রাজিব মাহমুদ
একটা এ্যাডফার্মের ক্রিয়েটিভ টিমের সাথে আজ হাসানের ইন্টারভিউ। চাকরিটা হলে ওর কাজ হবে মূলত দু’টো: (১) ক্লায়েন্টের প্রোডাক্টের বিবরণ শুনে টিমের সাথে বসে বিজ্ঞাপনের কনসেপ্ট তৈরিতে সাহায্য করা ও (২) বিজ্ঞাপনের সাথে যাবে এমন ট্যাগলাইন, পাঞ্চলাইন ও ক্যাপশান তৈরির আইডিয়া দেয়া। চাকরিটা হলে ইংরেজিতে ইভনিং এম.এটা চালিয়ে যেতে পারবে ও। পাশাপাশি ওর কবিতা লেখার যে অবাধ্য শখ সেটাকেও প্রশ্রয় দেয়া যাবে খানিকটা। যদিও তখন দিনরাত কাজ আর পড়াশোনার চাপে চ্যাপ্টা বাসি বার্গারের মতো হয়ে যাওয়ার বাঘ-সিংহভাগ সম্ভাবনা রয়েছে।
ইন্টারভিউয়ের দিন এসব ভাবতে ভাবতে কিছুটা দ্বিধা নিয়ে পৌঁছে গেল এ্যাডফার্মের সুদৃশ্য ত্রিতল অফিসটাতে। ঢুকতে গিয়ে দেখল ওর ঢোকার অনুমতি নেই। যে যার মতো কার্ড সোয়াইপ করে ঢুকে যাচ্ছে। একজনের দয়া হল ওর উপর। কেন এসেছে জিজ্ঞেস করে পাতলা ঠোঁটে আরও পাতলা একটা হাসি মিলিয়ে যেতে দিতে দিতে তার পেছন পেছন ভেতরে ঢুকতে বলল হাসানকে। বাইরে ঘন রোদের সাথে দীর্ঘ ও ঘর্মাক্ত চিপকাচিপকি’র পর ভেতরের এসি’র মিষ্টি বাতাস ওকে ‘কফি উইথ বর্ষা’র চৌকস হোস্ট বর্ষার মতো একটা সুগন্ধি ও শীত-শীত ‘হাগ’ দিল। শরীরটাও এতক্ষণের ক্লান্তি’র উইকেটটুকুকে আউট করে দিয়ে ‘হাগ’টাকে লুফে নিল আর কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘাম শুকিয়ে বেশ ‘ভদ্রস্থ’ একটা ইন্টারভিউ-সুলভ চেহারা দেয়ার চেষ্টা করল হাসানকে। দিলও বটে।
যাই হোক, ইন্টারভিউটা ঠিক টেবিলের এপাশ-ওপাশ মার্কা ফর্মাল ইন্টারভিউ না। ক্রিয়েটিভ টিম বলে কথা! এরা তাকে ইন্টারভিউ করবে ওদের অফিসের নিজস্ব ক্যাফেটেরিয়ায়। পুরো টিম চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসল। সংখ্যায় এঁরা চারজন; একজন একটা টেবিলে হেলান দিয়ে সামনের দিকে পা ছড়িয়ে বেশ কায়দা করে দাঁড়ালেন। আরেকজন টেবিলে চড়েই বসলেন। আর বাকি দু’জন হাসানের দুই পাশে চেয়ার টেনে বসলেন। দুইজন পুরুষ ও দুইজন নারী। দলনেতা গোছের যাকে লাগছে তিনি নারী। একে একে সবাই নিজেদের পরিচয় দিলেন ইংরেজিতে আর শেষজন তার দিকে ফিরে মুখে মাকড়সার ঝুলের মতো বিনবিনে হাসি ঝুলিয়ে বললেন, ‘এ্যান্ড ইউ?’
হাসান ঠিকই ধরেছিল। দলের প্রধান একজন নারী। পরিচয় পর্বেই সেটা পরিষ্কার হয়ে গেল। হাসান নিজের পরিচয় দিয়ে টিমের বিভিন্নজনের নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে গেল। এরপর শুরু হল ইন্টারভিউয়ের দ্বিতীয় পর্ব। এই পর্বে ওকে কয়েকদিন পর আসা একটা আন্তর্জাতিক ক্রিমের উদযাপিত নারীদিবস উপলক্ষে নারীদের উদ্দেশ করে ইংরেজিতে ৮-১০ শব্দের একটা উৎসাহমূলক ট্যাগলাইন লিখতে বলা হল। সময় ২০ মিনিট। এক কাপ গরম কফি আর সাথে কাগজ-কলম দিয়ে বেরিয়ে গেল পুরো টিম। ২০ মিনিট পরে ফিরে এসে ওর ট্যাগ-লাইন নিয়ে বিশ্লেষণ করবেন তাঁরা।
অনেক চিন্তা করেও প্রথম দশ মিনিট লেখার মতো নতুন কিছু পেল না হাসান। সব উপমা-উৎপ্রেক্ষারা ওর মগজের বহু ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে আর নীচের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে টিটকারি মারছে ওকে। হাল ছেড়ে দেয়ার আগের মুহূর্তে হঠাৎ খসখস করে ও লিখে উঠল ‘দিস ইজ ইওর ডে। গিভ বার্থ টু ইট।’
ক্রিয়েটিভ টিমের সবাই এসে গেল ঠিক ২০ মিনিট পরেই। ওর ট্যাগলাইনটা পড়ে টিমের নেতার ভ্রূ কুঁচকে উঠল। ওর দিকে ভীষণ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে তিনি বললেন–
‘আচ্ছা আপনাদের পুরুষদের প্রব্লেমটা কোথায়? হোয়্যার এগ্জাক্টলি লাইজ দ্য প্রব্লেম?’
হাসান কী বলবে ভেবে পেল না। হাতের বুড়ো আঙুলটা তর্জনীর সাথে চেপে ধরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই নেতা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন–
‘ইউ এ্যান্ড বাই ‘ইউ’ আই মিন অল মেইল্স থিংক দ্যাট উইমেন উইল ওনলি গিভ বার্থ, রাইট? মানে মেয়েরা অন্য আর কিছু করার উপযুক্ত নয়, তাইতো!’
ওর লোমকূপের শুকিয়ে যাওয়া ঘাম পুকুরের জন্য কাটা গর্তে পানি জমা’র মতো ফিরে আসতে শুরু করেছে। এসি’র শীতল বাতাস তার কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলেছে। ও ধীরে ধীরে তর্জনীটা আবার বুড়ো আঙ্গুলে চেপে ধরে বলে,
‘ওয়েল আই ডিডনট মিন দ্যাট। ইউ নো, ইট্স নট রিয়েলি এ ফার্টিলিটি মেটাফোর। ইট্স লাইক… ইউ গিভ বার্থ টু আ নিউ ডে। দ্য ডে ইজ অল ইয়োর্স। মানে দিনটাকে আপনি একেবারে নিজের মতো করে জন্ম দিন… ইউ নো… এটা একজন পুরুষের ক্ষেত্রেও হতে পারে। ইট’স নট আ লিটারাল বার্থ…’
নেতা এবার সব ধৈর্য হারিয়ে আগের হুঙ্কারটুকুর সাথে আরও দু চিমটি চিৎকার যোগ করে উনার উষ্মাকে দিলেন এক নতুন মাত্রা– ‘দেন আই উড সে দিস ইজ এ রাবিশ মেটাফোর কামিং ফ্রম ইওর আটার শ্যোওভিনিজম… উইমেন উইল জাস্ট গিভ বার্থ… ও মাই গড… হাউ ডিমিনিং!’
টিমের অন্য মেয়েটা হাসানকে কিছুটা সমর্থন দিতে চাইল, ‘আপা আই গেস… হি হ্যাজ আ পয়েন্ট… ইউ নো… দিস্ ইজ আ কম্পেরিজন বিটুইন…’
এবার মানবসুলভ হুঙ্কারে আর পোষাল না, শোনা গেল সিংহের গর্জন– ‘হেল উইথ ইওর রাবিশ কমপেরিজন… কাম অন্ অনিন্দিতা… ইউ আর আ উওম্যান… হাউ কাম ইউ আর সাপোর্টিং সাচ এ শ্যোওভিনিসটিক ক্যাপশন… শেইম অন ইউ’।
কিছুক্ষণের জন্য নীরবতা। দলনেতা আবার বলল, ‘বরং সকালে যে ফিমেল ক্যান্ডিডেট এ্যাপিয়ার করেছিল ওর ক্যাপশানটা ভালো ছিল। শিরোট, “হ্যাভ এন আইসক্রিম এ্যান্ড স্পয়েল ইওর ডায়েট টুডে”… হাউ স্মার্ট এ্যান্ড ক্রিস্প।’
হাসান যখন আবার রোদে বেরিয়ে এল, আকাশ ঘোলা হতে শুরু হয়েছে। অফিসের বাইরে এক পা দিতেই আকাশ আড়াল করে রাখা বিলবোর্ডটা চোখে পড়ল ওর। বিলবোর্ডে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা হাসছে। খোলা চুল, হাতে একটা বিশাল আইসক্রিম যাতে সে একটা চোখ বন্ধ করে কামড় বসাতে যাচ্ছে।
নিচে লেখা, ‘হ্যাভ এ্যান আইসক্রিম এ্যান্ড স্পয়েল ইওর ডায়েট’।
এর মাঝে কোনও ভাব-আলামত না দিয়েই বিলবোর্ড, আইসক্রিম, হাসান আর মেয়েটাকে ভিজিয়ে দিয়ে আঙুরের মতো বড় বড় পিন্স এ্যান্ড নিড্লস ফোটায় বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। বৃষ্টিটা’র বৈশিষ্ট্য কি নারীর নাকি পুরুষের নাকি সবার এ নিয়ে ভাবার সময় এই ‘মনোরম’ মেট্রোপলিসের অধিবাসীদের নেই। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে এর মধ্যেই তারা পিলপিল করে এদিক-ওদিক-সেদিক ছোটাছুটি শুরু করে দিয়েছে।