বইমেলার ঝাঁকিদর্শন — দ্বিতীয় দিনের দুনম্বরি বইমেলা

প্রিয়ক মিত্র

 

উমবের্তো ইকো হাতুড়ি, চামচ প্রভৃতির সঙ্গে বইয়ের তুলনা করে বলেছিলেন এইসব বস্তুর আলাদা করে কোনও প্রগতি নেই। চামচের বিকল্প যেমন উন্নততর চামচ হতে পারে না, বইয়ের বিকল্পও তেমন উন্নততর বই হতে পারে না। এক্ষেত্রে উন্নততর বই বলতে ইকো বোঝাতে চেয়েছেন কাঠামোর দিক থেকে এগিয়ে থাকা বই, যা বইয়ের সাধারণ চেহারাকে একবাক্যে ছাপিয়ে যাবে।

এখন এই প্রযুক্তির পাগলা ঘোড়ার এন্তার দৌড় দেখতে দেখতে আমাদের কাছে বইয়ের স্বাভাবিক চেহারার ঔজ্জ্বল্য কমে গেছে কিঞ্চিৎ, একথা মনে হতেই পারে। কিন্তু ইকো চামচের প্রসঙ্গ তুলেছিলেন প্রয়োজনীয়তার মেটাফর হিসেবে, অন্তত আমার স্বল্পবুদ্ধি তাই বলে। বই আর কিন্ডেলের মধ্যে লড়াইতে তাই শেষমেষ বই-ই টিকে থাকবে, কারণ প্রথমটির নিরিখেই দ্বিতীয়টির অস্তিত্বের নির্মাণ ঘটেছে।

যাক গে, মোদ্দা কথা, এসব সারেগামা পেরিয়ে আমাদের বইয়ের কাছে দুদণ্ড বসতে ইচ্ছে করে (ভাস্কর চক্রবর্তীর পংক্তির কাছে ক্ষমা চেয়ে)। কাজেই বাঙালির বাৎসরিক বইমোচ্ছবে ভিড় কমে না কোনওবারই। থিমপুজোর প্যান্ডেলের মতন সে ভিড় খানিক উঁকি দিয়েই ছত্রভঙ্গ হয় না, তা ছড়িয়েছিটিয়ে মিলেমিশে থাকে মহামানবের সাগরতীরে।

বইমেলা নিয়ে এক আজব লোফালুফি শুরু হয়েছে এক দশক আগে থেকে। এক পরিবেশবিদ এবং এক আইনজীবীর দাক্ষিণ্যে মূলত, বইমেলা উদ্বাস্তু হল। আমাদের ছোটবেলার ময়দানের ক্যালকাটা বুক ফেয়ার-এর স্মৃতির সরণী বেয়ে যে বিস্তীর্ণ লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন দেখতে পাই, যে মাঠধুলোর গন্ধ বেয়ে ছোটবেলার আনন্দ, দক্ষভারতী, পত্রভারতী দেখা যায় সেসব কবেই ভোঁ ভাঁ। পার্ক সার্কাস ময়দানে বইমেলা হবে হবে করেও হল না, নানাবিধ আপত্তির দরুণ। যুবভারতীতে ডার্বি হয় জানা ছিল, সেখানে বইমেলা কীকরে হবে? তাও হল। দুবছর পরপর। তারপর একলাফে খানিক এগিয়ে বইমেলা চলে এল মিলনমেলায়। কীসব গঠনমূলক কাজের জন্য সেখান থেকে আবার শর্টজাম্প মেরে বইমেলা চলে এল সেন্ট্রাল পার্কে।

এতবার বাড়ি পাল্টানোর পরেও কলকাতা বইমেলা তার জৌলুস হারায়নি বটে। বরং নানাবিধ পাঁচফোড়ন মিশেছে রান্নায়। কেমন সে সব? ধরা যাক, টিভিচ্যানেলের কথা। তাদের বড় বড় মঞ্চ প্রস্তুত হতে দেখা যায় এখন, আজ বইমেলায় হাজির হয়ে দেখা গেল নতুন সংযোজন ওয়েব চ্যানেলের স্টল। সেইসব স্টলে নানাবিধ সেলেব ভিড় জমাবে, আলোর ঝলকানি হবে, যেমন খুশি সাজো জাতীয় কীসব জানি হবে, অনেকের সুপ্ত প্রতিভা ঝলসে উঠবে। তাতে বইমেলার গন্ধ পালাই পালাই করলেই বা! তবে বইমেলার মুক্তমঞ্চ বলতেই চিরকাল মমার্ত-র কথা মনে পড়ে। আজ প্রায় পাঁচ ঘণ্টার সফরেও মমার্ত-র মুক্তমঞ্চ চোখে পড়ল না।

দুপুর দুটোয় আজ বইমেলায় হাজির হয়ে দেখা গেল কালকের মতন হাতুড়ি-পেরেকের ঠোকাঠুকি শোনা যাচ্ছে না সর্বত্র। নির্মীয়মাণ বাড়ির মতন পরিস্থিতিও নয়। মোটামুটি সেজে উঠেছে মেলা। একটি সরকারি চত্বর আছে মেলার। সেখানে বাউলসঙ্গীত চলে দিনভর, তার আশেপাশে মোবাইল ডি এস এল আর-এর খচখচ চলছে যথারীতি। কলকাতা পুলিশের বিশাল স্টলের সামনে একটি ট্রাফিক পুলিশের ম্যানিকুইনের সামনে দেখা গেল প্রবল ভিড়, কেন তা ভগাই জানে।

জুয়েলারি, ব্যাঙ্ক এসবের অযাচিত স্টল পেরিয়ে পছন্দের প্রকাশনের স্টল পাওয়া যাচ্ছে কিছু। মানচিত্র ছাড়া পছন্দসই স্টল খুঁজে পেতে হন্যেও হতে হচ্ছে এই ভুলভুলাইয়াতে। নলিন দাশের স্টলে মিষ্টির জন্য যখন মারপিট চলছে, তখন দুই সতীর্থকে দেখলুম হন্যে হয়ে খুঁজছে সুবর্ণরেখা-র স্টল। “এই তো দেখলাম এক্ষুণি, গেল কই স্টলটা?”

স্টলনম্বর ছাড়া সবই গোলকধাঁধা।

ধরা যাক কোনও স্টলের নম্বর ৩০০। এবারে এক নতুন নকশা হয়েছে, ৩০০-র আশেপাশেই ৩০০এ বা ৩০০বি দেখা যাচ্ছে। ৩০০এ যদি খুঁজতে হয় কাউকে, তাহলে তাকে হ্যারি পটারের সেই স্টেশনের মতন কোনও ফাঁকফোঁকর খুঁজে পেতে হবে।

ধানসিড়ির স্টলে খুঁজলাম অদ্রীশ বিশ্বাসের ‘অ্যাসাইলামের ডায়েরি’, নিষাদ-এর স্টলে অর্ক দেবের সম্পাদনা করা সাক্ষাৎকার-এর সংকলন ‘কথাবার্তা’, মনফকিরা-তে অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়ের ‘খাচ্ছি কিন্তু গিলছি না: সুত-মিত বাঙালি সমাজে’ দ্বিতীয় খণ্ড, রাবণ-এর স্টলে অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়েরই ‘অতঃকিম ভূত’, সপ্তর্ষি-তে অর্ণব সাহার ‘বাঙালির যৌনচর্চা: বটতলা থেকে হলুদ বই’ এবং চন্দ্রিল ভট্টাচার্যের ‘রোয়াবনামা’; এই বইগুলো জানা গেল ছাপাখানা থেকে এখনও রওনা দেয়নি। বোঝা গেল প্রেসপাড়ায় এখন যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজকর্ম চলছে।

লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ন কাল সন্ধেবেলা বেশ খানিকটা ফাঁকা ছিল, আজ বিকেল চারটে নাগাদ ভরাট। টেবিলে টেবিলে চেনামুখ দেখে থমকে দাঁড়ানো, খেজুরে আলাপ চলছে। হঠাৎ হঠাৎ চোখে পড়ছে অত্যাশ্চর্য কোনও বই। কাগজের ঠোঙা-র টেবিলে যেমন পেলাম ‘ময়দান ও পানশালা’, রাহুল পুরকায়স্থ-হিরণ মিত্র-র অদ্ভুত যুগলবন্দি। হুলিও কোর্তাসারের কবিতার অনুবাদ করেছেন শৌভিক দে সরকার। ছোটবেলার স্মৃতিতে থাকা ‘বাংলার মুখ’-এর কথা মনে পড়িয়ে দিয়ে ‘তবু বাংলার মুখ’ চোখে পড়ল। বোধশব্দ-র টেবিল এখনও অপেক্ষা করে আছে কবিতার বিপণন সংক্রান্ত নতুন সংখ্যার জন্য।

ডিমনিটাইজেশনের পর থেকেই স্টলে স্টলে বসেছে কার্ডের মেশিন, এটিএমও মজুত মেলার মধ্যেই। লোকজনের হাতে চৈত্র সেলের মতন বিবিধ প্রকাশনের প্যাকেটের সমাহার। কেনাকাটা, বিক্রিবাটা চলছে। রকমারি বই। রকমারি বেসাতি। কোনও কোনও স্টলে একেবারেই বই নেই। জুয়েলারির স্টলে আবার রত্নবিজ্ঞানের বই। বিনিপয়সায় বিলি হচ্ছে লিফলেট, ক্যালেন্ডার ইত্যাদি প্রভৃতি। সিনে সেন্ট্রালের স্টলে দেখা গেল টরেন্টবিলাসী বাঙালি বাংলা সিনেমার ডিভিডি কিনছে। চোখে পড়ার মতন বাড়ছে বিবিধ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্টল, তাদের অঢেল শাখা আছে গোটা বইমেলা জুড়ে। ধর্মকে এড়িয়ে জিরাফের নাগাল পাওয়া দুষ্কর। আছে বিভিন্ন ডিলার এবং জালি প্রকাশনের স্টল, যেসব জায়গায় মহাভারত থেকে সস্তার সেক্স জার্নাল, জাল ফেলুদা থেকে সফট পানু — সব মেলে।

যাদের দেখা গেল ইতস্তত, তাদের গন্তব্য বোঝা দায়। পাঠকরাই কি কেবল মৌতাত জমায় বইমেলায়? কে জানে! নানাবিধ ঝলক আশেপাশে। থিম ফ্রান্সের স্টল দেখে চিত্ত ঝলমল করে উঠতেই পারে, বইমেলার মাঝে এমন সব আলোর ঝলক! ধুলো কম, ঘাস নেই, পাথুরে সব। যুগল, একলা আহত প্রেমিক, গলায় প্ল্যাকার্ড ঝোলানো বেপরোয়া বইবিক্রেতা এবং উদাসীন ক্রেতা। এখনও চোখে পড়ল না পোর্ট্রেট, মেহেন্দির হিড়িক এবং সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে প্রমাণ করা অসামান্য ব্যক্তিটিকে। সেলফিকাতরতার ফলে চলার পথে বিঘ্ন ঘটছে সময়বিশেষে। মাঝেমধ্যেই লোডশেডিং হচ্ছে। তখন সব বইকেই দেখে শতাব্দীর সেরা ভূতের গল্প বলে ভ্রম হচ্ছে।

বইমেলার মহরৎ শেষে এখন জোরকদমে বইপার্বণ শুরু। বিরিয়ানি পুলিপিঠেকে কেন্দ্র করে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান, বাড়ি ফেরা নিয়ে চাপা টেনশন এসব পীড়াকে বাড়িয়ে বেজে চলেছে বিজাতীয় বইমেলার নতুন থিম সং। তার ফাঁকেই আচমকা কানে ভেসে এল, “তোমাকে দেখছি বইমেলা চত্বরে/তোমাকে দেখছি স্বতন্ত্র-র স্টল/অনুষ্টুপের ঠেলাঠেলি ভেদ করে/আসলে কিন্তু তোমাকে দেখার ছল।”

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4885 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...