সত্যশ্রী উকিল
শান্তিনিকেতন থেকে প্রায় আটচল্লিশ বছর আগে দিল্লিতে এসে প্রথমটা একেবারেই ভালো লাগেনি। অবশ্য ভালো লাগার কথাও নয়। কোথায় আদিগন্ত খোলা মাঠ ও গাছপালা, আর কোথায় রূপনগরে তেতলার ‘বর্সাতি’ — দুটি ছোট কামরা এবং কিছুটা ছাদ! বাবা একদম দেরি না করে ভর্তি করে দিলেন রাইসিনা ইস্কুলে, অজিত চক্রবর্ত্তী মশাই তখন প্রিন্সিপ্যাল।
দিল্লিতে এসে এতটাই মুষড়ে পড়েছিলাম যে, প্রথম দিকে ইস্কুলেই যেতাম না। বাড়ি থেকে সকালে বেরোতাম বটে বাসভাড়া আর টিফিনের পয়সা পকেটে নিয়ে, কিন্তু সারা দিন পড়ে থাকতাম রৌশ্নারা–বাগে। মুঘল দিল্লির সঙ্গে সেই প্রথম আলাপ শুরু হল। তখন শীতকাল, ফেরিওয়ালারা শস্তায় রাঙাআলু পোড়া বিক্রি করছে লেবু–মশলা মাখিয়ে — এদিককার লোকে বলে শক্করকন্দ্ — তারই দু–চার দোনা সাবড়ে সেই মুঘল উদ্যানে সময় দিব্যি কেটে যেত। তখনই লক্ষ করেছিলাম, রৌশনারা–বাগের কিছু গাছে অনেক বড় বড় বাদুড়ের বসতি আছে! আজও প্রত্যেক শীতকালে অন্তত একবার পোড়া রাঙাআলু খাওয়ার অভ্যাসটি কিন্তু ঠিক রয়ে গেছে…
তবে ইস্কুলে না যাবার ধোঁকাবাজিটা বেশি দিন টেঁকেনি — সেখান থেকে খবর গেল বাড়িতে, বাবা সচেতন হলেন। আর তা’ছাড়া ধীরে ধীরে ইস্কুলেও বন্ধু জুটল অনেক। মাস্টারমশাই ও দিদিমণিদের স্নেহ–ভালোবাসা তো ছিলই।
ইতিমধ্যে বাবা আমাদের জন্য একটা দারুণ নিয়ম বানালেন — বললেন, “আচ্ছা বেশ, প্রত্যেক রবিবারে সকাল সাতটায় তোরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবি, সারা দিন বাসে করে দিল্লি ঘুরে দেখবি — ঘরে ফিরবি সন্ধ্যা সাতটায় — সারা দিনে তোরা কোথায় যাবি সেটা নিজেরাই ঠিক করিস, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরলে গল্প হবে।”
দিল্লির সঙ্গে আলাপটা যেন তর্তর্ করে এগিয়ে চলল!
প্রথমেই দেখলাম তুঘ্লকাবাদ আর ঘিয়াসিদ্দীন তুঘ্লকের মক্বরা, দেখলাম মেহ্রৌলি গ্রামে যোগমায়ার মন্দির আর চিশ্তি সুফী কুতুবুদ্দীন বখ্তিয়ার কাকীর দর্গাহ্। দেখা হল কুতুবমিনার ও তৎসংলগ্ন স্থাপত্যগুলি। মুগ্ধ হয়েছিলাম ইল্তুৎমিশের সমাধি দেখে। তুর্কো–আফ্ঘান পৌরুষের সঙ্গে কবরের পাশেই অবস্থিত ছোট্ট মিহ্রাব্টির কী নান্দনিক কন্ট্রাস্ট্!
রাজা চন্দ্র–র লৌহস্তম্ভকে দু’হাতে পিছমোড়া করে বেড় দিয়ে ধরবার সে কতই যে অক্ষম প্রচেষ্টা! সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে বাবা–মা’র সঙ্গে চলত সারাদিনের গল্প বলা।
মনে আছে, তুঘ্লকাবাদ ও মেহ্রৌলী শেষ করে তবেই ঢুকেছিলাম শাহ্জাহানাবাদে। তবে এর মধ্যেই একটা ব্যাপার ঘটল — বাবা ঠিক করলেন, প্রত্যেক মাসের মাসকাবারী বাজার আনার সময়ে আমাকেও তাঁর সঙ্গে খরি–বাওলীতে যেতে হবে। খরি–বাওলী হচ্ছে শাহ্জাহানাবাদের অন্যতম প্রধান মুদিখানার বাজার — চাল, ডাল, আটা, চিনি, লবণ, তেল, মশলা — সব পাওয়া যায় ওখানে। আর আছে থরে থরে ড্রাইফ্রুটের দোকান — বাদাম, চিল্গুজা, অঞ্জীর, খোবানী। সে এক স্বর্গরাজ্য!
আমরা বাপ–বেটায় জওয়াহর–নগর থেকে তাঙ্গা ধরতাম বাজারে যাবার জন্য। তাঙ্গা ছুটত রিজ্ (Ridge) পেরিয়ে আন্ডার–হিল্ রোড ধরে মোরি–গেটের পথে, নিকোলসন সেমেট্রি (Nicholson Cemetery)–র ধার ঘেঁষে।
সত্য বলতে কি, এই বাজার করতে করতেই যেন মুঘল দিল্লির সঙ্গে পরিচয়টা সর্বপ্রথম দানা বাঁধল…
পরবর্তীকালে, মানে ১৯৮০র দশকের মাঝামাঝি, আমি যখন দিল্লির ত্রিবেণী কলা সঙ্গমে ও. পি. শর্মার অধীনে ফোটোগ্রাফির ক্লাস নিতাম, তখন ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নিয়ে চুটিয়ে পুরনো দিল্লিতে ঘুরেছি। প্রধানতঃ শাহ্জাহানাবাদ এবং মেহ্রৌলী ও তুঘ্লকাবাদে। যে দিল্লীর সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত ১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে পরিপূর্ণভাবে ১৯৭০-র দশকের গোড়ায়, সেই শহর আজ পাল্টে গেছে অনেকটাই। আমার দিল্লিতে ঘন্টেওয়ালাহ্-র লাড্ডু আর ছেনারামের করাচী-হালুয়ার সঙ্গে হাভেলী আজ়মখানের কাবাব-কোফ্তার বিরোধ ছিল না।
*লেখাটির সঙ্গে গোটা কয়েক ছবি দেওয়া গেল। সেই দিল্লির ছবি, যেটা ছিল আমার ভালোবাসার শহর।
আহা, মন ভরে গেল। অধম ও রাইসিনা সন্তান ।
জেনে ভালো লাগলো। আমি ১৯৭৩-এর ব্যাচ। আপনি?