সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
সুপ্রিয়া চৌধুরীর বিহনে বাংলা ছবিতে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হল একথাটা খুব অলীক সত্য নয়। এইজন্যই বলছি যে সুপ্রিয়াকে অন্যান্য অনেকের মতোই তাঁর প্রাপ্য মূল্য দেওয়া হয়নি। বরং বলা ভালো কানন দেবী, সুচিত্রা সেন, মাধবী মুখোপাধ্যায় বা অপর্ণা সেনকে নিয়ে যতটা কথা বলা হয়েছে, সুপ্রিয়া চৌধুরীকে নিয়ে ততটা কথা বলা হয়নি এবং অনেক সময়ই তাঁকে শুধুমাত্র উত্তম-সঙ্গিনী মনে করা হয়েছে। কিন্তু নিজ গুণে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সিনেমার এক অপর মেরু; অন্তত জনপ্রিয় সিনেমার ক্ষেত্রে। সুপ্রিয়া বিষয়ে কথা বললেই প্রথমেই যে কথা বলা হয়ে থাকে তা হল ‘মেঘে ঢাকা তারা’ এবং ‘কোমল গান্ধার’-এর প্রসঙ্গ। কোনও সন্দেহ নেই যে ঋত্বিক ঘটকের এই দুটি ছবিতে সুপ্রিয়া দেবীকে যেভাবে ব্যবহার করা হয়েছে তা তাঁর নশ্বরতা মুক্ত হবার জন্য যথেষ্ট। এবং সুপ্রিয়া এই দুটি ছবিতেই প্রায় জাতীয় প্রতীক হিসেবে কাজ করেছেন। মানবিক থেকে দেবী হয়ে ওঠা বা দেবী থেকে মানবিক যে অবতরণ, এই যে স্তরান্তরের গল্প ঋত্বিক সুপ্রিয়াকে দিয়ে বলিয়ে নিতে পেরেছেন তার মূল কারণ হল সুপ্রিয়া দেবীর মধ্যে লিরিক্যাল রেখার অভাব। সুপ্রিয়ার মুখচ্ছবি অনেকটাই আমাদের আটপৌরে পাথুরে রুক্ষ বাস্তবতার, এবং ঠিক সেই কারণেই নীতা বা অনসূয়ার চরিত্রে তাঁকে অনেকটা খাপ খাইয়ে দেওয়া যায়। এবং আরেকটা বিরাট কারণ সেটা হচ্ছে তাঁর কণ্ঠস্বর যাকে বলে ভয়েস এবং তাঁর দীর্ঘ গ্রীবা। এই দীর্ঘ গ্রীবাটিকে ঋত্বিক ঘটক এমনকি বতিচেল্লির অনেক প্রতিকৃতির মতো করে ব্যবহার করেছিলেন ‘কোমল গান্ধার’-এ এবং সেটা গ্রেট মাদার ইমেজ তৈরি করার ক্ষেত্রে তাঁকে সহায়তা দিয়েছিল। সুচিত্রা সেনের মধ্যে বা ধরা যাক অরুন্ধতী দেবীর মধ্যে এই শারীরিক বৈশিষ্ট্য ছিল না। এটা সুপ্রিয়ার ছিল এবং সুপ্রিয়ার থাকায় তাঁর অন্যান্য জনপ্রিয় ছবির মধ্যেও একধরনের আক্রমণাত্মক চেহারা থাকতে পারত। এই আক্রমণাত্মক চেহারাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা। কেননা সুপ্রিয়া চৌধুরী সাধারণভাবে বড় পরিচালক বলতে আমরা যাঁদের বোঝাই তাঁদের হাতে খুব বেশি ব্যবহৃত হননি। কিন্তু যখন ব্যবহৃত হয়েছেন, যেমন ধরা যাক অজয় করের ‘শুন বরনারী’ যেখানে তিনি উত্তমের বিপরীতে ছিলেন, বা অসিত সেনের ‘স্বরলিপি’ যেখানে তিনি সৌমিত্রর বিপরীতে ছিলেন, এমনকি যদি আমরা সত্তর দশকের বিখ্যাত ‘বনপলাশীর পদাবলী’-র কথা ভাবি যেখানে তিনি উত্তম কুমারের বিপরীতে, সব ক’টিতেই দেখা যাবে যে তাঁর শরীরী ভঙ্গিমা এবং তাঁর উপিস্থিতি পুরুষ চরিত্রকে ছাপিয়ে যায়। এই ছাপিয়ে যাওয়াটা যদি আমরা ধরি, যদি ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র বিশেষ কতগুলি কম্পোজিশন ধরি সনৎ-এর সঙ্গে তাহলে দেখব সুপ্রিয়া অনেক সময় সর্বগ্রাসী মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে থাকেন সিনেমার পর্দায়। এই সর্বগ্রাসী মুহূর্তগুলোই বাংলায় পুরুষতান্ত্রিক সমাজে একধরনের কাস্ট্রেশন কমপ্লেক্স তৈরি করে এবং সেই জন্যই সুপ্রিয়া চৌধুরীকে আমরা সাধারণত লিরিক্যাল ইমেজের নায়িকা হিসেবে মনে করি না। অনেকক্ষেত্রেই তাঁর যৌনতাও অস্বস্তিদায়ক হয়ে দাঁড়ায় বাংলা সমাজে। যেমন ১৯৬৯ সালের ‘মন নিয়ে’ ছবিটিতে তিনি ছোট বোনের যে যৌন বিপর্যয়ের চিত্রপট এঁকেছিলেন তা তাঁর অসামান্য অভিনয় দক্ষতার স্বাক্ষর এবং আমার মনে হয় অমসৃণ অভিনয়ের ক্ষেত্রে সুপ্রিয়া চৌধুরী অন্যান্য বাঙালি নায়িকাদের সহজেই ছাপিয়ে যেতে পারতেন। নক্ষত্রের জীবনে যে উপচে পড়া উপাদানগুলি লাগে অর্থাৎ সিনেমার পর্দার বাইরেও তার যে উপস্থিতি থাকে তা সুপ্রিয়ার ছিল। এই জন্য নয় যে তিনি শুধু উত্তম কুমারের প্রণয়িনী ছিলেন, এই জন্যও নয় যে তাঁর দাম্পত্য জীবনে কিছু অশান্তি ছিল, বরং দেখা গেছে তাঁর রান্নার সুঘ্রাণ বাঙালির টেলিভিশনের পর্দাকে ছাপিয়েছে, তাঁর বিষয়ে নানা গসিপ নানা সময়ে খবরের কাগজ তৈরি করেছে, অর্থাৎ যাঁকে ফরাসি সমাজতাত্ত্বিক এডগার মোরাঁ বলেন স্টার হলেন একজন স-জীবনী অভিনেতা, সুপ্রিয়া তা ছিলেন। এবং সুপ্রিয়ার যে পুরুষালিপনা, সেই পুরুষালিপনা পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের মহিলা অভিনেত্রীদের থেকে পাওয়াটা যথেষ্টই কষ্টসাধ্য ছিল। এই যে বাঁধা-ধরা ফ্রেমের বাইরে চলে যাওয়া, যেটাকে ঋত্বিক সঠিকভাবে ব্যবহার করেছেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’-তে এবং ‘কোমল গান্ধার’-এ যা দেখে সত্যিই আমাদের মনে হয় সুপ্রিয়ার জন্যই বোধহয় সেই ডায়লগ ‘দাদা আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম’। সত্যি বলতে গেলে সুপ্রিয়া চৌধুরীকে বাংলা সিনেমা প্রকৃত অর্থে তাঁর প্রাপ্য জায়গা করে দিতে পারল কিনা তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। এটা খুব আশ্চর্যের যে উত্তম কুমারের যে সিনেমা থেকে উত্থান, সেই ‘বসু পরিবার’-এ সুপ্রিয়া দেবীও ছিলেন। আসলে পঞ্চাশ দশক জুড়ে যে মধ্যবিত্ত একটা সামাজিক প্রতিকৃতি চাইছে বিশেষ করে নিচু তলার মধ্যবিত্ত, সুপ্রিয়া তাকে একটা অবয়ব দান করতে পেরেছিলেন এবং সেই অবয়ব দানের কাজটা তিনি রোমান্টিক মেলোড্রামার বাইরে এসে করতে পারতেন, এটাই তাঁর সাফল্য। উত্তম কুমারের সাথে তাঁর ছবিগুলো যদি মন দিয়ে দেখা হয়, তবে দেখা যাবে সুপ্রিয়ার যে উপস্থিতি তা কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলীর রাধিকার উপস্থিতির মতো নয়। তাঁকে কিছুটা স্বাধীন এবং অনমনীয় দেখায়। অর্থাৎ তাঁর মধ্যে একটা অনিয়মের লাবণ্য আছে। এই অনিয়মই তাঁকে বাংলা ছবিতে স্বাক্ষরিত করেছে। বিদায় সুপ্রিয়া।