সৌমিত দেব
১
তো পুলিশ এসে বলল সিগারেট খাওয়া মানা। আমরা খুবই অবাক হলাম। বইমেলায় সিগারেট খেতে মানা করছে? এবার তো বলবে মেলা আরও সরিয়ে সেন্ট্রাল পার্কে কর গে যা। তারপর বুঝলাম তাই তো! তাই সোনামুখ করে সিগারেটের আগুন খসিয়ে পকেটে রেখে দিলাম। তারপর হাঁটতে হাঁটতে গেলুম বাইরে। সেথায় দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে দেখি, নাহ, এটাই বইমেলাই। নাহলে এত লোকে পত্রভারতী ব্যাকগ্রাউন্ড রেখে ছবি তুলছে যে বড়! আনন্দে লাইন। হলে কাফকা। সিগনেটে শ্রীজাত। এপাশ ওপাশ দিয়ে ছররা বন্দুকের মতো আলাপি ছুটে যাচ্ছে। যেহেতু একটা কাশ্মীর নয় তাই কথা বলতে কোনও সমস্যাও হচ্ছে না। এখন আমার হাতের লেখা আর দেখার ধরণ দুইই বেশ খারাপ। ফলত, কেউ সই চাইলেও এড়িয়ে যাচ্ছিলাম। তাই একজন একখানা পেন দিয়ে গেল। সবার সামনে। ফলে নিতেই হল। তারপর মাঝখানে বসিয়ে চলল আমি কতবড় সেলেব তার পাঞ্চলাইন দেওয়ার দেওয়ার চেষ্টা।
–গুড্ডু এত্ত বড় সেলেব্রিটি যে একবার গুড্ডুতে টাইম ম্যাগাজিনের ছবি বেরিয়েছিল।
এই তার লেভেল। তাপ্পর পরপর আঠারোবার হৃদমাঝারে শুনে কনফার্ম করলাম না এটা বইমেলাই। কারণ এদিকে নিতাইকে না ছাড়বার আকুল প্রয়াস ওদিকে মাইকে গাঁকগাঁকিয়ে তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর। এই কন্ট্রাডিকশন বইমেলা ছাড়া পাওয়া দায়। এদিকে কেউ টেবিল পায়নি ওদিকে আবার সেলেব এসে স্টল আলোফালো করে একাক্কার। আজ দেখলাম এক কাপল মনের সুখে কাফফা নিয়ে তুমুল ঝগড়া করছে। আরেক কাপল মনের সুখে আইসক্রিম খাচ্ছে। এর পর হ্যান্ডমেড ব্যাগ কিনতে যাবে। ওদিকটায় পাওয়া যাচ্ছে। ওদিকটায় একটা ঝামেলা হয়েছে তাই আজ ভিড় কম। বইমেলায় ফোনে টাওয়ার থাকে না। তাই কেউ হারিয়ে যেতে চাইলে খুব সুবিধে। কিন্তু বইমেলায় কেউ হারায় না। “দাদা বাংলা রকের স্টলটা কই?” সর্যি কালচারকাকু অ্যালাউ করেনি এবার।
আজ দেখলাম মায়ের আঁচলে খুদে ছোটা ভীম দেখাচ্ছে। মায়ের হায়ে বুড়ো আংলা। ফেমাজ রথী মহারথী সম্ভার। তাদের সাথে ফ্যান। ফ্যানের সাথে ফলোয়ার। ফলোয়ায়ের সাথে… ওদিকে দার্জিলিং-এর চা আছে, ফ্রি গিফট বলে বিলোনো বাইবেল আছে। আঁতাত আছে। মিছিল আছে, মুখ বেঁধে। কোনও ইউনিফর্ম আটকাতে পারেনি। পারবে বলেও মনে হয় না। কত লোকে বাথরুমের সামনে ধোঁয়া উড়িয়ে আইন লঙ্ঘন করছে জানেন? তবে এই বইমেলায় যে ভাবে ব্যাগসার্চ হচ্ছে তাতে দেখলাম দু-একজন এয়ারপোর্ট ভেবে ঢুকে পড়েছে ভুল করে। অবশ্য এসব ভুল আর নতুন কী? আড্ডা মারবার সময় মনে থাকে দোকান গার্ড করলাম না ছোলার ডাল? খেয়াল থাকে? কারও খেয়াল রাখা সম্ভব? তবে হ্যাঁ এই যা বৈচিত্র তাতে এসব হওয়ার কথা ছিলই। স্টলে স্টলে ম্যাজিক, ভেন্ট্রিলোক্যুইস্ট, বল ছুঁড়ুন প্রাইজ পান, টিপ করুন প্রাইজ পান, ফর্ম ভরুন টাকা দিন আছে। আর আছে দেখা হয়ে যাওয়া। “আরে সৌমিতদা না?” বা “সই দিবি না কানের গোড়ায় দেব” আছে। অনেকের সাথে প্রথম আন্তরিকতা আছে। আমার প্রথম বই আছে। ফলে শনিবাজারে বইমেলা ছোট না বড়, মেজ না সেজ, বাঙালির সবই ভড়ং কিনা, কালচারের দাম কত, মান কে ঠিক করবে ইত্যাদি কিছুই চোখে পড়েনি কারণ সময় পাইনি। চারপাশে বন্ধুরা ঘিরে রেখেছিল। এই এক একটা লিটিলম্যাগকে ঘিরে থাকা, একেকটা স্বপ্নের মতো।
২
শনিবার। তেসরা ফেব্রুয়ারি দু-হাজার আঠারো। সোমেনদা ডেকে বলল — “বইমেলা নিয়ে একটা লেখা দিবি। মানে আজকের বইমেলা নিয়ে।” কিন্তু বইমেলা নিয়ে আলদা করে লেখার কী আছে? তাও রোজ? কিন্তু সোমেনদার মাথার পেছনে চাপড় দিয়ে বাড়ি যা বলার অধিকার আছে। তাই আর না করলাম না।
কিন্তু মেলা নিয়ে সত্যিই নতুন কিছু লেখার নেই।
মানে একে তো মেলা ছোট। সালা কুড়ি মিনিটে গোটা মেলা এক পাক মেরে বেশি। এতে রোজ আলাদা করে কিছু হয় না। সব এক। রোজ এক। কোনও বৈচিত্র নেই আলাদা করে। সেই বড় সেলেব লেখক নিয়ে লাল ফেলা। মেজ সেলেব লেখক নিয়ে আদেখলামো। ছোট সেলেব লেখকের নিজের আদেখলামো। আর হাজার হাজার পাঠক। তাদের ধরে প্রায় নিল গাইম্যানের মতো করছে। মিডিওক্রিটির ফুলের তোড়া হাতে জয়জয়কার। এ তো রোজ সেম। গতানুগতিক এক জিনিস চলে। রোজ রোজ রোজ। কফি ব্রিক্রি হয়। চপ বিক্রি হয়। ঢপের চপ বিক্রি হয়। ভদ্রতা বিক্রি হয় আলাপির বই বলে। ভদ্রতা করে তা কেনা হয়। কিনে তার পেছনে তাই নিয়ে খিস্তোনো হয়। এই হয় বইমেলায়।
গতকালও তাই হয়েছিল।
আজও তাই হয়েছিল।
কালও তাই হবে।
৩
বইমেলা যারা অপ্রয়োজনীয় বলে তারা আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিক।
পিডিএফে গুঁজে প্রেমপত্তর দিতে পেরেছে আজ অব্দি কেউ?