সুমন গুণ
না পড়া বইয়ের তালিকা তো প্রতি মুহূর্তে বাড়ছে। সেই দুরূহ আর প্রতারক তালিকায় এমন সব নাম আছে যে মাঝে মাঝে বিপন্ন লাগে। কোনও একটা বই নিয়ে কথা বলতে গেলে এই বিপন্নতা আরও টলমল করে ওঠে। নানাজনের মুখে শোনা, নানাভাবে পড়া বা জানা বইয়ের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। মন খারাপ হয়ে যায় এসব মনে পড়লে। পড়াশোনার বাইরে দিয়ে বয়ে চলেছে এই জীবন, বারে বারে তাই শুনতে ইচ্ছে করে : সুর ভুলে যেই ঘুরে বেড়াই কেবল কাজে, বুকে বাজে, তোমার চোখের ভর্ৎসনা যে।
একটা ব্যাপার এতদিনে স্পষ্ট হয়েছে যে বই বিক্রি ক্রমশ উহ্য হয়ে উঠবে বলে যে ভয় প্রচার পাচ্ছিল, অনেকদিন ধরে, তা কাটছে। সারা পৃথিবীতেই এমন অনেক লেখক আছেন, যাঁদের লক্ষ লক্ষ বই বিক্রি হয়, অনেক সময় কিনতে চেয়েও পাঠক হাতে পান না, অপেক্ষা করতে হয়। পাওলো কোয়েলহোর ‘দ্য অ্যালকেমিস্ট’ অনূদিত হয়েছে আশিটিরও বেশি ভাষায়, জীবিত লেখকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বই বিক্রি হয় তাঁর, এই মর্মে গিনেসে নামও উঠেছে। মার্কেসের বইয়ের প্রভাব লাতিন আমেরিকায় এতটাই সর্বগ্রাসী যে বলা হয় সেখানকার লেখকেরা ‘solitude’, ‘hundred years’ কথাগুলিই এড়িয়ে চলতে চান, কারণ এগুলো লিখলেই যেন মনে হয় মার্কেস তাঁদের ওপরে ভর করছেন। আজই পড়লাম পলা হকিন্স-এর ‘The girl on the train’ নিয়ে তিনটি লেখা। দেড় কোটিরও বেশি বইটি বিক্রি হয়েছে সারা পৃথিবীতে গত অক্টোবরেই। মানসিক নানা জটিলতায় পীড়িত একটি মেয়ের অভিজ্ঞতার এই আখ্যান কদর পেয়েছে থ্রিলার হিসেবেই, কিন্তু লেখাটি আমার পড়তে হবে অন্য কারণে। আমরা যারা বনগাঁ থেকে, কৃষ্ণনগর থেকে, ব্যারাকপুর থেকে রোজ কলকাতা আসাযাওয়ার অভিজ্ঞতায় বড় হয়েছি, ট্রেন লাইনের ধারে ধারে আলোছায়াময় বিভিন্ন সংসারের চকিত পরিচয় পেয়েছি, তাদের কাছে এই বইটি আদর পাবেই। আমি নানা সময়ে ট্রেনের অভিমতহীন জানালা দিয়ে চোখে-পড়া টুকরো টুকরো ঘটনা কবিতায় অনুবাদ করেছি, অনেকগুলোই হারিয়ে গেছে। এই বইটিতে এইরকম কিছু আসন্ন কবিতার টুকরো জুড়ে জুড়ে উপন্যাসের আকার দেওয়া হয়েছে। অনেকদিন আগে ট্রেন থেকে দেখা দৃশ্য ধরা পড়েছিল একটি কবিতায় :
স্টেশনের পাশে বাড়ি, সুযোগসন্ধানী জায়গা পাওয়া গেছে
গতপুরুষের ধূর্তফলে
জানলায় কাচ, নকশাকাটা গ্রিল পরদাঢাকা
সামনে মাপা ফাঁকা জমি, সুপুরি নারকেল জবা স্বাস্থ্যকর নিম
স্টেশনে দাঁড়ালে অল্প চোখে পড়ে সংসারকল্যাণ
‘দিদি, তোর ফোন’, ‘অন্তু, সবটুকু দুধ খেতে হবে’,
‘মিস্ত্রি এসেছে, চোখে চোখে রেখো, আজ আগেই ফিরব’
এইসব দৃশ্যের কল্পনাময় বুনন রয়েছে হকিন্সের লেখায়। যতদূর বুঝলাম, প্রাক্তন সঙ্গীর বাড়িটিই যাত্রাপথে লক্ষ্যে থাকে একটি মেয়ের। ট্রেনটি সেখানে দাঁড়ায়, আরেকটি বাড়ির দাম্পত্যের ধারাবাহিকতার সঙ্গে সেই বাড়ির চর্চা যুক্ত হয়ে যায়, তারপর রহস্যময় আর সমাধানহীন নানা দুর্ঘটনার বাঁক পার হতে হতে ঘটনা এগোতে থাকে। যদিও, এটাও টের পাওয়া যাচ্ছে যে শেষে মোক্ষম একটা থ্রিলারের আকার পাবে লেখাটি আর সেই জন্যই এত সমাদর এই বইয়ের, কিন্তু ট্রেনযাত্রার দৃশ্যলিপির টানেই বইটি চেয়ে আমাজনে হানা দিলাম।
রাজনৈতিক ক্ষমতা ও যশের বশ না হয়ে লেখকের কলার তুলে বেঁচে থাকার সদ্যতম নজির: ট্রাম্পের হুঙ্কারের বিরুদ্ধে Michael Wolff ও তাঁর প্রকাশকের দাপট। ট্রাম্পের কীর্তি নিয়ে লেখা ‘Fire and Fury: Inside the Trump White House’ বইটি ট্রাম্প তুলে নিতে বলায় রাষ্ট্রনায়ককে তাঁরা যে মোক্ষম জবাব দিয়েছেন, চিরকালীন বশংবদরা তা থেকে কি কিছু শিখবেন? লেখক এমন কথাও বলেছেন : ‘ট্রাম্পের চেয়ে উপেক্ষার যোগ্য বিশ্বে আর কেউই না!’ এই বইটি পাওয়া এক্ষুণি একটু মুশকিল, তবে দেখছি আনানো যায় কি না। এই সূত্রেই আরও কয়েকটি বইয়ের তালিকা হাতে এল, যা ট্রাম্পের সেই কুখ্যাত ‘পচা’ দেশগুলির লেখকদের লেখা। ট্রাম্প সেদিন বলেছেন, অনেক “shithole countries”-এর লোকজনকে আমেরিকা আশ্রয় দিয়েছে। নরওয়ে থেকে মানুষ এলে অসুবিধে ছিল না! এই সূত্রেই আমেরিকার সেইসব লেখকদের ধ্রুপদী কয়েকটি বই নিয়ে একটি তালিকা বানানো হয়েছে, যে-বইগুলো আমেরিকার সাহিত্যে অবধারিত স্বাস্থ্য দিয়েছে। সেই তালিকার কয়েকটি বই হাতে নেবার অপেক্ষায় আছি। কয়েকটির নাম দিলাম : The Art of Death : Edwidge Danticat. Behold the Dreamers : Imbolo Mbue (এটি লেখকের প্রথম উপন্যাস)। Americanah : Chimamanda Ngozi Adichie।
‘In the Mood for Love’ দেখছিলাম বছর দেড়েক আগে। ভালোবাসাময় সম্পর্কের মধ্যে যত আন্দোলন, সব উহ্য রেখে, নীরবতার ডানা মেলে দিয়েছে ছবিটি, অনন্তের দিকে। আমার দেখা প্রেমের ছবিগুলোর মধ্যে এই মুহূর্তে এটি একেবারে আগে। ডেভিড লিন-এর ‘Brief Encounter’-এর পরে আরেকটি নিঃশব্দ প্রেমের ছবি আমাকে আচ্ছন্ন করেছিল। কাছাকাছি সময়ে একমাত্র ‘লাঞ্চবক্স’-এর অনুচ্চারিত রোমাঞ্চের কথা মনে পড়ছে। সেখানে প্রেমিকার সঙ্গে প্রথম দেখা করতে এসেও ছেলেটি, দেখা না করে, দূরের আবেগকেই বরণীয় মনে করেছিল। এই ছবিতেও প্রেমিককে ফোন করে, তার স্বর শুনেও সাড়া না দেবার দ্বিধাজড়িত অসহায়তায় থমকে যায় তরুণীটি। চিন দেশের ছবি আমি খুব বেশি দেখিনি, কয়েক বছর আগে সম্ভবত গোয়া বা দিল্লি ফিল্মোৎসবে প্রথম দেখি। আমি এই ছবির চিত্রনাট্যটি পড়তে চাই। ছবিটির শেষে একটি মন্দির স্থাপত্যের দীর্ঘ ব্যবহার আছে, এমন দীর্ঘস্থায়ী ও বাঙ্ময় নীরবতা আমি আর কোনও ছবিতে দেখেছি মনে করতে পারছি না। চিত্রনাট্যে এটা কোন সংকেতে দেখানো হয়েছে সেটা চাক্ষুষ করা জরুরি।
খুব ভাল লাগল পড়ে, একটা ভাল লেখা উপহার দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। সত্যি মন খারাপ হয়ে যায় এক এক সময় বসে চুপ করে ভাবলে। জীবন ভর রুটি রুজির তাড়নায় কত পড়ার সময় পেবিয়ে গেছে, জীবনের শেষ ইনিংসে নৈশ প্রহরীর জায়গায় পৌঁছে বড় আফশোষ হয়।