপতি আর কোনও পথ না পেয়ে সম্ভবত বাধ্য হয়েই এমন কাজ করেছেন।
পরিস্থিতি অত্যন্ত জটিল। মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের অন্যতম প্রাক্তন বিচারপতি হিসাবে এবং বর্তমানে কর্মরত অনেক বিচারপতির প্রাক্তন সহকর্মী হিসাবে আমার পক্ষে কোনও একদিকে দাঁড়ানো প্রায় অসম্ভব। এতদসত্ত্বেও আমি মনে করি, মাননীয় প্রধান বিচারপতির উচিত ছিল তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঘনিয়ে উঠতে থাকা সমস্যাটির পর্যালোচনা করে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা। আমি মনে করি, তাঁর উচিত ছিল এই চার বরিষ্ঠ বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা করা, এবং পারস্পরিক মতপার্থক্য যাতে প্রকাশ্যে না আসে সে বিষয়ে সচেষ্ট হওয়া ও তা নিশ্চিত করা। মাননীয় প্রধান বিচারপতির কাছে আমি আশা করব, তিনি বিবাদ এবং অহংবোধের ঊর্ধ্বে উঠে এই চার বিচারপতির সঙ্গে আলোচনায় রত হোন, এবং যথাশীঘ্র সম্ভব অনুসরণীয় পদ্ধতি-সংক্রান্ত বিষয়ে ঐকমত্যে আসার ক্ষেত্র প্রস্তুত করুন।
সংবিধানের ঊর্ধ্বে কেউ নয়, এই কথা সকলকেই মনে রাখতে হবে। এই সংবিধান দেশের সমস্ত বিচারপতিদের উপর ন্যস্ত করেছেন কঠিন দায়িত্ব, এবং নির্দেশ দিয়েছেন কায়মনোবাক্যে তা পালনের। মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের মাননীয় প্রধান বিচারপতিও এই নির্দেশাবলীর আওতায় পড়েন। বিচারপতিরা কর্মক্ষেত্রে তাঁদের সাংবিধানিক ক্ষমতার ব্যবহার করে থাকেন। একইসঙ্গে তাঁদের কর্তব্য, নিজেদের অহংবোধ যদি থেকে থাকে, তবে সংবিধানের শুদ্ধতার স্বার্থে তাকে বিসর্জন দিয়ে স্ব-স্ব সাংবিধানিক দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করা। বিচারপতিদের থেকে দেশবাসী প্রত্যাশা করেন গভীর দায়িত্ববোধ। বিচারপতিদের কর্তব্য তাঁদের কাজেকর্মে সংবিধানসিদ্ধ নৈতিকতা ও মূল্যবোধের পরিচয় রাখা।
বিচারপতিদের যেহেতু সাংবিধানিক নীতিসমূহকে পূর্ণ মান্যতা দিয়ে নিজেদের দায়িত্বপালন করতে হয়, মামলা বণ্টনের ক্ষেত্রে প্রণীত নিয়মরীতি মেনে চলাও তাঁদের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মামলা বণ্টনের ক্ষেত্রে কোনও অস্বচ্ছতা — যার থেকে মনে হতে পারে এই অস্বচ্ছতা ইচ্ছাকৃত এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত — না থাকাই বিধেয়। এমন কোনও ধারণা যদি তৈরি হয়ে থাকে — ওই সাংবাদিক সম্মেলন দেখে যা হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে — ভারতীয় বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রতি এখনও আমি শ্রদ্ধাশীল। আমি মনে করি আমার সঙ্গে এই দেশের কোটি-কোটি মানুষও মাননীয় সুপ্রিম কোর্টের প্রতি — যা বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রের উচ্চতম বিচারালয় — আস্থাবান। আমার ঐকান্তিক আশা, বিচারপতিদের মধ্যকার মতপার্থক্য এবং তজ্জনিত বিতর্কের অচিরেই সমাধান ও সমাপ্তি ঘটবে। মাননীয় উচ্চ ন্যায়ালয় গরিমার সঙ্গে তাঁর কাজের দ্বারা দেশের সেবা করবেন।