দেবব্রত শ্যামরায়
বুড়ি কলকাতাটা কলকাতাতেই থেকে গেছে বটে, কিন্তু এহেন কলকাতায় বার্ষিক বইমেলার অবস্থান অতটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। বরং ওটি যেন হাইজেনবার্গের খটোমটো তত্ত্ব আর গেছোদাদা একই দেহে হল লীন। গত পরশু আপনি যাকে ধুলো পায়ে ময়দানে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন, টুক করে একবার যুবভারতী ছুঁয়েই কাল সে পৌঁছে গেছে মিলনমেলায়; যখন ভাবা হল এখানে সে শেষমেশ গেঁড়ে বসল বোধহয়, উঁহু, আজ চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম সম্পাদকের আদেশে অন্যত্র খুঁজতে এসেছি বইমেলার মুখ। বিধাননগরের বনবিতানে। দেখা পাব কি? দেখা যাক।
আজ তৃতীয় দিনে নিজেকে বেশ গুছিয়ে নিয়েছে বইমেলা। শেষ মুহূর্তের ঠোকাঠুকি শেষ। গতকালের ফাঁকা সেলফগুলো আজ রঙবেরঙ। নতুন পুস্তকতালিকা সামনে রেখে সুজন পাঠকের অপেক্ষায় বসে ছোট-বড় প্রকাশনার কর্মীরা। পড়ন্ত বিকেলে এখনও মেলা জমেনি তেমন। চায়ের বুটিক বিপণির সামনে খানিক জমায়েত। মাটির লম্বাটে ভাঁড়ে হু হু বিক্রি হচ্ছে পঁচিশ টাকার মশালা চা। এমন সময় সিগনেট-এ একাকী শ্রীজাতকে দেখতে পেয়ে মৃদু গুঞ্জন উঠল স্টলে ঢোকা তরুণীদের ঝাঁকে।
কবিতা ও কবিতা নিয়ে কিছু বই খুঁজছিলাম, চোখে পড়ল কালীকৃষ্ণ গুহ-এর কবিতা সংগ্রহ। বৈ-চিত্র ও ঋত প্রকাশনের যৌথতায় বেরিয়েছে এই বই। রাতে বালিশের পাশে রেখে পড়ার মতো সংকলন। আরও কিছু ভালো কাজ চোখে পড়ল এই স্টলে। কমলকুমার-পত্নী দয়াময়ী মজুমদারকে নিয়ে স্মৃতিচিত্র লিখেছেন প্রশান্ত মাজী। বাংলাদেশের চিত্রপরিচালক তানভীর মোকাম্মেল ও শিলাদিত্য সেন-র এক দীর্ঘ কথোপকথনও প্রকাশ করেছেন এঁরা। সিরিয়াস সাহিত্যের একগুচ্ছ জরুরি সম্ভার নিয়ে যথারীতি উপস্থিত অনুষ্টুপ। এর মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক দীপেশ চক্রবর্তীর প্রবন্ধ সংগ্রহ ‘মনোরথের ঠিকানা’, ফিদেল কাস্ত্রোকে নিয়ে রাজকুমার চক্রবর্তীর কিউবা বিপ্লবের অজানা ইতিহাস, ‘হোয়াকিন মুরিয়েতার মহিমা ও মৃত্যু’ – যে বইয়ে পাবলো নেরুদার তিনটি নাটকের অনুবাদ করেছেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। সপ্তর্ষির স্টলে নজরে এল অন্যতম প্রিয় কবি রণজিৎ দাশের বই ‘খোঁপার ফুল বিষয়ক প্রবন্ধ’। নাহ, এরপর আর নিজেকে আটকে রাখার মানে নেই কোনও।
স্টল থেকে বেরিয়ে এক পেয়ালা চায়ে চুমুক দেওয়ার ফাঁকে আবার খুঁজছিলাম বইমেলার মুখ। এবারের থিম প্যাভেলিয়ন ফ্রান্সের সামনে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে নিজস্বী তুলছে যে যুগল, বইমেলা কি তাদের? যে কিশোর ছেলেটা জলের পাউচ শেষ হয়ে এলে আবার ভরে দিচ্ছে খালি ড্রাম, এই বইমেলার কাছে কি তার কোনও দাবী আছে? নাকি সেই জেন-ওয়াই গল্পকার যিনি প্রতিদিন ফেসবুকে নিজের বই বিক্রির স্টক আপডেট দিচ্ছেন, এই বইমেলা তার?
আজ থেকে ঠিক একুশ বছর আগে, এমনই এক অপ্রস্তুত বসন্তসন্ধ্যায় এক লক্ষ বই বুকে নিয়ে আগুনে পুড়ে মরেছিল বইমেলা। মফস্বল থেকে ট্রেনে চেপে আসা বছর আঠারোর এক নবীন, যে ভাবত শুধু ভালো ভালো বইয়ের পাটভাঙ্গা পৃষ্ঠার গন্ধেই একটা গোটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যেতে পারে, তার হাঁ-মুখের সামনে সেদিন আতসবাজি, আর্তচিৎকার, প্রাণপণ দৌড়। পদপিষ্ট হয়েছিলেন একজন, মনে পড়ে। আগুনের ফুলকি লেগে গর্ত হয়ে যাওয়া শীতপোষাকটা খুঁজলে মায়ের আলমারির খাঁজে আজও পাওয়া যাবে।
আজ এতদিন পর বইমেলা এসে সেই পোড়া গন্ধটা আবার পেলাম। হ্যালোজেন জৌলুস আর প্রচার দামামার আড়ালে সশব্দ শারীরিক নয়, বরং নিঃশব্দ এক দহন। কথা হচ্ছিল এক প্রকাশনা কর্মীর সাথে, ভিন্নধারার বই ছাপেন, নিজের ও সংস্থার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক। জানালেন কয়েকবছর আগে পর্যন্ত এখানে প্রকাশিত নতুন বইগুলির কপি জমা নিতেন রাজ্য সরকার। বই নির্বাচিত হলে সরকার ও রামমোহন ফাউন্ডেশনের যৌথ সহায়তায় কিনে নেওয়া হত সেই বইয়ের বেশ কিছু কপি, বইপিছু কম করে একশো কুড়ি থেকে দু’শো কপি। সেইসব বই পৌঁছে যেত জেলায় জেলায়, বিতরিত হত সরকারি অনুদানে চলা গ্রন্থাগারগুলিতে। প্রতি বছরের এই সরকারি আনুষ্ঠানিকতা প্রকাশকদের, বিশেষত ছোট প্রকাশনা সংস্থাগুলির কাছে একটি বড় আর্থিক ভরসার জায়গা ছিল। সেই উদ্যোগ আজ কমতে কমতে প্রায় শূন্য, অথবা বড় হাউসগুলোই আত্মস্থ করছে দাক্ষিণ্যের সিংহভাগ। ছদ্মবেশী চটি, ভূত আর গোয়েন্দা গল্পের বই ছাপায় বিশ্বাস রাখেন না এমন অনেক ছোট প্রকাশক ধুঁকছেন, ঝাঁপ ফেলছেন, কেউ কেউ বাঁচার তাগিদে বেছে নিচ্ছেন মাছের তেলে মাছ ভাজার সুবিধেবাদী বাণিজ্যিক মডেল। ক্ষমতার সাথে ছায়া হয়ে ঘুরে বেড়ান যেসব প্রকাশনী, তাদের অবশ্য কায়াবৃদ্ধি। গৌরী সেনের পয়সায় তাদের কারও কারও ভাগ্যে আজ ফ্রাঙ্কফুর্ট তো কাল লণ্ডন। ভদ্রলোককে ধন্যবাদ জানিয়ে স্টল থেকে বেরিয়ে আসার সময় আমাদের রাজ্যের বর্তমান গ্রন্থাগারমন্ত্রীর মুখটা মনে করার চেষ্টা করছিলাম।
দেখতে পেলাম গথিক ছাঁদের এক প্যাভিলিয়নে এঁটে গেছে সম্পূর্ণ বাংলাদেশ। ভেতরে পা রাখতেই দিগন্তে জুড়ে আছড়ে পড়ল হুমায়ুন আহমেদ নামের ঢেউ। ঢেউ সরিয়ে দু-একটি মুক্তো খোঁজার চেষ্টায় নজরে এল সৈয়দ সামসুল হকের সাতটি কবিতার বইয়ের অতি সুদৃশ্য প্যাক — ‘আমার দরোজাগুলি’। পাতা ওল্টালাম শান্তনু কায়সরের নতুন গল্পগ্রন্থের। বিতর্কিত নিন্দিত নেটিজেন পিনাকী ভট্টাচার্যের নাস্তিক-বিরোধী বই অবধি চোখে পড়ল, কিন্তু সবক’টা স্টল খুঁজেও শহীদুল জহিরের গল্প বা উপন্যাসের চিহ্ন পাওয়া গেল না।
আচ্ছা, এবার কি মঁমার্ত নেই? লিটল ম্যাগাজিন প্যাভেলিয়নটাই বা কোথায়? হ্যাঁ, ঐ কোণে স্থান হয়েছে তার। বাংলা আকাডেমির সামনের মাঠে দীর্ঘদিন ধরে যে লিটল ম্যাগ মেলা হত, এ বছর তাকে রবীন্দ্র-ওকাকুরা ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়েছে। সেই নিয়ে চলছে অসন্তোষ। অনেক লিটল ম্যাগের স্থান হয়নি সেখানে। বইমেলায় সেরকম কোনও সংকট প্রকট নয়, তবে একজন জানালেন, এখানেও স্থানাভাবে টেবিলের সংখ্যা কমেছে। মাত্র দু’শোটা লিটল ম্যাগ জায়গা পেয়েছে এবারের বইমেলায়। একটা সময় ছিল, যখন বইমেলায় কোনও আলাদা জায়গা ছিল না এইসব চড়ুইপত্রের। এ যেন আবার সেই শুরুর দিকে যাত্রা। লিটল ম্যাগ বই বলে গণ্য হত না, সেসময় মাটিতে রাখা লিটল ম্যাগের পাশেই কিছু আলু পটল রেখে সেই উপেক্ষার প্রতীকী প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁদেরই কয়েকজন। সেই ‘রেবেল’ চরিত্রটাই আবার ফিরে আসছে দু’হাজার সতেরো-আঠারোয়। বালুরঘাটের ঈশিতা জানালেন কলকাতা বইমেলার ওপর আর তাঁরা নির্ভরশীল নন, জেলাসদরে-মফস্বলে লিটল ম্যাগ মেলা হচ্ছে এখন। লেখা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, বই বিক্রি হচ্ছে, মনস্ক পাঠক ও লেখকের দেখা হচ্ছে, কথা হচ্ছে, পিজ্জা-ফিশফ্রাইহীন পরিবেশে। ঘড়ির কাঁটা আটটা ছুঁচ্ছে, ফিরে আসার আগে নিজেদের পয়সা ও আন্তরিকতায় করা প্রত্নতত্ত্ব-বিষয়ক এক কাগজ টেবিলের এপারে আমার দিকে ঠেলে দিচ্ছিলেন যে অক্ষরকর্মী, তার নামটা জিজ্ঞেস করিনি। পত্রিকাটা খুলে দেখাচ্ছিলেন, ওতে ওঁর নিজেরও একটা লেখাও রয়েছে, প্রাচীন মন্দির নিয়ে, লেখাটা তৈরি করার জন্য গাঁ-গঞ্জে অনেক ঘুরেছেন, উনি বলছিলেন, আমি দেখছিলাম। চোখে হালকা ফ্রেমের চশমা, জুলপিতে অল্প পাক ধরেছে, তিনি যেন আমারই যমজ। হওয়ারই কথা, লেখক তো প্রকৃত প্রস্তাবে, পাঠকেরই সহোদর। ভিড় পাতলা হয়ে আসছে, মাইকে ঘোষণা হচ্ছে কালকের অনুষ্ঠান, শীতের শেষ হিম আলগোছে ঘিরে নিচ্ছে বইয়ের শহর। দূরের অটো স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে হাঁটতে ভাবছিলাম, দিনের শেষে বোধহয় পেয়ে গেছি, আমার বইমেলার মুখ।