রায়ানের আশ্চর্য আলো

দেবব্রত কর-বিশ্বাস

 

কোনও ঘরে উজ্জ্বল আলো জ্বালানো থাকলে একদম ভালো লাগে না রায়ানের।

রায়ান বেশিরভাগ সময়ে একটা ডিম লাইট জ্বালিয়ে রাখে ঘরে। বেশ একটা মায়া মায়া হয়ে থাকে গোটা ঘর… রায়ান খুব ভালো ছেলে। মানে সমাজ যাকে ভালো ছেলে বলে মানে, ঠিক তেমন। পড়াশোনায় ভালো, ছবি আঁকায় ভালো, চাকরিতে ভালো, ফ্যামিলিতে ভালো, প্রেমে ভালো, সময়জ্ঞানে ভালো। সবই ভালো-ভালো। নিখুঁত বলে যদিও কিছু হয় না, তাও মোটামুটি রায়ানকে নিখুঁত বলাই যায়। তা এই রায়ান খুব বিপদে পড়েছে। কিন্তু সেটা কাউকে বলতে পারছে না। এমনকী নিজেরও ভাবতে অস্বস্তি হচ্ছে। আসলে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে তার জীবনে, গত কয়েকদিন ধরে। অভ্যেসবশত সে রাতে ঘুমোনোর সময়েও ওই ডিম লাইটটা জ্বালিয়ে রাখে। সেভাবেই ঘুমোয়। কিন্তু হয়েছে কী, গত কয়েকদিন ধরে সে ঘরে না থাকলেও ওই আলোটা জ্বলে থাকছে। প্রথমে সে ভেবেছিল ইলেকট্রিসিটির প্রবলেম। ইলেকট্রিকের লোক ডাকবে বলেও ভেবেছিল। কিন্তু সে আরও একটা অদ্ভুত জিনিস দেখেছে বলে আর লোক ডাকেনি। সে দেখেছে আলোটা মোটেই আর বাল্ব থেকে বেরোয় না। প্রথম দিন বেরিয়েছিল। তারপর থেকে আলোটা বাল্ব থেকে সরে সরে গেছে নতুন নতুন জায়গায়। গত সোমবার বাল্ব থেকে আলো বেরিয়েছিল। মঙ্গলবার সিলিং। বুধবার পূবদিকের দেওয়াল। বৃহস্পতিবার দক্ষিণদিকের জানলার ঠিক ওপরে… এভাবেই আলো তার স্থান বদলেছে। ওই ঠিক একই পাওয়ারের আলো। আর মায়া হয়ে থাকা গোটা ঘর। সবথেকে অবাক ব্যাপার এই ঘটনায় রায়ান এতটুকু ভয় পায়নি। তাই শুক্রবার নাগাদ আলোটা যখন জানলার ডানদিকে সরে গেছে তখন হাই উঠছিল রায়ানের। কিন্তু রাতে ঘুমোবার আগে একবার ফোন না করলে প্রেমিকারা রেগে যায়, তাই সে কল করল জাগরীকে।

–হ্যাঁ, হ্যালো!

–কী করছিস?

–এই তো, তোর সঙ্গে কথা বলে ঘুমোব, কাল আবার ভোর ভোর বেরোতে হবে, রাত থাকতেই…

–আচ্ছা একটা কথা বল, ওই ভোর ভোর, মানে যখন সূর্যের আলো পুরোপুরি ফোটে না, তখন কেমন মনকেমন করে, বল?

–মনকেমন? খামোখা মনখারাপ করবে কেন?

–উফ, মনখারাপ নয়। মনকেমন!

–শোন রায়ান, আমার না এত কিছু ভাবার সময় থাকে না সবসময়। সত্যি বলতে ভালোও লাগে না…

–আচ্ছা ছাড়… আমি আমার ফ্ল্যাটটা বদলাতে চাই জাগ!

–কেন? এনি প্রবলেম?

–বাদ দে…

–দিলাম।

জাগরী আজকাল কেমন উদাসীন ব্যবহার করে রায়ানের সঙ্গে। যেন তার কোনও কিছুতেই তার কিছু এসে যায় না। অবশ্য তাতে তেমন কোনও প্রবলেম নেই রায়ানের। জাগরী মেয়ে ভালো। প্রেমিকা হিসেবেও। এই যে কাল অত ভোরে ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছে, ফিরবে সেই এক সপ্তাহ পরে। ওয়ার্কশপ আছে। জাগরীর সঙ্গে একটি ছেলেও যাচ্ছে ওদের অফিসের। অথচ এই নিয়ে রায়ানের মনে কোনও কমপ্লেক্স নেই। সন্দেহও নেই। সে ভালোই জানে ছেলেটিকে কাজ ছাড়া খুব বেশি এন্টারটেইন করবে না জাগরী। এই ছেলেটিই ক’মাস আগে জাগরীকে প্রোপোজ করেছিল। অফিসের সবাই জানে। বসও। আর জেনেশুনেই জাগরীর সঙ্গে ছেলেটিকে পাঠিয়েছে। কেন? ভাবতে গিয়ে ঘুম পেল রায়ানের। সে চোখ বুজল। চোখ বোজার আগে মনে হল আলোটা অল্প দপদপ করছে। চোখ বোজার পরে স্বপ্ন পেল তার। স্বপ্ন তো মানুষের পায়। খিদে, ঘুম, যৌনতার মতো স্বপ্নও পায়। শুধু অন্যগুলোর মতো মানুষ সেটা বুঝতে পারে না। রায়ান দেখতে শুরু করল, একটা টর্চ তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে। ধীরে ধীরে। সেই টর্চ কারও হাতে ধরা। যার হাতে ধরা তাঁর মুখে মাস্ক। হাতে গ্লাভস। চারপাশে ঠিক একইরকম দেখতে আরও কতগুলো শরীর। তাঁদের হাতেও টর্চ। কিন্তু সেগুলো জ্বলছে না। কিন্তু টর্চগুলো যেন রায়ানের দিকেই তাক করা। রায়ান কিছু বুঝতে পারল না। বিশেষ পাত্তাও দিল না। সে ছোটবেলা থেকেই জানে, ঘুমের মধ্যে থাকা স্বপ্নগুলোকে পাত্তা দিতে নেই। জেগে দেখা স্বপ্নগুলোই আসল স্বপ্ন। এবার একটা অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। যে টর্চটা জ্বলছিল, সেটা নিভে গেল, অন্যটা জ্বলল, তারপর অন্যটা, তারপরে আবার অন্যটা। এভাবেই আলোটা টর্চে টর্চে ঘুরে বেড়াতে লাগল। রায়ান এবার একটু থমকাল। ব্যাপারটা তার চেনাচেনা লেগেছে। সে এবার বলল — “কী চাই? কে আপনারা?” সবকটি টর্চ দু’বার দপদপ করে জ্বলল, শোনা গেল — “আমরা রায়ান। আপনার ভালো চাই।” রায়ান? সে আবার কী? নিজের নাম শুনে অবাক হয়ে রায়ান জিজ্ঞেস করল — “আমি কি স্বপ্ন দেখছি?”… আবার একইরকম ভাবে টর্চের আলো জ্বলে-নিভে উত্তর দিল — “না। স্বপ্ন নয়।  আপনি যা দেখছেন তা বাস্তব।” উঠে বসল রায়ান। চোখ কচলাল। টিপিক্যাল সবাই যেমন করে, তেমনই গায়ে চিমটি কেটেও দেখল। নাঃ। সে ঘুমিয়ে নেই। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে চারপাশের দেওয়ালের দিকে তাকাল, কোথাও আলো জ্বলে নেই। ঘড়ি দেখল রায়ান — একটা বাজে। রাত একটা। তাঁর ঘরে এই মুহূর্তে ছ’জন একইরকম দেখতে মানুষ। একইরকম মানে সবার মুখ একরকম কিনা বোঝা যাচ্ছে না, কারণ সবার মুখে মাস্ক লাগানো। কিন্তু চেহারার আকার দেখে তো বোঝা যাচ্ছে যে তাঁরা একরকম। রায়ান বলল — “আপনারা বসুন না!” মানুষগুলোর হাতের টর্চ জ্বলে উঠল — “আমরা বসতে আসিনি।” রায়ান উত্তর দিল — “বেশ। কিন্তু আপনাদের আসার কারণ কী? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।” আবার একইরকম ভাবে সবকটি মানুষ উত্তর দিল — “আমরা রায়ান। আমরা আপনার অংশ। আপনি আমাদের ভীষণ খাটাচ্ছেন। কিন্তু সেটা আপনি করছেন শুয়ে শুয়ে। মানে আপনার নিজের অজান্তেই আপনার মস্তিষ্ক ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমাদের পরিশ্রম করাচ্ছে। তাই আমরা আপনার ঘুম ভাঙাতে এসেছি।” রায়ান অবাক হল — “আপনারা কী বলছেন আমি জাস্ট বুঝতে পারছি না। আমি তো এখন জেগে আছি!” উত্তর এল — “হ্যাঁ। আপনি আজকাল জেগে ঘুমোচ্ছেন, আর সেই কারণে আমাদের পরিশ্রম বাড়ছে। আমরা সেটা করতে রাজি নই। অকারণে আমরা কাজ করি না।” এবার রায়ানের একটু রাগ হল — “দেখুন যা বলার পরিষ্কার করে বলুন। আমি ধোঁয়াশা পছন্দ করি না। আমি স্পষ্ট কথার মানুষ।” এবার একজনের থেকে পাল্টা এল — “না। আপনি নিজেকে নিয়ে যা ভাবেন আপনি আসলে তেমন নন। আপনি নিজের ইমেজ বাঁচিয়ে রাখতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখেন নিজস্ব ভাবনার হাত থেকে। আর আপনি যখনই এমন করেন তখনই আমরা সক্রিয় হতে বাধ্য হই। এই যেমন আপনার কলিগ আপনার থেকে কিছু টাকা চেয়েছিল আপনি দেননি।” রায়ান বলল — “হ্যাঁ। দিইনি। ও নিজের বউকে গিফট দেবে, টাকা শর্ট পড়েছিল, আমি কেন দেব?” উত্তর এল — “দিলে কি খুব প্রবলেম হত? আসলে আপনি দিতে চাননি কারণ আপনি কাউকে কোনওদিন ওই গিফটটা দেওয়ার সুযোগ পাননি।” রায়ান চুপ করে রইল। এবার অন্য একজন বলতে শুরু করল — “ফ্ল্যাট কেনার পরে আপনার কাছে বেশি টাকা ছিল না, সেই কারণে কোম্পানির একটা প্রজেক্ট বে-আইনিভাবে একটি সংস্থাকে পাইয়ে দিয়ে সেখান থেকে টাকা নিয়েছিলেন, অথচ আপনি জানেন, আপনার এই কাজের জন্য কোম্পানির অনেক টাকা ক্ষতি হয়ে যেতে পারে।” রায়ান বলল — “হ্যাঁ করেছি, অনেকেই এমন করে। আমি সেই টাকা কোনও ভালো কাজে লাগাব ভবিষ্যতে।” উত্তর এল — “না। আপনি তেমনটা করবেন না, কারণ টাকাটা খরচ হয়ে গেছে মার্সিডিজ গাড়ি কিনতে। আর নিজের স্বপ্নপূরণ করতে আপনি কারও ক্ষতিও করে দিতে পারেন, এতটাই উচ্চাভিলাষ আপনার।” রায়ানের অস্বস্তি হতে শুরু করল। আরেকজন বলতে শুরু করল — “আর আপনার প্রেমিকা জাগরী? তার ব্যাপারে কিছু বলার আছে আপনার?” রায়ান উত্তর দিল — “নাঃ। আয়াম সো হ্যাপি উইথ হার।” পাল্টা উত্তর এল — “নো, ইউ আর নট… কারণ জাগরী আপনাকে ভালোবাসে না। কোনওদিনই ভালোবাসত না। সে এখন যার সঙ্গে অফিসিয়াল ট্রিপে গেছেন, তার সঙ্গেই সম্পর্ক চলছে। এই যে একটু আগে ওর সঙ্গে ফোনে কথা বলার নাটকটা করছিলেন, সেটা কেন করছিলেন? আপনি তো আদৌ ওকে ফোন করেননি। করলেও অবশ্য সে ফোন তুলত না।” রায়ান মাথা নামিয়ে বিড়বিড় করতে শুরু করল। লোকটা আবার বলল — “কারণ আপনার ভ্রান্ত ধারণা যে জাগরী আসলে আপনাকে ভালোবাসে, আর সেটা বারবার সবার কাছে প্রমাণ করতে চান, নাহলে অন্যরা ভাববে আপনি হেরে গেছেন।” সেটা শুনে রায়ানের চোখ যেন নিজেকে ভিজিয়ে নিল। এবার আরেকজন বলা শুরু করল — “গত মাসে মেডিক্যাল চেক-আপে আপনার সুগার ধরা পড়েছে। মাত্র তেত্রিশ বছরেই সুগার! ডাক্তার বলেছেন, অতিরিক্ত মানসিক চাপ থেকে হয়েছে। তিনি খাবারেও কিছু রেস্ট্রিকশন দিয়েছেন। আপনি যে লুকিয়ে লুকিয়ে রোজ মিষ্টি খাচ্ছেন, জানেন কতটা ক্ষতি করছেন নিজের? এত লোভ কেন আপনার? কোনও মায়াদয়া নেই নিজের জীবনের ওপর?” চোখ মুছে এবার হেসে ফেলল রায়ান। বলল — “মায়াদয়া? কেন থাকবে? কে দেখিয়েছে মায়াদয়া আমার ওপর? সবাই চেয়েছে আমি শুধু সফল হই। শুধু জাগরীই আমার সাকসেসকে পাত্তা দেয় না।” কথাটা টেনে নিয়ে অন্য একজন বলতে শুরু করল — “নিজের ওপর মায়াদয়া নেই? তাহলে পাড়ার সেই ছেলেটা, যে সদ্য সাইকেল চালানো শিখছিল, সে চালাতে গিয়ে টাল সামলাতে না পেরে আপনার গায়ে পড়ে গেছিল। ধাক্কা লেগে আপনিও পড়ে গেছিলেন। হাত-পা সামান্য কেটে গেছিল আপনার। সেই কারণে আপনি ছেলেটাকে অমন বেধড়ক মেরেছিলেন কেন?” রায়ান ছিটকে বলে উঠল — “সে তো রেগে গেছিলাম।” পাল্টা এল — “কিন্তু এতটা রাগ হওয়া কি সুস্থতার লক্ষণ?” রায়ান আবার রেগে গেল — “কী বলতে চাইছেন আমি অসুস্থ?” এবার অন্যজন উত্তর দিল — “আচ্ছা লাস্ট অফিস পার্টিতে ড্রিংক করে বাড়ি ফিরে পাশের ফাঁকা ফ্ল্যাটের কাজের মেয়েটির সঙ্গে যেসব কাজ করেছিলেন সেটা নিশ্চয়ই সুস্থতার লক্ষণ নয়!” এবার রায়ান চমকে গেল। এত কিছু জানল কীকরে লোকগুলো? এরা কারা? রায়ানের মনে এই প্রশ্ন এসেছে বুঝতে পেরে কিনা কে জানে ছ’জন লোকই দুলেদুলে হাসতে লাগল। ঠিক রায়ান যেমন দুলে দুলে হাসে। মুখে মাস্ক পরা বলে হাসির আওয়াজ পাওয়া না গেলেও বুঝতে অসুবিধা হল না ওরা আসলে অবিকল তার মতোই। রায়ানের গা-হাত-পা কেমন ছেড়ে দিল। অসাড় লাগল নিজেকে। তার এতদিনের ‘ভালো’ ইমেজ এরা টুকরো টুকরো করে ভেঙে দিল বলে। রায়ানের ঘুম পেল। ওই লোকগুলো কাছে এসে তাকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিল। তারপর ছ’জনের হাতে ছ’টি টর্চ জ্বলে উঠল। তারা সমস্বরে বলল — “রায়ান, আমরা আপনার কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্য। আমরা আপনার ষড়রিপু। যখন আপনি আমাদের জাগিয়ে দেন, তখন আমরা টর্চ জ্বালাই। এগুলোর মানে আপনাকে সতর্ক করা। আমাদের বেশি কাজ করতে বাধ্য করলে আপনি মরবেন। নিশ্চিত মরবেন।”

রায়ান মরার মতো ঘুমোল বাকি রাত। একটু বেলাতে ঘুম থেকে উঠে দেখল, মোবাইলে ছ’টা মিসড কল। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল সে। তারপর দেখল, দেওয়ালের নানা জায়গায় কালো কালো পোড়া দাগ। গতরাতের কথা মনে পড়ল তার। সে রঙের মিস্তিরিকে ডাকার সিদ্ধান্ত নিল। দাগগুলো ঢাকতে দেওয়ালে রঙের পোচ দিতে হবে। ‘ভালো’ ছেলেদের মাঝেমাঝে নিজের ঘরের দেওয়ালে রঙ করাতে হয়।  

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4880 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...