অতীন্দ্রিয় চক্রবর্তী
পঞ্চম উপকথা, পর্ব — এক এখানে
সে অনেক বছর অনেক কথা। সাতপুড়া পাহাড়ের পুবদিকের ঢলে ছিল একটা ছোট্ট গোণ্ড রাজত্ব — দেওগঢ়। তার রাজাও গোণ্ড, প্রজারাও। একবার গাঔলি রাজার বাহিনী ভীষণ আক্রমণ করল সেখানে। দুই পক্ষই যুযুধান। ঢালে তলোয়ারে তীরে কুঠারে বল্লমে সমানে সমানে টক্কর চলল বহুদিন। কিন্তু, মহাকাব্যের আদিবাসী সাম্রাজ্যের বিশ্বাসঘাতক সুগ্রীব, বিভীষণদের মতোই, এই দেওগঢ়েও এক হঠকারী ঘরশত্রু ছিল -– আর কেউ নয়, সে সেই দেওগঢ়েরই গোণ্ডরাজা ভূষণের ভাই এবং রাজ্যের মন্ত্রী, নাম ঘুড়ন। ঘুড়নের চক্রান্তে গাঔলি রাজার কাছে হেরে গেল ভূষণ। গাঔলি রাজা মহিপাল সেখানকার নতুন রাজা হল, কিন্তু রাজমন্ত্রী থেকে গেল সেই ঘুড়ন-ই। নতুন রাজা মহিপালের উপরেও এই ঘুড়ন তার কুটিল প্রভাব বিস্তার করল।
পরাধীন গোণ্ড প্রজারা আড়ালে ঘুড়নের নামে থুথুক্কার করত, কিন্তু সামনে রাজমন্ত্রী ও নতুন রাজাদের হিংস্র দোর্দণ্ডপ্রতাপে কিছুই বলতে পারত না। এদিকে বিজেতা গাঔলিরা বিজিত গোণ্ডদের উপর চরম অত্যাচার আরম্ভ করল। পরাভূত গোণ্ড রাজমহিষী ও রাজকুমারীকে দাসী বানিয়ে রাখল মহিপাল। তাঁদের উপরেও নিয়ত চলতে থাকল নানান ধরণের উৎপীড়ন। মিষ্টস্বভাবা সেই হতভাগ্য রাজতনয়ার নাম ছিল ভুনিয়া। রূপগুণের কদরে বিজেতা অনাদিবাসীদের রাজমহলে তার নাম হয়ে গেল — ‘মনোমোহিনী’।
দেওগঢ়ে গাঔলিরা আসার আগে গোণ্ডরা একটা কেল্লা বানিয়েছিল। কেল্লায় ছিল তাদের এক দেবীর থান। জাঁকজৌলুশের সাথে পুজো চড়ত সেখানে গোণ্ডরা যখন স্বাধীন ছিল। কিন্তু গাঔলি রাজারা আসার পর পুজো বন্ধ হয়ে যায়। সেইখানে পুজো দেওয়া গাঔলি রাজা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। ছিন্দওয়াড়া থেকে ক্রোশ কুড়ির দূরত্বে পাহাড়-জঙ্গলের বুক কেটে কেটে বানানো সেই দেওগঢ় কেল্লার এক কোণে অযত্নে অবহেলায় পরে ছিল সেই পরিত্যক্ত থান। যত্ন অবশ্য একজন নিত।
প্রত্যহ চুপিসারে ভুনিয়া পৌঁছে যেত সেই থানে। ঝাড়পোছ করত, ফুলমালা চড়াত। কিন্তু একদিন ধরা পরে গেল সে গাঔলিরাজার কেল্লাপ্রহরীদের হাতে। শুরু হল অকথ্য নির্যাতনের পালা। এক সময়ে মারের চোটে সংজ্ঞা হারাল রাজকন্যা ভুনিয়া। প্রহরীরা ভাবল বুঝি সে মরে গ্যাছে। ঘন জঙ্গলের ভিতর তার রক্তাক্ত শরীর ফেলে এল তারা।
সংজ্ঞাহারা গভীর সুষুপ্তিতে ভুনিয়া স্বপ্ন দেখল, দেবী এসেছেন। মৃদু স্মিত হেসে দেবী তার হাত স্পর্শ করছেন, বলছেন —
–‘উঠ লো ভুনিয়া! তোর দুখের দিন গেল।’
অবাক ভুনিয়া অনুভব করল, দেবী তাকে উঠিয়ে বসাচ্ছেন। বলছেন —
–‘দেখ লো, বীরপুত্র এল তোর কোঁখে। তোর সব কষ্ট ঘোচাবে সে।’
ভুনিয়া দেখেই চলল — দেবী একটা কাঠের তলোয়ার আলতো করে রেখে দিচ্ছেন ওর পাশেই, বলছেন —
–‘এই লকড়ির তলোয়ার সামলে রাখ। সময় এলে, কাজে দেবে।’
এই বলে অন্তর্হিতা হলেন দেবী। ধিরে ধিরে ভুনিয়ার চৈতন্য ফিরে এল। মাটির দিকে এদিক ওদিক তাকাতেই তার চোখে পড়ল — যেইখানে সে পড়েছিল, তার পাশেই ঝরাপাতার মধ্যে রাখা আছে একটা কাঠের তলোয়ার। সেই জঙ্গলের ভিতরেই কুটির বানিয়ে থাকতে লাগল আদিবাসী রাজতনয়া।
যেদিন ভুনিয়ারই সেই খুড়োর বেইমানিতে রাজ্য খুইয়েছিল ভুনিয়ার বাপ, সেইদিন থেকে শুরু করে সেই কেল্লায় দেবীথানে তার প্রহরীদের হাতে ধরা পরে যাওয়ার দিন অবধি তাকে কতজন যে ধর্ষণ করেছিল তার গিণতি ভুনিয়া করেওনি। জংলা কুটিরেই একদিন এক সুস্থ-সবল পুংসন্তান প্রসব করল সে। ছেলের নাম রাখল — ‘জটবা খণ্ডাৎ’, অর্থাৎ ‘খণ্ডা’ বা খাঁড়া-ধারী জটবা। (গোণ্ডি ভাষায় যা ‘খণ্ডা’, বাংলা ভাষায় তা-ই ‘খাঁড়া’)। অবশ্য এই বীরত্বব্যঞ্জক নামের পাশাপাশি মা ছেলের একটা স্নেহের নাম রেখেছিল — ‘বুধন’।
দিন যায়। অত্যাচারের নিত্যনতুন তুঙ্গে চড়তে থাকে বাঔলিরাজা মহিপাল, রাজমন্ত্রী ঘুড়নেরা। শোষণের চড়তে থাকা পারদের সামনে যে সব পরাধীন গোণ্ড প্রজা প্রতিবাদ করে উঠছিল, তাদের জুটছিল বেদম প্রহার ও নিগ্রহ, কয়েদ, যথেচ্ছ, বিচারবিহীন মৃত্যুদণ্ড। অনাদিবাসী গাঔলি রাজতন্ত্রের ছিল রমরমা কাঠের ব্যবসা। কাঠ সংগ্রহ করার জন্য তারা পরাধীন গোণ্ড প্রজাদের দিয়ে নাগাড়ে অজস্র গাছ কাটাতে লাগল। শোষণের মানুষি নিয়মেই, কাঠুরেবৃত্তি করতে থাকা গোণ্ড আদিবাসীরাই হল গাঔলি কাঠ-ব্যবসার নিপীড়িত পিলসুজ। দুনিয়াভর আদিবাসীদের যে আদিপ্রাকৃত টোটেমধর্ম, তাতে, বনস্পতি সদাসর্বদা পূজ্য, সংরক্ষণীয় ও অবধ্য। অথচ ইচ্ছের বিরুদ্ধেই, অবস্থার ফেরে, দেওগঢ়-হরিয়াগড়-ছিন্দওয়ারাময় কানহন নদীর দুই তীরে বসবাসকারী গোণ্ড আদিবাসীদের পেট চালাতে যৎসামান্য মজদুরির বিনিময়ে অরণ্যনাশ করে যেতে হয়েছিল গাঔলি কাঠব্যবসায় কাঁচামালের ইন্ধন জোগাতে। ভিতরে ভিতরে রাগে-দুঃখে-গ্লানিতে ফুঁসছিল পরাধীন গোণ্ডপ্রজা।
একদিন গোণ্ড কাঠুরিয়াদের একদল গিয়েছে গভীর জঙ্গলে। ক্ষিদে-তেষ্টায় তাদের প্রাণ ওষ্ঠাগত, অথচ সামান্য যা দিনমজুরি জোটে, তাতে বনে আসার সময়ে সঙ্গে করে কোঁচড়ে ভরে সামান্য চিড়ে-গুড় আনার যো কৈ? এমন সময়ে, তারা সামনে দেখতে পেল একটা আমগাছে লোভনীয় আম ফলে আছে। তড়িঘড়ি তারা যেই না আম পাড়তে গেল, ওমনি শোনে, পিছনে কোন কিশোরের কণ্ঠস্বর — ‘ওই বুনো আমগুলো খেও না, তার চেয়ে চলো, আমাদের কুঁড়েঘরে দুদণ্ড জিরিয়ে নিয়ে দুটো ভাত-মকাই যা আছে খেয়ে নিও না হয়।’ এই জঙ্গলে মানুষের গলার আওয়াজ পেয়ে যারপরনাই ঘাবড়ে গেল কাঠুরিয়ারা। এদিক ওদিক তাকাতেই দেখতে পেল, এক শ্যামলা রঙের আদিবাসী কিশোর গাছগাছালির আড়াল থেকে ওদের দিকে চেয়ে আছে একজোড়া আশ্চর্য উজ্জ্বল চোখ দিয়ে, আর মিটিমিটি হাসছে।
আশ্বস্ত হয়ে কাঠুরিয়ারা এগিয়ে গেল সেই কিশোরের দিকে। অমানবিক শারীরিক ও মানসিক কষ্টে ভেঙে পড়া তাদের ক্ষুধিত-তৃষিত চোখ-মুখ-শরীরের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল সেই কিশোর।
–‘তা, হ্যাঁগা, তোমাদের এই দশা কেন?’
এই প্রশ্নের সামনে ঝরঝর কেঁদে দিল কাঠুরিয়াদের অনেকে। প্রাণ উজার করে বলে গেল গোণ্ডদের পরাধীনতার গ্লানির কথা, অনাদিবাসী রাজপুরুষদের যথেচ্ছাচার-অত্যাচারের কথা। লোকালয়ে রাজার গুপ্তচরের ভয়, অরণ্যে সেই ভয় নেই। তাই, এতদিন পরে কাউকে এইসব বলার সুযোগ পেয়ে বুক নিঙড়ে দুখের কথা প্রকাশ করল সেদিনের গোণ্ড কাঠুরেরা।
শুনতে শুনতে সেই কিশোরের মনের সুপ্ত আদিবাসী-মান জেগে উঠল ধিকধিক করে। নিজের লোকেদের দুঃখকষ্টের খবরে মন-মুঠি-চোয়াল শক্ত থেকে আরও শক্ত হয়ে উঠতে লাগল। সাতপুরা পাহাড়ের কোলে অবাক কাঠুরেরা সেইদিন দেখছিল ইনডিগনেশানের রাগে থরথর করে কাঁপছে, গ্লানিমোচনের প্রতিজ্ঞায় মুঠিআঁট করছে যে মানবিক যোদ্ধামূর্তি, তার সাথে তাদের কিছু আগের দেখা দীঘলচোখা শ্যামলাবরণ আদিবাসী কিশোরমূর্তির কি জমিন-আসমান ফারাক! গোণ্ড আদিবাসীরা যে সিংহগর্জনের সাথে তাদের আদিতম দৈবশক্তিকে স্মরণ করে আসছে যুগযুগান্ত ধরে, সেই গর্জনেই গর্জে উঠেছিল সেদিনের ‘খণ্ডা-মুখিয়া’ (খাঁড়াধারী মুখিয়া) জটবা —
–‘বূঢ়াল পেন্টা!’
ধূসর আদিম প্রজ্ঞা-পরম্পরার প্রাকৃত-সংস্কারে তৎক্ষণাৎ প্রত্যুত্তর এল কাঠুরেদের দল থেকে —
–‘সেওয়া! সেওয়া!’
পরমুহূর্তেই আবার সেই উজ্জ্বল উচ্ছ্বল প্রাকৃত কিশোরমূর্তি হেসে বলছে —
–‘তা, চলো আমার সাথে, চাট্টি ভাত খেয়ে প্রাণ জুড়াও আগে।’
পরম উৎসাহে আগে আগে চলতে লাগল জটবা। তার পায়ে বুঝি বনহরিণের চেতনা। লাফিয়ে পার হয় নালা-কাঁদোর-ঝিরা, তরতর করে কখনও চড়তে থাকে পাহাড়ি পাথুরে পাকদণ্ডি তো কখনও চেপে বসে কোনও গাছের মগডালে। পিছে পিছে তার সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে হাঁপিয়ে উঠল কাঠুরিয়ার দল। তাদেরও মনে তখন হিল্লোল তুলেছে সেই কিশোরের আনন্দ। এইভাবে বন পেরিয়ে কনহন নদীর তীরে একটা পর্ণকুটিরের সামনে হল তারা। জটবা কুড়ের দরজা থেকেই হাঁক পাড়ল –
–‘মা! ও মা! দেখো কাদের এনেছি!’