মোহাম্মদ ইরফান
সংস্কৃতির অন্যতম বাহন ভাষা। ভৌত এবং ভার্চুয়াল যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি বিশ্বজুড়ে ভাষা-সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটাচ্ছে আজ। বিশ্বায়নের এই কালে একে অন্যের সম্পদ আহরণ করে সমৃদ্ধ হতে পারত ছোট বড় সব ভাষাই। তবে তেমনটি কি হচ্ছে? ভাষীগরিষ্ঠ অনেক ভাষাই আজকাল স্বাতন্ত্র হারাচ্ছে বৈশ্বিক কিংবা আঞ্চলিকভাবে প্রভাবশালী ভাষার আধিপত্যে, আগ্রাসনে। আবার ভাষাতাত্ত্বিক, প্রযুক্তিবিদদের উদ্ভাবনী সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়ে পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে অনেক অনেক ভাষা। সাইন্স ম্যাগাজিনের দুহাজার চারের এক নিবন্ধ অনুযায়ী, বিশ্বজোড়া ভাষা-শুমারীগুলোতে অনুমিত ছ’ থেকে সাত হাজার ভাষার শতকরা নব্বই ভাগের অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন।
জীব বৈচিত্র্য রক্ষার মতো ভাষা বৈচিত্র্য রক্ষায়ও বিশ্ব সম্প্রদায়ের সম্মিলিত অঙ্গীকার জরুরি। বাঙালির ভাষা আন্দোলনের ফলশ্রুতি একুশে ফেব্রুয়ারি গত প্রায় বিশ বছর ধরে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে ভাষা সংস্কৃতির বৈচিত্র্য সংরক্ষণের লক্ষ্যে নিবেদিত একটি দিবস হিসেবে। এবারের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেও এই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে জাতিসংঘ। লক্ষণীয় যেটি সেটি হচ্ছে ঐতিহ্য সংরক্ষণ কিংবা অধিকারই শুধু নয় বহু ভাষাভাষী সংস্কৃতির আর্থসামাজিক প্রয়োজনীয়তার কথাটিও উঠে এসেছে মাতৃভাষা দিবসের এবছরের থিমে। টেকসই উন্নয়নের যেসমস্ত লক্ষ্য নির্ধারিত হয়েছে দুহাজার ত্রিশ সালের মধ্যে বিশ্বব্যাপী অর্জনের প্রত্যাশায় সেই গন্তব্যে পৌঁছানোর কর্মযোগে মাতৃভাষার চর্চা ও বিকাশকে একীভূত করার অভিপ্রায় ফুটে উঠেছে জাতিসংঘের আহ্বানে।
বাস্তবতা হচ্ছে, ভাষায় ভাষায়, আদতে ভাষাভাষীদের মধ্যে শক্তির যে ব্যবধান ইতঃমধ্যে তৈরি হয়ে গেছে সেটি ব্যাপক। এই ব্যবধান যদি বেড়েই চলে তবে উন্নয়নের সূচক কাঁটাগুলো জায়গামতো পৌঁছে গেলেও দিনের আর পরিবর্তন হবে না। ব্যাবিলনের বিশাল টাওয়ারেরও চেয়েও উঁচু উন্নয়নের ফিরিস্তি নিয়ে পরস্পরের অবোধ্য ভাষায় পুনঃপুন পরিকল্পনা প্রণয়নে পর্যুদস্ত হবে অভিশপ্ত মানব প্রজাতি।
চিত্র ১: ভাষার বৈচিত্র
বৈচিত্র্য আর বৈষম্য দুটোই সুস্পষ্ট প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তে। ওয়াশিংটন পোস্ট এথনোলগ নামক সংস্থা থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত সংশ্লেষণ করে তৈরি করা এক হিসেবে দেখিয়েছে শুমারীকৃত সাত হাজার একশত দুইটি ভাষার প্রায় এক তৃতীয়াংশ এশিয়ার, আরও এক তৃতীয়াংশের কাছাকাছি ভাষা আফ্রিকার, তেরশোর অধিক ভাষা প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের, সহস্রাধিক ভাষা বিদ্যমান উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায়, বাকি দুশো ছিয়াশিটি ভাষা চালু আছে ইউরোপে। (চিত্র ১)। ভাষাভাষীর মাপে এই সপ্ত সহস্রাধিক ভাষার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ভাষা ডজনখানেক। সাতশো কোটি লোকের দুই তৃতীয়াংশ-ই এই বারোটি ভাষার আওতায় পড়ে। অনেকেই হয়ত জেনে অবাক হবেন, ইংরেজির অবস্থান এদের মধ্যে তৃতীয়। জনশক্তিতে অগ্রাগামী চীনাদের ভাষা (সকল উপভাষা-সহ) আছে এক নম্বরে। হিন্দি আর উর্দু সম্মিলিতভাবে আছে দ্বিতীয় স্থানে। ইংরেজি, আরবি, স্প্যানিশ আর আরবির পরেই বাংলার অবস্থান লাকি সেভেনে (চিত্র-২)।
চিত্র ২: ভাষার জনমিতি
পঁচিশ কোটি বাঙালির প্রাণের ভাষা বলেই বাংলা এত সহজে মরে যাবে না এটি ভেবে বসে থাকা ভুল হবে। কালের আবর্তে সুচর্চিত, সুশৃঙ্খল ভাষা সংস্কৃতও অনেক পেছনে পড়ে গেছে। এই পেছনে পড়ার যুক্তিসঙ্গত অনেক ব্যাখ্যাই দিয়েছেন পণ্ডিতেরা। হিন্দুত্ববাদীদের অনেকেই সংস্কৃত ভাষার গতিধারা রুদ্ধ হওয়ার পেছনে মোগল-তুর্কী শাসকদের রাজকীয় ফরমানই প্রধান কারণ বলে মনে করেন। শুরুতে (দ্বাদশ শতাব্দীর দিকে) মুসলিম হামলাকারীরা সংস্কৃতের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করলেও পরবর্তীতে ভারতীয় সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষকতাই করেছেন মুসলিম শাসকেরা। পঞ্চদশ শতাব্দীর সুলতান জয়নাল আবেদিন, ষোড়শ শতাব্দীর সম্রাট আকবর এমনকি সপ্তদশ শতাব্দীতে সংস্কৃতের শেষ বড় কবি-সমালোচক “রসগঙ্গাধর” “ভামিনীবিলাস” খ্যাত জগন্নাথ পণ্ডিতরাজের পৃষ্ঠপোষক সম্রাট শাহজাহান পর্যন্ত মুসলিম শাসকেরা উৎসাহ দিয়েছেন সংস্কৃতি চর্চায়। সংস্কৃত যুগের অবসান বরঞ্চ ত্বরান্বিত হয়েছে ইংরেজ আমলে। তবে এর পেছনে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিই যে দায়ী সেটি নিশ্চিত করে বলা যায় কি? ইংরেজরা সংস্কৃত কলেজ করে দিলেও সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক ঈশ্বরচন্দ্র কিন্তু আমজনতার উদ্দেশ্যে যা লিখেছেন তা বাংলাতেই লিখেছেন। রাজার দরবার আর পুজোর কারবারে সীমাবদ্ধ থাকার কারণে আমজনতা কোনওদিনই সংস্কৃতে পটু হয়ে ওঠেনি। প্রাচীন কিংবা মধ্যযুগীয় ভারতের যে সমস্ত রাজ্যে রাজকীয় আনুকূল্যে সংস্কৃতের চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছিল (যেমন, বিন্ধ্য পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত বিজয়নগরে ১৩৪০ থেকে ১৫৬৫ সালের মধ্যকার সময়টুকু) সে সব রাজ্যে আজকালকার মতো সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু থাকলে সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার বিবর্তনে ভূমিকা রাখায় সীমাবদ্ধ না থেকে সংস্কৃত হয়তো আরও অবিকৃতভাবে থেকে যেত। আজকের বাংলায়, বাংলাদেশে লিখিত ভাষা আর মুখের ভাষায় যেভাবে প্রতিনিয়ত ঢুকে পড়ছে ইংরেজি আর হিন্দি। এটি যতটা না ঘটছে প্রয়োজনে তার চেয়েও অনেক বেশি প্রতিস্থাপনে। প্রযুক্তিগত দুর্বলতার কারণে বাংলা লিপিও প্রতিস্থাপিত হচ্ছে রোমান হরফ দিয়ে, যদিও রোমান হরফে বাংলা বর্ণমালার অনেক বর্ণেরই কোনও সমকক্ষ নেই। এই ধারা বজায় থাকলে দু, চারশো বছর পরের কোনও বাঙালির কাছে আজকের বাংলা “এরাইভাল” ছবির ভিনগ্রহবাসীর হেপ্টাপড এ এবং হেপ্টাপড বি-র মতো অচেনা/অজানা দুটি ভাষা বলেই মনে হবে হয়তোবা। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র কিংবা ভাস্করের সিদ্ধান্ত শিরোমণি পড়ার জন্য আজ যেমন আমাদের অনুবাদ কিংবা পণ্ডিতের আশ্রয় নিতে হয় তেমনি হয়তোবা রবি ঠাকুর কিংবা নজরুলের দর্শন মিলবে কদাচিৎ কোনও বিশেষ ক্ষণে, বিশেষজ্ঞের হাত ধরে।
চিত্র ৩: ভাষার অর্থনীতি
এই যে এক ভাষার ওপর অন্য ভাষার কর্তৃত্ব এটির জন্য কেবল ভাষা ব্যবহারকারীদের দায়ী না করে বরং এর পেছনের রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশ্লেষণ করা দরকার। ইংরেজি ভাষা জনমিতির হিসেবে তিন নম্বরে থাকলেও ইংরেজি বলা লোকজন পৃথিবীর মোট উৎপাদনের যে অংশ নিয়ন্ত্রণ করে সেটি চীনা এবং হিন্দি/উর্দুভাষী জনগণের সম্মিলিত উৎপাদনের চার গুণেরও বেশি (চিত্র ৩)। মাতৃভাষা ইংরেজি এমন লোকের সংখ্যা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার মাত্র সাত শতাংশের মতো হলেও ইংরেজি রাষ্ট্রভাষার সম্পদশালী দেশগুলোর প্রথম চারটি পৃথিবীর মোট সম্পদের পঞ্চাশ ভাগেরও বেশি তাদের দখলে রেখেছে (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৪১.৬%, যুক্তরাজ্য ৫.৬%, কানাডা ৩% আর অস্ট্রেলিয়া ২%)। এই বিপুল সম্পদ, বিশাল আয়ের সবটুকুই যে ইংরেজিভাষী জনগণের মধ্যে সুষমভাবে বণ্টিত তা মোটেই নয়। তবে এইসব রাষ্ট্রগুলোর একজন নিম্নবিত্ত লোকও অন্য ভাষাভাষী দেশের মধ্যবিত্তের লোকের তুলনায় অনেক বেশি স্বচ্ছল। এই স্বচ্ছলতা নূতন জ্ঞান, উদ্ভাবন, প্রযুক্তি, সংস্কৃতি সবকিছুতেই একটি সুবিধাজনক অবস্থা তৈরি করে ইংরেজিভাষীদের জন্য। সম্পদে আয়ে শক্তিশালী দেশ, সেইসব দেশের কোম্পানিগুলো নিয়ন্ত্রণ করে অর্থনীতি, চাকুরি-ব্যবসা। উন্নয়নশীল দেশের লোকেদের উপায় থাকে না ইংরেজি না শিখে। তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে ইংরেজি ভাষায় তৈরি আনন্দোপকরণ হাতের কাছে পাওয়ার পর দেশীয় ভাষায় তৈরি জিনিস জোলো মনে হয় ইংরেজি জানা লোকেদের। জ্ঞান, বিজ্ঞান, বিনোদন, ব্যবসার প্রয়োজনে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি শিক্ষার যে সাম্প্রতিক হুজুগ তাতে বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজি বলা লোকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় দেড়শো কোটিতে। দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ইংরেজির পরে যেই ভাষাটির জনপ্রিয়তা সেই ফরাসী জানা লোকের সংখ্যা মাত্র বিরাশি লাখ (চিত্র-৪)।
চিত্র ৪: ভাষার প্রাধান্য
চিত্র ৫: ভাষার প্রকাশনা
এই দ্বিতীয় ভাষার বৈষম্যের কুপ্রভাব মাতৃভাষায় বৈষম্যের চেয়েও ক্ষতিকর, বিশেষ করে জ্ঞানের জগতে। সৃষ্ট জ্ঞানের বিতরণের প্রধান মাধ্যম ভাষা। আর নব্যলব্ধ জ্ঞানের ভাগ যদি সবচেয়ে বেশি সংখ্যক লোকের কাছে পৌঁছে দিতে হয়, সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়ার আশা করতে হয় তবে সবচেয়ে বেশি লোক যে ভাষা বোঝে সেটিতে না লিখে উপায় থাকে না পণ্ডিতদের। স্বভাবতই ইংরেজিতে লিখা গবেষণা প্রবন্ধের সংখ্যা যেটি শ খানেক বছর আগেও জার্মান ভাষায় লিখা প্রবন্ধের তুলনায় পিছিয়ে ছিল, সেটি আজ ছাড়িয়ে গেছে সব ভাষাকে অনেকদূর। এই ব্যবধান দিন দিন বাড়ছে, ধনে ধনার্জনের মতই জ্ঞানে জ্ঞানার্জনের ধনাত্মক ঊর্ধ্বারোহণ ইংরেজি জানা লোকেদের এগিয়ে দিয়েছে অনেকটা (চিত্র-৫)। জ্ঞানের এই ব্যাপক সঞ্চয়কে সব ভাষাতে ছড়িয়ে দিতে পারলেই কেবল ইতঃমধ্যে পাহাড়সম সম্পদের অধিকারীদের সম্পদ আরও বাড়ানোর কাজে নিযুক্ত না থেকে এই জ্ঞানভাণ্ডার কাজে আসবে গোটা মানবজাতির। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জিত হওয়ার সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে আরও। সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারের আত্মাহুতি সফল হবে আরও একবার।