শোভন ভট্টাচার্য
মেলার চরম উদ্দেশ্য যত বাণিজ্যিকই হোক না কেন, তার পরম উদ্দেশ্য অবধারিতভাবেই সাংস্কৃতিক। হ্যাঁ, তাই বোধহয় ‘রথ দেখা’-র প্রসঙ্গ ‘কলা বেচা’-র চেয়ে আগে আসে। এমনকী তা যদি বাণিজ্যমেলাও হয়, তারও কোনও কফি ব্রেকে, বয়ে যেতেই পারে, কর্পোরেট গুলি-মারা আড্ডা-হাসি-মেলামেশার একঝলক বেহায়া বাতাস। মেলার প্রধান চাহিদাই যে মিলন। অন্তত এই বাংলায়, এই কলকাতায়। আর তা যদি হয় বইমেলা, তবে তো আর কথাই নেই। এমনটাই জেনে আসছি, দেখে আসছি ছোটবেলা থেকে। শীতের কলকাতার এক সত্যি রূপকথার নাম ছিল ‘কলিকাতা পুস্তক মেলা’, যতদিন তা ছিল ময়দানের অবারিত ঘাস-ধুলোর সংসর্গে, অগণিত গাছের ছায়ায়। ছিল সেই মাঠসংলগ্ন এক টানা জলাশয়। মেলার আলোয় ঝলমল করত তার জল। কত স্বপ্নের ফেরিওয়ালা প্ল্যাকার্ড-পোস্টার হাতে, পত্রিকা হাতে, গিটার হাতে ঘুরে বেড়াতেন সারা মেলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। কত তরুণ শিল্পী তাদের সাধ্যমতো জলরঙের কাজ নিয়ে বসে পড়তেন মেলার বিভিন্ন জায়গায়। তরুণ কবির দল, যারা টেবিল বা স্টল নেবার কথা ভাবতেও পারতেন না, নিজেদের প্রকাশিত পত্রিকা আর পুস্তিকাসমূহ মাটিতে পেতেই বসে পড়তেন যে যার মতো দল বেঁধে। সামগ্রিকভাবে, নিজেদের অজান্তেই তাঁরা সমগ্র মাঠময় গড়ে তুলতেন এক আশ্চর্য ইন্সটলেশন। বেচাকেনার ফাঁকফোকরে দুটো রসের কথা বলার পরিসর পেতেন বিখ্যাত প্রকাশকেরাও। সারা মাঠ জুড়ে বাজত মায়াবী সব গান। ধরুন, রবীন্দ্রনাথের ‘মধুর ধ্বনি বাজে’ বাজার পর যে আধুনিক বাংলা গানটি, তা হয়তো তালাত মাহমুদের ‘আধো রাতে যদি ঘুম ভেঙে যায়’ বা নির্মলা মিশ্রের গাওয়া ‘জানি বাহিরে আমার তুমি অন্তরে নও’ — যা সমাগত বই-প্রেমীদের হৃদয়কে সফলভাবেই স্থাপন করতে পারত এক বিশিষ্ট আত্মিক উচ্চতায়। একটা বিরাট খোলামেলা স্টল থাকত ইন্ডিয়ান কফি হাউসের। বই-কেনা বা নিছকই ঘোরাফেরার পর সেখানে একা কিংবা দোকা কিংবা সদলবলে ঘাসের ওপর দু’দণ্ড বসে দু’পেয়ালা কফি খাওয়ার যে কী আমেজ, যাঁদের অভিজ্ঞতা নেই তাঁরা বললেও বুঝবেন না।
আমি প্রথম একা বইমেলায় যাই ১৯৯৭ সালে, যেবার ফ্রান্স ছিল থিম, দেরিদা এসেছেন সেবার কলকাতায়, পুড়ে খাক হয়ে গেছে এক-তৃতীয়াংশ বইমেলা। মনে আছে, তখন আমি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতায় আসক্ত, সদ্য পরলোকগত কবির অপ্রকাশিত বই ‘কিছু মায়া রয়ে গেল’ মুক্তমঞ্চে প্রকাশ করলেন সুনীল। পোড়া বইমেলা ঘুরেফিরে আমি কিনলাম ‘প্রভু নষ্ট হয়ে যাই’ আর ‘ও চিরপ্রণম্য অগ্নি’। ১৯৯৮ সালে আমার বন্ধুত্ব হয় কলেজস্ট্রিটের প্রতিষ্ঠিত আড্ডাবাজ অনির্বাণ, অয়ন, অভীক, বিপ্লব, জয়দীপ, স্বর্ণেন্দু, সুদীপ্ত সহ আরও কত তরুণ কবির সাথে। অয়ন তখন ‘গান্ধার’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে। পত্রিকা বিছিয়ে সটান বইমেলার ধুলো-মাঠে বসে পড়ত অবলীলায়। তার সাথে ভিড় জমাতাম আমরাও। ১৯৯৯ সালে সেভাবেই বিক্রি হল অয়নের সদ্য প্রকাশিত প্রথম কবিতার বই ‘মায়া’ সহ আগেরবারের ‘গান্ধার’, কারণ সেবার নতুন ‘গান্ধার’ বেরোয়নি এবং রসিকজনের মনোরঞ্জনকল্পে জানাই ‘গান্ধার’ ঘোষিতভাবেই ছিল ‘একটি অনিয়মিত ত্রৈমাসিক’। ২০০০-এর মেলায় আমার আর বিপ্লব চৌধুরীর প্রথম কবিতার বইও বিক্রি করা হল সেভাবেই। বিক্রি যদিও নামমাত্র, আসলে বই বিতরণ, এবং তাই ঘিরেই ছিল আমাদের উন্মত্ত আবেগ। আমার দ্বিতীয় বই ‘এক প্রেমিকের ইচ্ছামৃত্যু’ অফবিট থেকে বেরিয়েছিল ময়দানের শেষতম বইমেলায়, ২০০৬ সালে। সেবছর আক্ষরিক অর্থেই মৃত্যু হয়েছিল সেই সত্যি রূপকথাটির। অন্তত যাঁরা তার আগেকার কলকাতা বইমেলা দেখেছেন, তাঁদের কাছে।
বাকি যাকিছু কাজের কাজ তখন হত, চলছে প্রতিবছরই নিয়মিত। হয়তো সেসব ক্রিয়াকলাপ আজ থেকেই চালু হয়ে যাবে আবার। কেননা আজ, ৩১ জানুয়ারি, ২০১৮ থেকে সল্টলেকের সেন্ট্রালপার্ক সংলগ্ন মাঠে সর্বসাধারণের জন্য চালু হয়েছে ৪২তম আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলা। প্রতিবারের চেনা ছবিগুলো দেখার আগে মনে মনেই ফুটে উঠছে তাই। উদ্বোধনের মঞ্চ আলো করে গতকালই রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক-সাংস্কৃতিক দায়িত্ব মিটিয়ে গেছেন। আজ হয়তো যথারীতি, প্রতিষ্ঠিত কবি সাহিত্যিকগণ বড় প্রকাশনের স্টলে দাঁড়িয়ে নিজের বিক্রীত বইয়ে বইয়ে সই বিলিয়ে চলেছেন অকাতর। সন্ধেবেলা চেলাচামুণ্ডা নিয়ে কবিতা-গল্প পাঠ করতে অডিটোরিয়ামের মঞ্চে উঠছেন সগৌরবে। মাঠময় তাঁদের সদলবল মার্চপাস্টেও নিশ্চয়ই খামতি হয়নি বিশেষ। ছকবাজেরা দাদা-বাবুদের অপ্রতিরোধ্য তেল মারার কাজটি চালিয়ে যাচ্ছেন নাছোড় নিষ্ঠাসহযোগে। বিক্রিবাট্টাও আগের চেয়ে খুব কিছু কমবে বলে মনে হয় না। কারণ বইমেলার চরম আর পরম উদ্দেশ্য আজ একাকার হয়ে, মেলাটিকে স্রেফ একটা বইবাজারের চেহারা দিয়েছে। স্টলের সংখ্যা কমছে, স্টলের মাপ ছোট হচ্ছে, পোল্ট্রির মতো প্যাভিলিয়নে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে ছোটমাপের স্টলগুলোকে, শুধু দিনের পর দিন উদর ফুলে উঠছে ফুড কোর্টের, টিভি চ্যানেলের স্টলগুলোর চিৎকার বেড়ে উঠছে দিনের পর দিন, আর সেখানেই ভিড় জমছে সবচেয়ে বেশি। সব মিলিয়ে একবিংশ শতাব্দীর গ্লোবাল বাঙালির সাংস্কৃতিক দৈন্য এবং ক্রমবর্ধমান রুচিহীনতার সার্থক প্রতীক হয়ে উঠেছে আজকের ‘কলিকাতা পুস্তক মেলা’। ভিড় হয়তো এখনও হচ্ছে প্রচুর, কিন্তু সেই ভিড়ের আজ আর কোনও সাংস্কৃতিক চরিত্র নেই। পাগলে পাগলে মিলন হবার অলৌকিক অবকাশ আজ হারিয়ে যেতে বসেছে পুরোপুরি।
সম্ভবত কোনও জমায়েত আজ আর গিল্ড কিংবা প্রশাসনের পছন্দ নয়, তাই পাঁচটা মানুষ মিলিত হয়ে কোথাও যেন বসতে না পারেন, তার দিকে পুলিশি নজর থাকছে ভরপুর। ফলে আড্ডা উবে গেছে, থেমে গেছে গান, কিন্তু মাননীয় সরকার বা গিল্ড বোধহয় ভুলে যাচ্ছেন, কলকাতা বইমেলার চরিত্র যদি কোনওদিন দিল্লি বইমেলা বা ফ্রাঙ্কফ্রুর্ট বইমেলার মতো হয়ে যায়, স্বাভাবিকভাবেই তা চরিত্রহীন হয়ে নিজের গুরুত্ব হারাতে থাকবে ক্রমশ।
রবীন্দ্রনাথ একটি প্রবন্ধে (‘সাহিত্য’ নামক প্রবন্ধবইটির কোনও এক প্রবন্ধে) লিখেছিলেন — মুলো জিনিসটা খাদ্যবস্তু হিসেবে ব্যবহৃত হয় বলে তা মানুষের জীবনে ফুলের তুলনায় বেশি কার্যকরী। তাই বলে কি পৃথিবীর সব ফুলের বাগান উপড়ে মুলোর ক্ষেত করে দেওয়া চলে? বইমেলা প্রসঙ্গেও আজ সেই কথাটাই মনে হচ্ছে। বইমেলায় বই তো থাকতেই হবে, কিন্তু তার ভেতর থেকে সমস্ত বৈঠকের পরিসর যদি লুপ্ত হয়ে যায়, অদূর ভবিষ্যতেই যে আমাদের সাধের কলকাতা বইমেলা এক উপচে-পড়া মুলোর ক্ষেতে পরিণত হবে, তাতে আর সন্দেহের কিছুমাত্র অবকাশ নেই।
gia-nostal … khub bhalo laglo pore ..